“গ্রাম-গঞ্জের মানুষ ঢাকার দিকে তাকিয়ে আছে, ঢাকামুখী কর্মসূচির জন্য। তাদের একটাই কথা- বড় কর্মসূচি দিন,” বলছেন গাইবান্ধার বিএনপিকর্মী সোহরাব উদ্দিন।
Published : 08 Aug 2023, 01:04 AM
গত ২৮ জুলাই সমাবেশে যোগ দিতে ঢাকায় এসেছিলেন রংপুর জেলার যুবদলকর্মী শফিক আহমেদ। তারপর আর এলাকায় ফেরেননি। তার বাসনা, আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটিয়েই যাবেন।
শফিকের মতো বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের কর্মীরা এখন আশায় আছেন, এক যুগেও যা করা যায়নি, এবার তা হবে। সেই স্বপ্ন সফলে রাজধানীকেন্দ্রিক কর্মসূচি চাইছেন তারা।
২০০৬ সালে ক্ষমতা ছাড়ার পর আর ক্ষমতায় যেতে পারেনি বিএনপি। দুই বছর সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনের পর ভোটে জিতে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় বসে আওয়ামী লীগ। তারপর টানা তৃতীয় মেয়াদে শেখ হাসিনার সরকার চালাচ্ছে দেশ।
২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি সংবিধান থেকে বিলোপের পর তা ফিরিয়ে আনার আন্দোলনে নামে বিএনপি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ২০১৪ সালে ভোট ঠেকানোর ঘোষণাও দিয়েছিল বিএনপি, তবে সফল হয়নি।
এরপর ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিলেও ভোট কারচুপির অভিযোগ তুলে ফল প্রত্যাখ্যান করে। দলটির সাতজন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেও গত বছর একযোগে সবাই পদত্যাগ করেন।
সংসদ থেকে বিএনপির ৭ এমপির পদত্যাগ
‘দফা’ এখন এক, সরকারের পদত্যাগ: ফখরুল
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে আসার মধ্যে এখন আবার নির্দলীয় সরকারের দাবি সামনে এনেছে বিএনপি; আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে হটানোর একদফা আন্দোলনেও নেমেছে।
তবে এবার আর ২০১৪ সালের ব্যর্থতার পুনরাবৃত্তি চান না দলটির কর্মীরা; যাদের অনেকেই মনে করেন, সেবার জেলাগুলোতে শক্ত আন্দোলন হলেও রাজধানীতে তা জমাতে না পারায় টিকে যায় আওয়ামী লীগ।
নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ থেকে ঢাকার সমাবেশে যোগ দিতে আসা যুবদলকর্মী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “নেতাদের বাসায় গিয়ে বলেছি, রাজপথের কর্মসূচি দিতে। বিক্ষোভ-মানববন্ধন কর্মসূচি দিয়ে সরকার হটানো যাবে না। এমন কর্মসূচি দিতে হবে যেন ওরা পালাবার পথ না পায়। ঢাকার রাস্তা মানুষে মানুষে সয়লাব করে দেওয়ার মতো কর্মসূচি চাই।”
তার মতোই মত গাইবান্ধা থেকে আসা বিএনপিকর্মী সোহরাব উদ্দিনের। তিনিও বলেন, লাগাতার কঠিন কর্মসূচি দিতে হবে।
সারাদেশের বিএনপি সমর্থকরা এখন ঢাকার আন্দোলনের দিতে তাকিয়ে আছে বলে জানান সোহরাব।
“গ্রাম-গঞ্জের মানুষ ঢাকার দিকে তাকিয়ে আছে, ঢাকামুখী কর্মসূচির জন্য। ২৮ তারিখের সমাবেশে আপনি খোঁজ নিয়ে দেখেন, অর্ধেক মানুষ ছিল ঢাকার বাইরের। তাদের একটাই কথা- বড় কর্মসূচি দিন।”
গত ১২ জুলাই বিএনপিসহ সমমনা জোটগুলো যুগপৎভাবে এক দফার আন্দোলনের ঘোষণা দেয়। তাদের দাবি হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ করে সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্দলীয় সরকারের হাতে ক্ষমতা দেবে, তাদের অধীনেই হবে নির্বাচন।
সেই আন্দোলন জোরদারে ২৮ জুলাই ঢাকায় মহাসমাবেশের পর ২৯ জুলাই রাজধানীর প্রবেশপথগুলোতে অবস্থান কর্মসূচি দিয়েছিল বিএনপি। অবস্থানে সংঘাত ঘটলেও সাম্প্রতিক কর্মসূচিগুলোতে নেতা-কর্মীদের অংশগ্রহণ বিএনপি নেতাদেরও আশাবাদী করে তুলছে।
