Published : 04 Jan 2024, 09:52 PM
ঢাকায় জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেওয়া একমাত্র আসনে আওয়ামী লীগের কোনো পক্ষের সমর্থন না পেয়ে বেকায়দায় লাঙ্গলের প্রার্থী শেরীফা কাদের, যিনি দলটির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের স্ত্রী।
উত্তরা, তুরাগ, উত্তরখান, দক্ষিণখান, বিমানবন্দর ও খিলক্ষেত এলাকায় বিস্তৃত এই আসনটিতে জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক শক্তি সীমিত, অতীতে এককভাবে ভোটে অংশ নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাতেও আসতে পারেননি দলের কোনো প্রার্থী।
আওয়ামী লীগ তার প্রার্থী ও বর্তমান সংসদ সদস্য মোহাম্মদ হাবিব হাসানকে বসিয়ে দিয়ে শেরীফাকে সমর্থন দেয়। তবে নৌকার প্রার্থী সরে গেলেও লাঙ্গলের প্রার্থী সুখকর অবস্থানে ছিলেন না কখনো।
কেটলি প্রতীক নিয়ে এখানে ভোটের মাঠে আছেন ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক মো. খসরু চৌধুরী ও ট্রাক প্রতীকে মাঠে আছেন দলের এই কমিটির মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক প্রার্থী এস এম তোফাজ্জল হোসেন।
আওয়ামী লীগের একাংশ খসরুর পেছনে, বাকিরা তোফাজ্জলের পেছনে। সংসদ সদস্য হাবিব হাসানের সমর্থনও পাচ্ছেন তিনি।
ভোটের চিত্র কেমন দেখছেন, এই প্রশ্নে উত্তরার ৪ নম্বর সেক্টরের বাসিন্দা রাজিবুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখন পর্যন্ত ভোটের মাঠে এগিয়ে আছেন কেটলি ও ট্রাক মার্কার প্রার্থী। এই দুই প্রার্থীর মধ্যেই মূলত হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। দুজনের একজন সামান্য ভোটের ব্যবধানে জয়ী হবেন। আর লাঙ্গলের লোকজনকে তেমন দেখা যায় না।”
জাতীয় পার্টির এক নেতা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে বলেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ আসন শেরীফা কাদেরকে উপহার দিয়েছেন। ভোটের মাঠ অংশগ্রহণমূলক ও সরগরম রাখতেই স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। আমরা এটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করছি না।”
বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এবার আসন ভাগাভাগি নিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাতীয় পার্টির আলোচনা দীর্ঘায়িত হয়েছে শেরীফা কাদেরকে ঘিরেই। ক্ষমতাসীন দল ঢাকায় লাঙ্গলকে কোনো আসনে ছাড় দিতে রাজি ছিল না। কিন্তু একটি আসন না পেয়ে জাতীয় পার্টি ভোটে থাকার চূড়ান্ত ঘোষণা দিতে রাজি ছিল না।
পরে ঢাকা-১৮ শেরীফা কাদেরকে ছাড়তে রাজি হওয়ার পর জাতীয় পার্টি ভোটে থাকার চূড়ান্ত ঘোষণা দেয়। তবে দলটির একটি চাওয়া পূর্ণ হয়নি। তারা চেয়েছিল, জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেওয়া আসনে আওয়ামী লীগের কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে থাকবে না। তবে আওয়ামী লীগ রাজি হয়নি এতে।
ভোটের অংকে কোথায় দাঁড়িয়ে জাতীয় পার্টি
১৪টি ওয়ার্ডের ২১৭টি কেন্দ্রে ৫ লাখ ৮৮ হাজার ৬০৮জন ভোটার রয়েছেন আসনটিতে।
১৯৯৬ ও ২০০১ সালে আসনটি যখন গুলশান বাড্ডা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল (তখনকার ঢাকা-৫), সে সময় জাতীয় পার্টি এককভাবে লড়াই করে। এর মধ্যে ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের সপ্তম সংসদ নির্বাচনে বর্তমানের বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গাজী গোলাম দস্তগীর লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে পান ২৪ হাজার ৫৫৭ ভোট।
ওই নির্বাচনে জয় পাওয়া আওয়ামী লীগের এ কে এম রহমত উল্লাহ ভোট পান ১ লাখ ৩২ হাজারের বেশি। বিএনপির কামরুল ইসলামের পক্ষে পড়ে ১ লাখ ৯ হাজারের কিছু বেশি।
