কুমিল্লার দিশাবন্দ এলাকার বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন বলছিলেন, “সিটি করপোরেশন আর ইপিজেডের পাল্টাপাল্টি দোষারোপের বলি হচ্ছি আমরা।
Published : 01 Dec 2024, 12:55 PM
কুমিল্লা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা-ইপিজেডের ভেতরের খাল দিয়ে বের হওয়া বিষাক্ত তরল বর্জ্য বছরের পর বছর ধরে জেলার দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে পরিবেশের ওপর ভয়াবহ নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করছে; পাশাপাশি মানবিক বিপযর্য়য়ের আশঙ্কা করছেন পরিবেশবিদরা।
কুমিল্লা নগরীর উনাইশার এলাকায় ইপিজেডের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের সীমানা প্রাচীরের নিচ দিয়ে বের হয়েছে খালটি। এরপর পাশের দিশাবন্দ ও কাজীপাড়া খাল হয়ে পানি মোস্তফাপুরে গিয়ে গুংগাইজুরি খালে পড়ছে৷
গুংগাইজুরি খালটি সদর দক্ষিণ উপজেলার বিজয়পুর এলাকা হয়ে লালমাই উপজেলার বাগমারা এলাকায় গিয়ে ডাকাতিয়া নদীতে মিশেছে। মূলত এই খাল দিয়ে দূষিত পানি প্রবাহিত হচ্ছে বলে স্থানীয়রা বলছেন।
তাদের অভিযোগ, কিন্তু এই বিষাক্ত বর্জ্য কার- সেটা নিয়ে সিটি করপোরেশন ও ইপিজেড কর্তৃপক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব আছে।
একদিকে, ইপিজেড কর্তৃপক্ষ বলছে, তাদের সবকটি শিল্প প্রতিষ্ঠান পরিবেশ অধিদপ্তরের নীতিমালা অনুযায়ী সেন্ট্রাল ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের (সিইটিপি) অধীন; সেটি ২৪ ঘণ্টাই চালু থাকে। ফলে শিল্পাঞ্চলের ক্ষতিকর কিছু খাল দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার সুযোগ নেই।
অপরদিকে, সিটি করপোরেশন বলছে, নগরীর পানিতে তো কোনো রাসায়নিক নেই, ফলে ওই পানি ডাকাতিয়াতে গেলেও দূষিত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
এই দুই প্রতিষ্ঠানের ‘দ্বন্দ্বের’ মধ্যেই কুমিল্লার দক্ষিণাঞ্চলের বিশাল এলাকার প্রতিটি খাল-বিল ও নালার মধ্যে গাঢ় কালো রংয়ের পঁচা ও দুর্গন্ধযুক্ত হয়েছে। গত প্রায় ১৫ বছর ধরে মানুষ ভোগান্তির শিকার হচ্ছে।
খাল-বিলে মাছ প্রায় নাই হয়ে গেছে; আশপাশের ফসলি জমিও মারাত্মকভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছে। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, এক সময় এসব খালের পানি দিয়েই জমির সেচ কাজ চলত। এখন সেই খালের পানিই বিষাক্ত হয়ে পড়েছে।
বিপদের কথা তুলে ধরে নগরীর দিশাবন্দ এলাকার বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন বলছিলেন, “তাদের দুই প্রতিষ্ঠানের পাল্টাপাল্টি দোষারোপের বলি হচ্ছি আমরা। আমাদের এলাকায় বসবাস করা এখন দায় হয়ে পড়েছে। জলাশয়ের পানি থেকে ভেসে আসে পঁচা ও বিষাক্ত দুর্গন্ধ। খালের পানি দিয়ে কৃষি আবাদও এখন প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।”
জানা গেছে, ১৯৯৯ সালের মার্চ মাসে ২৬৭ দশমিক ৪৬ একর জায়গা নিয়ে কুমিল্লা ইপিজেড প্রকল্প অনুমোদিত হয়। ২০০০ সালের ১৫ জুলাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই ইপিজেডের উদ্বোধন করেন। বর্তমানে এই ইপিজেডে বিদেশি, দেশি এবং দেশি-বিদেশি যৌথ মালিকানাধীন মোট ৪৭টি কারখানা চালু রয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠার পর কুমিল্লা ইপিজেডে কোনো ধরনের তরল বর্জ্য পরিশোধনাগার স্থাপন করা হয়নি।
সর্বশেষ স্থানীয়দের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালের ১৩ ডিসেম্বর ইপিজেডের দক্ষিণ প্রান্তে বর্জ্য পরিশোধনাগার স্থাপন করার কাজ শুরু হয়। ২০১৪ সালের ৩০ নভেম্বর ৩৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ের ওই প্রকল্পের কাজ শেষ হয়।
বর্জ্য পরিশোধনাগারটি রাসায়নিক ও জৈবিক উভয় পদ্ধতিতে প্রতিদিন কমপক্ষে ১৫ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য পরিশোধন করতে পারে। ২৪ ঘণ্টাই এটি চালু থাকার কথা। এটি চালুর ফলে কুমিল্লা ইপিজেডের কারখানাগুলো কেন্দ্রীয়ভাবেই বর্জ্য পরিশোধনের সুযোগ পায়।
