সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা বলছেন, জেনারেল ইবরাহিম ‘বিক্রি হওয়ার পাত্র নন’।
Published : 22 Nov 2023, 07:07 PM
‘বিশ্বাসঘাতক, দালাল’ আখ্যা পেতে হতে পারে জেনেও আন্দোলনে ইতি টেনে, ‘ঝুঁকি নিয়ে’ ভোটে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম।
এক দশকের বেশি সময় ধরে বিএনপির সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রাজনীতি করে আসা সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা বলছেন, জেনারেল ইবরাহিম ‘বিক্রি হওয়ার পাত্র নন’। তিনি পথ বদলেছেন, কারণ সরকারবিরোধী আন্দোলনে আর ‘পেরে উঠতে’ পারছিলেন না।
নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার না হলে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা আছে বিএনপির। একই দাবিতে দশম সংসদ নির্বাচনেও আসেনি দলটি। সেই নির্বাচনে ইবরাহিমের কল্যাণ পার্টি ছিল বিএনপির জোটেই।
২০১৮ সালে এই জোট ভোটে এলে চট্টগ্রামের একটি আসনে ২০ দলীয় জোটের মনোনয়নও পান তিনি। তবে জিততে পারেননি।
গত ডিসেম্বরে বিএনপি ২০ দলীয় জোট ভেঙে দেওয়ার পর এই জোটের ১২ শরিক মিলে যে জোট গড়ে তোলে, তাতে যোগ দেয় ইবরাহিমের কল্যাণ পার্টি। এই জোট বিএনপির সরকার পতন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ‘এক দফা’ দাবির পক্ষে অবস্থান নেয়। বিএনপির সঙ্গে মিল রেখে যুগপৎ কর্মসূচিও পালন করতে থাকে। চলমান হরতাল ও অবরোধ তাদেরও কর্মসূচি ছিল।
গত ১৫ নভেম্বর আগামী জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর বিএনপির পাশাপাশি তা প্রত্যাখ্যান করে ১২ দলীয় জোটও।
তবে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় শেষ হতে আট দিন বাকি থাকতে বুধবার চমক নিয়ে হাজির হলেন ইবরাহিম। জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে ঘোষণা দিলেন নতুন জোট ‘যুক্তফ্রন্ট’ এর।
সংবাদ সম্মেলনে ছিল এতদিন বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দুই দল জাতীয় পার্টি (মতিন) ও বাংলাদেশ মুসলিম লীগও।
ইবরাহিম বলেন, “আমি এখান থেকে বেরুনোর পর পাঁচশ কমেন্ট এখানে আসবে ‘বিশ্বাসঘাতক’, ‘দালাল, ‘বেচা হয়ে গেছে’। কিন্তু মেজর জেনারেল ইবব্রাহিম বীর বীর প্রতীক ‘বেচা যাওয়ার’ পাত্র নন। আপনাদের কাছে আবেদন করব, এটা ধৈর্য পরীক্ষা। দেখুন কী হয়, কী করি।”
তিনি বলেন, ‘‘আমার এই মুহূর্তে রাজনৈতিক অক্ষমতা, আর তো পেরে উঠছি না এই সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে। এটা একটা সুনির্দিষ্ট অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে ২৮ অক্টোবরের পরে। আমাকে একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমি নিশ্চুপ থাকব নাকি আমি বিকল্প একটা পন্থা অবলম্বন করব।
‘‘আমি বিকল্প অবস্থানটা নিলাম এই মর্মে যে, আমি চেষ্টা করি, আমার এই কথাগুলো বলার আর জায়গা নাই আর কোনোখানে… সেটা যদি আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কবুল করে পার্লামেন্টে বলার।”
তবে সংসদে গেলে বা না গেলে ‘জেনারেল ইবরাহিম সাহেবের সুনামের কোনো তফাৎ হবে না’, এই কথাটিও জানিয়ে রাখেন তিনি।
সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে যে কয়েকটি রাজনৈতিক দলের জন্ম হয়েছিল, তার একটি ছিল বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি। সে সময় ‘কিংস পার্টি’ নামে যে কয়টি দল আলোচনায় আসে, তার একটি ছিল এই দল।
নবম সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-১৭ আসনে অংশ নিয়ে প্রচারে বেশ মনও দিয়েছিলেন ইবরাহিম। তবে জামানত রক্ষার মত ভোট পাননি তিনি। এরপর বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বে জোটে চলে যায় তার দল।
সাংবাদিক তার কাছে প্রশ্ন রাখেন, এই সিদ্ধান্ত ‘রাজনৈতিক আত্মহত্যা’ বা ‘সরকারের সঙ্গে আতাঁত’ বলে পরিচয় পাবে কি না, তিনি কোনো চাপে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কি না, ইত্যাদি ইত্যাদি।
