আরপিও সংশোধন: সরকারের ভাবনা জানাতে ‘শেষ দফা’ চিঠি ইসির

সময়মত সাড়া না পেলে নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা, স্বাধীনতা ও সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে ‘জনমনে সংশয় তৈরি হতে পারে’ বলে সতর্ক করেছে ইসি।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Nov 2022, 12:42 PM
Updated : 27 Nov 2022, 12:42 PM

রিপ্রেজেন্টেশন অব দ্য পিপল অর্ডার (আরপিও) বা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংশোধনের প্রস্তাবে সাড়ে তিন মাস ধরে আইন মন্ত্রণালয়ের কোনো সাড়া না পাওয়ায় ফের ‘বিশেষ তাগাদা’ দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।

তৃতীয় দফায় এবং শেষবারের মতো আগামী ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে ওই প্রস্তাবের ব্যাপারে লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের উদ্যোগ বা অগ্রগতি জানাতে বিশেষ অনুরোধ জানিয়েছে কমিশন।

আর তা না হলে নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা, স্বাধীনতা এবং সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে ‘জনমনে সংশয় তৈরি হতে পারে’ বলে সতর্ক করা হয়েছে ইসির চিঠিতে।

আরপিও সংশোধনীর খসড়া প্রস্তাব গত ৮ অগাস্ট আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে এবং এর লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগকে পাঠিয়েছিল নির্বাচন কমিশন। এরপর ২৮ সেপ্টেম্বর লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগকে জরুরি চিঠি দিয়ে প্রস্তাবের বিষয়ে গৃহীত অগ্রগতি জানাতে বলে ইসি। কিন্তু তাতে সাড়া না মেলায় ফের ১০ অক্টোবর চিঠি দেওয়া হয়।

রোববার নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের উপসচিব মো. আব্দুল হালিম খান সই করা তৃতীয় দফার চিঠিতে বলা হয়, এখন পর্যন্ত ওই প্রস্তাবের বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের অবস্থান জানতে পারেনি ইসি।

যদিও দুই দফা ইসির চিঠি পাওয়ার কথা জানিয়ে আইন মন্ত্রণালয় বলছে, ওই প্রস্তাব পর্যালোচনা চলছে, সেটি রুটিন কর্মকাণ্ড। মন্ত্রীর দপ্তরে এ নিয়ে কাজ চলছে।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আরপিওতে একগুচ্ছ সংশোধনী আনার প্রস্তাব দিয়েছে ইসি। ইসি কর্মকর্তারা জানান, আরপিওর ৭, ১২, ১৫, ২৫, ৩১, ৩৬, ৪৪, ৮৪, ৯০, ৯১ অনুচ্ছেদসহ বেশ কিছু ধারা-উপধারায় সংযোজন-বিয়োজন ও করণিক সংশোধনের প্রস্তাব রাখা হয়েছে।

ভোটের সময় কোনো অভিযোগ পেলে কমিশন খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নিতে পারে বিদ্যমান আইনে। এখন ভোটের সময়ের পরে থেকে ফলাফল প্রকাশের পর, এমনকি গেজেট প্রকাশের আগে নির্বাচনের যে কোনো পর্যায়ের অভিযোগের ক্ষেত্রে কমিশন যেন তদন্ত করতে পারে এবং অনিয়মের প্রমাণ পেলে ভোট বাতিল করতে পারে, এজন্য ৯১ অনুচ্ছেদে দুটি উপধারা সংযোজনের প্রস্তাব করা হয়েছে।

ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার জানিয়েছিলেন, নির্বাচনের যে কোনো মুহূর্তে ‘পেশীশক্তি বা অন্যবিধ যে কোনো কারণে’ নির্বাচন বন্ধ/বাতিল জন্য এ প্রস্তাব করা হয়েছে।

এ বিধির অধীনে কারো প্রার্থিতা বাতিল হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যেন নতুন করে ওই নির্বাচনে অংশ নিতে না পারেন, সেজন্যও প্রস্তাব রয়েছে। এছাড়া কোনো ব্যক্তি ‘অবৈধ প্রভাব বিস্তার করে’ নির্বাচনী দায়িত্ব পালনকারী কোনো ব্যক্তিকে নির্বাচনী কাজে বাধা দিলে বা বাধাদানের চেষ্টা করলে তাকেও শাস্তির আওতায় আনতে ৪৪ অনুচ্ছেদে উপধারা সংযোজনের প্রস্তাব করা হয়েছে।

