গাজীপুরে আজমতের নৌকা ডুবিয়ে মাকে ভাসালেন জাহাঙ্গীর

“চ্যালেঞ্জের মধ্যে আমার জন্ম হয়েছে... আমার বাঁচা মরার মতো একটা নির্বাচন ছিল,” বলছেন জাহাঙ্গীর আলম।

মঈনুল হক চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 May 2023, 09:16 PM
Updated : 25 May 2023, 09:16 PM

পারলেন না আজমত উল্লা খান; নৌকা প্রতীক নিয়েও হারতে হল তাকে। দল থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পর জাহাঙ্গীর আলম বলেছিলেন, গাজীপুরে আওয়ামী লীগেরই তাকে প্রয়োজন। ভোটে দৃশ্যত তাই তিনি দেখালেন; দলকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে মাকে প্রার্থী করে জিতিয়ে আনলেন।

বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত গাজীপুর সিটি করপোরেশনের তৃতীয় নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে মেয়র হতে চলছেন সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুন।

ইভিএমে দিনভর গোলযোগহীন ভোটগ্রহণের পর মাঝরাতে রিটার্নিং কর্মকর্তা ফরিদুল ইসলামের ঘোষিত ফলে দেখা যায়, টেবিল ঘড়ি প্রতীকে জায়েদা পেয়েছেন ২ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৪ ভোট।

তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লা খান নৌকা প্রতীকে পেয়েছেন ২ লাখ ২২ হাজার ৭৩৭ ভোট।

অর্থাৎ স্বতন্ত্র প্রাথী জায়েদা ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর চেয়ে ১৬ হাজার ১৯৭ ভোট বেশি পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন।

Also Read: গাজীপুরের শান্তিপূর্ণ ভোটে ইসিতে স্বস্তি

Also Read: গাজীপুর ভোট: জাহাঙ্গীরের মা জায়েদাকে বিজয়ী ঘোষণা

Also Read: গাজীপুরে নৌকার নয়, ব্যক্তির পরাজয় হয়েছে: জাহাঙ্গীর

খাতাপত্রে জায়েদা বিজয়ী হলেও এই ভোট ছিল মূলত জাহাঙ্গীর ও আজমতের দ্বৈরথ, যার শুরুটা হয়েছিল ২০১৩ সালে গাজীপুর সিটির প্রথম নির্বাচন থেকে।

টঙ্গী পৌরসভার ১৮ বছরের চেয়ারম্যান আজমত সিটি করপোরেশন হওয়ার পর প্রথম নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থনে প্রার্থী হয়েছিলেন। নির্দলীয় প্রতীকের সেই নির্বাচনে দলের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে মেয়র প্রার্থী হয়েছিলেন জাহাঙ্গীরও।

ভোটের আগে নাটকীয়ভাবে অন্তর্ধান হওয়ার পর ফিরে এসে জাহাঙ্গীর বিরস বদনে আজমতকে সমর্থনের ঘোষণা দিলেও তাতে দলীয় প্রার্থীর জয় আসেনি। লাখো ভোটের ব্যবধানে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী আবদুল মান্নানের কাছে হেরেছিলেন আজমত।

সিটি করপোরেশন আইন সংশোধনের পর ২০১৮ সালে দ্বিতীয় নির্বাচনে আজমতকে হটিয়ে দলের মনোনয়ন ছিনিয়ে নেন সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর। নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করে বিএনপির ধানের শীষের প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকারকে হারিয়ে মেয়র হন তিনি।

তবে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে একটি ঘরোয়া আলোচনায় বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের নিয়ে ‘আপত্তিকর’ মন্তব্য করার অভিযোগ উঠে মেয়র জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে।

আওয়ামী লীগের একটি অংশের ক্ষোভ-বিক্ষোভের মধ্যে জাহাঙ্গীরের দলীয় সদস্যপদ কেড়ে নেয় আওয়ামী লীগ। বরখাস্ত হন মেয়র পদ থেকেও।

