Published : 28 Nov 2023, 11:17 AM
চট্টগ্রামের-১ (মিরসরাই) আসনটিকে বলতে গেলে নিজের করে নিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের মোশাররফ হোসেন। সেখানে নৌকা আর তার নাম ছিল সমান্তরাল।
তবে জীবনের চক্রে থামতে হয় মানুষকে। সাতবার সংসদ সদস্য হওয়ার পর অবশেষে ক্ষ্যান্ত দিলেন তিনি।
৮০ বছর বয়সী এই রাজনীতিক আগেই জানিয়ে দিয়েছেন, আর ভোট করার ইচ্ছা তার নেই। তার আসনে ছেলে মাহবুব রহমান রুহেলকে গত কয়েক বছর ধরেই পরিচয় করিয়ে দিয়ে আসছিলেন।
আওয়ামী লীগ তার প্রবীণ নেতার ইচ্ছাকে মূল্যায়ন করেছে। ছেলের হাতেই দেওয়া হয়েছে বাবার আসন ধরে রাখার চ্যালেঞ্জ।
চট্টগ্রামের এই আসনটিতে মোশাররফের জনপ্রিয়তা সব সময় ছিল প্রশ্নাতীত। ১৯৭০ সালে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হওয়ার পর অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধে। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩, ১৯৮৬, ২০০৮, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালেও জয় পান তিনি। ১৯৯৬ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কাছে অল্প ভোটে হেরে গেলেও পরে উপনির্বাচনে জয় পান। খালেদা জিয়া এই একবারই ভোটে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিলেন।
মাহবুব রহমান রুহেল চলচ্চিত্রের সঙ্গে জড়িত। তিনি স্টার সিনেপ্লেক্স মুভি থিয়েটারের মালিক শোমোশন লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান।
চলচ্চিত্র প্রযোজক হিসেবেও তার পরিচিতি আছে। তার ‘ন ডরাই’ সিনেমা ২০১৯ সালে শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্য এবং বাংলাদেশ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতেছে।
মাহবুব রহমান ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস অ্যাট আর্লিংটন থেকে ইনফরমেশন সিস্টেম এবং কম্পিউটার সায়েন্সে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছেন। পাশাপাশি আল্টো ইউনিভার্সিটি এক্সিকিউটিভ এডুকেশন থেকে এমবিএও করেছেন।
তিনি সায়মন বিচ রিসোর্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
মাহবুব রহমান রুহেল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "আমার উপর আস্থা রেখেই বাবা আর ভোট করছেন না। গত দুইবার সংসদ নির্বাচনে আমি বাবার পাশে থেকে কাজ করেছি। উনার থেকেই আমার রাজনীতি শেখা।
“বাবা আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন, দলীয় সভানেত্রীর আমার উপর আস্থা রেখে আমাকে দলের মনোনয়ন দিয়েছেন। সেই আস্থার প্রতিদান দিতে আমি কাজ করব।”
নিজের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা জানিয়ে মাহবুব রহমান বলেন, "২০ বছর ধরে আমি মাঠে আছি। মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের নিয়ে প্রথম কাজ শুরু করেছিলাম এলাকায়। যুব সমাজকে সঙ্গে নিয়ে গত ১৫ বছর ধরে পরিবেশ সুরক্ষা ও মাদকবিরোধী কাজ করে চলেছি। ভোটারদের ৫০ ভাগই যুবসমাজ। তাই তরুণদের সিংহভাগ ভোট আমি পাব।”
৮২ বছর বয়সী এইচ এন আশিকুর রহমানও রাজনীতি থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ১৯৮৬ সাল থেকে রংপুর-৫ আসনে নৌকা প্রতীক নিয়ে লড়াই করে আসছিলেন তিনি। সাতটি নির্বাচনে লড়াই করার পর তিনিও তার আসনে ছেলে রাশেক রহমানকে মনোনয়ন দেওয়ার অনুরোধ করেছিলেন। দলের কোষাধক্ষ্যের অনুরোধ ফেলেনি আওয়ামী লীগ।
জাতীয় পার্টির শাসনামলে ১৯৮৬ সালে রংপুরের মিঠাপুকুর আসন থেকে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন আশিকুর। এরপর ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে হেরে যান। তবে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আসনটি ছেড়ে দিলে উপনির্বাচনে জয় পান তিনি।
এরপর ২০০১ সালে আবার হেরে গেলেও গত দিনটি নির্বাচনে জয় পেয়েছেন আশিকুরই। জাতীয় পার্টি তার এক সময়ের ঘাঁটিতে আশিকুরের কাছে পেরে উঠছে না।
বাবার হাত ধরেই রাজনীতিতে এসেছেন রাশেক রহমান। তিনি ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় প্রচার ও প্রকাশনা উপ-কমিটির সদস্য হন। এর আগে দলের কেন্দ্রীয় উপকমিটির সহসম্পাদক ছিলেন। পাশাপাশি রংপুর জেলা কমিটির সদস্য রাশেক। গত কয়েক বছর ধরেই বিভিন্ন টেলিভিশনের টকশোতে তার সরব উপস্থিতি দেখা যায়।
রাজনীতির পাশাপাশি ব্যবসাতেও জড়িত রাশেক। তিনি সফটওয়্যার সলুশনস অ্যান্ড লজিস্টিকস এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। পাশাপাশি জেনেভেক বিডি নামে একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
মেঘনা ব্যাংক লিমিটেডের উদ্যোক্তা পরিচালকও রাশেক। পাশাপাশি পুঁজিবাজারেও তার সংশ্লিষ্টতা আছে। টেড এক্স সিকিউরিটিজ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক তিনি।