একের পর এক প্রশ্ন শুনে হাত তুলে ইবরাহিম বলেন, “সবাই বললে তো উত্তর দিতে পারব না। আপুরা-ভাইয়েরা আমার আপনারা এত প্রশ্ন একসঙ্গে করেছেন, আমি সব হারিয়ে ফেলেছি। কিছুই মনে করতে পারছি না।”
পরে তিনি বলেন, “একজন প্রশ্ন করেছেন, আপনাদের জোট মৌসুমি জোট হবে কি না, নির্বাচনের পরে হারিয়ে যাবে কি না।
“আপনাদের অনুগ্রহপূর্বক খেয়াল রাখতে হবে, হাতি হারায় কম এবং প্রজাপতি হারায় বেশি। ছোট ছোট জীব আল্লাহর দুনিয়াতে তাদের বেঁচে থাকা কষ্ট, বড় প্রাণীদের বেঁচে থাকা ইজি। আপনাদের মিডিয়ার চ্যানেলগুলোর মধ্যে বড়গুলো বেঁচে থাকে, ছোটগুলোর ভিউয়ার কম আর টিআরপি কম। এটা আপনাকে মেনে নিতে হবে। সুতরাং আমি কোনো চ্যালেঞ্জ দেব না।
“আমি এই করব, আমি ওই করব, হ্যান করব, এরকম চ্যালেঞ্জ আমরা নেব না।’’
বিএনপির জন্য ‘কোনো পরামর্শ নেই’
কল্যাণ পার্টির নেতা বলেন, “আমি কখনোই বলব না, বিএনপি তুমি নির্বাচনে আসো। এটাও আমি কখনো বলব না, ‘আসিও না।’
“আমি তাদের সঙ্গে ১২ বছর ছিলাম। তাদের দুর্বলতা, তাদের ভুলভ্রান্তি, আমার দুর্বলতা, আমার ভুলভ্রান্তি এখানে আলোচ্য বিষয় এখানে হওয়াটা সমীচীন না।”
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সংলাপ আয়োজনে সরকার এবং আন্তর্জাতিক বিশ্বের প্রতি আহ্বান জানান ইবরাহিম। তিনি বলেন, “সেখানে আপনারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন; জাতির মঙ্গলের জন্য যেটা ভালো হবে সংলাপের মাধ্যমে সেটা নিন।”
‘বিএনপি আন্দোলনে ব্যর্থ’- এমন কথা বলতে চান না যুক্তফ্রন্টের নেতা। তবে তিনি মনে করেন, গত ২৮ অক্টোবরের পরে আন্দোলন কোন পর্যায়ে এসেছে, তার মূল্যায়ন হওয়া প্রয়োজন।
বিএনপির সঙ্গে বা ১২ দলীয় জোটের আলোচনায় নির্বাচনে যাওয়ার বিষয়ে কিছু বলেননি জানিয়ে ইবরাহিম বলেন, “বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের (তারেক রহমান) সঙ্গে অনেক ব্যক্তির আলাপ হয়। আজকে থেকে ৪৮ ঘণ্টা আগেও আমার সঙ্গে আলাপ হয়েছে। আমি সসম্মানে তার প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়েছি, তিনিও সসম্মানে আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়েছেন।
“আমি বিশ্বাস করি, বৈরী পরিবেশে টিকে থাকার জন্য আমাদের সংযম ও ধৈর্য প্রয়োজন। আমরা সেই সংযম ও ধৈর্যের মধ্যে থাকতে চাই।”
নির্বাচনের পরিবেশের বিষয় স্পষ্ট হতে ‘সময় লাগবে’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “কুয়াশা একটু ধীরে ধীরে কাটে। গোধূলীও ধীরে ধীরে আসে। একটা সুইচ টিপে ইলেকট্রিক বাতি জ্বালানো যায়, কিন্তু পরিবেশের বাতি জ্বালানো যায় না। একটু সবুর করতে হবে।”
আন্দোলনের ‘এক দফা’ দাবি থেকে সরে নির্বাচনে যাওয়ার পেছনে কোনো চাপ ছিল কি না জানতে চাইলে জবাব দিতে অস্বীকৃতি জানান সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা।
সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রত্যাশা, প্রার্থী ১০০ আসনে
আগামী জাতীয় নির্বাচন গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু হবে আশা করে ইবরাহিম বলেন, “অতিরিক্ত আশাবাদী সরকার ও নির্বাচন কমিশন সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করবেন। কিন্তু এর নিশ্চয়তা আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব না, তার অনুকূলে গ্যারান্টি দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না।”
যদি সেটা না হয়, তাহলে তিনি ব্যক্তি হিসেবে নিজে এবং রাষ্ট্রের সব নাগরিকই ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
কয়টি আসনে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন করবে– এই প্রশ্নে তিনি বলেন, এ মুহূর্তে তাদের প্রস্তুতি একশটির।
এখনও তত্ত্বাবধায়ক সরকার চান
বর্তমান সরকারের অধীনে ভোটে এলেও ইবরাহিম তত্ত্বাবধায়কের দাবি ছাড়েননি।
তিনি বলেন, “আপনারা জিজ্ঞাসা করেছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার কি চান? আমি বলেছি, ‘চাই’। কিন্তু যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার পাওয়া না যায় তাহলে কী করব? উত্তরে আমি বলেছি, হয় বসে থাকতে হবে, না হয় যা আছে তার সঙ্গে অংশগ্রহণ করে চেষ্টা করতে হবে। আমি যা আছে তার সঙ্গে অংশগ্রহণ করে চেষ্টা করার পক্ষে মত দিয়েছি।”
