গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার ওড়াকান্দি ইউনিয়নের মাঝকান্দি-খাগড়াবাড়িয়া সড়কের এই তিনটি সেতুর মূল নির্মাণকাজ শেষ হয় আট বছর আগে।
Published : 03 Jan 2025, 01:43 PM
গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলায় তিনটি সেতুর কাজ শেষ না করেই ঠিকাদার ‘অস্ত্র ঠেকিয়ে’ সমুদয় টাকা তুলে নিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
উপজেলার ওড়াকান্দি ইউনিয়নের মাঝকান্দি-খাগড়াবাড়িয়া সড়কের এই তিনটি সেতুর মূল নির্মাণকাজ শেষ হয় আট বছর আগে। তবে কোনোটিরই অ্যাপ্রোচ সড়ক তৈরি করেননি ঠিকাদার।
কিন্তু তিনটি অ্যাপ্রোচ সড়কের জন্য বরাদ্দ টাকাই ঠিকাদার ‘অস্ত্র ঠেকিয়ে’ তুলে নেন বলে জেলা পরিষদের অবসরপ্রাপ্ত উপ-সহকারী প্রকৌশলী মনির হোসেন দাবি করেছেন।
পরে দুটি সেতুতে ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে ৪০ দিনের কর্মসৃজন কর্মসূচির আওতায় শ্রমিক দিয়ে মাটি কেটে যাতায়াতের ব্যবস্থা করা হয়। তবে এই পথ দিয়ে কোনো গাড়ি চলাচল করতে পারে না।
আরেকটি সেতুতে বাঁশ দিয়ে সিঁড়ি তৈরি করা হয়েছে। এটি ভোগান্তি কমানোর বদলে বাড়িয়েছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।
তিনটি সেতুতেই দুর্নীতি হয়েছে- এমন অভিযোগে ভিত্তিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) গোপালগঞ্জ জেলা সমন্বিত কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. সোহরাফ হোসেন সোহেলের নেতৃত্বে গঠিত দলের তদন্ত শুরু হয়েছে। তারা তিনটি সেতুই পরিদর্শন করেছেন।
প্রাথমিক অনুসন্ধানে দুর্নীতির আলামত পাওয়া গেছে জানিয়ে দুদকের জেলা সমন্বিত কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. মশিউর রহমান বলেন, “অভিযোগটি দুদকে তফসিলভুক্ত হয়েছে। তাই দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনে মামলা করার জন্য সুপারিশ করে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষের নির্দেশে পরবর্তীতে কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে।”
দুদক জানায়, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ওড়াকান্দি ইউনিয়নের আড়কান্দি সেতু হতে মাইজকান্দি হয়ে আড়ুয়াকান্দি খাল পর্যন্ত তিনটি সেতুসহ এইচবিবি রাস্তার নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। নির্মাণ কাজের প্রাক্কালিত মূল্য ছিল ৯০ লাখ টাকা।
কাজটি বাস্তবায়নের জন্য কাশিয়ানীর মেসার্স হাবিব অ্যান্ড কোম্পানি নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর কার্যাদেশ দেয় জেলা পরিষদ।
তবে মেসার্স হাবিব অ্যান্ড কোম্পানির নামে কাজটি করেন গোপালগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম। ৯০ লাখ টাকার মধ্যে তিনটি অ্যাপ্রোচ সড়কের জন্য বরাদ্দ ছিল ৬ লাখ ৩৩ হাজার টাকা। কিন্তু অ্যাপ্রোচ সড়ক না করেই তিনি সেই টাকাও তুলে নেন।
অ্যাপ্রোচ সড়ক ছাড়াই তিনটি সেতু ঠিকাদারের কাছ থেকে বুঝে নেন জেলা পরিষদের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মনির হোসেন ও সহকারী প্রকৌশলী মো. আনিচুর রহমান।
সরজমিনে দেখা গেছে, জনদুর্ভোগ লাঘবে সরকার ৯০ লাখ টাকা ব্যয় করে সেতু নির্মাণ করলেও দুর্ভোগ কমেনি। একটি সেতুতে বাঁশের সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করছেন এলাকাবাসী। এতে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটেছে।
মাইজকান্দি গ্রামের বাসিন্দা মো. বেল্লাল খান, আমিরুল ইসলাম, তাসলিমা বেগম বলেন, ভোগান্তি দূর করতে সেতু নির্মাণ করে আরও ভোগান্তি বাড়িয়ে দিয়েছে। সিঁড়ি বেয়ে সেতুতে উঠতে হয়।
শিশু ও বৃদ্ধরা মাঝে-মধ্যে সিঁড়ি থেকে হোঁচট খেয়ে পড়ে আহত হয়। মাইজকান্দি গ্রামের মোরাদ তালুকদার সেতু থেকে পড়ে গিয়ে আহত হয়েছে। পরে তার বাম পা কেটে ফেলতে হয়েছে।
ওড়াকান্দি ইউপি চেয়ারম্যান বদরুল আলম বিটুল বলেন, “তিনটি সেতু নির্মাণ করলেও অ্যাপ্রোচ সড়ক না করেই অফিস কাজ সম্পন্ন দেখিয়ে ঠিকাদারকে বিল পরিশোধ করে দিয়েছে। আট বছর ধরে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে এলাকাবাসী।
“আমি এলাকাবাসীর সুবিধার্থে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ৪০ দিনের কর্মসৃজন কর্মসূচির শ্রমিক দিয়ে দুটি সেতুতে মাটি দিয়ে কোনো মতে চলাচলের ব্যবস্থা করে দিয়েছি। তবে একটিতে বাঁশের সিঁড়ি দিয়ে উঠানামা করছে এলাকাবাসী। দ্রুত সেতুটিতে সংযোগ সড়ক নির্মাণ করা হলে স্থানীয়রা দুর্ভোগ থেকে রক্ষা পাবে।”
তবে মাইজকান্দি গ্রামের বাসিন্দাদের অভিযোগ, প্রকৌশলীদের সঙ্গে যোগসাজশ না থাকলে অ্যাপ্রোচ সড়ক না করেই কীভাবে ঠিকাদার টাকা তুলে নিল?
যদিও জেলা পরিষদের অবসরপ্রাপ্ত উপ-সহকারী প্রকৌশলী মনির হোসেন কোনো ধরনের যোগসাজশ বা ঘুষের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
তার ভাষ্য, “আমি বিলে প্রথমে স্বাক্ষর করতে চাইনি। পরে ঠিকাদার গোপালগঞ্জ সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম অস্ত্র ঠেকিয়ে আমার কাছ থেকে জোর করে স্বাক্ষর করিয়ে নিয়েছেন।”
গোপালগঞ্জ শহরের থানাপাড়া এলাকার বাসিন্দা আওয়ামী লীগ নেতা সাইফুল ইসলাম ৫ অগাস্ট সরকার পতনের পর থেকেই গা-ঢাকা দিয়েছেন। তিনি যে মোবাইল ব্যবহার করতেন সেটিও বন্ধ রয়েছে। ফলে তার বক্তব্য সংগ্রহ করা যায়নি।
গোপালগঞ্জ জেলা পরিষদের প্রশাসক ও জেলা প্রশাসক মুহম্মদ কামরুজ্জামান বলেছেন, “আমি দ্রুতই সরজমিন পরিদর্শন করে জনগণের যাতায়াতের সুবিধার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করব।”