এসব সংশোধনী প্রস্তাবের খসড়া নিয়ে অগ্রগতি জানতে রোববার ‘শেষবারের মত’ আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের সচিব বরাবর পাঠিয়েছে ইসি।

আর ইসির প্রস্তাবগুলো নিয়ে কাজ চলছে জানিয়ে লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগ যুগ্মসচিব (ড্রাফটিং) মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান নূর বলেন, “এসব রুটিন ওয়ার্ক।”

কী বলছেন সিইসি

বারবার চিঠি দিয়ে সাড়া না পাওয়ায় সাংবিধানিক সংস্থাটির অনুরোধ ও চাহিদা উপেক্ষতি হচ্ছে বলে মনে করছে কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন কমিশন।

রোববার সিইসি সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা যেহেতু সময় বেঁধে দিয়েছি, ওই সময়ের মধ্যে নিশ্চয় তারা রেসপন্স করবেন। দেরি হয়েছে… সরকারের বিভিন্ন ব্যস্ততার কারণে হয়ত সময় করে উঠতে পারেনি। এজন্যে সময় দিয়েছি একটা।

“আমরাও তো অনন্ত কাল ধরে একটা ম্যাটার পার্সু করতে পারি না। এজন্যে বিষয়টা আমরা শেষ করে দিতে চাই। রেসপন্স না পেলে আমরা অন্য কাজে রেসপন্স করব।”

হাবিবুল আউয়াল বলেন, “এ বিষয়টাকে নিয়ে আমাদের হয়ত আর পার্সু করতে হবে না। এ চিঠির পর আর রিকোয়েস্ট করা হবে না। চিঠির জবাব না পেলে ওই সময়ের পর (১৫ ডিসেম্বর) আমরা বসে সিদ্ধান্ত নেব, কোনটা গুরুত্বপূর্ণ। সবকিছু খুবই গুরুত্বপূর্ণও না। সরকারেরও বলার থাকবে, যুক্তি থাকতে পারে- এটা অলরেডি কোথাও অ্যাড্রেস করা আছে।

“সেটাও যদি কমিশন জানতে পারে তা নিয়ে আর এগোতে চায় না কমিশন। সরকারের রেসপন্সটা এ বিষয়ে কী জানতে চাইছিলাম। নিশ্চয় তাদেরও যুক্তি থাকতে পারে এটা নিয়ে। আইন প্রণয়ণের অথরিটি সরকার ও পার্লামেন্টের। তারা যদি মনে করেন, পর্যাপ্ত আইন রয়ে গেছে; এ বিষয়ে করণীয় কিছু নেই। সেটুকু জানিয়ে দিলেও হবে।”

সিইসির বক্তব্যের বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের প্রতিক্রিয়া জানতে টেলিফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে তার সাড়া মেলেনি।

আইন মন্ত্রণালয় যা বলছে

আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগ যুগ্মসচিব (ড্রাফটিং) মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান নূর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ইসির চিঠি পেয়েছেন তারা। আরপিও সংশোধন বিষয়ে কোনো ‘জিজ্ঞাসা’ দেওয়া হয়নি। বিষয়গুলো মন্ত্রীর দপ্তরে রয়েছে।

“খসড়া প্রস্তাবের বিষয়টি পর্যালোচনা চলছে। এটা রুটিন কাজ। সাধারণত ড্রাফটিং শাখা দেখভাল করে। এ ধরনের প্রস্তাবগুলো ভেটিং প্রক্রিয়া শেষে মন্ত্রিসভা ও সংসদে যাবে। মন্ত্রী মহোদয়ের দপ্তর এ নিয়ে জানবেন।”

‘সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে সংশয় ইসির চিঠিতে’

রোববার ইসির উপ- সচিব আব্দুল হালিমের সই করা চিঠি আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের সচিব বরাবর পাঠানো হয়। এতে বলা হয়, আরপিওর সংশোধন সংক্রান্ত খসড়া বিলের অগ্রগতির বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে আগামী ১৫ ডিসেম্বরের  মধ্যে জানাতে ‘শেষবারের মত বিশেষভাবে সনির্বন্ধ’ অনুরোধ করা হচ্ছে।

