এ মামলায় টিউলিপ ছাড়াও রাজউকের সাবেক সহকারী আইন উপদেষ্টা শাহ মো. খসরুজ্জামান এবং সরদার মোশারফ হোসেনকে আসামি করা হচ্ছে।
Published : 15 Apr 2025, 05:31 PM
ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঢাকার গুলশানের একটি প্লট ‘অবৈধভাবে হস্তান্তরের ব্যবস্থা’ করিয়ে দিয়ে ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেডের কাছ থেকে ‘ঘুষ’ হিসেবে একটি ফ্ল্যাট নেওয়ার অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগ্নি ও যুক্তরাজ্যের এমপি টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে মামলা করতে যাচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
দুদকের মহাপরিচালক আক্তার হোসেন মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেছেন, “সংস্থার ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে সহকারী পরিচালক মনিরুল ইসলাম বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করবেন। মামলার প্রক্রিয়া বর্তমানে চলমান।”
এ মামলায় টিউলিপ ছাড়াও রাজউকের সাবেক সহকারী আইন উপদেষ্টা শাহ মো. খসরুজ্জামান এবং সরদার মোশারফ হোসেনকে আসামি করা হচ্ছে।
দুদক বলছে, তারা ‘একে অপরের সঙ্গে যোগসাজশ করে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র, দুর্নীতি, দায়িত্বে অসদাচরণ ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে’ কোনো টাকা না দিয়েই ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেডের কাছ থেকে ‘অবৈধ পারিতোষিক’ হিসেবে ফ্ল্যাট দখল ও পরে রেজিস্ট্রির মাধ্যমে মালিকানা নিতে টিউলিপকে সহযোগিতা করেছেন।
এ মামলায় তিনজনের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ১২০(বি), ৪০৯, ১৬১–১৬৫(ক), ১০৯ ধারা এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭-এর ৫(২) ধারায় অভিযোগ আনা হচ্ছে।
এর আগে পূর্বাচলে প্লট দুর্নীতির এক মামলায় টিউলিপকে আসামি করেছে দুদক। ওই মামলায় তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করেছে আদালত।
টিউলিপের আইনজীবী অবশ্য দাবি করেছেন, এই ব্রিটিশ এমপির বিরুদ্ধে দুদকের আনা অভিযোগ ‘সম্পূর্ণ মিথ্যা’।
কী অভিযোগ মামলায়?
দুদকের নথিতে বলা হয়েছে, ১৯৬৩ সালে তৎকালীন বিচারপতি ইমাম হোসেন চৌধুরী গুলশানে ১ বিঘা ১৯ কাঠা ১৩ ছটাক আয়তনের একটি প্লট (বর্তমান ১১এ ও ১১বি) বরাদ্দ পান। সরকারি লিজ চুক্তি অনুযায়ী, ৯৯ বছরের মধ্যে ওই প্লট হস্তান্তর বা ভাগ করে বিক্রি নিষিদ্ধ ছিল।
কিন্তু ১৯৭৩ সালে তিনি মো. মজিবুর রহমান ভূঁইয়াকে আমমোক্তার করে প্লটটি হস্তান্তর করেন। মজিবুর রহমান ভূঁইয়া এরপর প্লটটি ভাগ করে স্ত্রী শামসুন নাহার এবং শ্যালিকা জেরিন বেগমের কাছে বিক্রি করেন।
শামসুন নাহার পরে ৫০ লাখ টাকায় ওই প্লট বিক্রি করেন ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেডের চেয়ারম্যান জহুরুল ইসলামের দুই মেয়ে নাইমা ইসলাম ও কনিতা ইসলামের কাছে। তারা দুই বোন পরে ওই জমিতে ভবন নির্মাণের জন্য তাদের বাবা জহুরুল ইসলামকে ব্যক্তি হিসেবে আমমোক্তারনামা (পাওয়ার অব অ্যাটর্নি) দেন।
জহুরুল ইসলাম রাজউকের মাধ্যমে প্লটটি দুই ভাগে বিভক্ত করে ছয় তলা ভবন নির্মাণ শুরু করেন। কাজ চলার মধ্যেই তিনি মারা যান। পরে দুই বোন তাদের ভাই মঞ্জুরুল ইসলামকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দেন। কিন্তু পারিবারিক দ্বন্দ্বের কারণে সেই আমমোক্তারনামা বাতিলও করেন।
