কুমিল্লায় খান পরিবার কোন দিকে?

আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা আফজল খানের মেয়ে আঞ্জুম সুলতানা সীমা বলেছেন, “দলের কোনো প্রার্থী নেই, যে যার খুশি, তাকে ভোট দেবে।”

মাসুম বিল্লাহকুমিল্লা থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 March 2024, 04:03 PM
Updated : 8 March 2024, 04:03 PM

কুমিল্লায় আরো একটি নির্বাচন, আবার আলোচনায় বহুল আলোচিত আফজল-বাহার দ্বৈরথ, এক নেতার মৃত্যুর পরেও যা বয়ে চলছে উত্তরাধিকারদের মধ্যে।

কাগজ-কলমে ক্ষমতাসীন দলের কোনো প্রার্থী নেই। তবে সদর আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের মেয়ে তাহসীন বাহার সূচনা প্রার্থী থাকায় প্রয়াত আফজল খানের অনুসারীরা কী করবেন, সেই আলোচনা জেগেছে ভোটের আগে আগে।

বিএনপির বর্জনের পরেও দলটির দুই জন নেতার প্রার্থী হওয়া, আওয়ামী লীগে আফজল-বাহার কোন্দল, ক্ষমতাসীন দলের আরো এক জন নেতার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা- সব মিলিয়ে ভোট নিয়ে তৈরি হয়েছে জটিল সমীকরণ।

২০২১ সালের ১৬ নভেম্বর করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে আফজল খানের মৃত্যুর পর তার অনুসারীরা প্রয়াত নেতার সন্তানের পাশে দাঁড়িয়েছেন। এই সন্তানদের মধ্যে আফজলের ছেলেও মারা গেছেন। এখন সবাই মেয়ে আঞ্জুম সুলতানা সীমার পাশে।

আফজল অনুসারীদের প্রকাশ্যে কারো সঙ্গে নেই। তবে তাদের বক্তব্য বাহার কন্যা সূচনার বিরুদ্ধে। পরিবারের ঘনিষ্ঠ একাধিক নেতা বলেছেন, তাদের সহানুভূতি বিএনপির সাবেক মেয়র মনিরুল হক সাক্কুর দিকে। তবে সীমা বলেছেন, ‘দলের কোনো প্রার্থী নেই, যে যার খুশি, তাকে ভোট দেবে।’  

বাহার এখন কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি, সীমা দলের মহানগর শাখার উপদেষ্টা। তিনি আগে এই কমিটির সহসভাপতিও ছিলেন।

নগরীতে আওয়ামী লীগের মূলধারার নিয়ন্ত্রক মূলত বাহার। দলের সহযোগী সংগঠনগুলোর প্রায় সব নেতাই তার অনুসারী। তবে বাহার-বিরোধীরা আছেন সীমার পক্ষে।

দুই বছর আগে বাহার অনুসারী আরফানুল হক রিফাত জয় পাওয়ার আগে সিটি করপোরেশনের দুটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী করে আফজল পরিবার থেকে। ২০১২ সালে আফজলকে আর ২০১৭ সালে তার মেয়ে আঞ্জুম সুলতানা সীমাকে প্রার্থী করে হেরেছে আওয়ামী লীগ। দুইবারই ‘কাঠগড়ায়’ ছিলে বাহার ও তার অনুসারীরা। 

২০২২ সালে ৩৪৩ ভোটে জয় পাওয়া রিফাত আগাগোড়া ছিলেন বাহার অনুসারী। তার মৃত্যুতেই হচ্ছে এবারের উপনির্বাচন। সেই নির্বাচনে আফজল অনুসারীদের ভূমিকা নিয়ে ছিল প্রশ্ন। তবে নৌকা জয় পাওয়ায় ভোট শেষে আলোচনা আর আগায়নি।

এই তিন জনের বাইরে ক্ষমতাসীন দল থেকে ভোটের মাঠে আছেন আরো একজন। তিনি হলেন মহানগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা নূর-উর রহমান মাহমুদ তানিম। তবে তার প্রভাব কতটা, বোঝা মুশকিল।

ভোটের লড়াইয়ে আছেন ২০০৫ পৌরসভা এবং ২০১২ ও ২০১৭ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির সমর্থন বা প্রতীকে জয় পাওয়া মনিরুল হক সাক্কু আছেন, আছেন স্বেচ্ছাসেবক দলের বহিষ্কৃত নেতা নিজামউদ্দিন কায়সার, যিনি ২০২২ সালের নির্বাচনে ২৯ হাজারের বেশি ভোট পেয়ে চমক দেখিয়েছিলেন।

দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে ভোট করায় দুই জনই বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত। সেই আদেশ প্রত্যাহার হয়নি এখনো। তবে বিএনপি সমর্থকদের দিকেই তাকিয়ে তারা।

কুমিল্লার রাজনীতি বিশ্লেষক আহসানুল কবির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই নির্বাচনে ভোটটি হচ্ছে বাহারের পক্ষে এবং বাহারের বিপক্ষে।

