“আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে একটা সুস্পষ্ট কথা শুনতে চাই যে তারা একটা নিরপেক্ষ নির্বাচন দেবেন কি না”, বলেন সিপিবি সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স।
Published : 12 Oct 2024, 10:04 PM
সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য মন্ত্রণালয়ের ওপর নির্বাচন কমিশনের ‘খবরদারির ক্ষমতা’ দেওয়ার সুপারিশ করেছেন বক্তব্যে বস্ত্র ও পাট এবং নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন। নির্বাচন কমিশনে নিয়োগে সরকারের যেন হস্তক্ষেপ না থাকে, সেটিও নিশ্চিত করতে বলেছেন তিনি।
শনিবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কেমন চাই’ বিষয়ে এক সেমিনারে তিনি এ কথা বলেন।
সাখাওয়াত নিজেও এক সময় নির্বাচন কমিশনে ছিলেন। সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ থেকে চার বছরের জন্য নিয়োগ পান তিনি। সেই কমিশনের অধীনেই ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনে ভূমিধস জয় পায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট।
রিপোর্টার্স ফোরাম ফর ইলেকশন অ্যান্ড ডেমোক্রেসি (আরএফইডি) আয়োজিত এই সেমিনারে সাখাওয়াত বলেন, “নির্বাচনের সময় মন্ত্রণালয়গুলোর ওপর ‘খবরদারির ক্ষমতা’ ইসিকে দিতে হবে।
“নির্বাচন কমিশন যাদেরকে নিয়োগ দেয়, তাদের ক্ষেত্রে ইসি যে রিপোর্ট দেয় সেটিই যেন চূড়ান্ত হয়। এটির জবাবদিহিতা নিশ্চিতে কাজ করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকার যেন হস্তক্ষেপ না করে।”
নির্বাচন কমিশনার নিয়োগই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলেও মন্তব্য করেন তিনি। বলেন, “একটা প্রস্তাব রয়েছে.. তিন ধাপে, প্রথম ধাপ প্রিলিমিনারি সিলেকশন, সেকেন্ড ধাপ সেকেন্ড সিলেকশন, থার্ড ধাপে পার্লামেন্টে যারা আছেন সরকারি দল এবং বেসরকারি দল। তাদের কমিটির মাধ্যমে ফাইনাল সিলেকশন হবে।
“দুইজনের নাম রাষ্ট্রপতির কাছে যাবে এবং সেখান থেকে একজন ফাইনাল সিলেকশন হবে। এখানে প্রধানমন্ত্রীর কোনো হস্তক্ষেপ হচ্ছে না।
“প্রধানমন্ত্রীও থাকছেন সেখানে, বিরোধী দলীয় নেতারাও থাকছেন। তাই এখানে সমান সমান অনুপাতে সেখানে রিপ্রেজেন্টেশন হবে, সেখানে আলোচনা হবে। সেই আলোচনার মাধ্যমেই সিলেকশন হবে।”
প্রাথমিক আলোচনায় যে নামগুলো আসবে, সে নামগুলো সবাই জানতে পারবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আপনারাই আলোচনা করতে পারবেন যে, ‘উনাকে দিয়ে’ হবে কি হবে না।
“এখন যেমন কারও নাম উঠলেই তার আদ্যোপান্ত খুঁজে বের করে, …তো সেগুলো তখন পরিষ্কার হবে।”
কমপক্ষে তিন বছর কোনো দলের সদস্য না থাকলে সেই দলের প্রার্থী হতে না পারার বিধান করার তাগিদও দেন সাবেক এই নির্বাচন কমিশনার।
তিনি বলেন, “ব্যবসায়ীরা টাকা নিয়ে চলে আসে। যে ১০ কোটি টাকা দিয়ে নমিনেশন কিনল, সে আরও ২০ কোটি টাকা খরচ করবে যাতে ইলেকশনে উনি জিততে পারেন।
“পলিটিশিয়ানরা নির্বাচনের ধারে কাছে নেই, যারা বড় বড় বিজনেসম্যান তারা নমিনেশন ‘কিনে’ চলে আসছে। যারা পলিটিক্স করে, তাদের জন্য নমিনেশন হয় না।”
দলগুলোকে তৃণমূল থেকে প্রার্থী বাছাইয়ের পরামর্শও দেন সাখাওয়াত।
নির্বাচনকালীন ‘নিরপেক্ষ’ সরকার দরকার
সেমিনারের প্রধান আলোচক নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বলেন, “নির্বাচন একটা প্রক্রিয়া, এই প্রক্রিয়াটা সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হতে হবে। আমরা যদি ওই একদিনই নির্দিষ্ট থাকি তাহলে নির্বাচন অনেকভাবে বিতর্কিত ও অগ্রহণযোগ্য হতে পারে। তাই পুরো প্রক্রিয়াটা নির্বাচন কমিশনের পর্যবেক্ষণ করা দরকার।”
