“ঐকমত্য কমিশনের রিপোর্ট আসার পরে যদি উনারা (নির্বাচন কমিশন) থাকতে পারলে থাকবে, না থাকতে পারলে থাকবে না।"
Published : 20 Apr 2025, 05:04 PM
ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের পক্ষ থেকে রোডম্যাপ ঘোষণার আগেই নির্বাচনের পথে 'ডিসেম্বরকে মাথায় রেখে' ইসির তৎপরতায় ‘সন্দেহ’ প্রকাশ করেছে তরুণদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি।
ভোটের আগে সীমানা পুননির্ধারণ, দল নিবন্ধন, জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচন প্রস্তুতি, ভোটকেন্দ্র স্থাপন, ভোট কর্মকর্তাদের প্যানেল প্রস্তুত নিয়ে ইসি যে কর্মপরিকল্পনায় আছে, তাতে সাংবিধানিক এই সংস্থাটিকে ‘সতর্ক করা' হয়েছে দলটির পক্ষ থেকে।
এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, “সাংবাধিানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমরা অনেকগুলো কথা ইসি থেকে শুনতে পাই। যেগুলো আমাদের প্রধান উপদেষ্টার থেকে শুনিনি। রোডম্যাপের কথা শুনিনি, ইসি থেকে এসেছে। এজন্য আমরা বলব, কোনো জায়গায় কথা বলার জন্য ইসি নিজেদের জায়গায় সতর্ক থাকবেন।”
বরং এ বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করা হবে বলে প্রধান উপদেষ্টা যে সময়সীমা জানিয়ে দিয়েছেন, ইসি সে বিষয়ে কাজ ‘শুরু করতে পারে’ বলে মন্তব্য করেছেন এই নেতা।
রোববার সকালে আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিনের সঙ্গে বৈঠকে বসেন এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধি দল।
বৈঠকে আরো ছিলেন এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক অনিক রায়, খালেদ সাইফুল্লাহ, মুজাহিদুল ইসলাম শাহিন ও তাজনূভা জাবীন।
আগামী নির্বাচনের জন্য চলতি বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুন নাগাদ সম্ভাব্য সময়ের কথা কদিন আগেই জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
প্রধান উপদেষ্টা বলেছিলেন, তারা দেশের ইতিহাসে ‘সবচেয়ে ভালো নির্বাচন’ আয়োজন করতে চান, যে নির্বাচন দেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় এক 'ঐতিহাসিক মাইলফলক' হিসেবে চিহ্নিত হবে।
এদিকে নির্বাচনের পথে ডিসেম্বরকে মাথায় রেখে অগ্রাধিকারমূলক সব ধরনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন। সেজন্য রোডম্যাপের আদলে ‘অ্যাকশন প্ল্যান’ নিয়ে খসড়া তৈরির কাজ চলছে বলেও জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা।
গত ৮ এপ্রিল নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেছেন, “ভোটের প্রাথমিক কাজ শেষ করে জুন-জুলাইয়ে ‘কর্মপরিকল্পনা বা অ্যাকশন প্ল্যান’ ঘোষণা করা হবে ইনশাহআল্লাহ।”
এ দিন বৈঠক শেষে ইসির নির্বাচন নিয়ে এই কর্মতৎপরতার সমালোচনা করেছেন এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী।
সাংবাদিকদের সামনে এ বিষয়টি তুলে ধরে পাটওয়ারী বলেন, “কিন্তু রোডম্যাপ বা সরকার থেকে কোনো দিক নির্দেশনা আসার আগেই যখন নির্বাচন কমিশন নিজেদের থেকে কথা বলে থাকেন সেজন্য আমরা সন্দেহ পোষণ করি।”
বৈঠকে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বিষয়ে ঐকমত্য কমিশনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে জোর দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন পাটওয়ারী।
পাটওয়ারী বলেছেন, দুই ঘণ্টা ব্যাপী ওই বৈঠকে মনোনয়নপত্র সশরীরে জমা দেওয়া, দল নিবন্ধন নবায়ন এবং দল নিবন্ধনের সময় বাড়ানো, ঋণেখেলাপি ও হলফনামায় ভুল তথ্য দিলে সদস্যপদ বাতিলসহ অন্তত দশটি দাবি প্রধান নির্বাচন কমিশনারে কাছে তুলে ধরেছে এনসিপি।
এছাড়া নির্বাচন কমিশন, আইন সংস্কারসহ অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছে দলটির প্রতিনিধিরা। ঐকমত্য কমিশনের প্রতিবেদন আসার পর তা বাস্তবায়নে জোর দিয়েছে নতুন দলটি।
ইসি পুনর্গঠন নির্ভর করে ঐকমত্য কমিশনের উপর
এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী জানিয়েছেন, সংস্কারের মাধ্যমে যেন নতুন নির্বাচন আসে, জনদাবির মুখে ইসি যেন ‘সেদিকে ধাবিত হয়’ সেটি তারা বলেছেন।
মৌলিক সংস্কারসহ ইসির পুনর্গঠন চেয়েছেন- সেক্ষেত্রে বর্তমান ইসি নাকি পুনর্গঠন বা বর্তমান ইসির প্রতি আস্থা আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমরা বরাবরই বলেছিলাম, ২০২২ এর যে আইন (সিইসি ও ইসি নিয়োগ) বিএনপিও বিরোধিতা করেছিল, সবগুলো দলই বিরোধিতা করেছিল, ফ্যাসিস্ট সরকার সে নিয়মগুলো বানিয়েছিল।"
বৈঠকে ভোটের সময়কাল নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে 'আলোচনা হয়নি' বলেও জানিয়েছেন পাটওয়ারী।
এক প্রশ্নের জবাবে এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক বলেন, “আমরা স্পেসিফিক বলেছিলাম, ২০২২ সালের যে আইনে সার্চ কমিটির মাধ্যমে যে প্রক্রিয়া আমরা ওই প্রক্রিয়ার বিরোধিতা করি। যাতে সংস্কারের মধ্য দিয়ে, একটা সুন্দর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সেখানে যদি ঐকমত্য কমিশন সম্মত হয়, তারা যদি এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়। তার পরবর্তীতে যদি হয় এটা সরকারের সিদ্ধান্ত।
“যারা কমিশনার রয়েছেন, সে বিষয়ে না, আমরা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখি। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান আকারে সরকার, ঐকমত্য কমিশন থেকে ডিসিশন আসে সে বিষয়ে ইসি পুনর্গঠন হলে আমরা দেখব। যদি না হয় তখন এ বিষয়ে কমেন্ট করবো।”
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “(সিইসি ও ইসি নিয়োগ) ২০২২ এর আইন রয়েছে আমরা পূর্বে জানিয়েছিলাম, আইনটা অবৈধ। অন্যান্য দলও জানিয়েছে অবৈধ। সে আইনের অধীনেই হয়েছে বর্তমান (ইসি)। আমরা এ আইনের বিরোধিতা করি। কিন্তু এখন যারা আছেন, তাদেরকে সংস্কার প্রক্রিয়ার মধ্যে নিতে হবে। ঐকমত্য কমিশনের রিপোর্ট আসার পরে যদি উনারা থাকতে পারলে থাকবে; না থাকতে পারলে থাকবে না। এটা ঐকমত্য কমিশনের রিপোর্টের উপর নির্ভর করবে। কারো প্রতি কোনো অবজেনকশন নেই, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ঐকমত্য কমিশনের রিপোর্টের অনুযায়ী হোক।
প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়ন চায় এনসিপি
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বিষয়ে ঐকমত্য কমিশনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে জোর দিয়েছে এনসিপি।
পাটওয়ারী বলেন, “ঐকমত্য কমিশনের রিপোর্ট যখন ফাইনাল হয়ে আসবে, তখন সরকার প্রতিটি সাংবিধানিক কমিশনে পাঠাবে। ওই সিদ্ধান্ত যেন বাস্তবায়ন হয়। আমরা ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বসেছিলাম, নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়েও বলেছি। ফাইনাল হতে তা বাস্তবায়নের জন্য বলেছি।”
এনসিপি মুখ্য সমন্বয়কের মতে, ইসি নিত্যকার কাজগুলো করতে পারে। অভ্যন্তরীণ কাজগুলো করতে পারে।
“কিন্তু নির্বাচনের ফুলফেইজের কাজে যাবে সে বিষয়ে ঐকমত্য কমিশনের যে ফাইনাল রিপোর্ট আসবে, তার মত হওয়া উচিত বলে মনে করি। নতুনভাবে দেশে সুন্দর যাত্রা শুরু হবে।"
পাটওয়ারীর কথায়, “ডেমোক্রেটিক পদ্ধতির মধ্য দিয়ে যাওয়ার জন্য ইলেকশন রিফর্ম অতি জরুরি। বর্তমানে যে প্রক্রিয়া রয়েছে, ঐকমত্য কমিশনের রিপোর্টটা আসার পরে, সিদ্ধান্তগুলো হওয়ার পরে সে অনুযায়ী ইসি পরিচালিত হয় তাহলে বাংলাদেশে সুন্দর নির্বাচন হবে। বর্তমান ব্যবস্থায় অনেক সংস্কার জরুরি। অনেক বিষয়ে ইসি সম্মত হয়েছে, আইনগুলো ঐকমত্য কমিশনের হয়ে আসতে হবে।
বদিউল আলম মজুমদারের নেতৃত্বে গঠিত নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের কথা তুলে ধরেন পাটওয়ারী।