“আমার মনে হয়, নিকটতম যে প্রতিদ্বন্দ্বী থাকবেন, তাদের ভোটটা হয়ত সেখানেই যাবে। খান পরিবারের ভোট বাহার বলয়ের বিরুদ্ধে যিনি নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী থাকবেন, তার বাক্সে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।“

২০১২ এবং ২০১৭ সালে আফজল খানের পরিবার বিএনপির সাক্কুকে সমর্থন করার অভিযোগ বাহারের বিরুদ্ধে। কুমিল্লায় প্রচার আছে, ‘পাশার দান উল্টে’ সর্বশেষ নির্বাচনে খান পরিবার সাক্কুকে সমর্থন দিয়েছিল।

কিন্তু স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক নেতা কায়সারের বিপুল ভোট পাওয়ার মধ্যে ৩৪৩ ভোটে হেরে যান সাক্কু।

এবার খান পরিবারের সমর্থন কার পক্ষে যাবে, সেটা বুঝতে ওই পরিবারের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে কথা বলেছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।

তাদের একজন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মেয়র রিফাতের মৃত্যুর পর সাক্কু ও সীমার মধ্যে একাধিকবার যোগাযোগ হয়েছে। গত সংসদ নির্বাচনে সাক্কুর সমর্থকরা সীমার পক্ষে কাজ করেছেন। যার কারণে সীমার অনুসারীদের সমর্থন পাচ্ছেন সাক্কু।

“আওয়ামী লীগের আরেক নেতা তানিমের জেতার সম্ভাবনা কম হলেও তিনি যাতে আওয়ামী লীগের ভোট টানতে পারেন, সেই চেষ্টা আমরা করছি।”

আফজল পরিবার ঘনিষ্ঠ সেই আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, “প্রত্যেকে ওয়ার্ডেই আমাদের যারা নেতাকর্মী আছে, তাদেরকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ভোটারদের কেন্দ্রে নিয়ে আসার জন্য। কারণ, ভোটাররা যাতে কেন্দ্রে না আসে, সেজন্য ভয়ভীতি ও হুমকি দিয়ে আসছেন এমপি বাহারের কর্মীরা।” 

যার যাকে খুশি ভোট দেবে: সীমা

আঞ্জুম সুলতানা সীমা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মোট কথা হচ্ছে, ভোট কুমিল্লায় এখন আতঙ্ক হয়ে গেছে। আমরা যে বলি, উৎসবমুখর পরিবেশে ভোটগ্রহণ হবে, ওই ধরনের কোনো পরিবেশই নাই। একটা আতঙ্ক।”

আপনি কার পক্ষে- এই প্রশ্নে তিনি দিলেন কৌশলী জবাব। বললেন, “দলীয় কোনো বিষয় তো নাই রে ভাই। যারা বলে, দলের দলের, দলের কে? উনিই (বাহার) দল? উনাকে দিয়ে আওয়ামী লীগ? আমাদের নেত্রী কি কিছু না? নেত্রী কি দলীয় কোনো ঘোষণা দিয়েছেন?

“যেহেতু দলের কোনো সিদ্ধান্ত নাই, এ ব্যাপারে কোনো কিছু না বলাটাই ভালো। কারণ, এটা ওপেন, সবাই যার খুশিমতো ভোট দেবে।”

বাহার ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে নির্বাচনে প্রভাব খাটানোর অভিযোগও করেন সীমা। বলেন, “এটা কীসের ভোট? কালকে রাতেও ২১ নম্বর ওয়ার্ডে মহড়া দিয়ে আসছে, সিসিটিভি ফুটেজ প্রকাশ হয়েছে। একটু আগে ফোন এল, প্রকাশ্যে টাকা বিলাচ্ছে। এগুলো নিয়ে কী মন্তব্য করব ভাই?

 “যার যা খুশিমতো ভোট দিতে কেন্দ্রে যাবে। আর না যাওয়ার জন্য তো পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে, যাতে ভোটাররা না যায়।”

ভোটাররা কেন্দ্রে না গেলে কার সুবিধা, এই প্রশ্নে হাসতে হাসতে সীমা বলেন, “যার অভ্যাস ছিনিয়ে নেওয়ার, তারই ভালো হয়।”

সাক্কুকে সমর্থন দেওয়ার বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “সমর্থন দেওয়ার মতো কি কিছু আছে? মুখ আছে বলে দিলে তো হলো না। কোনো প্রমাণ যদি থাকে।” 

আগের নির্বাচনগুলোতে কী হয়েছিল

২০১২ সালে সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচন দলীয় প্রতীকে হয়নি। সেবার মেয়র পদে আওয়ামী লীগ সমর্থন জানায় জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক আফজল খানকে। বিএনপি ছিল মনিরুল হক সাক্কুর পাশে। সাক্কু জেতেন ৩৫ হাজারের বড় ব্যবধানে।

