একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে দেশে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে রাজনৈতিক মতভেদের মধ্যে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে বিশ্ব সংস্থাটির একজন সহকারী মহাসচিবের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
Published : 13 Sep 2018, 11:44 PM
জাতিসংঘের রাজনীতি বিষয়ক সহকারী মহাসচিব মিরোস্লাভ জেনকার সঙ্গে বৃহস্পতিবার সকালের (নিউ ইয়র্ক সময়) এই বৈঠকে দেশে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিরোধী দলকে দমন-পীড়নের অভিযোগ এবং দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে আলোচনা করেন বিএনপি মহাসচিব।
ফখরুলের এই সফর জাতিসংঘ মহাসচিবের আমন্ত্রণে বলে তার দলের নেতাদের পক্ষ থেকে দাবি করা হলেও বিশ্ব সংস্থাটির দপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএনপির উদ্যোগেই এই বৈঠক হয়েছে।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের সঙ্গে বৈঠক করতে ফখরুল নিউ ইয়র্ক গেছেন বলে খবর ছড়ালেও তার বৈঠকটি হয়েছে একজন সহকারী মহাসচিবের সঙ্গে।
জাতিসংঘে পদমর্যাদায় আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেলেরও পরে সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল বা সহকারী মহাসচিবদের অবস্থান। পদমর্যাদায় জাতিসংঘ মহাসচিবের পরে রয়েছেন একজন উপ মহাসচিব; তার নিচে রয়েছেন বর্তমানে ২১ জন আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল। এই আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেলদের সহায়তায় রয়েছেন বিভাগভিত্তিক অনেক সহকারী মহাসচিব।
বছর শেষে অনুষ্ঠেয় একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে দশম সংসদ নির্বাচন বয়কটকারী বিএনপির মহাসচিবের এই সফর দেশেও রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার সৃষ্টি করে।
প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দলের মহাসচিবের এই সফরের প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেন, “নালিশে নালিশে বিরক্ত হয়ে হয়ত জাতিসংঘ তাদের ডেকেছে। এটা জাতিসংঘ করতেই পারে।
“তবে আমরা আমাদের সংবিধানের বাইরে কারও চাপের কাছে নতি স্বীকার করব না। সংবিধানসম্মতভাবেই নির্বাচন হবে।”
বাংলাদেশে বিরোধপূর্ণ রাজনৈতিক দলগুলোকে সমঝোতায় আনতে ২০১৩ সালে জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিবের উদ্যোগে ঢাকায় এসেছিলেন তৎকালীন একজন সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো। তিনি দফায় দফায় বৈঠক করলেও ব্যর্থ হয়ে ফিরে যান। এরপর বিএনপির বর্জনের মধ্যে নির্বাচন করে ক্ষমতায় থেকে যায় আওয়ামী লীগ।
জেনকার সঙ্গে বৈঠকে ফখরুলের সঙ্গে ছিলেন দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য তাবিথ আউয়াল এবং লন্ডন থেকে আসা সহ-আন্তর্জাতিক সম্পাদক হুমায়ূন কবীর।
বৈঠক শেষেই বিএনপি মহাসচিব ওয়াশিংটন ডিসির উদ্দেশে রওনা হন। যাওয়ার আগে বৈঠকের ফলাফল নিয়ে স্থানীয় সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি বলেন, “একদিনের বৈঠকে কী ফল জানা সম্ভব?”
ফখরুল বলেন, “মহাসচিবের আমন্ত্রণে এ বৈঠকে এসেছিলাম। আসন্ন নির্বাচনসহ বাংলাদেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা হয়েছে। খালেদা জিয়ার সাথে সরকারের চরম বৈরী আচরণের প্রসঙ্গও স্থান পায় এ বৈঠকে।”
এই বৈঠক নিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র ফারহান আজিজ হক এক ই মেইল বার্তায় বলেন, “বিএনপির অনুরোধে সহকারী মহাসচিব মিরোস্লাভ জেনকা বিএনপি মহাসচিবকে সাক্ষাৎ দেন।
“বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে মাঝেমধ্যেই সহকারী মহাসচিবের দপ্তর রাজনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করে, এটি তার ব্যতিক্রম নয়।”
ফারহান বলেন, “বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট সকলের কাছে আমাদের প্রত্যাশা, তারা জবাবদিহিতাপূর্ণ, বিশ্বাসযোগ্য, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য ভূমিকা রাখবেন।”
এই বৈঠকের গুরুত্ব প্রসঙ্গে জাতিসংঘে বাংলাদেশের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি এ কে এ মোমেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সবকিছু নির্ভর করে দেন-দরবারকারীদের সঙ্গে থাকা দেশগুলোর ওপর। সেসব দেশ যদি খুব শক্তিশালী হয়, তাহলে প্রত্যাশিত ফল পাওয়া যায়। আর যদি দুর্বল হয়, তাহলে ফটোসেশনে পরিণত হয় এমন বৈঠক।
“বিএনপির মহাসচিবের বৈঠকের জন্য কারা তদবির করেছে তার ওপর সবকিছু নির্ভর করবে।”
জাতিসংঘ মহাসচিবের সচিবালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “যে কোনো কাজে জাতিসংঘকে উদ্বুদ্ধ করতে হলে শক্তিশালী বা প্রভাবশালী রাষ্ট্রের অকুণ্ঠ সমর্থন লাগে।”
দেশে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী মোমেন বলেন, “সকলকে মনে রাখতে হবে যে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বের অনেক প্রভাবশালী রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা ফোন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। সাবেক দুই মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিন্টন এবং জন কেরিও শেখ হাসিনাকে ফোন করেন পৃথক দুটি ইস্যুতে। জাতিসংঘ থেকেও কয়েক বছর আগে একজন আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল ঢাকায় গিয়ে দেন-দরবার করেছিলেন। ফলাফল সকলেই জানি।
“বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা নিজের কর্মদক্ষতা এবং নেতৃত্বগুণে বাংলাদেশের মানুষের ওপর এতটাই আস্থাবান যে, অন্যের কথায় নড়চড় করেন না।”
এদিকে ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ফখরুল বৈঠক করবেন বলে বিএনপি নেতাদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনে তদবির চালাতে বিএনপি ওয়াশিংটনে একটি ‘লবিং ফার্ম’ ভাড়া করেছে বলেও খবর দিয়েছে রাজনীতি বিষয়ক ম্যাগাজিন পলিটিকো।
বিএনপির এই তৎপরতার প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক হাছান মাহমুদ বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, “দেশের মানুষের প্রতি বিএনপির কোনো আস্থা নেই। এজন্য তারা এখন বিদেশমুখী।
“তারা নালিশ বাংলাদেশের মানুষকে দিচ্ছে না, বরং বিদেশে গিয়ে বিদেশিদের কাছে নালিশ উপস্থাপন করছে। এটি তদের রাজনৈতিক দৈন্যের বহিঃপ্রকাশ। জনগণের উপর তাদের আস্থাহীনতারই বহিঃপ্রকাশ।”