মঞ্জুরুল ইসলাম তখন আদালতে মামলা করেন। অন্যদিকে তার দুই বোনও তাদের স্বত্ত্ব ফিরে পাওয়ার জন্য আদালতে মামলা করেন। মামলা চলমান থাকা অবস্থায় দুই বোন ফ্ল্যাট হস্তান্তরের অনুমতি না দেয়ার জন্য রাজউকে আবেদন করেন।
দুদক বলছে, রাজউকের তৎকালীন আইন উপদেষ্টারা তখন দুই দফায় ‘অসত্য তথ্য’ দিয়ে ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেডকে ‘অবৈধভাবে’ ফ্ল্যাট হস্তান্তরের অনুমোদন দেন, যদিও ইস্টার্ন হাউজিং প্লটের মালিক না।
লিজ দলিলের শর্ত অনুযায়ী ৯৯ বছরের মধ্যে ওই প্লট হস্তান্তর করার কথা নয়। আংশিক বিভাজন করে হস্তান্তরেরও সুযোগ সেখানে নেই। সেখানে শর্ত না মেনে ‘ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে’ আমমোক্তার নিযুক্ত করা হয়েছে ও প্লটটি বিক্রি, বিভাজন ও হস্তান্তর করা হয়েছে বলে দুদকের ভাষ্য।
দুদক বলছে, ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেডের চেয়ারম্যানকে আমমোক্তার নিয়োগের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রাজউক দুই পক্ষকে ডাকলেও তারা হাজির হননি। ওই আমমোক্তারনামা অনুমোদনই হয়নি।
মামলার অভিযোগে বলা হচ্ছে, ওই প্লট ভেঙে দুই টুকরো করে তাতে ভবন তুলে ৩৬টি ফ্ল্যাট বিক্রি বা হস্তান্তর করা হয়। অথচ Individual Person থেকে Legal Person হিসেবে ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেডের মালিকানা স্থানান্তর দুদকের ভাষায় ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ ছিল।
আর এখানেই আসছে টিউলিপের নাম। দুদক বলছে, নিয়ম ভেঙে প্লটের বিভাজন এবং ৩৬টি ফ্ল্যাট হস্তান্তরের অনুমোদন করিয়ে দেবার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছেন টিউলিপ সিদ্দিকী। তার খালা শেখ হাসিনা তখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। ইস্টার্ন হাউজিংকে ওই ব্যবস্থা করিয়ে দেওয়ার বিনিময়ে ‘অবৈধ পারিতোষিক হিসাবে বিনে পয়সায়’ একটি ফ্ল্যাট নিয়েছেন।
‘অবৈধ সুবিধা নেওয়ার প্রমাণ’ হিসেবে ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেডের একটি চিঠির কথা বলছে দুদক, যেখানে ‘রিজওয়ানা সিদ্দিকী টিউলিপ’কে বিনামূল্যে একটি ফ্ল্যাট দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
ইস্টার্ন হাউজিং থেকে রাজউকে ফ্ল্যাট মালিকদের যে তালিকা পাঠানো হয়েছিল, তার ৫ নম্বরে টিউলিপের নাম ছিল। দুদক বলছে, টিউলিপ যে ‘অবৈধ প্রভাব খাটিয়েছেন’ ওই তালিকা তার প্রমাণ।
সিটি করপোরেশনে দেওয়া ইস্টার্ন হাউজিংয়ের এক চিঠির বরাতে দুদক বলছে, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালে ২০০১ সালের ১৯ মে থেকে ওই ফ্ল্যাটের দখল টিউলিপের কাছে রয়েছে এবং তিনি ওই সময় থেকে হোল্ডিং ট্যাক্স দিয়ে আসছেন।
দুদকের নথি বলছে, প্লটটির দাম সর্বসাকুল্যে ৪৫ লাখ ২৪ হাজার ৯২০ টাকা। গ্যারেজের মূল্য ৬ লাখ টাকা থেকে কোম্পানিকে মাত্র দুই লাখ টাকা পরিশোধ দেখানো হয়েছে। কিন্তু ওই দুই লাখ টাকা পরিশোধের কোনো রশিদও পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ, টিউলিপ ওই ফ্ল্যাট ‘বিনামূল্যে রেজিস্ট্রি দলিল’ করে নেন।
টিউলিপ সিদ্দিক ও রাজউকের দুই সাবেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়ার কথাও বলছে দুদক।