ভোট শেষে আফজল পরিবার বলে, বাহারের বিরোধিতায় এই ফল। প্রমাণ হিসেবে তারা দেখায় বাহারের প্রভাবিত এলাকায় বড় ব্যবধানে হারেন আফজল।

বিএনপির বর্জনে ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনে সদর আসনে বাহারের সঙ্গে আফজল খানের ছেলে মাসুদ পারভেজ খান ইমরানের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়।

নৌকা নিয়ে বাহার জেতেন ৫৯ হাজার ২৫ ভোট পেয়ে, ইমরান পান ৩৮ হাজার ২৯৩ ভোট।

২০১৭ সালের সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগ প্রার্থী করে আফজল কন্যা সীমাকে। কুমিল্লায় দুই পক্ষ যেন এক হয়ে লড়াই করে, সে জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন দলের কেন্দ্রীয় কমিটি।

সীমা ব্যবধান কমিয়ে আনতে পারেন ১১ হাজারে। হেরে যাওয়ার পর তার অনুসারীরা আবার বাহারের বিরুদ্ধে আনেন অসহযোগিতার অভিযোগ। এবারও দেখা যায়, বাহারের প্রভাবিত কেন্দ্রগুলোতে হেরে গেছে নৌকা।

গত বছর সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে দুই পরিবারের কাউকে না নিয়ে বেছে নেওয়া হয় আরফানুল হক রিফাতকে। তিনিও বাহারের অনুসারী হিসেবেই পরিচিত। নৌকা না পেয়ে মনোনয়নপত্র জমা দেন আফজলপুত্র মাসুদ পারভেজ ইমরান। পরে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেন।

সিটি করপোরেশনে দুই বার এবং এর আগে পৌরসভা থাকার সময় আরও দুটি নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর প্রথম রিফাতের হাত ধরে জয় পায় আওয়ামী লীগ।

আফজলপুত্র সিটি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেও সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নের জন্য তিনি লড়াই করবেন, এমন একটি প্রচার ছিল। তবে গত বছরের ৬ মার্চ তিনি মারা যান। ফলে বাবার ‘রাজনৈতিক উত্তরাধিকারের’ প্রশ্নে একা হয়ে যান সীমা।

গত ৭ জানুয়ারি নির্বাচনেও একাদশ সংসদের সংরক্ষিত আসনের সদস্য সীমা নৌকার প্রার্থী বাহারের বিরুদ্ধে লড়েন। ঈগল প্রতীকে তিনি ভোট পান ৪৪ হাজার ৯৬৯। বাহার পান ১ লাখ ৩২ হাজার ২১০ ভোট।

২০০১ সালে বাহার নৌকা না পেয়ে ভোটে দাঁড়ান স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে। সেবার হেরে গেলেও এর পরের চারটি নির্বাচনে তিনিই ‘সেরা’। 

আফজল-বাহারের বিরোধের পূর্বাপর

১৯৮৪ সালে আফজল ছিলেন কুমিল্লা শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি, বাহার ছিলেন সাধারণ সম্পাদক।

সে বছর পৌরসভা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে প্রার্থী হন আফজল। বাহার তাকে সমর্থন না দিয়ে নিজেও ভোটে নামেন, জিতেও যান।

সেই নির্বাচনের পর থেকেই দুই নেতার মধ্যে দ্বন্দ্ব আর রাজনৈতিক বিরোধ প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে। এরপর একজন ভোটে দাঁড়ালে অন্যজন তার বিরোধিতা করেছেন, এটি এক নিয়মিত চিত্র ছিল সেখানে।

কুমিল্লার প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা আফজল খান, যার সঙ্গে বাহারের বিরোধিতা সারা দেশে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের উদাহরণ হয়ে আছে।

২০০১ সালের অষ্টম সংসদ নির্বাচনেও কুমিল্লা সদর আসনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ও দলীয় প্রার্থীর সম্মিলিত ভোট বিজয়ী বিএনপির প্রার্থী আকবর হোসেনের চেয়ে বেশি ছিল।

সেই নির্বাচনে ধানের শীষ নিয়ে আকবর জেতেন ৬৫ হাজার ৪৪৭ ভোট পেয়ে। নৌকার প্রার্থী এটিএম শামসুল হক পান ৩৪ হাজার ৩৯৯ ভোট।

বাহার সেই নির্বাচনে মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে পান ৩১ হাজার ৪৯০ ভোট। আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের ভোট বিএনপির প্রার্থীর চেয়ে বেশি ছিল।

২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নবম সংসদ নির্বাচনে জিতে ১৯৭৩ সালের পর প্রথমবারের মতো আসনটি পায় আওয়ামী লীগ। সেই নির্বাচনের বাহারকে মনোনয়ন দিয়ে আফজলকে নির্দেশ দেওয়া হয় একসঙ্গে কাজ করতে। তার ফলও মেলে। ২৪ হাজার ভোটে জয় পায় নৌকা।

তবে সেই ঐক্য বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ২০১২ সালে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনে এসেই প্রকাশ্যে আসে পুরোনো দ্বন্দ্ব আর বিরোধ।