চিঠিতে আরও বলা হয়,  “বাংলাদেশের সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদের বিধান মতে দায়িত্ব পালনে নির্বাচন কমিশনকে সহায়করা  সকল নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য। আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং এর লেজেসটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগ রাষ্ট্র ও সরকারের নির্বাহী বিভাগের একাংশ। দায়িত্ব পালনে নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করা ইহার সাংবিধানিক সংবিধিবদ্ধ দায়িত্ব।

“নির্বাচন কমিশন মনে করে, সংবিধান ও আইনের সুস্পষ্ট বিধানের ব্যত্যয়ে  কমিশনের যাচিত অনুরোধ ও চাহিদা উপেক্ষিত হলে কমিশন স্বীয় দায়িত্ব পালনে আবশ্যক সক্ষমতা অর্জন করতে পারবে না। এতে নির্বাচন বিষয়ে কমিশনের সক্ষমতা, স্বাধীনতা এবং সরকারের সদিচ্ছা প্রশ্নে জনমনে অনাকাঙ্ক্ষিত সংশয়ের উদ্রেক হতে পারে।”

‘দুরত্ব নয়, সমন্বয় ও প্রত্যুত্তর থাকা দরকার’, সাবেক ইসি

সাবেক নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম জানান, ২০১৭-২০২২ সালে নির্বাচন কমিশন আরপিও সংস্কার নিয়ে বেশ উদ্যোগ নিলেও তা নিয়ে কখনও আইন মন্ত্রণালয়ে তাগাদা দিতে হয়নি।

“এ ধরনের প্রস্তাবনা কমিশন সচিবালয় থেকে পাঠানো হয়। কখনও কখনও বিলম্ব হয় এবং কখনও কখনও আইন মন্ত্রণালয় ফেরতও পাঠায়। এটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপারও। আমাদের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়, তখন সদুত্তর পাওয়া যায়। আমরা তো এভাবে চিঠি দেইনি, সরাসরি যোগাযোগ করেছি।”

মন্ত্রণালয়ের ড্রাফটিং শাখার সঙ্গে যোগাযোগের সমন্বয় রাখাও একটা প্রক্রিয়া বলে মনে করেন সাবেক এ বিচারক।

ইসির অনুরোধ ও চাহিদা উপেক্ষার মতো কিছু ঘটেছে কিনা, তা নিয়ে সতর্ক মন্তব্য করতে চান কবিতা খানম। তার মতে, যোগাযোগ করা হলে আইন মন্ত্রণালয় একটু সময় চেয়ে নেয়। দুই পক্ষের মধ্যে দুরত্ব তৈরি না করে সমন্বয় রাখায় জোর দেন তিনি।

কবিতা খানম বলেন, “ইসির পক্ষ থেকে যোগাযোগ করেছে কিনা বলা মুশকিল। আমাদের সময় ব্যক্তিগতভাবেও যোগাযোগ করতাম। ভেটিংয়ে পাঠিয়েছে, যোগাযোগটা আরও সক্রিয়ভাবে করা যেতে পারে। সচিবের সঙ্গে কথা বলতে পারে, আমরা ড্রাফটিং শাখার সঙ্গেও কথা বলেছি।”

কমিশন থেকে চিঠি দেওয়ার পর একটা ‘ভদ্রতাবশত প্রত্যুত্তর’ মন্ত্রণালয়ের থাকা উচিত বলে মনে করেন তিনি।

“ডিসটেন্স তৈরি হয়েছে হয়ত। চিঠি দিলে একটা রিপ্লাইও আসা দরকার। কেন তারা ফেলে রাখছে তাও জানানো দরকার। …দেরি হলে কথাও বলতে পারে। কথা বলতে পারে, চিঠির মধ্যে আবদ্ধ না থেকে এগিয়ে যাওয়া উচিত। আইন মন্ত্রণালয় এমন নয় যে ইগনোর করেছে, করবো না তাও তো বলেনি। ভেটিংয়ে দিয়ে ব্যাক করতেও তো পারে।”

আরও খবর

Also Read: আরপিও সংশোধনে একগুচ্ছ প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠাচ্ছে ইসি

Also Read: আরপিও সংশোধনে বিল খেলাপিদের ছাড় দেওয়ার প্রস্তাব