যে বাজারে কখনও আগুন লাগে না

জার্মানিতে এসেছি তিন বছর হয়ে গেছে। প্রথম যখন বাজারে গিয়েছিলাম, তখন এক লিটার পরিশোধিত সরিষার তেল কিনেছিলাম নিরানব্বই সেন্ট দিয়ে। টাকায় রূপান্তর করলে দাম দাঁড়ায় নব্বই টাকা।

মাহবুব মানিক, জার্মানি থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 Nov 2017, 04:17 AM
Updated : 22 Nov 2017, 04:17 AM

কদিন আগেও এক লিটার তেল কিনলাম একই দাম দিয়ে। আসার পর থেকেই কিনে আসছি ওই একই দাম দিয়ে। তেলের দাম এক সেন্টও এদিক-সেদিক হয়নি। সূর্যমুখী তেল প্রথম কিনেছিলাম এক ইউরো ঊনত্রিশ সেন্ট দিয়ে। একটি দিনের জন্যেও দামের কোনও হেরফের হয়নি।

এই দাম শুধু আমার এলাকাতেই নয়, সমগ্র জার্মানিতে একই দামে বিক্রি হচ্ছে। আধুনিক শহর কিংবা অজপাড়া গায়েও একই দাম। চকচকে মিউনিখ শহরের ঝকমকে শপিং সেন্টারে সবজির যে মূল্য, পূর্ব জার্মানির প্রত্যন্ত একটা গ্রামেও ওই একই মূল্য দিয়ে সবজি কিনতে হয়।

 বাংলাদেশে এমনটা কল্পনার বাইরে। এখানে কোনোদিন কারও মুখে শুনিনি যে চাহিদার তুলনায় সবজির যোগান কম, উৎপাদন বন্ধ। তাই, তড় তড় করে দাম বেড়ে যাচ্ছে।

তিন বছর আগে প্রথম মুরগির ডিম কিনেছিলাম নিরানব্বই সেন্ট দিয়ে। একটি ডিমের বাক্সে ডিমের সংখ্যা থাকে দশটি। মাঝে ডিমের দাম বেড়ে এক ইউরো ঊনত্রিশ সেন্ট হয়ে গিয়েছিল। বর্তমানে দাম চলছে এক ইউরো নয় সেন্ট। তিন বছরে দামের হেরফের এতটুকুই।

প্রতি কেজি পাকা কলার মূল্য নিরানব্বই সেন্ট থেকে এক ইউরো নয় সেন্টের মধ্যে। এর বাইরে কখনোই যায়নি। ময়দার দাম বত্রিশ সেন্ট প্রতি কেজি। দামের কোনও পরিবর্তন নেই। চিনির মূল্য ঊনসত্তর সেন্ট প্রতি কেজিতে। এর দামেও কোনও হেরফের নেই।

প্রতি লিটার পাস্তুরিত দুধের দাম ফ্যাটের পরিমাণভেদে চল্লিশ থেকে ষাট সেন্টের মধ্যে। বাসমতি চাল প্রথম কিনেছিলাম এক ইউরো নিরানব্বই সেন্ট প্রতি কেজি। আতপ চাল ঊননব্বই সেন্ট প্রতি কেজি। সেদ্ধ চাল বিরাশি সেন্ট প্রতি কেজি।

মাঝে বাসমতি চালের দাম কমে এক ইউরো ঊনসত্তর সেন্ট হয়েছিলো। আবার বেড়ে আগের দামেই থিতু হয়ে গিয়েছিলো। আজ আবার দোকানে গিয়ে দাম দেখলাম এক ইউরো ঊনআশি সেন্ট হয়েছে। বাকি চালের দাম সারা বছরই অপরিবর্তিত।

টমেটোর দাম ঋতুভেদে ঊননব্বই সেন্ট থেকে আড়াই ইউরোর মধ্যেই থাকে। এর বাইরে দামের কোনও হেরফের নেই। পেঁয়াজের দাম বছরের বেশিরভাগ সময়ই থাকে চল্লিশ-পঞ্চাশ সেন্ট প্রতি কেজি। তবে প্রতিকূল ঋতুতে দাম কেজিতে বেশি হলে এক ইউরো হয়। সেটাও সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে থাকে।

