দুদকের অনুসন্ধান দল এ ‘অপরাধের’ সঙ্গে ইস্টার্ন হাউজিংয়ের প্রয়াত চেয়ারম্যান জহুরুল ইসলামের এবং সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী প্রয়াত মোহাম্মদ নাসিমের ভাই প্রয়াত মো. সেলিমের ‘সংশ্লিষ্টতার প্রাথমিক প্রমাণ’ পায়।
Published : 15 Apr 2025, 11:33 PM
ঢাকার গুলশানের একটি প্লট ‘অবৈধভাবে হস্তান্তরের ব্যবস্থা’ করিয়ে দিয়ে ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেডের কাছ থেকে ‘ঘুষ’ হিসেবে একটি ফ্ল্যাট নেওয়ার অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার ভাগ্নি ও যুক্তরাজ্যের এমপি টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক।
মঙ্গলবার দুদকের ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে টিউলিপ সিদ্দিকসহ রাজউকের দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এ মামলা দায়ের করেন সংস্থার সহকারী পরিচালক মনিরুল ইসলাম।
আসামিদের বিরুদ্ধে পরস্পরের ‘যোগসাজশে’ এবং ‘ক্ষমতার অপব্যবহার’ করে ‘অবৈধ সুবিধা’ নেওয়ার অভিযোগে এ মামলা হওয়ার তথ্য দিয়েছেন দুদকের মহাপরিচালক আক্তার হোসেন।
অভিযোগের অনুসন্ধানে দুদকের দল এই তিনজন ছাড়াও এ ‘অনিয়মের’ সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী প্রয়াত মোহাম্মদ নাসিমের ভাই রাজউকের আইন উপদেষ্টা মো. সেলিম এবং ইস্টার্ন হাউজিংয়ের চেয়ারম্যান জহুরুল ইসলামের জড়িত থাকার প্রাথমিক প্রমাণ পায়।
তবে তারা মারা যাওয়ায় তাদেরকে মামলার আসামি করার সুযোগ নেই বলে এজাহারে বলা হয়েছে।
ঢাকা ও যুক্তরাজ্যে ফ্ল্যাট ও প্লটে ‘অনিয়ম’ এবং প্রকল্পে ‘দুর্নীতির’ অভিযোগের খাতায় নাম আসা টিউলিপের বিরুদ্ধে ঢাকার গুলশান ২ নম্বরের এ ফ্ল্যাটের অভিযোগের অনুসন্ধানের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলেন, ওই প্লটের হস্তান্তর প্রক্রিয়া শুরু হয় ১৯৯৭ সালে শেখ হাসিনার প্রথম মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর থেকে।
নতুন এ মামলার বিষয়ে দুদকের মহাপরিচালক আক্তার বলেন, “এজাহারে একে অপরের সঙ্গে যোগসাজশ করে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র, দুর্নীতি, দায়িত্বে অসদাচরণ ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে কোনও অর্থ প্রদান না করেই ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেড থেকে অবৈধ সুবিধা নিয়ে গুলশানের একটি ফ্ল্যাট দখল এবং পরে রেজিস্ট্রির মাধ্যমে মালিকানা গ্রহণ করেন টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিক।”
তাকে এ কাজে সহযোগিতা করায় রাজউকের সাবেক সহকারী আইন উপদেষ্টা শাহ মো. খসরুজ্জামান ও সরদার মোশারফ হোসেনকে মামলার আসামি করার কথা বলেন তিনি।
এর আগে পূর্বাচলে প্লট দুর্নীতির এক মামলায় টিউলিপকে আসামি করেছে দুদক। ওই মামলায় তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করেছে আদালত।
টিউলিপের আইনজীবী অবশ্য দাবি করেছেন, এই ব্রিটিশ এমপির বিরুদ্ধে দুদকের আনা অভিযোগ ‘সম্পূর্ণ মিথ্যা’।
