প্রবাসের চিঠি: নিয়ম না ভাঙ্গার শহরে

রেলওয়ে প্লাটফর্মে দাঁড়াতেই দেখি সবাই ছুটছে। বাচ্চা, বুড়ো, তরুণ- সবাই ছুটছে। ছোট-বড় লাগেজ নিয়ে ছুটছে।

মাহবুব মানিক, জার্মানির হালে থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 May 2018, 06:48 AM
Updated : 7 May 2018, 06:48 AM

চমকে উঠলাম। সামনে-পেছনে পর্যবেক্ষণ করছি, ব্যাপার কী? কোথাও আগুন লেগেছে নাকি? নাকি কোথাও মারামারি লেগেছে? আমাদের দেশে হঠাৎ মারামারি লেগে গেলেই এভাবে মানুষ দিগ্বিদিক ছুটে চলে। তবে এরা ছুটছে একমুখী হয়ে। প্লাটফর্মের একদিকেই সবাই ছুটছে।

সবারই লক্ষ্য একটি নির্দিষ্ট ট্রেন। ট্রেনের সময় হয়ে এসেছে। দূরে জায়ান্ট স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলাম। ট্রেনের ছাড়ার সময় মাত্র এক মিনিট বাকি। এরা সবাই এই ট্রেনেরই যাত্রী। যেভাবেই হোক ট্রেনে উঠতেই হবে। তাই এই অসম বয়সের দৌড় প্রতিযোগিতা।

জার্মানিতে তখন প্রায় সন্ধ্যা নামবে। দিনের আলো এখনও ফুরিয়ে যায়নি। দুইটি রাস্তার সিগন্যাল পার হলেই আমার বাসা। পথচারীদের জন্য তখন সবুজ বাতি জ্বলছিল। রাস্তার কার্নিশে দাঁড়াতেই লাল বাতি জ্বলে গেলো। রাস্তা তখন ফাঁকা। নিরব চারপাশ। কোনো গাড়ি নেই।

আমার সাথে আরও চার-পাঁচজন মধ্যবয়সী জার্মান নারী-পুরুষ। যতদূর চোখ যায়, ততদূরে গাড়ির কোনো নাম-নিশানা নেই। আমরা ইচ্ছা করলেই গায়ে বাতাস লাগিয়ে নিশ্চিন্তে রাস্তা পেরিয়ে যেতে পারতাম। আমি কিংবা অন্যরা কেউ কিন্তু রাস্তা পার হইনি। সবাই সবুজ বাতি জ্বলার অপেক্ষায় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলাম।

এটা আসলে একটি দেশের সিস্টেমের প্রতি এক ধরনের অলিখিত সম্মান প্রদর্শন। আমি বাংলাদেশ থেকে গেলেও এই সিস্টেমের প্রতি সম্মান দিতে তাদের কাছ থেকেই শিখেছি। তারা যদি এসব নিয়মকানুন না মানতো, তখন হয়তো আমিও এসব মানতাম না। ব্যস্ত সড়কেই হাতের ইশারায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গাড়ি থামিয়ে রাস্তা পার হয়ে যেতাম।

তখন সবে মাত্র জার্মানিতে এসেছি। সন্ধ্যা হবার ঠিক আগ মুহূর্ত। ভাবছি রাস্তা পাড়ি দিয়ে একটু ওপারে যাবো। ছোট্ট রাস্তায় পারাপারের জন্য কোনো সিগন্যাল বাতি নেই। একটু দূরে তাকিয়ে দেখি, কালো পিচের রাস্তায় একটা জেব্রাক্রসিং সন্ধ্যা বাতির আলোয় জ্বল জ্বল করছে। রাস্তার এপাশে দাঁড়াতেই কোত্থেকে যেন একটা গাড়ি এসে জেব্রা ক্রসিংয়ের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়লো। মনে মনে ভাবছি, তোমাদের দেশ তোমরা আগে চলে যাও, তারপরেই আমি রাস্তা পার হচ্ছি।

সন্ধ্যার আলোতে ভালোই বোঝা যাচ্ছে, গাড়ির ভেতরে সাদা চামড়ার একজন ভদ্রলোক চালকের আসনে বসে। আমিও দাঁড়িয়ে, গাড়িও দাঁড়িয়ে। গাড়ির ভেতরের অল্প আলোতেই লক্ষ করলাম, তিনি হাতের ইশারায় আমাকে কিছু বলতে চাচ্ছেন। বুঝতে বেশি বেগ পেতে হলো না। আমাকে হাতের সাহায্যে বার বার ইশারা করছেন, পার হয়ে যাবার জন্য।