তিন বছরের অভিজ্ঞতা বলে, দাম তো কখনও অযাচিতভাবে বাড়েনি, বরং হঠাৎ করেই মাঝে মাঝে বিভিন্ন অফারে পণ্যগুলো কম দামে বিক্রি হতো। হয়তো বাজারে গেলাম। সূর্যমুখী তেলের দাম এক ইউরো ঊনত্রিশ সেন্টের জায়গায় ছোট করে লাল স্টিকার মারা। সেখানে লেখা নিরানব্বই সেন্ট। অর্থাৎ ছাড়ে বিকোচ্ছে। এটা সকল পণ্যের ক্ষেত্রেই একটা সাধারণ ঘটনা। বাংলাদেশে যেটা উল্টো ঘটে। হয়তো গতকাল তেল কিনলাম একশ’ টাকা লিটার। আজ গিয়ে দেখি একশ’ বিশ টাকা। এরকম হরহামেশাই ঘটে থাকে সকল পণ্যের ক্ষেত্রে।

একবার চিন্তা করুন,তিন বছর পূর্বে বাংলাদেশে জিনিসপত্রের যে মূল্য ছিলো, সেটা কি এখন আছে? নাকি কমেছে? কমেওনি, আবার আগের জায়গাতেও নেই। সবকিছুর দাম বেড়েছে। চাল, ডাল, মাংস, সবজি- সবকিছুই সময়ানুক্রমিকভাবে বেড়েই চলেছে। এভাবে চলতে থাকলে হয়তো অচিরেই চাল কিনতে হবে পাঁচশ’ টাকা কেজি। মাংস কিনতে লাগবে ব্যাংকের ঋণ। অথবা টিভি-ফ্রিজ কেনার মতো কিস্তিতে কিনতে হবে!

আমার স্পষ্ট মনে আছে, ছোটবেলাতে আব্বা চাল কিনতো দশ-বারো টাকা কেজি। পোলাওয়ের চাল বিশ-পঁচিশ টাকা কেজি। গরুর মাংস পঞ্চাশ টাকা কেজি। যা কিনা বর্তমান কালের চালের মূল্য। তাহলে প্রমাণ পেয়েছেন তো? গরুর মাংস পঞ্চাশ থেকে পাঁচশ’তে পৌঁছেছে। চালের মূল্য কোনও এক কালে কেনো পাঁচশ’তে পৌঁছাবে না।

জার্মানিতে আলু, মুলা, বেগুন, গাজর, টমেটো, শসা, পালং শাক ইত্যাদি যে কোনো ধরনের সবজি সারা বছর পাওয়া যায় এবং তা পঞ্চাশ সেন্ট থেকে দেড় ইউরোর মধ্যেই। হিমায়িত মিশ্র সবজি প্রতি কেজির দাম এক থেকে দেড় ইউরোর মধ্যে এবং সবজির প্রকারভেদে স্থিতিশীল। দর দামের কোনও বালাই নেই। প্রতিটা সবজির দাম নির্ধারণ করা থাকে। দোকানে যাও খাদ্য দিয়ে ট্রলি লোড করো, ক্যাশে দাম মেটাও। বাজার শেষ।

জার্মানিতে খাদ্য শস্যের চাষাবাদ বলতে গেলে গম, ভুট্টা, সরিষা ও বিট ছাড়া আর তেমন কিছুই নাই। অথচ এখানে ঋতুভিত্তিক শাক-সবজির বাজার সবসময়ই সরগরম থাকে। এবং তা হাতের নাগালের মধ্যে। কাঁচা বাজারে দামের আগুন কখনও পরখ করিনি।

আমাদের মৌলিক চাহিদার মধ্যে অন্যতম চাহিদা হচ্ছে খাদ্য ও পানীয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, জার্মানিতে সবচেয়ে সস্তায় যেগুলো মেলে, তার মধ্যে অন্যতম হলো এ দু’টি জিনিস। এতোটাই সস্তা যে মাসের বেতনের খুব সামান্য অংশই ব্যয় করতে হয় এ দু’টি খাতে।

জার্মানিতে ফুল টাইম জব করলে ট্যাক্স বাদে সর্বনিম্ন বেতন মেলে হয়তো পনেরোশ’ ইউরো। যেখানে একটা পরিবারের খাদ্য যোগাতে সর্বোচ্চ খরচ হয় দুইশ’ ইউরো। ব্যাচেলরদের মাসিক খাদ্য খরচ লাগে হয়তো মাত্র পঞ্চাশ-একশ’ ইউরো।

এখানে পানি আবার বিনামূল্যে মেলে। কারণ, যে কোনো শহরে বাসার সাপ্লাই পানি একশ’ ভাগ নিরাপদ বলে গণ্য করা হয়। ট্যাপ থেকে সরাসরি গ্লাসে নিয়ে নিশ্চিন্তে পান করা যায় গন্ধ-বর্ণহীন মিষ্টি পানি।