২০০১ সালের অষ্টম সংসদ নির্বাচনে লাঙ্গল নিয়ে ভোটে লড়েন মো. আলফাজ উদ্দিন, পান ১১ হাজার ৫৫৮ ভোট।
এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নৌকায় পড়ে ১ লাখ ৬৬ হাজারের বেশি। ২ লাখ ১১ হাজারের কিছু বেশি পেয়ে জয় পান ধানের শীষের কামরুল ইসলাম।
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাতীয় পার্টি জোট করে ভোটে অংশ নেয়। সীমানা পুনর্বিন্যাসের পর আসনটি হয় ঢাকা-১৮, সেটির আয়তন কমে যায়। জেতেন আওয়ামী লীগের সাহারা খাতুন। তিনি ভোট পান ২ লাখ ১৩ হাজারের বেশি। বিএনপির আজিজুল বারী হেলালের পক্ষে রায় দেন ১ লাখ ১৬ হাজারের কিছু বেশি।
টানা তিনবার জয় পাওয়া সাহারা ২০২০ সালের ৯ জুলাই মারা গেলে ওই বছরের ১২ নভেম্বরের উপ-নির্বাচনে জেতেন আওয়ামী লীগের হাবিব হাসান।
মনোনয়ন পেয়েও বসে যেতে বাধ্য হওয়া হাবিব হাসান নির্বাচন থেকে দূরে নন। তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী তোফাজ্জল হোসেনকে জেতাতে সক্রিয়। অন্যদিকে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের বেশিরভাগই নেতা নেমেছেন খসরু চৌধুরীর পক্ষে। মূলত এই দুই স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের কারণেই জমে উঠেছে ভোটের মাঠ।
আওয়ামী লীগের কোন নেতার পাশে কে
ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান মতি, উত্তর খান থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. কামাল উদ্দিন ও সাধারণ সম্পাদক আতিকুর রহমান মিলন, দক্ষিণ খান থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ কে এম মাসুদুজ্জামান মিঠু, তুরাগ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি নাসির উদ্দিন, খিলক্ষেত থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি কেরামত আলী দেওয়ান কেটলি প্রতীকে খসরু চৌধুরীকে জেতাতে সক্রিয়।
১ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আফসার উদ্দিন খান, ৪৭ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোতালেব মিয়া, ৪৯ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর, ৫১ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. শরিফুর রহমান, ৫৩ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নাসির উদ্দিন, ৫৪ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর যুবরাজ খান, সাবেক কাউন্সিলর বুলবুল দেওয়ান, ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক আনিসুর রহমান নাইমও আছেন তাদের সঙ্গে।
জাতীয় পার্টিকে ছাড় দেওয়া আসনে লাঙ্গলের পক্ষে না থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থীর পাশে কেন- এই প্রশ্নে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান মতি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আসনটি জাতীয় পার্টির লাঙ্গলকে ছাড় দিয়ে নৌকার প্রার্থী বসিয়ে দেওয়া হয়েছে ঠিক। কিন্তু আওয়ামী লীগ তো শুধু নৌকা প্রত্যাহার করেছে, কেন্দ্রীয়ভাবে আর তো কোনো নির্দেশনা নেই। তাছাড়া জাতীয় পার্টির প্রার্থী আমাদের ডাকেনওনি, কথাও বলেননি।
“তাছাড়া নির্বাচনকে উৎসমুখর করতে নৌকার পাশাপাশি স্বতন্ত্র প্রার্থীও রেখেছে আওয়ামী লীগ। সে ক্ষেত্রে আমি খসরু চৌধুরীকে সমর্থন দিয়েছি। আমি ছাড়াও দলের অনেক নেতাকর্মী কেটলির নির্বাচন করছে। আমরা শতভাগ আশাবাদী।”
৫২ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি সোহেল মিয়া বলেন, “সবার আগে ভোটের মাঠ নিজেদের দখলে নিয়েছেন খসরু চৌধুরী। দক্ষিণখান ও উত্তরখান এলাকায় উনার ব্যবসা, ফসলি জমি ও বাসাবাড়ি। এখানে উনি এগিয়ে আছেন।”