এদিকে আমিও তাকে মার্জিতভাবে পাল্টা ইশারা করছি, জনাব আপনি চলে যান। তারপরে আমি পার হচ্ছি। উনিও নাছোরবান্দা। আমাকে রাস্তা পার না করিয়ে উনি যাবেন না। শেষে আমার আর জেদ রক্ষা হলো না। তার জোড়াজুড়িতে রাস্তাটা পার হয়েই গেলাম। তারপর পেছনে তাকিয়ে দেখলাম, উনিও চলে গেলেন।

পরে জেনেছি, এটাই এখানকার সিস্টেম। জেব্রাক্রসিংগুলোতে অগ্রাধিকার পথচারীর। তারপরে দুই ধারের ছোট-বড় গাড়ির। রাস্তার দুই ধারের পথচারী না পার করিয়ে এরা কখনোই ডোরাকাটা জেব্রার কথিত শরীর ক্রস করে না। তবে ব্যতিক্রমও আছে।

জরুরী অবস্থার অ্যাম্বুলেন্স, পুলিশ বা ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি। তাদের জন্য যেকোনো সিগন্যাল বা জেব্রাক্রসিংয়ের আইন নেই। গাড়ি বা পথচারী সবাইকে অবশ্যই তাদের যাবার জায়গা দিতে হবে। এটাই আইন। এই আইন শুধু লোক দেখানো আইন নয়। তিন বছর ধরে প্রতিনিয়ত এই আইনের বাস্তবায়ন দেখে আসছি।

অফিস শেষ করে বাসায় ফিরবো। বাসের অপেক্ষায় আছি। নির্ধারিত সময়ের এক মিনিট আগে স্টপেজে বাস আসলো। বাসে কোনো যাত্রী নেই। চালকের আসনে শুধু ড্রাইভার বসা। চোখের ইশারায় বাসের আগে পিছে সিটের কোণায়-কানায় লোকজন খোঁজার চেষ্টা করলাম। কেউ নেই। যাত্রী হিসেবে শুধু আমিই উঠলাম। আমাকে তুলেই ড্রাইভার বাস ছুটিয়ে চললো।

দুই কম্পার্টমেন্টের বড় একটি মার্সিডিজ বাস, যাত্রী শুধু আমি। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই ঘটনা শুধু একদিনের জন্য নয়, মাঝে মাঝেই এমনটা ঘটে। শুধু বাসে নয়, ট্রামের একটা বড় বগিতে আমি একা একজন যাত্রী বসে থাকি। আবার এমনও হয়, পুরো ট্রেন ফাঁকা। হাতে গোণা চার-পাঁচজন যাত্রী, তবুও সময়ের গণ্ডি বেঁধে নিয়ম করেই সব চলছে। এমন অবস্থাতে নিজেকে কেমন যেন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি মনে হতো!

জার্মানিতে যখন প্রথম আসি, তখন অবশ্য খুব ভয় লাগতো। না জানি নির্জনে ছিনতাইকারী ধরে কিনা! বিশেষ করে রাতের বেলাতে। তবে দিনে বা রাতে, এখনও পর্যন্ত ছিনতাইকারী চোখে পড়েনি। আবার শহরে একটা পকেটমারও দেখিনি।

মজার ব্যাপার হলো, এখানে চোরের উৎপাতে সাইকেল রাখা দায়। যদিও অন্য কিছু চুরি করার মতো চোর আজ ও চোখে পড়েনি। পরিবহন গাড়িগুলোর সময় বেঁধে চলার ব্যবস্থাটা বেশ মজার।যাত্রী থাকুক বা নাই থাকুক, বাস, ট্রাম, ট্রেন যে যার মতো নিয়মেই চলছে।

আমি যে শহরে থাকি, এখানে কোনো রাস্তায় আজ পর্যন্ত কোনো ট্রাফিক পুলিশ দেখিনি। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, এখানে প্রতিটা বড় সড়কেই আছে সিগন্যাল বাতি। কোনো জার্মানকে দেখিনি যে বাতি অমান্য করে গাড়ি চালাতে বা রাস্তা পার হতে।