এক বছরের বেশি সময় পর ভবিষ্যতে সংগঠনের স্বার্থ পরিপন্থী কার্যক্রম ও সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ না করার শর্তে গত ১ জানুয়ারি তাকে ক্ষমা করার কথা জানিয়ে চিঠি দেয় আওয়ামী লীগ।

তবে ভোটের সময় এলে আবার ১০ বছর আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখা যায়। আওয়ামী লীগ আজমতকে মনোনয়ন দিলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র দাখিল করেন জাহাঙ্গীর। তবে খেলাপি ঋণের কারণে তার প্রার্থিতা বাতিল হয়ে যায়। এরপর আবার দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।

Also Read: গাজীপুরের জাহাঙ্গীর ফের আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত

Also Read: আওয়ামী লীগেরই আমাকে প্রয়োজন: জাহাঙ্গীর

তার বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্রের অভিযোগ করে আসা জাহাঙ্গীর পরিস্থিতি আঁচ করে মা জায়েদা খাতুনের নামেও মনোনয়নপত্র কিনে রেখেছিলেন। আর নিজে প্রার্থী হতে না পারার পর গৃহিনী মাকে নিয়ে ভোটের লড়াইয়ে নেমে যান।

অনেকটা ‘ডামি প্রার্থী’ মায়ের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট হিসেবে প্রচার-প্রচারণা মূলত জাহাঙ্গীরই চালান। আর বয়সে প্রবীণ হলেও রাজনীতিতে নবিশ জায়েদা খাতুনও বলেন, তার এই লড়াই ছেলের জন্য।

আগের নির্বাচনে বিএনপি নেতার কাছে হারলেও এবার বিএনপিবিহীন নির্বাচন প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা আজমতের জন্য বড় সুযোগ হিসেবেই দেখছিলেন অনেকে।

ষাটের দশকের শেষভাগ থেকে ছাত্রলীগে যুক্ত আজমত মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের পর শ্রমিক আন্দোলনেও যুক্ত ছিলেন। গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি আজমত দলের কেন্দ্রীয় কমিটিরও সদস্য। ফলে তার জয়ের জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে প্রচারে নামেন দলীয় নেতারা। একদল অভিনয়শিল্পীকেও দেখা যায় নৌকার পক্ষে প্রচারে নামতে।

Also Read: আত্মবিশ্বাসী আজমত বললেন ‘নৌকার জয় হবে’

জাহাঙ্গীরের পক্ষে স্থানীয় আওয়ামী লীগের কেউ কেউ নামলেও তাকে আমলে নিচ্ছিলেন না আজমত। তার দাবি ছিল, বিতর্কিত ও অপকর্মকারীরাই কেবল জাহাঙ্গীরের পক্ষে।

বৃহস্পতিবার নিজের ভোট দেওয়ার পরও সন্তোষ জানিয়ে নিজের জয়ের আশা প্রকাশ করেছিলেন আজমত। দৃঢ় কণ্ঠে তিনি বলেছিলেন, “আল্লাহর উপর ভরসা রেখে আমি বলতে চাই, আজকে জয় এখানে নৌকারই হবে।”

দিনভর দেখা গেলেও রাতে যখন গাজীপুর শহরের বঙ্গতাজ মিলনায়তনে স্থাপিত ফল পরিবেশন কেন্দ্র থেকে ফল ঘোষণা হচ্ছিল, তখন সেখানে দেখা যায়নি আজমতকে। তিনি তার টঙ্গীর বাড়িতেই ছিলেন বলে তার সমর্থকরা জানায়।

অন্যদিকে মাকে নিয়ে ভোট দেওয়ার পর বিভিন্ন কেন্দ্র ঘুরে জাহাঙ্গীর অভিযোগ করেছিলেন, ভোটারদের নানা ভাবে ভয় দেখানো হচ্ছে, তার এজেন্টদের কেন্দ্রে থাকতে দেওয়া হচ্ছে না।

সন্ধ্যার পর সমর্থকদের নিয়ে বঙ্গতাজ মিলনায়তনে অবস্থান নেন জাহাঙ্গীর, যেখানে ফল ঘোষণার শেষ পর্যন্ত তিনি ছিলেন। মাঝে তিনি ফল ঘোষণার দেরি দেখে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে অসন্তোষও প্রকাশ করেন।

