নৌকার প্রার্থী বলেন, “আমার জন্য সবাই দোয়া করবেন। আর যারা ভোটার সবাই ৭ তারিখে ভোট দিতে আসবেন।”
Published : 29 Dec 2023, 09:36 PM
ভোটের প্রচারে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী দৃশ্যত নেই। তবু ঢাকা-৭ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সোলায়মান সেলিম ভোটের প্রচারে ছাড় দিচ্ছেন না। সঙ্গীরা বলছেন, ভোটারের কাছে যাওয়ার মূল উদ্দেশ্য কেন্দ্রে উপস্থিতি বাড়ানো।
পুরান ঢাকার চারটি থানা নিয়ে গঠিত আসনটি নিয়ে উৎসাহী মানুষের দৃষ্টি থাকে বরাবরই। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি-জামায়াত ও সমমনাদের বর্জনের ভোটে নৌকার নতুন প্রার্থীকে নিয়েও চর্চার শেষ নেই।
তিনি রাজনীতিতে পরিচিত মুখ এমন না, তবে এই আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য হাজী মোহাম্মদ সেলিমের বড় ছেলে- এই পরিচয়টি তাকে নিয়ে বাড়তি আগ্রহের কারণ।
বিএনপির হাত ধরে রাজনীতিতে আসা হাজী সেলিম ১৯৯৬ সালে নৌকা নিয়ে লড়ে আসনটি নিজের করে নেন। এরপর জেতেন আরও দুইবার। এর মধ্যে একবার স্বতন্ত্র হিসেবে তিনি হারান নৌকার প্রার্থীকেই। তবে ভোটের কয়েক বছর পর আবার ফেরেন আওয়ামী লীগেই।
এবারও সেলিম নৌকার মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। তবে দুর্নীতির মামলায় সাজার কারণে মনোনয়ন টেকে কি না, এ নিয়ে সংশয় ছিল শুরু থেকেই। আর দলীয় মনোনয়ন ফরম কেনার সময় দুই ছেলের নামেও দুটি নেন তিনি। শেষ পর্যন্ত বড় ছেলে সোলায়মানকে নৌকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় আওয়ামী লীগ।
ভোটের প্রচারে গিয়ে সোলায়মান বারবার বলছেন তার বাবার কথা। তাকেও ভোট দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন।
শুক্রবার নেতাকর্মীদের নিয়ে বংশাল রুকন উদ্দীন জামে মসজিদে জুমার নামাজ পড়েন সোলায়মান। নামাজ শেষে মসজিদেই তিনি সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বলেন, “আমরা চাই মাদক ও সন্ত্রাস নির্মূল করতে। এলাকাটা শান্তিপূর্ণ থাকুক সেটাই প্রত্যাশা। আমার জন্য সবাই দোয়া করবেন। আর যারা ভোটার সবাই ৭ তারিখে ভোট দিতে আসবেন।”
সোলায়মান সেলিমের ব্যক্তিগত সহকারী আরিফ হাসান সজীব বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রতীক পাওয়ার প্রথম দিন থেকেই দিন-রাত পরিশ্রম করছেন। অন্য প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা জনপ্রিয়তায় উনার ধারেকাছেও নেই। উনি নিশ্চিন্তে বিজয় লাভ করবেন৷ তবুও বিরামহীন কাজ করে যাচ্ছেন। উনার উদ্দেশ্য একটাই, সেটি হল কেন্দ্রে ব্যাপক উপস্থিতি।
“ভোটের লড়াইয়ে বাবাকেও অতিক্রম করে যাওয়ার চেষ্টা করছেন তিনি (সোলায়মান)।”
সোলায়মান বাবার মতোই কোটিপতি ব্যবসায়ী। আবার আইনেও স্নাতক। তার বিরুদ্ধে এলাকায় বলার মতো তেমন কোনো অভিযোগ শোনা যায়নি কখনো। বরং ঠান্ডা মাথার মিষ্টভাষী মানুষ হিসেবেই পরিচিতি আছে তার।
