জেলায় আবাদ হওয়া ২ লাখ ২২ হাজার ৭৯৫ হেক্টর জমিতে প্রায় ১৩ লাখ ৫৩ হাজার মেট্রিক টন ধান উৎপাদিত হবে বলে জানায় কৃষি বিভাগ।
Published : 06 Apr 2023, 09:23 AM
সুনামগঞ্জের হাওরজুড়ে দুলছে সোনাবরণ ধানের শীষ। কোথাও আধা-পাকা, কোথাও রং ততোটা গাঢ় নয়। আর মাত্র কয়েকটা দিন, বৈশাখের শুরুতেই গোটা হাওর মেতে উঠবে ‘দাওয়ামারিতে’।
তার আগে চৈত্রের মাঝামাঝিতে স্বল্প করে হলেও শুরু হয়ে গেছে আগাম দেশি ধান কাটা। মাড়াই করে শুকানো হচ্ছে সেই ধান। কেউ কেউ বাজারেও তুলছেন। যেকোনো হাইব্রিড ধানের চেয়ে বাজারে এই দেশি ধানের দামও একটু বেশি।
‘চৈত্রের নিদানের’ কালে (অভাবের সময়) গোলায় উঠা এ ধান কৃষকের জন্য বাড়তি পাওয়া। এই ‘আদি জাতের’ ধান চাষ হয় মূলত হাওরের গভীরে; ‘অবহেলার’ জমিতে।
যদিও বছরের একমাত্র ফসল বোরো ধান কাটা শুরু হতে অপেক্ষা করতে হবে আরও অন্তত ১০ থেকে ১২ দিন। এ থেকে আসবে সারা বছরের ‘খোরাকি’।
সুনামগঞ্জে বিচ্ছিন্নভাবে এখন পর্যন্ত ৫ হেক্টর জমির আগাম দেশি ধান কাটা শেষ হয়েছে বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ।
ধর্মপাশা উপজেলার জয়শ্রী ইউনিয়নের ধারাম হাওর, জগন্নাথপুর উপজেলার নলুয়ার হাওর, তাহিরপুর, দিরাই, মধ্যনগর উপজেলার কিছু হাওরে এই ধান কাটা শুরু হয়েছে।
চৈত্রের অভাব দূর করতে বোরো, জাগলি বোরো, লালডিঙ্গাসহ দেশি প্রজাতির সুস্বাদু এই ধান আবাদ করেন চাষিরা।
হাওরের প্রবীণদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একটা সময় ছিল, যখন হাওরের মানুষ চৈত্র মাসকে খুব ভয় পেতেন। বলা হতো, ‘চৈতের মন্দা’। তখন গোলায় কোনো ধান থাকত না। হাতে কোনো কাজ থাকত না। ফলে মানুষকে খুব অভাবের মধ্যে দিন কাটাতে হতো। কিন্তু দেশি ধান চৈত্রের মাঝামাঝি কাটতে পারলে সেই অভাব কিছুটা দূর হতো।
হাওড়ে বন্যা আসার আগেই কেটে ফেলা হয় এই বোরো ধান। তবে এতে ফলন তুলনামূলক কম। যার ফলে এখন উফশী ও হাইব্রিড ধানই চাষ করেন কৃষকরা।
ধর্মপাশা উপজেলার ধারাম হাওরের বাঘাউড়া গ্রামের কৃষক তোফায়েল আহমদ, বাদেহরিপুর গ্রামের তৌহিদ মিয়া, জুয়েল মিয়া, রমজান আলী, আবুল কাশেম এর মধ্যে ধারাম হাওরে লাগানো দেশি বোরো ধান কেটে ফেলেছেন।
এবার প্রতি কেদারে (৩০ শতাংশ) ফলন হয়েছে পাঁচ থেকে ছয় মণ ধান। তবে অন্য ধানের তুলনায় এই ধান চাষে তেমন কোনো খরচ হয় না বলে জানান তারা।
তারা জানান, জমিতে ধান লাগিয়ে গিয়েছিলেন। তারপর এসে কেটেছেন। হাইব্রিড, উফশী ধানের মতো তেমন কোনো পরিচর্চা করতে হয়নি।
কৃষক তোফায়েল আহমদ বলেন, “আমাদের এলাকার কৃষকরা শখ করে দেশি বোরো ধান চাষ করেন। একবার লাগিয়ে যাওয়ার পর এসে শুধু ক্ষেত থেকে ধান কেটে তুলি। কোনো পরিশ্রম বা পরিচর্চা করতে হয় না। সুগন্ধি এই দেশি বোরো ধানের স্বাদ দিয়েই আমাদের বৈশাখ শুরু হয়।“
“চৈত্র মাসে কৃষকের ভাড়ার (গোলা) শূন্য হয়ে যাওয়ায় এই দেশি বোরো ধান দিয়েই চৈত্রের নিদান (অভাব) দূর করি আমরা। তবে দিন দিন দেশি ধানের চাষ কমছে।”
বাদেহরিপুর গ্রামের কৃষক আবুল কাশেম বলেন, “আমাদের গ্রামের ৬-৭ জন কৃষক কিছু দেশি ধান কেটেছেন। আমিও কেটেছি। অন্য প্রজাতির ধান পাকতে আরও ১০-১২ দিন সময় লাগবে। তবে সুগন্ধি দেশি ধান দিয়েই আমরা প্রতি বছর বৈশাখী ধানের স্বাদ নিই এবং আমাদের চৈত্রের অভাব দূর করি।”
সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলেন, “বিভিন্ন উপজেলায় দেশি প্রজাতির কিছু ধান কাটা শুরু হয়েছে। এ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ হেক্টর জমির দেশি ধান কাটা হয়েছে। আগামী ১৪ এপ্রিল থেকে জেলার সব হাওরে ধান কাটা শুরু হবে।“
কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, জেলায় প্রায় পৌনে চার লাখ চাষি পরিবার রয়েছে। চলতি বছর সুনামগঞ্জ ১ হাজার ৩৭০ হেক্টর জমিতে দেশি ধান আবাদ হয়েছে। প্রতি কেয়ার (৩০ শতাংশে এক কেয়ার) ফলন সাত থেকে আট মণ ধান হয়।
উফশী আবাদ হয়েছে ১ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর। প্রতি হেক্টরে ফলন হয় পৌনে ছয় টন ধান।
হাইব্রিড আবাদ হয়েছে ৬০ হাজার ৮০০ হেক্টর। প্রতি হেক্টরে ফলন ফলন হয় সাত টন।
সব মিলিয়ে এবার জেলায় ২ লাখ ২২ হাজার ৩০০ হেক্টর বোরো জমির লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে আবাদ হয়েছে ২ লাখ ২২ হাজার ৭৯৫ হেক্টর।
যা থেকে প্রায় ১৩ লাখ ৫৩ হাজার মেট্রিক টন ধান উৎপাদিত হবে। যার বাজার মূল্য প্রায় ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।
হাওরে ধানে ব্লাস্ট রোগের প্রকোপ
হাওরের গভীরে কিছু অংশের জমিতে বিআর-২৮ ও বিআর-২৯ ধানে ব্লাস্ট রোগের প্রকোপ দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন কৃষকরা।
ব্লাস্ট ছড়িয়ে পড়ায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ক্ষেতের ধান। চোখের সামনে বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে সবুজ ধানক্ষেত। এতে বিশাল ক্ষতির মুখে পড়েছেন তারা।
তাহিরপুর উপজেলার পাটাবুকা গ্রাম ও লতিফপুর গ্রামের লতিফপুর হাওরের কৃষক রিপচান হাবিব, তুলা মিয়া, আব্দুল কাইয়ুমসহ নয় কৃষকের জমিতে ব্লাস্ট রোগ দেখা দিয়েছে।
এ ছাড়া মধ্যনগর, ধর্মপাশা, সুনামগঞ্জ সদরের হাওরের কিছু জমিতে ব্লাস্ট রোগ দেখা দিয়েছে।
কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, ধানের ব্লাস্ট একটি ছত্রাকজনিত ক্ষতিকারক রোগ। বোরো ও আমন মৌসুমে সাধারণত ব্লাস্ট রোগ হয়ে থাকে। অনুকূল আবহাওয়ার কারণে ধানে এ রোগ আক্রমণ করে। এতে ফলন শতভাগ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। তবে যারা অগ্রহায়ণ মাসে বিআর-২৮ ও বিআর-২৯ ধান চাষ করেছে তাদের কোনো সমস্যা নেই। যারা এর আগে চাষ করেছে তাদের ক্ষেতের ধান কিছুটা নষ্ট হচ্ছে।
কৃষক রিপচান হাবিব বলেন, “আমার ১৮০ শতক জমিতে বিআর- ২৮ ধান ব্লাস্ট রোগে সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। আমার মতো আমার এলাকার নয়জন কৃষকের একই অবস্থা। আমরা এখন বিরাট ক্ষতির মুখে পড়েছি। ব্লাস্ট আমাদের সর্বনাশ করেছে। এই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার মতো নয়।”
হাওরের কৃষি ও কৃষক রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন তালুকদার বলেন, “আমি গত কয়েকদিন ধরে মধ্যনগর ও ধর্মপাশা উপজেলার কয়েকটি হাওর ঘুরেছি। সব হাওরেই কিছু ব্লাস্ট রোগের প্রকোপ দেখেছি। এ নিয়ে কৃষকরা উদ্বিগ্ন। মেয়াদোত্তীর্ণ বিআর-২৮ ও বিআর-২৯ ধান হাওরে চাষবাস নিষিদ্ধ করা উচিত।“
সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিমল চন্দ্র সোম ব্লাস্ট রোগের প্রকোপের বিষয়ে বলেন, “সারাদেশে এই রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। তবে আমরা কিছুটা স্বস্তিতে আছি। কারণ আমাদের এখানে ব্লাস্টের প্রকোপ তেমন নেই। গভীর হাওরে যারা সময়ের আগে চাষাবাদ করেছেন তাদের ক্ষেতে এখন আবহাওয়ার কারণে কিছু ব্লাস্ট রোগ দেখা দিয়েছে।”
তবে এই ক্ষতি পরিসংখ্যানে আসার মতো না জানিয়ে এই কৃষি কর্মকর্তা বলেন, “ব্লাস্ট বিষয়ে সচেনতার জন্য আমরা মৌসুমের শুরুতেই উঠান বৈঠক, প্রচারপত্র বিতরণ, মতবিনিময় সভা করেছি।“