চূড়ান্ত ফলে জায়েদা খাতুনকে বিজয়ী ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় টেবিল ঘড়ির প্রধান এজেন্ট জাহাঙ্গীর বলেন, “গাজীপুরে নৌকা জিতছে, আর ব্যক্তি হারছে।”

তিনি বলেন, “গাজীপুরের সিটি করপোরেশন নির্বাচন আমার বাঁচা মরার মতো একটা নির্বাচন ছিল। আমার মা আমাকে জন্ম দিয়েছেন। তিনি বলেছেন- এই শহরের ওপর তোমার ওপর অত্যাচার হয়েছে। আমি মা হয়ে ঘরে বসে থাকতে পারি না। আমি এই নির্বাচনটা করতে চাই।

“আমার মা বলেছে- যে ব্যক্তি তোমার ক্ষতি করেছে, তার বিরুদ্ধে আমি দাঁড়িয়েছি। সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে আমার মায়ের জয় হয়েছে। গাজীপুরের ভোটারদের জয় হয়েছে।”

দল থেকে বহিষ্কৃত হলেও জাহাঙ্গীর বলেন, “আমি বলেছিলাম, আমি কখনও আওয়ামী লীগের বিপক্ষে যাইনি, যাব না; নৌকার বিরুদ্ধে যাইনি, যাব না।

“আমি বলেছিলাম, নেত্রী (শেখ হাসিনা) আমার ভালবাসা-শ্রদ্ধার জায়গা। এখানে যেন কেউ আঘাত না করে। মিডিয়ার বন্ধুদের বলব আল্লার ওয়াস্তে আমাকে আর আমার পরিবারকে নিয়ে দয়া করে আর মিথ্যা কথা লিইখেন না, বইলেন না।”

ভোটের আগে জাহাঙ্গীর বলেছিলেন, মা মেয়র হলে তিনি তার পাশে থেকে সিটি করপোরেশনের কাজে সার্বিক সহযোগিতা দিয়ে যাবেন।

“আমি যেহেতু এই সিটি করপোরেশনে মেয়রের দায়িত্ব পালন করেছি, এর আগে উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছি, সেসব থেকে আমার একটা অভিজ্ঞতা হয়েছে। মা নির্বাচিত হলে আমি সার্বিকভাবে তার কাজে সহযোগিতা করব। প্রশাসনিকভাবে মা-ই প্রধান থাকবেন। কিন্তু সার্বিকভাবে নগরবাসীকে সঙ্গে নিয়ে তাকে যত রকমের সহযোগিতা করা যায়, তা আমি করব।”

৬১ বছর বয়সী জায়েদা গৃহিনী হয়ে এই পর্যন্ত জীবন কাটিয়ে দিলেও তাকে ‘সংগ্রামী’ নারী বলে অভিহিত করেন ছেলে জাহাঙ্গীর।

জায়েদার স্বামী মিজানুর রহমানের গ্রামের বাড়ি ছিল গাজীপুরের কালীগঞ্জের বান্দাখোলা এলাকায়। বিয়ের ১০ থেকে ১২ বছর পরে বড় মেয়ে জারমিন আক্তারকে নিয়ে তারা চলে আসেন কালীগঞ্জের কানাইয়া এলাকায়। সেখানে এক খণ্ড জমি কিনে করেন বাড়ি। সেখানেই জাহাঙ্গীর আলম ও ছোট ভাই আল আমিনের জন্ম।

ভোটে মায়ের জয়ের পর জাহাঙ্গীর বলেন, “চ্যালেঞ্জের মধ্যে আমার জন্ম হয়েছে। কোনো সন্ত্রাসী, অপকর্মের সাথে আমি আপস করি নাই। ১২ লাখ ভোটারের সহযোগিতা চাই। এই শহরে প্রায় তিন হাজার ইন্ডাস্ট্রি আছে, প্রায় ১৭০ দেশের ক্রেতা, ২৪ লাখ গার্মেন্টসের কর্মকর্তা-কর্মচারী আছে। এই শহর ভালো থাকলে দেশের অর্থনীতি ভালো থাকবে। অর্থনীতি ভালো থাকার জন্য আমার মাকে সহযোগিতা করব।”