এ বিষয়ে টিউলিপ সিদ্দিক সোমবার যুক্তরাজ্যে সাংবাদিকদের বলেন, “আমি ভুল কিছু করেছি, এমন কোনো প্রমাণ নেই।”
স্কাই নিউজ জানিয়েছে, সোমবার লন্ডনে নিজের বাড়ির বাইরে এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত শাসক শেখ হাসিনার ভাগ্নি টিউলিপ। তিনি বলেন, তিনি “রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচারের শিকার।”
সোমবার সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে টিউলিপ বলেন, বাংলাদেশের কোনো কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত তার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি এবং তাকে ‘মিডিয়া ট্রায়ালের’ শিকার হতে হচ্ছে।
লেবার এমপি টিউলিপ বলেন, “এই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচার নিয়ে মন্তব্য করে আমি এগুলোকে গুরুত্ব দিতে চাই না। তারা আমাকে হয়রানি করার চেষ্টা করছে।”
‘অবৈধ সুবিধায়’ নেওয়া ফ্ল্যাটের এজাহারে যা আছে
দুদকের মহাপরিচালক আক্তার বলেন, “তাদের (টিউলিপ ও রাজউকের দুই কর্মকর্তা) বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ১২০(বি), ৪০৯, ১৬১–১৬৫(ক), ১০৯ ধারাসহ দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭-এর ৫(২) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।”
সাত পৃষ্ঠার এজাহারে বলা হয়েছে, ১৯৬৩ সালে তৎকালীন বিচারপতি ইমাম হোসেন চৌধুরী গুলশানে ১ বিঘা ১৯ কাঠা ১৩ ছটাক আয়তনের একটি প্লট বরাদ্দ পান। সরকারি ইজারা চুক্তি অনুযায়ী, ৯৯ বছরের মধ্যে ওই প্লট হস্তান্তর বা ভাগ করে বিক্রি নিষিদ্ধ ছিল। তবে ১৯৭৩ সালে তিনি মো. মজিবুর রহমান ভূঁইয়াকে আমমোক্তার মাধ্যমে প্লটটি হস্তান্তর করেন। এরপর প্লটটি ভাগ হয়ে বিক্রি হয় এবং ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেডের চেয়ারম্যান জহুরুল ইসলামের মাধ্যমে ভবন নির্মাণ শুরু হয়।
মামলায় অভিযোগ করা হয়, ”জহুরুল ইসলামের মৃত্যুর পর তার সন্তানদের মধ্যে বিরোধ শুরু হলে মামলা হয়। মামলার চলমান অবস্থায় এবং হস্তান্তর নিষিদ্ধ থাকা অবস্থায় রাজউকের সংশ্লিষ্ট আইন উপদেষ্টারা ইস্টার্ন হাউজিংকে ফ্ল্যাট হস্তান্তরের অনুমোদন দেন-যা অবৈধ ছিল। কারণ কোম্পানিটি লিজ হোল্ডার বা বৈধ প্রতিনিধি ছিল না।“
এজাহারের বিবরণে বলা হয়, রাজউকের রেকর্ড অনুযায়ী, ৯৯ বছরের ইজারার শর্তে নির্ধারিত সময়সীমা শেষ হওয়ার আগে প্লট হস্তান্তর করার সুযোগ নেই। তবুও ইস্টার্ন হাউজিংকে আমমোক্তার করে ওই প্লট ভাগ করে ৩৬টি ফ্ল্যাট নির্মাণ ও হস্তান্তরের অনুমোদন দেওয়া হয়।
এজহারে অভিযোগ করা হয়, এই প্রক্রিয়ায় ইজারার শর্ত ভঙ্গ করে ‘অবৈধভাবে’ হস্তান্তরের ব্যবস্থা করা হয় এবং এর বিনিময়ে টিউলিপ সিদ্দিকী ’অবৈধ পারিতোষিক’ হিসেবে ইস্টার্ন হাউজিং থেকে ’বিনামূল্যে একটি ফ্ল্যাট গ্রহণ’ করেন।
”ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেড কর্তৃক প্রদত্ত এক চিঠিতে উল্লেখ রয়েছে, টিউলিপ বিনামূল্যে ফ্ল্যাট গ্রহণ করেছেন। রাজউকে প্রেরিত ফ্ল্যাট মালিকদের তালিকায় তার নাম অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।”