মুখ্য সমন্বয়ক বলেন, “আমরা তাদের জানিয়েছিলাম, সংস্কারের প্রত্যেকটি রিপোর্টের পাতা বাই পাতা, ওয়ঢার্ড বাই ওয়ার্ড, প্রয়োগের মরধ্য দিয়ে আগামী একটি নির্বাচনে যেতে হবে। সংস্কার সুপারিশের প্রতিটি লাইন এসেছে সেগুলো নিয়ম, নীতির মধ্য দিয়ে প্রায়োগিক আকারে বাংলাদেশকে সে দিকে যাত্রা শুরু করতে হবে।
“সিইসি একমত হয়েছেন। ঐকমত্য কমিশনের সাথে ঐক্যমত পোষণ করে, না হলে আমরা আস্থা পোষণ করতে পারবো না।”
পাটওয়ারীর কথায় নির্বাচন কমিশন ১৫ বছরে একটা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে ‘ইঞ্জিরিয়ারিং হয়েছে অনেক’।
“নতুন বাংলাদেশে এটা দেখতে চাই না। স্পেসিফিক বক্তব্য পেশ করেছি। নির্বাচন কমিশন করতে হলে একটা সুন্দর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। তাহলে পার্থক্য কি থাকল। কমিশন এসব বিষয় বিচেনায় রেখেছেন।“
যত দাবি এনসিপির
পাটাওয়ানী জানিয়েছেন, মনোনয়নপত্র জমা দিতে সশরীরে আসার বিধান, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ইসি থেকে নির্বাচনের সার্টিফিকেশন দেওয়া, প্রার্থীদের হলফনামা তদন্ত করে তার সত্যতা নিরূপণ করা, নির্বাচনী সহিংসতা রোধে আচরণবিধি ও ব্যয়ের বিধিতে পরিবর্তন আনা, ঋণখেলাপিদের নির্বাচনে অংশ নেওয়া বন্ধ করার কথা তারা ইসিকে বলেছেন।
এছাড়া হলফনামায় ভুল তথ্য থাকলে প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল ও নির্বাচিত হলেও যেন তারা সংসদে থাকতে না পারে সেই ব্যবস্থা করা, প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা, রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের জন্য সময় বাড়ানো, রাজনৈতিক দলগুলো যেন অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক চর্চা করে তা নিশ্চিত করার বিষয়েও তাগিদ দিয়েছেন এনসিপির নেতারা।
এগুলো বাস্তবায়ন না হলে নির্বাচনে যাওয়া ও ভোটাধিকার প্রয়োগ ‘সম্ভব হবে না’ বলে মনে করছেন তারা।
৩ নির্বাচনে দায়ীদের বিচার
২০১৪ সালের দশম এবং ২০২৪ সালের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি-জামায়াত ও সমমনারা বর্জন করে, ২০১৮ সালে তারা ভোটে এলেও আগের রাতেই সিল মেরে বাক্স ভর্তি করার অভিযোগ উঠে।
আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদের তিন নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রার্থী এবং নির্বাচন কমিশনের জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারিদের তদন্ত সাপেক্ষে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন পাটওয়ারী।
তিনি বলেন, “যাতে ভবিষ্যত বাংলাদেশে কোনো প্রতিষ্ঠান, স্বাধীন, সাংবিধানিক হোক বা অসাংবিধানিক হোক ব্যক্তি যেন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে না গিয়ে বাংলাদেশের হাজারো মানুষের রক্তের ওপর প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে নতুন একটি যাত্রা করতে পারে এবং এই দুঃসাহস যেন কেউ না দেখাতে পারেন। "
তাদের এই দাবিটির প্রতি কমিশন ‘প্রতিশ্রুতবদ্ধ’ হয়েছে জানিয়ে পাটওয়ারী বলেন, “তারা (ইসি) বলেছেন, কর্মকর্তা-কর্মচারি যারা রয়েছেন, তাদের কাছ থেকে উনারা শপথ নিয়েছেন।
"কিন্তু আমরা বলেছি শুধু শপথ নিলে হবে না, ১৫ বছর যারা এই কাজগুলো করেছে, তাদের যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে আনতে হবে।"
নাসিরুদ্দীন পাটোয়ারি জানিয়েছেন গণঅভ্যুত্থানে আহত, নিহত এবং গত দেড় দশকে গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদেরও ‘ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল’।
“জালিয়াতির মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি ফ্যাসিস্ট কাঠামোতে রুপান্তর করা হয়েছিল। এই কাঠামো রুপান্তরে অন্যতম ভূমিকা রেখেছিল নির্বাচন কমিশন। এই সংস্কারের মধ্য দিয়ে আমরা যে নতুন একটি বাংলাদেশ পুনর্গঠন করতে যাচ্ছি, এই সংস্কার কার্ক্রমের মধ্য দিয়ে আমরা যাতে নির্বাচন কমিশনকেও নিয়ে যেতে পারি, সেটা নিয়ে আমরাদের দীর্ঘক্ষণ আলোচনা হয়েছে।"