নির্বাচনকালীন ‘নিরপেক্ষ’ সরকারের গুরুত্ব উল্লেখ করে তিনি বলেন, “যে নির্বাচন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কার্যকর করে না, সেটা সংবিধানের লঙ্ঘন। সরকার, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সহায়তা না করলে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।”
রাজনৈতিক দলগুলো সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করলে নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি। বলেন, গণমাধ্যম, নাগরিক সমাজসহ আরও অংশীজনদেরও সঠিক ভূমিকা পালন করতে হবে।
রাজনৈতিক নেতারা যা বলছেন
সেমিনারে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সদস্যরাও বক্তব্য রাখেন।
বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, “পরপর দুইবার প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি হতে পারবেন না এটা বিএনপিরই প্রস্তাব।”
কোনো আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার মতো পরিস্থিতি তৈরি হলে সেখানে পুনরায় নির্বাচন করার প্রস্তাব নেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান রিপন।
জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, “নির্বাচন কার্যক্রম সংস্কার করাই এই সরকারের মূল দায়িত্ব। বাকিগুলোও চাইলে করতে পারে। কিন্তু নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার না করতে পারলে এই সরকারকে সফল বলা যায় না।”
সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, “আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে একটা সুস্পষ্ট কথা শুনতে চাই যে তারা একটা নিরপেক্ষ নির্বাচন দেবেন কি না। আপনারা একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যেটুকু কাজ করার দরকার সেটুকু করেন। আর বাকি সংস্কারের প্রস্তাবনা নির্বাচিত সরকারের জন্য রেখে দেন।”
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, “সংস্কারটা এমনভাবে করতে হবে, যাতে কেউ চাইলেই নির্বাচনে প্রভাব না খাটাতে পারে। আর নির্বাচনকালীন একটা অন্তর্বর্তী সরকার অবশ্যই প্রয়োজন।”
নির্বাচনে ‘টাকার খেলা’ কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় সেটা নির্বাচন কমিশনের দেখতে হবে উল্লেখ করে এবি পার্টির সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, “নির্বাচনে মনোনয়ন বাছাইয়ের ক্ষেত্রে যে টাকার খেলা হয়, তা ঠেকাতে হবে। আর রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের ক্ষেত্রটাও আরও সহজ করা দরকার।”
জামায়াতে ইসলামীর কর্মপরিষদ সদস্য শফিকুল ইসলাম মাসুদ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহারের বিরোধিতা করেন। পাশাপাশি জাতীয় সংসদ নির্বাচন একাধিক দিনে করার প্রস্তাব দেন।
গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নূরুল হক নূর বলেন, “প্রশাসনসহ সরকারে বিএনপি-জামাতের আধিপত্য কায়েম করা চলবে না। নিরপেক্ষ প্রশাসন ও নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
“প্রশাসন ও বিভিন্ন সেক্টরে যদি কোনো স্পেসিফিক রাজনৈতিক দলের আধিপত্য থাকে আপনি আগামীতে কীভাবে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কায়েম করবেন?”
আওয়ামী লীগ নেতা সাবের হোসেন চৌধুরীকে ‘বিদেশি চাপে’ মুক্তি দেওয়া হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, “একটা নতুন সরকার দুই মাসের মাথায় বিদেশি শক্তির কাছে মাথা নত করল। কোনো বিদেশি সংস্থা বা অন্য কোনো দেশের স্বার্থে যদি আপনারা কাজ করেন তাহলে আপনারাও অপমানিত হবেন।”
সেমিনারের সভাপতিত্ব করেন আয়োজন সংগঠন আরএফইডির সভাপতি একরামুল হক সায়েম, সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক মো. হুমায়ুন কবীর।