বাজেটের যে কাঠামো, তা ধনী ও ব্যবসায়ীদের ‘সুবিধা দেওয়ার জন্য’ তৈরি হয়েছে অভিযোগ করে আসন্ন নতুন অর্থবছরের বাজেটে ধনীদের দেওয়া ভর্তুকি প্রত্যাহার করার দাবি জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ এমএম আকাশ।
জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপনের আগে মঙ্গলবার বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ দাবি তুলে ধরেন।
অধ্যাপক আকাশ বলেন, বাজেটের বর্তমান কাঠামোতে গরিব মানুষের কাছ থেকে কর নিয়ে ঋণ খেলাপিদের ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে ‘রাজনৈতিক সিদ্ধন্তে’, এটা বন্ধ করতে হবে।
দুই লাখ কোটি টাকার বেশি ঘাটতি ধরে নতুন বাজেট করা হচ্ছে। এই ঘাটতি পূরণ করতে সরকার কোন কোন খাতে নতুন করে কর আরোপ করবে, তা দেখার অপেক্ষায় থাকার কথা বলেন অর্থনীতির এই শিক্ষক।
তিনি বলেন, আইএমএফ ঋণ দেওয়ার সময়ে সামগ্রিকভাবে ভর্তুকি কমাতে বলেছে। তারা নির্দিষ্ট কোনো খাত বলে দেয়নি।
“ঋণ খেলাপিদেরও এখন ছাড় দেওয়া হচ্ছে। ঋণ ও সুদ মাফ করা হচ্ছে। এটাও ঋণ খেলাপীদের জন্য সরকারের ভর্তুকি। আমাদের দাবি হচ্ছে, ধনীদের যে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে, তা প্রত্যাহার করতে হবে।
“এক সময় জ্বালানি খাতের বিশ্বব্যাপী দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশেও বাড়ানো হল। এখন দাম কমলেও দেশে দাম কমানো হয়নি।”
এমএম আকাশ বলেন, আগে আলোচনা ও গণ শুনানির মাধ্যমে জ্বালানির দাম বাড়ানো হত। বিশ্ব ব্যাংকের পরামর্শেই সেটা করা হত। এখন জ্বালানির দাম বৃদ্ধির বিষয়টি সরকার ‘রাজনৈতিকভাবে’ নির্ধারণ করছে।
“বাজেটের আকার বেড়ে গেলেও তা যাচ্ছে অবকাঠামো খাত ও আমলাদের সুবিধা দেওয়ার জন্য। কিন্তু স্বাস্থ্য, শিক্ষা খাতে সেভাবে যাচ্ছে না। সরকার বলছে, এসব খাতে খরচ করতে পারছে না মন্ত্রণালয়গুলো। মেগা প্রকল্পে খরচ করতে পারলেও মৌলিক খাতের স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় খরচ করতে না পারা সরকারের একটি ব্যর্থতা বলে মনে করি।”
তিনি বলেন, “পাচার হওয়া টাকাই যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিটেন্স আকারে আসছে। পাচার হওয়া টাকা ফেরাতেই আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। এটার সুবিধাভোগী হচ্ছে সেই ধনী শ্রেণিই।”
সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বলেন, “নিম্ন প্রবৃদ্ধি, সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভ কমে যাওয়া, আয় বৈষম্য বেড়ে যাওয়া, গণতন্ত্রহীনতা ও কর্তৃত্বপারয়ণতা ও বৈদেশিক চাপের মত চালেঞ্জগুলো এখন অর্থনীতিতে রয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে ‘মৌলিক অর্থনৈতিক সংস্কার’ প্রয়োজন বলে মনে করে সিপিবি।”
বাজেটের কাঠামো ও দর্শন ‘ধনীদের কল্যাণের জন্য’ অভিযোগ করে তিনি বলেন, “বাজেটের দর্শন সংবিধান অনুযায়ী হচ্ছে না। সংবিধানে রাষ্ট্রীয় খাত, সমবায় খাত ও আইন দ্বারা নির্ধারিত খাতে ব্যয় করার কথা বলা হয়েছে। সেখানে দর্শন হচ্ছে সাধারণ মানুষের জন্য। কিন্তু সরকার মুক্তিযুদ্ধের কথা বললেও অর্থনীতির মৌলিক ধারায় সেই দর্শন মানছে না।”
সিপিবির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, “আমরা একটি গভীর গণতান্ত্রিক পরিবর্তন চাই। সেটি চাই অর্থনীতিতেও। নিম্ন প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, আমরা চাই তা বাড়াতে। এজন্য প্রয়োজন বিনিয়োগ। গত কয়েক বছর ধরেই বিনিয়োগ জিডিপির তুলনায় ২৪ শতাংশে আটকে আছে।
“আমরা চাই রাষ্ট্র ও সমবায়ভিত্তিক পদক্ষেপ। কিন্তু সরকার এমনভাবে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে, যেখানে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ যুক্ত হচ্ছে, যার সুবিধা একটি ধনী শ্রেণিই পাচ্ছে। আর আমরা চাই এমন বিনিয়োগ উদ্যোগ যেখানে-সাধারণ মানুষের অন্তর্ভুক্তি বেশি থাকবে।”
এমএম আকাশ বলেন, ব্যবসায়ীরা আন্ডার বা ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে টাকা পাচার করছেন বিদেশে। এখন সেই টাকা ফেরত আসছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে রেমিটেন্স আকারে। দেওয়া হচ্ছে প্রণোদনা। অথচ মধ্যপ্রাচ্যের দেশ থেকে রেমিটেন্স সেভাবে আসছে না।
রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, “আমরা জানতে পেরেছি, বাজেটে ফের কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হচ্ছে। আমরা এর বিরোধিতা করছি।”
লিখিত বক্তব্যে ১৪টি দাবি জানিয়ে বলা হয়, আইএমএফ ও যুক্তরাষ্ট্রের ‘গণবিরোধী’ শর্ত ও চাপের কাছে নতি স্বীকার করা চলবে না। দুর্নীতি-বৈষম্য মুক্ত গণতান্ত্রিক সমাজ গড়া ও সুশাসনের লক্ষ্য সামনে রেখে বাজেট প্রণয়ন করতে হবে।
এছাড়া প্রত্যক্ষ করনীতি ও প্রগতিশীল ভ্যাট নীতি চালু, আয়- ব্যয়ের স্বচ্ছতা আনা, জন সাধারণের জন্য রেশন চালু, প্রতি দুই বর্গকিলোমিটার এলাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন, কর্মসংস্থান, খেলাপি ঋণ উদ্ধার, বাজার সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়ার দাবিও জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে।
পল্টনের মুক্তি ভবনে দলীয় কার্যালয়ে এ সংবাদ সম্মেনে সিপিবি সভাপতি শাহ আলম বলেন, “সরকারের অর্থনৈতিক দর্শন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিত্তিতে হতে হবে। বর্তমানে কোনো বিরোধী দল নেই। আমরাই বিরোধী দলের দায়িত্ব পালন করছি সরকারের অর্থনৈতিক দর্শন বদলানোর জন্য।”