বাবার আসনে নির্বাচন করার বিষয়ে জানতে চাইলে মন্তব্য করতে রাজি হননি রাশেক।
উত্তরের জেলা ঠাকুরগাঁও-২ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য দবিরুল ইসলাম অবশ্য মনোনয়ন চেয়েছিলেন। তিনিও সাতবারের সংসদ সদস্য। তার বদলে ছেলে মো. মাজহারুল ইসলামকে মনোনয়ন দিয়েছে আওয়ামী লীগ।
১৯৪৮ সালে জন্ম নেওয়া দবিরুল রাজনীতিতে পোড় খাওয়া মানুষ। বামপন্থি রাজনীতিতে আস্থা ছিল এক সময়। ১৯৮৬ ও ১৯৯১ সালের নির্বাচনে সেই আসন থেকে অংশ নেন সিপিবির প্রার্থী হিসেবে, জয়ও পান।
পরে ১৯৯৬ সালে দবিরুল যোগ দেন আওয়ামী লীগে। ওই বছরের ১২ জুনের সপ্তম সংসদ নির্বাচন, ২০০১ সালের অষ্টম, ২০০৮ সালের নবম, ২০১৪ সালের দশম ও ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে নৌকা নিয়ে ভোটে জেতেন।
৭৫ বছর বয়সী এই রাজনীতিক শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছেন। তার স্বাভাবিক চলাফেরাও বিঘ্নিত হচ্ছে। এবার আওয়ামী লীগ মনোনয়ন ফরম ছাড়ার পর তার পরিবারের আরও তিন জন প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
মনোনয়ন পাওয়া বড় ছেলে মাজহারুল ইসলাম সুজন দীর্ঘদিন ধরেই রাজনীতিতে জড়িত। তিনি ঠাকুরগাঁও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। পাশাপাশি শিক্ষকতা করেন।
দবিরুলের অন্য ছেলেরাও রাজনীতি করেন। ছোট ছেলে মোহাম্মদ আলী উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলেন। দবিরুলের ছোট ভাইয়ের ছেলে বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আলী আসলাম জুয়েলও মনোনয়ন চেয়েছিলেন।
গত ২২ নভেম্বর আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম জমা দেওয়ার শেষ দিনে ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য হাজী মোহাম্মদ সেলিমের সঙ্গে তার দুই ছেলের ফরম জমা দেওয়া দেখেই বোঝা যাচ্ছিল সেখানে মনোনয়ন পাল্টাতে পারে।
এক সময় বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত হাজী সেলিম ১৯৯৬ সালে বিএনপির মনোনয়ন চেয়েছিলেন। দল থেকে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর চলে আসেন আওয়ামী লীগে। জয়ও পান।
২০০১ সালে অল্প ভোটে হেরে যাওয়ার পর দুটি নির্বাচনে মনোনয়ন পাননি। এর মধ্যে ২০১৪ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নৌকা প্রতীকের মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনকে হারিয়ে দেন। পরে আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন। একাদশ সংসদ নির্বাচনে আবার তিনি নৌকা নিয়ে প্রার্থী হন।
দুর্নীতির মামলায় সাজা হওয়ায় তার সংসদ সদস্য পদ থাকবে কি না, সেই প্রশ্ন ওঠে সম্প্রতি। এই অবস্থায় তিনি বড় ছেলে সুলাইমান সেলিম ও ইরফান সেলিমের নামেও দুটি ফরম জমা দেন।
সুলাইমানকে নানা সময় হাজী সেলিমের সঙ্গে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সক্রিয় দেখা গেছে। পাশাপাশি তিনি তার বাবার ব্যবসা-বাণিজ্যও দেখাশোনা করেন বলে জানিয়েছেন ঘনিষ্ঠজনরা।
সুলায়মান সেলিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "আমার বাবা এই আসনের তিনবারের সংসদ সদস্য, এই অঞ্চলের মানুষের জন্য সব সময় কাজ করে গেছেন, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সুখে দুঃখে পাশে ছিলেন। আওয়ামী লীগের জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। বিরোধী দলের সময় অনেক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, দুইশর অধিক মামলার আসামি হয়েছেন। অনেক অপপ্রচারের স্বীকার হয়েছেন।
"যেহেতু বাবার হাত ধরেই আমার রাজনীতি শেখা, উনার আদর্শ ধরে রেখে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এগিয়ে যাব। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের একজন মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলব।"
স্ত্রীর আসনে স্বামী
২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে নোয়াখালী-৬ আসনে নৌকার মনোনয়ন পেয়েও নির্বাচন করতে পারেননি মোহাম্মদ আলী। খেলাপি ঋণের কারণে তার মনোনয়ন বাতিল হয়ে গেলে তার স্ত্রী আয়েশা ফেরদাউস স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটে অংশ নেন। তাকে সমর্থন দেয় আওয়ামী লীগ। তবে হেরে যান ভোটে।
আয়েশা এরপর ২০১৪ সালের দশম ও ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন।
মোহাম্মদ আলী ছাত্রজীবনে বামপন্থায় বিশ্বাসী ছিলেন। পরে যোগ দেন যুবদলে। জাতীয় পার্টির সদস্য হয়ে তিনি ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে ওই আসন থেকে নির্বাচিত হন।
১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টি থেকে নির্বাচন করে হেরে যাওয়ার পর দল পাল্টে আসেন আওয়ামী লীগে। তবে ২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।