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ‘প্রয়োজনীয়তা আছে’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থতির কারণে তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি আসছে না। না হওয়ার কারণে আমাকে এই সিদ্ধান্তে (নির্বাচনে যাওয়ার) যেতে হয়েছে।”
আগ্রহ ‘বিরোধী বেঞ্চে’
আগামী সংসদে সরকারি দলের আসনে নাকি বিরোধী দলের আসনে বসতে চান, এমন প্রশ্নে ইবরাহিম বলেন, “আমাদের আগ্রহ বিরোধী দলের বেঞ্চে বসা, জনগণের পক্ষে কথা বলার চেষ্টা করা।”
সাবেক এই সেনা কর্মকর্তার ভাষ্য, মানুষের কথাগুলো বলার সুযোগ থেকে তিনি এখন ‘বঞ্চিত আছেন’। সংসদে কী কী বলতে চান, তার একটি উদাহরণও টানেন তিনি।
ইবরাহিম বলেন, “আমি মেজর জেনারেল ১৯৯৭ সালের স্কেলে পেনশন পাই। অপর পক্ষে মেজর জেনারেল ‘ক’ বা ‘খ’ ২০২১ সালে রিটায়ার করেছেন। তিনি ২০২১ সালের স্কেলে পেনশন পাচ্ছেন। কিন্তু সকলের জন্য বাজার দর তো সমান।
“এটা ভারতে আছে, অন্যান্য দেশে আছে। আমরা সরকারের কাছে বলতে চাই, আমরা সৈনিকগণের রেশনের কথা পুনরায় বলতে চাই, সৈনিকগণের চিকিৎসার কথা পুনরায় বলতে চাই। এ কথাগুলো বলার জন্য আমাদের একটা সুযোগ প্রয়োজন।
“আমাদের কষ্টের কোনো শেষ নাই, সাংবাদিক সমাজের কষ্টের কোনো শেষ নাই, বিচার পাওয়ার আকাঙ্ক্ষার কোনো শেষ নাই। এই কথাগুলো যে আনুষ্ঠানিক বলতে চাই। এই বলার জন্য আমরা বিবেচনা করেছি আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে।”
কেন রাজনৈতিক দল করলেন?
সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দল গঠনের কারণও ব্যাখ্যা করেন ইবরাহিম।
তিনি বলেন, “আমি সচেতন নাগরিক হিসেবে মনে করি দেশের মানুষের জন্য আমার কিছু করা প্রয়োজন। এই তাগাদা থেকেই ২০০৭ সালে আমি রাজনৈতিক দল কল্যাণ পার্টি প্রতিষ্ঠা করেছিলাম।”
‘দেশ অনেককিছু দিয়েছে’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আপনি অবসর জীবনে সন্তানদের নিয়ে বিনোদন কেন্দ্রে গিয়ে খেলাধুলা করে সময় কাটাবেন না কি দেশের মানুষের জন্য কিছু করবেন, সেই চেতনা থেকে ‘পরিবর্তনের জন্য রাজনীতি’ নিয়ে দল করেছি।”
বিএনপির সঙ্গে জোটে যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে পরে তিনি বলেন, “পরিবর্তন তো আমরা একলা পারব না। সেজন্য আমরা প্রধান বিরোধী দল (সে সময়ের) বিএনপির কাছে আবেদন করেছি, সরকারি মহলের কাছে আবেদন করেছি, জনগণের কাছে বার বার আবেদন করেছি যে, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পদ্ধতিতে অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি, অনেক দূষণ। সমাজকে এটা থেকে মুক্ত করতে হলে সকলের চেষ্টা করা প্রয়োজন। তাই আমরা সর্বাত্মক চেষ্টায় আবারও আত্মনিবেদন করতে চাই।”
সংবাদ সম্মেলনে শুরুতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি এম এ জি ওসমানী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন ইবরাহিম।
তিনি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর দাবি জানান। সেই সঙ্গে বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিয়ে আসার অনুমতি দেওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতাও জানান।
জনাকীর্ণ এই সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ মুসলিম লীগের সভাপতি শেখ জুলফিকার বুলবুল চৌধুরী, মহাসচিব তফাজ্জল হোসেন, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (মতিন) মহাসচিব জাফর আহমেদ জয়, নির্বাহী চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম, অতিরিক্ত মহাসচিব ফারক-উল ইসলাম, প্রেসিডিয়াম সদস্য আনোয়ারুল ইসলাম, কল্যাণ পার্টির মহাসচিব আবদুল আউয়াল মামুন, স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদও উপস্থিত ছিলেন।
আরও পড়ুন:
এক দফা ছেড়ে ‘যুক্তফ্রন্ট’ গড়ে ভোটের মিছিলে সৈয়দ ইবরাহিম
বিএনপির শরিকরা এল ‘১২ দলীয় জোট’ নিয়ে