বংশালের বাসিন্দা আতিকুর রহমান বলেন, “বাবা ও ছোট ভাইয়ের মতো তিনি কখনো মাথা গরম করেন না। তার মাথা যথেষ্ঠ ঠান্ডা থাকে। মানবিক, শিক্ষিত ও মার্জিত তরুণ নেতা তিনি। তার উপরে ভরসা করা যায়।”
প্রচারে অন্যদের ছাড়িয়ে নৌকার সোলায়মান
পুরানা মোগলটুলী ও বংশাল রোড দিয়ে আগালে সড়কে যত পোস্টার চোখে পড়ে যার সিংহভাগই সোলায়মানের নৌকার।
আসনটিতে অন্য প্রার্থীদের মধ্যে লাঙ্গল নিয়ে জাতীয় পার্টির মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলনই পরিচিত মুখ, তবে তিনি কখনো ভোটের লড়াইয়ে সুবিধা করতে পারেননি।
ঈগল প্রতীকে স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ হাসিবুর রহমান মানিক শেষ পর্যন্ত ভোটে থাকতে পারবেন কি না, সেই সিদ্ধান্ত আসবে আদালত থেকে। নির্বাচন কমিশন তার প্রার্থিতা বাতিল করে দেওয়ার পর হাই কোর্ট তাকে বৈধ প্রার্থী ঘোষণা করে। তবে তথ্য গোপন করে প্রার্থী হওয়ার অভিযোগে আপিল বিভাগে একটি আবেদন আছে। তার ওপর শুনানি হবে আগামী ২ জানুয়ারি।
অন্য প্রার্থীরা হলেন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) মো. ইদ্রিস ব্যাপারী (মশাল), ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) মো. মাসুদ পাশা (আম)
বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের নুরজাহান বেগম (ছড়ি) এবং নতুন নিবন্ধিত বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির (বিএসপি) মোহাম্মদ আবছার আলী (একতারা)। এরা নির্বাচনি এলাকায় ভোটারদের মধ্যে সেভাবে পরিচিতই না, তাদের পক্ষে প্রচারও চোখে পড়ে না বললেই চলে।
বংশালে ভ্যানে করে বরই বিক্রি করেন হৃদয় হোসেন রিয়াজ। তিনি বলেন, “ছরি মার্কা ও একতারার মিছিল দেখছি কয়েকদিন আগে। গতকালও মিছিল দেখছি লাঙ্গলের। সবাই ভোট চাইতাছে।”
লড়াই কার মধ্যে হবে- এই প্রশ্নে স্থানীয় বাসিন্দা মো. আবুল কাশেম বলেন, “মানিক বিএনপি করে। সে ঈগল প্রতীকে দাঁড়াইছে। সোলায়মান সেলিমের সাতে মানিকের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হইব। আর বাকিগুলান তেমন শক্ত না।”
প্রচারে আচরণবিধির লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে কয়েকজন প্রার্থীর বিরুদ্ধে। তবে কোনো সংঘাত সহিংসতা নয়, অভিযোগগুলো মাইকিং ও পোস্টার সংক্রান্ত।
রাস্তায় পোস্টার ঝুলানোর পাশাপাশি দেয়ালে এমনকি বিদ্যুতের খুঁটিতেও সাঁটানো হয়েছে পোস্টার। সোলায়মান সেলিম, সাইফুদ্দিন মিলন ও হাসিবুর মানিক- সবার বিরুদ্ধেই তোলা যাচ্ছে এই অভিযোগ।
এলাকাবাসী জানালেন, নির্ধারিত সময়ের বাইরে মাইকিং করা হচ্ছে। মসজিদের ভেতরেই প্রচার চালাচ্ছেন কেউ কেউ।
সোলায়মানের প্রচারে কিছুক্ষণ
জুমার নামাজের পর নৌকা প্রতীকের প্রার্থী বংশাল এলাকায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডে রাস্তার দুই পাশে দোকানে দোকানে গিয়ে ভোট চান। সঙ্গে ছিলেন শতাধিক তরুণ।