আমার শহরে গণপরিবহনের মধ্যে রয়েছে বাস, ট্রাম, স্ট্রিট ট্রেন (স্ট্রাসে বান) ও লোকাল ট্রেন (রিগিওনাল ছুগ)। আমাদেরকে এর জন্য আলাদা করে টিকেট করতে হয় না। এক টিকেটেই এগুলোর সবগুলোতেই চড়া যায়। এই সার্ভিসগুলো একক মালিকাধীন এবং সেটা সরকার নিয়ন্ত্রিত। এর বাইরে রাস্তায় অন্য কারো পাবলিক ট্রান্সপোর্ট নামানোর অনুমতি নেই। তবে ট্যাক্সি সার্ভিসের প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ আলাদা। তার জন্য আলাদা মোবাইল অ্যাপস ও আলাদা সিস্টেম।

প্রতিটি এলাকায় আলাদা আলাদা জোন নম্বর আছে। কোনো নির্দিষ্ট জোনে একদিনের জন্য যদি একটি টিকেট কিনি, তাহলে সারাদিনে ওই নির্দিষ্ট জোনের মধ্যে যতবার খুশি ততবার ওই এলাকার বাস, ট্রাম বা ট্রেনে ভ্রমণ করতে কোনো বাধা নেই। প্রত্যেকের জন্য বিভিন্ন রকমের টিকেট আছে। যার যেটা সুবিধা, সে সেটাই কেনে।

একবার ভ্রমণের জন্য, সারা দিন ভ্রমণ কিংবা সপ্তাহ বা মাসের জন্যে টিকেটও আছে। স্কুলের বাচ্চা বা ট্রেনিং করছে, এমন বেকার ব্যক্তিদের জন্য কম মূল্যের টিকেটও আছে। ট্রান্সপোর্টে চড়ার জন্য ও ট্রান্সপোর্টের সময়সূচি জানার জন্য আমরা সকলে মোবাইল ফোনে বিশেষ অ্যাপস ব্যবহার করি। মূলত জার্মানি জুড়ে দুইটি অ্যাপস ব্যবহার হয়- ডিবি (ডয়েচে বান) ও ইজি গো।

আমার কোথাও যেতে হবে, আমি চিনিনা বা জানিনা কীভাবে যেতে হয়? অ্যাপসে ওই স্টপেজের নাম লিখে সার্চ দিলেই অ্যাপস আমাকে বলে দেবে, কতো নম্বর গাড়িতে যেতে হবে। সেটা হতে পারে ট্রাম, বাস বা ট্রেন। এমনকি অ্যাপস আমাকে সময়ও বলে দেবে এখন উঠলে ঠিক কখন গিয়ে আমার গন্তব্যে পৌঁছাবো। বাস্তবে আমি ঠিক সেই সময়েই গন্তব্যে পৌঁছে যাবো।

আবার কোনো রুটের ট্রান্সপোর্টে সমস্যা, দেরি বা বাতিল হলেও অ্যাপস বলে দেবে, এই নম্বর বাতিল হয়েছে বা পাঁচ মিনিট দেরিতে আসবে। অর্থাৎ শত ভাগ নিশ্চিত হয়েই রাস্তায় বের হতে হয়। এতে করে স্টপেজে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয় না। শুধু পাঁচ মিনিটই নয়, কোনো ট্রান্সপোর্ট যদি এক মিনিটও দেরি হতো, সেটাও অ্যাপসে উল্লেখ করা থাকতো। কাজের দিনে জার্মানদের এক মিনিট অপচয় করার মন-মানসিকতা দেখিনি।

আমার শহরের পরিষ্কার রাস্তাগুলো তিন ভাগে ভাগ করা। বড় ভাগটা বড় গাড়ির জন্য। তার পাশে একটু উঁচুতে চিকন লাল রংয়ের রাস্তা বাইসাইকেলের জন্য এবং তার পাশের চিকন রাস্তা পথচারীদের জন্য। পথচারীদের রাস্তায় যেমন সাইকেল ঢুকে পড়ে না, ঠিক একইভাবে সাইকেলের রাস্তায় কখনো বড় গাড়ি ঢোকে না। অন্যকে বিরক্ত না করেই যার যার পথ তার ঠিকানায় চলে যায়।

নিয়ম না ভাঙ্গার শহরে প্রতিদিনই নিয়মের গণ্ডি বেঁধে চলতে হয়। এক মিনিটের জন্য ট্রেন, বাস, ট্রাম মিস করার রেকর্ডও আছে। আবার দৌড়ে সেই সময়কে পিছে ফেলে সেগুলোতে চড়ার রেকর্ডও অনেক আছে। সব মিলিয়ে বলতে হয়, নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ মসৃণ আমাদের পথচলা।

লেখক: গবেষক, মার্সেবুর্গ ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লাইড সায়েন্স

ইমেইল: mahbub_chkbd@yahoo.com

এই লেখকের আরও লেখা

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!