তবে স্থানীয়দের অভিযোগ, কেন্দ্রীয়ভাবে বর্জ্য পরিশোধনের কথা বলা হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। ইপিজেড হয়ে তরল বিষাক্ত বর্জ্য কুমিল্লা জেলার দক্ষিণাংশের বিভিন্ন ফসলি জমি, নদী-নালা, পুকুর, খাল-বিল ও জলাশয়ে যাচ্ছে। এতে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে।
নগরীর কাজীপাড়া এলাকার বাসিন্দা জসিম উদ্দিন বলেন, “কুমিল্লা ইপিজেড চালুর আগে কখনোই খালে এমন কালো ও দুর্গন্ধযুক্ত পানি দেখিনি। এই বিষাক্ত পানি খালে আসার আগ পর্যন্ত এলাকার খালগুলো দেশীয় মাছে ভরপুর ছিলো।
“কিন্তু বিষাক্ত পানির কারণে প্রায় এক যুগ ধরে আমাদের কষ্টের শেষ নেই। খাল-বিল এখন মাছশূন্য।”
সদর দক্ষিণ উপজেলার মোস্তফাপুর এলাকার বাসিন্দা ওমর ফারুক বলেন, “আগে খালের পানি দিয়ে আমরা কৃষি আবাদ করতাম। কিন্তু প্রায় ১৫ বছর ধরে এই পানি বেশি বিষাক্ত হয়ে পড়েছে।”
“যার কারণে আমরা এখন চাষাবাদে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল বলা চলে। ভূগর্ভস্থ ভালো পানি পেতে হলেও পাইপ অনেক গভীর পর্যন্ত নিতে হয়। পাইপের গভীরতা কম হলে ভূগর্ভস্থ পানি থেকেও দুর্গন্ধ আসে। আমাদের এই কষ্ট এবং দুর্ভোগের কবে শেষ হবে জানি না।”
পরিবেশবাদীরা কী বলছেন
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কুমিল্লা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আলী আকবর মাসুম বলেন, “আমরা দীর্ঘদিন ধরে এ বিষয়ে কথা বলছি। এছাড়া আমরা ইপিজেডের কেন্দ্রীয় তরল বর্জ্য পরিশোধনাগারটি পরিদর্শন করেছি। আমাদের কাছে মনে হয়েছে পরিশোধনাগারটি সবসময় সচল থাকে না।
“দীর্ঘদিন ধরেই বিষয়টি নিয়ে কুমিল্লা ইপিজেড ও সিটি করপোরেশনের পাল্টাপাল্টি দোষারোপ চলছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত সমস্যা সমাধানে আমরা সম্মানিত কোনো উদ্যোগ দেখিনি। এতে প্রতিনিয়ত সমস্যা তীব্র হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, “আমরা চাইব মানুষের দীর্ঘদিনের এই সমস্যা লাঘবে দ্রুত সিটি করপোরেশন ও ইপিজেড সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করবে। না হলে পরিবেশ বিপর্যয় চরম আকার ধারণ করবে।”
যা বলছে ইপিজেড কর্তৃপক্ষ
এসব প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কুমিল্লা ইপিজেডের নির্বাহী পরিচালক আবদুল্লাহ আল মাহবুব বলেন, “আমরা বারবারই বলছি আমাদের ৪৭টি প্রতিষ্ঠানের প্রতিটিরই তরল বর্জ্যই পরিশোধন হচ্ছে। কেন্দ্রীয় তরল বর্জ্য পরিশোধনাগার ২৪ ঘণ্টাই চালু থাকে। আমাদের একাধিক বিশেষ টিম সার্বক্ষণিক সরাসরি এবং অনলাইনের মাধ্যমে বিষয়টি মনিটরিং করেন।
তার দাবি, ইপিজেডের ভেতরে সিটি করপোরেশনের দুটি নালা রয়েছে। সেগুলো দিয়ে মানব বর্জ্যসহ শহরের দূষিত পানি আমাদের পরিশোধিত পানির সঙ্গে একসঙ্গে বের হচ্ছে। মূলত এ কারণে মানুষ না বুঝেই আমাদেরকে মিথ্যা দোষারোপ করছে। এ ছাড়া বিমানবন্দর ডেইরি ফার্মের বর্জ্য এসব খালে যাচ্ছে।
আবদুল্লাহ আল মাহবুব বলেন, “আমরা দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানাচ্ছি বিমানবন্দর, উনাইসার, কাজীপাড়া ও গুংগাইজুরিসহ প্রতিটি খাল ও নালা খনন করার জন্য। খাল ও নালা খনন করা হলে পানির প্রবাহ বেশি থাকবে। তখন এই সমস্যা অনেকাংশেই কমে যাবে।”
প্রায় একই কথা বলছেন পরিবেশ অধিদপ্তরের কুমিল্লার উপ-পরিচালক মোসাব্বের হোসেন মোহাম্মদ রাজিব।
তিনি বলেন, “কুমিল্লা ইপিজেডের তরল বর্জ্যে এভাবে পানি বিষাক্ত হওয়ার সুযোগ নেই বলে আমরা মনে করি। কারণ তাদের তরল বর্জ্য পরিশোধনাগারটি ২৪ ঘণ্টা চালু থাকে৷ আমরা সরাসরি এবং আইপি ক্যামেরার মাধ্যমেও বিষয়টি মনিটরিং করছি। ইপিজেড হয়ে কুমিল্লা নগরের মানববর্জ্যও এসব খাল ও নালায় যাচ্ছে।”
সিটি করপোরেশনের বক্তব্য
কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ছামছুল আলম বলেন, “নগরের ড্রেনের পানি ওইদিকে গেলেও খালের পানি এভাবে বিষাক্ত হতে পারে না। দুর্গন্ধযুক্ত ওই বিষাক্ত কালো পানি কুমিল্লা ইপিজেডের। নগরের পানির কারণে দক্ষিণ কুমিল্লার খাল বিলের পানি বিষাক্ত হয়নি। কারণ নগরের নালার পানিতে পানিতে রাসায়নিক দ্রব্য নেই।”