Also Read: জিতলে মা প্রশাসনিক প্রধান হবেন, আমি থাকব সহযোগিতায়: জাহাঙ্গীর

জাহাঙ্গীর বার বার আলোচনায়

জাহাঙ্গীর ছিলেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি; পরে গাজীপুর সদর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি।

তবে তার নাম বড় পরিসরে আলোচনায় আসে ২০১৩ সালে, যখন তিনি সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত আজমত উল্লার বিপরীতে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমে।

দলের নির্দেশেও ভোট থেকে সরে দাঁড়াতে রাজি না হওয়ার পর সেবার নিখোঁজ হয়েছিলেন তিনি। ভোটের ঠিক আগে আগে গাজীপুরে ফিরে কাঁদতে কাঁদতে আজমতকে সমর্থন জানান তিনি। তবে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের সময় শেষ হয়ে যাওয়ায় ব্যালটে তার নাম থেকে যায়।

গাজীপুরে আওয়ামী লীগের শক্তিশালী অবস্থান থাকলেও সেই নির্বাচনে আজমত হারেন ১ লাখ ৬ হাজার ৫৭৭ ভোটে। জাহাঙ্গীর তখন বলেছিলেন, প্রার্থী নির্বাচনে ভুল করেছে তার দল।

পাঁচ বছর পরে ২০১৮ সালের নির্বাচনে জাহাঙ্গীরকে দলীয় প্রতীক নৌকা দেয় আওয়ামী লীগ। বিএনপির প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকারকে ২ লাখ দুই হাজার ৩৯৯ ভোটে হারিয়ে দেন তিনি।

সেই নির্বাচনের পর থেকে রাজধানী লাগোয়া এই জনপদে জাহাঙ্গীরের প্রভাব ক্রমেই বাড়ছিল। তবে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে একটি ঘরোয়া আলোচনায় বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের নিয়ে ‘আপত্তিকর’ মন্তব্য করার অভিযোগ উঠে তার বিরুদ্ধে।

আওয়ামী লীগের একটি অংশের ক্ষোভ-বিক্ষোভের মধ্যে মেয়রের দলীয় সদস্যপদ কেড়ে নেয় আওয়ামী লীগ। তারপর বরখাস্ত হন মেয়র পদ থেকেও।

ভবিষ্যতে সংগঠনের স্বার্থ পরিপন্থী কার্যক্রম ও সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ না করার শর্তে গত ১ জানুয়ারি তাকে ক্ষমা করার কথা জানিয়ে চিঠি দেয় আওয়ামী লীগ।

সেই ‘ক্ষমা’র শর্ত ভঙ্গ করে দলের প্রার্থী আজমত উল্লা খানের বিরুদ্ধে প্রার্থী হন জাহাঙ্গীর। মনোনয়নপত্র দাখিলের পর তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, তাকে ‘গুম’ করা হতে পারে।

এরপর খেলাপি ঋণের কারণে তার প্রার্থিতা বাতিল হয়ে গেলে আপিল করেও কাজ না হওয়ার পর তিনি মাকে নিয়ে নির্বাচনে নামেন। এই পর্যায়ে আওয়ামী লীগ তাকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করেন। এরপর দুর্নীতি দমন কমিশন তাকে তলবও করে।

তবে ভোটের ফল ঘোষণার পর জাহাঙ্গীর বলেন, “আমি আওয়ামী লীগেরই তৈরি, আওয়ামী লীগ আমার রক্তের সঙ্গে আছে।”

Also Read: গাজীপুরের মেয়র জাহাঙ্গীর বরখাস্ত

Also Read: গাজীপুরের জাহাঙ্গীরের বহিষ্কারাদেশ তুলে নিল আওয়ামী লীগ

Also Read: ব্যবসা হারিয়েছেন জাহাঙ্গীর, আজমতের আয় এখন বেশি

Also Read: মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে ‘গুমের শঙ্কায়’ জাহাঙ্গীর

Also Read: জাহাঙ্গীরের প্রার্থিতা কি টিকবে?