রাজধানীর নেতা-কর্মীরাও এবার শক্ত অবস্থান আন্দোলন গড়ে তোলার মতো সামর্থ্য অর্জনের দাবি করছেন।
ঢাকার বাড্ডার মহিলা দলের নেত্রী সোনিয়া আখতার বলেন, “২০১৪ সালে নির্বাচনের আগে সারাদেশে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, কিন্তু চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে দেখা গেল, ঢাকায় আন্দোলন গড়ে উঠেনি। তবে ঢাকার সাংগঠনিক শক্তি এখন অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক শক্তিশালী।
“এখন ঢাকাকে টার্গেট করেই কর্মসূচি দেওয়ার সময় এসেছে। শেখ হাসিনাকে পদত্যাগে বাধ্য করতে হলে এর কোনো ভিন্ন পথ নাই।”
ঢাকা মহানগর ছাত্রদলকর্মী ওমর শাফিন বলেন, পুলিশ তথা সরকারকে চ্যালেঞ্জ জানাতে তারা এখন ‘প্রস্তুত’।
এর বিকল্প কিছু নেই মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। মিথ্যা মামলায় আমরা জর্জরিত, ৬৭টা মামলা আমার বিরুদ্ধে। এই সরকারের সাথে রফা করে কোনো লাভ হবে। আমরা চাই, রাজপথের কঠিন কর্মসূচি। যা কিছু করতে হবে রাস্তায় করতে হবে। তা না হলে আমরা শেষ হয়ে যাব।”
কর্মীরা কঠোর কর্মসূচি চাইলেও বিএনপি তার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সঙ্কটকাল পার করছে গত এক দশক ধরে। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দুর্নীতির মামলায় হয়েছেন দণ্ডিত; কারাগার থেকে সরকারের নির্বাহী আদেশে মুক্ত হলেও অসুস্থ অবস্থায় রয়েছেন ঘরে। দলের নেতারাও তার দেখা পান কালে-ভদ্রে।
খালেদা জিয়া দণ্ডিত হওয়ার পর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন তার ছেলে দলের জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনিও নেই দেশে। কয়েকটি মামলায় দণ্ড নিয়ে ফেরারী আসামি হয়ে তিনি সপরিবারে রয়েছেন যুক্তরাজ্যে।
এই পরিস্থিতিতে ‘নেতৃত্বশূন্য’ বিএনপির আন্দোলনের সামর্থ্য নিয়ে বারবারই প্রশ্ন তুলে আসছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা। নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবি প্রত্যাখ্যানের পাশাপাশি বিএনপির এক দফার আন্দোলন নিয়েও কটাক্ষ করে যাচ্ছেন না।
তবে বিএনপি নেতারা এখন তা আমলে না নিয়ে সরকার পতনের আন্দোলনের কৌশল সাজাচ্ছেন। পরবর্তী কর্মসূচি নিয়ে সমমনা দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন।
যুগপৎ আন্দোলনে থাকা পেশাজীবী সংগঠনগুলোকে এক ছাতার নিচে এনে এই আন্দোলন জোরদার করার পরিকল্পনা হয়েছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন দলের আইনজীবীদের একত্রিত করে ‘ইউনাইটেড ল ইয়ার্স ফ্রন্ট’ গঠন করা হয়েছে।
ফ্রন্টের অন্যতম নেতা গণফোরামের সুব্রত চৌধুরী বলেন, ‘‘সকল দল-সংগঠন-গোষ্ঠিকে একছাতার নিয়ে এনে শেখ হাসিনার সরকারকে ধাক্কা দিতে হবে।
“সব রাজনৈতিক দলের ছাত্র-যুব-শ্রমিক সংগঠনগুলোকেও এই প্রক্রিয়ায় একতাবদ্ধ করে চূড়ান্ত ফয়সালায় রাস্তায় নামতে হবে। এখন সময় বেশি নেই, যা কিছু করতে হবে অতিদ্রুত করতে হবে।”
বিএনপি নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জাতীয় নির্বাচনের কয়েকমাস বাকি থাকায় কর্মীদের ভাবনার সঙ্গে মিল রেখে ঢাকাকেন্দ্রিক কর্মসূচি নিয়ে এগোতে চাইছেন তারাও।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “আমাদের দফা একটাই… শেখ হাসিনা ও তার সরকারকে সরে যেতে হবে। সংসদ বিলুপ্ত করতে হবে। এক দফা আন্দোলনে আমরা মাঠে আছি, নতুন কর্মসূচি নিয়ে আবার মাঠে নামব।”