এজাহারে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে ২০০১ সালের ১৯ মে থেকে টিউলিপ ফ্ল্যাটের দখলে রয়েছেন বলে ইস্টার্ন হাউজিং সিটি কর্পোরেশনে একটি চিঠিতে জানিয়েছে। তিনি ওই তারিখ থেকে হোল্ডিং ট্যাক্সও দিয়ে আসছেন।
মামলার এজাহারে ঘটনার সময়কাল ১১ জুলাই ১৯৬৩ থেকে ৩০ অক্টোবর ২০০২ পর্যন্ত উল্লেখ করা হয়েছে।
দুদকের অনুসন্ধান দলের তথ্য তুলে ধরে এজাহারে অভিযোগ করা হয়, “সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতার শেষ লগ্নে (ক্ষমতা হস্তান্তরের তারিখ ১৫/০৭/২০০১) তড়িঘড়ি করে তার নিয়োগকৃত নিজ দলীয় লোক (আওয়ামী লীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোঃ নাসিমের বড় ভাই ডঃ মোঃ সেলিম) এবং শাহ্ খসরুজ্জামানকে দিয়ে অসৎ উদ্দেশ্যে অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে ইষ্টার্ণ হাউজিং এর নামে লিগ্যাল পার্সন হিসেবে আম-মোক্তার অনুমোদন করিয়ে ইর্স্টান হাউজিং এর প্রস্তাবিত তালিকাভুক্ত ব্যক্তিদের নামে ফ্ল্যাট হস্তান্তরের অনুমোদন করিয়ে নেয়া হয়।
“যার মধ্যে অবৈধভাবে লাভবান হওয়া টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিক এর নাম প্লট নং ১১বি এর ৫নং ক্রমিকে অন্তর্ভূক্ত ছিল এবং রিজওয়ানা সিদ্দিক ওরফে টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিক বিগত ১৯/০৫/২০০১ খ্রি. তারিখ থেকে অবৈধ সুবিধা করিয়ে দেয়ার নিমিত্তে বিনামূল্যে উক্ত ফ্ল্যাটটি দখলে রাখেন।
”এসময় টিউলিপ সিদ্দিকীর আপন খালা শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন ছিলেন এবং সেই সুযোগে অবৈধভাবে প্রভাব বিস্তার করে কাজে লাগিয়েছেন।”
এজাহারে ‘অবৈধভাবে প্রভাবিত’ করে ইস্টার্ন হাউজিংকে আমমোক্তার অনুমোদনপূর্বক ও ফ্ল্যাট বিক্রয়ের অনুমোদন করিয়ে ’অবৈধ সুবিধা দিয়ে ও নিজে অবৈধ সুবিধা নিয়ে বিনামূল্যে একটি ফ্ল্যাট গ্রহণ করার’ এ কাজে পাঁচজন ’শাস্তিযোগ্য অপরাধ’ করেছেন বলে তুলে ধরা হয়।
আসামি তিনজন ছাড়া বাকি দুইজন হলেন ইস্টার্ন হাউজিংয়ের চেয়ারম্যান জহুরুল ইসলাম ও রাজউকের সাবেক আইন উপদেষ্টা মোঃ সেলিম (তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাসিমের ভাই)। এ দুজন মারা যাওয়ায় তাদের আসামি করা হয়নি।
এ বিষয়ে ইস্টার্ন হাউজিংয়ের বক্তব্য জানার চেষ্টা করছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।
আরও পড়ুন
'ঘুষ হিসেবে' গুলশানে ফ্ল্যাট নেওয়ার মামলা হচ্ছে টিউলিপের বিরুদ্ধে
'ঘুষ হিসেবে' গুলশানে ফ্ল্যাট নেওয়ার মামলা হচ্ছে টিউলিপের বিরুদ্ধে
দুদকের অভিযোগ 'সম্পূর্ণ মিথ্যা': পরোয়ানা জারির খবরে টিউলিপের আইনজীবী
প্লট দুর্নীতি: হাসিনা, রেহানা, ববির সঙ্গে ব্রিটিশ এমপি টিউলিপকে গ্রেপ্তারেও পরোয়ানা
দালিলিক প্রমাণের ভিত্তিতেই টিউলিপ 'দুর্নীতির' আসামি: দুদক চেয়ারম্যান
ঢাকার ফ্ল্যাট নিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টকে ‘বিভ্রান্ত’ করার অভিযোগ টিউলিপের বিরুদ্ধে
বাংলাদেশ সরকার 'হয়রানিমূলক' প্রচারণা চালাচ্ছে, অভিযোগ টিউলিপের