খসরু চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আওয়ামী লীগের নগর ও স্থানীয় নেতারা আমার সঙ্গে আছেন, সব সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাকর্মীরাও আছেন। সুতরাং নৌকা ছাড়াই আমি আওয়ামী লীগের প্রার্থী।”
ট্রাক প্রতীকের এস এম তোফাজ্জল হোসেনের পক্ষে সংসদ সদস্য হাবিব হাসান ছাড়াও আছেন উত্তরা পশ্চিম থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহিদ আহমেদ সিদ্দিকি, উত্তরা পূর্ব থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মতিউল হক মতি, ভাটার থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ১৭ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ইশহাক মিয়া, খিলক্ষেত থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসলাম মিয়া, ৪৪ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শফিক ইসলাম শফিক, উত্তরখান থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ৪৫ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জয়নাল আবেদিন, ৫০ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ডিএম শামীম ৫২ নং ওয়ার্ডে কাউন্সিলর ফরিদ উদ্দিন।
তোফাজ্জলের পক্ষে নামার কারণ জানতে চাইলে সংসদ সদস্য হাবিব হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা তোফাজ্জল হোসেনের পাশে পাশি। তিনি দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতি করে আসছেন। দক্ষিণখান আদর্শ ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান হিসেবে এলাকায় জনপ্রিয়তার প্রমাণও রেখেছেন। আশা করি উনি জয় পাবেন।”
ট্রাক মার্কার পক্ষে প্রচারে থাকা কর্মী মো. সামসুল ইসলাম বলেন, “তোফাজ্জল ভাই স্থানীয় মানুষ। সুখে দুঃখে তাকে পাওয়া যায়। ভোটাররা তাকেই ভোট দেবেন।”
তোফাজ্জল হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সংসদ সদস্য তো আছেনই, আমার সঙ্গে আওয়ামী লীগের এবং বেশ কয়েকজন নির্বাচিত কাউন্সিলরও আছেন। সুতরাং আমি আশা করছি বিপুল ভোটে জয় পাব।”
মানুষ লাঙ্গলকেই বেছে নেবে, আশা শেরীফার
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কাউকে পাশে না পেয়ে জাতীয় পার্টি গুটিকয় নেতাকর্মীকে নিয়ে চলছে লাঙ্গলের প্রচার।
আওয়ামী লীগকে পাশে না পেলেও শতভাগ ব্যাপারে আশাবাদী শেরীফা কাদের বলেন, “লাঙ্গল হচ্ছে মঙ্গলের প্রতীক, লাঙ্গল হচ্ছে উন্নয়ন ও অগ্রগতির প্রতীক। ভোটারদের কাছে লাঙ্গল হচ্ছে আস্থার প্রতীক। আমরা সাধারণ মানুষের আস্থা সমুন্নত রাখতেই রাজনীতি করছি।”
স্বতন্ত্রী প্রার্থী থাকায় কোনো সমস্যা মনে করছেন কি না- এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “সাধারণ ভোটাররা ভোট দিতে পারলে লাঙ্গল জয়ী হবে। এর বাইরে আর কোনো চিন্তা করছি না।”
শেরীফা বলেন, “আমি নির্বাচিত হলে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে একত্রে কাজ করব। আমি যদি জিততে নাও পারি, তাহলেও আমাকে ডাকলে কাজ করব। আমি চাই ঢাকা-১৮ আসনে ব্যাপক উন্নয়ন।”
অন্য সাত প্রার্থীর পরিচিতিই নেই
এই নির্বাচনে আরও সাত জন প্রার্থী আছেন। তবে হাত ঘড়ি নিয়ে বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির দয়াল কুমার বড়ুয়া, টেলিভিশন নিয়ে বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট-বিএনএফ এর এস এম আবুল কালাম আজাদ, ছড়ি নিয়ে বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তি জোটের ফাহমিদা হক সুকন্যা, সোনালী আঁশ নিয়ে তৃণমূল বিএনপির মোহাম্মদ মফিজুর রহমান, আম প্রতীকে ন্যাশনাল পিপলস পার্টির মো. জাকির হোসেন ভূইঁয়া, মোড়া প্রতীকে স্বতন্ত্র মো. নাজিম উদ্দিন এবং ঈগল প্রতীকে আরেক স্বতন্ত্র মো. বশির উদ্দিনের পক্ষে তেমন প্রচার নেই। ভোটারদের মধ্যে তাদের পরিচিতিও নেই সেভাবে।