গণসংযোগে যোগ দেওয়া আসাদুর রহমান বলেন, “তরুণদের বেশি গুরুত্ব দেন সোলায়মান সেলিম। তাই আমরা তরুণরা নিজেদের প্রত্যাশার কথা মন খুলে বলতে পারি। তাই তিনি তরুণদের কাছে বেশ জনপ্রিয়।”
৩৫ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রমজান আলী ববিন বলেন, “আমি ১৫ বছর হাজী সেলিমের সঙ্গে রাজনীতি করছি। সোলায়মান সেলিমকেও দেকছি। জীবনে কারো লগে উচ্চ গলায় কতা কয় নাইক্কা। শিক্ষা-দীক্ষায় ভালো মানুষ সোলায়মান সেলিম। ধারাবাহিকতা বজায় রাখলে বাবাকেও ছাইড়া যাইব।”
গণসংযোগে আসা সুফিয়া বেগম কিছু দাবিও জানিয়ে রাখলেন। তিনি বলেন, “এলাকার রাস্তা কিছুটা খারাপ আছে। পানি জমলে যাওয়া যায় না। রাস্তাগুলান সোলায়মান ভাই ঠিক করব আশা করি।”
সোলায়মানের বাবা হাজী সেলিম ধনকুবের- এ কথা অজানা নয় কারও। তরুণ সোলায়মানও হলফনামায় প্রায় ১২ কোটি টাকার সম্পদ, বছরে দেড় কোটি টাকার বেশি আয়ের তথ্য জানিয়েছেন। এলাকাবাসীও জানেন তার আর্থিক সামর্থ্যের কথা।
মো. নবিকুল ইসলাম ২০ বছর ধরে থাকছেন বংশালে। সাইকেল মেরামতের কাজ করেন। তবে সুনামগঞ্জের শাল্লার ভোটার।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “মানুষজনের কাছে শুনছি সোলায়মান সেলিমের নাকি অনেক টাকা-পয়সা। নিজের ইচ্ছায়ও চাইলে উন্নয়ন করতে পারবেন।”
ভ্যানে করে কমলা বিক্রি করেন মো. মহিউদ্দিন। তিনি সোলায়মান সেলিমের কর্মীদের থেকে লিফলেট পেয়েছেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “গ্যাসের সমস্যা নিয়ে ভয়াবহ ঝামেলায় আছি, বৃষ্টি হউক আর না হউক রাস্তায় পানি উঠবই। এই পানি কি আর সেই পানি? দুনিয়ার ময়লা পানি। যেই ক্ষমতায় আহুক, তা না নিয়া মাথা ব্যাথা নাই। রাস্তার সমস্যা সমাধন চাই।”
চারটি থানা-লালবাগ, চকবাজার, বংশাল, কোতয়ালী নিয়ে গঠিত ঢাকা-৮ আসন। ১২৫ টি কেন্দ্রে এখানে ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ ৪৩ হাজার ৮৯ জন।
এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালে সে সময়ের ঢাকা-৮ আসনটিতে জিতেন বিএনপির মীর শওকত আলী। তার হাত ধরেই রাজনীতিতে আসেন হাজী সেলিম। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে মীর শওকত চলে যান ঢাকা-৯ (ধানমন্ডি-মোহাম্মদপুর) আসনে।
হাজী সেলিম সে সময় ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন। তবে মনোনয়ন না পেয়ে চলে যান আওয়ামী লীগে। নৌকা নিয়ে হারান বিএনপির আবুল হাসনাতকে। তবে ২০০১ সালে বিএনপির নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টুর কাছে হেরে যান।
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ প্রতীক দেয় মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনকে। পরের নির্বাচনেও তিনিই পান নৌকা। বিএনপির বর্জনের সেই ভোটে তাকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে চ্যালেঞ্জ করেন হাজী সেলিম। পরে ২০১৮ সালে আবার হাজী সেলিমকে নৌকা দেয় আওয়ামী লীগ।