জার্মানিতে বেতনের স্কেল নির্ধারণ করা হয় এলাকাভিত্তিক। আরও সংক্ষিপ্ত করে বললে বলতে হয়, বাসা ভাড়ার পরিমাণভিত্তিক। যেখানে বাসা ভাড়া বেশি ও সহজলভ্য নয়, সেখাকার বেতনও তুলনামূলক বেশি। তবে খাদ্য ও পানীয়ের দাম সারাদেশে একই এবং স্থিতিশীল। এমনটা নয় যে প্রত্যন্ত গ্রামে আলুর কেজি তিন টাকা আর ঢাকার কারওয়ান বাজারে ত্রিশ টাকা।

জার্মানিতে কিছু কিছু খাবার তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশের থেকেও সস্তায় বিকোয়। বাজারে যেতেও মজা লাগে। দরদামের ঝামেলা নেই, ঠকার ভয় নেই, ফরমালিন ও কার্বাইডমুক্ত পণ্য, কৃত্রিম রঙের ব্যবহার নেই।

তখন সম্ভবত কুষ্টিয়া সরকারী কলেজে পড়তাম। খাবার হোটলগুলোতে প্রতি পিস পরোটার দাম ছিল মাত্র দুই টাকা। সিঙ্গারা, ডালপুড়ি সব এক টাকা করে। মোগলাই পরোটা আট-দশ টাকা। তখন ময়দার দাম ছিল সম্ভবত আঠারো থেকে বিশ টাকা প্রতি কেজি। হঠাৎ করে ময়দার দাম বেড়ে হলো চল্লিশ টাকার মতো। সাথে সাথে সিঙ্গারা, ডালপুড়ি আর পরোটার দাম লাফিয়ে বেড়ে হলো পাঁচ থেকে আট টাকা। মোগলাই পরোটার দাম বেড়ে হলো বিশ-পঁচিশ টাকার মতো।

 কিছুদিন পরে ময়দার দাম কমে পঁচিশ থেকে ত্রিশ টাকার মধ্যে নেমে আসলো, কিন্তু খাবার হোটেলের সিঙ্গারা, ডালপুড়ির দাম আর কমলো না। বাংলাদেশে এটা একটা সাধারণ সমস্যা। কোনো একটা জিনিসের দাম হঠাৎ বেড়ে গেলে স্বাভাবিকভাবেই এর উপর নির্ভরশীল সব জিনিসের দাম বেড়ে যায়। কোনো এক সময় ওই জিনিসটার দাম কমে গেলেও ওই জিনিসগুলোর দাম অপরিবর্তিত রয়ে যায়। অনিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থাপনাই হয়তো দায়ী।

আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে। এখানে ধর্মীয় উৎসব, বিশেষ করে বড়দিনের আগে সকল নিত্যপণ্যের ওপর অফার শুরু হয়ে যায়। বিশেষ ছাড়ে সবকিছু বিক্রি হয়। যেটা বাংলাদেশের সম্পূর্ণ উল্টো। ধর্মীয় উৎসবের আগে যেখানে নিত্যপণ্যের দাম আকাশ ছোঁয়া থাকে! এই বিষয়টিকে কীভাবে ব্যখ্যা করা উচিত, সেটা আমার বোধগম্য নয়।

বাংলাদেশে বিক্রেতাদের এটা একটা সাধারণ উক্তি, চাহিদার তুলনায় যোগান কম। ফসল ভালো হয়নি, বৃষ্টিতে ফসল ধুয়ে গেছে। রোদ ওঠেনি চালের দাম বেড়ে গেছে। জানি না বাংলাদেশের সরকারই বা কীভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে এবং জার্মানির স্থিতিশীল বাজার কোন কৌশলে নিয়ন্ত্রিত হয়!

যেখানে বাংলাদেশ নিজেই ফসল উৎপাদন করে আর জার্মানির নিজস্ব উৎপাদিত ফসল বলতে গেলে কিছুই নাই, সবই আমদানি নির্ভর। তারপরও স্থবির পণ্যমূল্য।

লেখক: গবেষক, মার্সেবুর্গ ইউনিভার্সিটি অব এপ্লাইড সায়েন্স, হালে, জার্মানি।

এই লেখকের আরও লেখা

প্রবাস পাতায় আপনিও লিখতে পারেন। প্রবাস জীবনে আপনার ভ্রমণ,আড্ডা,আনন্দ বেদনার গল্প,ছোট ছোট অনুভূতি,দেশের স্মৃতিচারণ,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক খবর আমাদের দিতে পারেন। লেখা পাঠানোর ঠিকানা probash@bdnews24.com। সাথে ছবি দিতে ভুলবেন না যেন!