আমি এদিক সেদিক মাথা ঘুরিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম বিমানে আর কেউ বুঝতে পেরেছেন কিনা গোলাম আযম তাদের সাথে একই ফ্লাইটে ঢাকা যাচ্ছেন।
Published : 27 Dec 2022, 01:18 PM
গোলাম আযমের নাগরিকত্ব পাওয়া নিয়ে জামায়াতের সর্বস্তরে উৎসবের আমেজ থাকলেও তাকে আমির বানাবার বিষয়টি জামায়াতের একটি অংশকে মনঃক্ষুণ্ণ করে। তারা আব্বাস আলী খানকে আমির পদে রেখে দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন। কেননা পাকিস্তান আমলে, ১৯৬৯-৭১-এ দুই বছর আমির থাকা ছাড়া জামায়াত গঠনে গোলাম আযমের তেমন ভূমিকা নেই।
পাকিস্তান আমলে জামায়াত গড়ে উঠেছিল মওলানা রহীমের নেতৃত্বে। স্বাধীন বাংলাদেশে জিয়াউর রহমান ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিলে আব্বাস আলী খানের নেতৃত্বে ১৯৭৯ সালের মে মাসে জামায়াতের আবার রাজনৈতিক মঞ্চে আবির্ভাব ঘটে।
১৯৭১ সালে ১৭ সেপ্টেম্বর ডা. আবদুল মুতালিব মালেককে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিয়োগ করে নতুন প্রাদেশিক সরকার গঠন করেন ইয়াহিয়া খান। এ সরকারে শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন আব্বাস আলী খান। দেশ স্বাধীন হবার প্রাক্কালে হয় তিনি পালাতে পারেননি অথবা পালাতে চাননি কর্মীদের রেখে। যুদ্ধের পরপরই ১৯৭২ সালে তিনি গ্রেপ্তার হন এবং দালাল আইনে দোষী-সাব্যস্ত হয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। ১৯৭৩ সালে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আওতায় তিনি মুক্তি পান।
মুক্তি পেয়ে আব্বাস আলী খান গোপনে জামায়াত সংগঠিত করবার উদ্যোগ নেন। প্রাকাশ্যে রাজনীতি করবার সু্যোগ পাবার পর জামায়াতকে তিনি অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে কীভাবে গ্রহণযোগ্য করা যায় সে চিন্তা করেন।
জিয়াউর রহমান জামায়াতকে রাজনীতি করবার সুযোগ দিলেও তাদের সাথে জোট করেননি। তৎকালীন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির গতিপ্রকৃতির ওপর জেনারেল জিয়ার ধারণা ছিল বেশ গভীর। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, জামায়াতের সাথে জোট করা বিএনপির রাজনীতির জন্য নেতিবাচক হবে। জিয়ার এ উপলব্ধি যে সঠিক ছিল, পরবর্তীতে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে জামায়াতের সাথে জোট করবার মধ্য দিয়ে তা প্রমাণিত হয়েছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে গ্রহণযোগ্য হবার কৌশলের অংশ হিসেবে আওয়ামী লীগ, বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের সমান্তরালে এরশাদ আমলে জামায়াত কর্মসূচি দিতে শুরু করে। এভাবে সমান্তরাল কর্মসূচি দিয়ে আস্তে আস্তে এরশাদের সময়ে দলের একটা শক্ত ভিত্তি তৈরি করেন আব্বাস আলী খান। তবে এমনভাবে কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া হতো যাতে কোনোভাবেই সরকার বা তার পেটোয়া বাহিনীর সাথে দলকে সংঘাতে জড়াতে না হয়।
আজকে চরমোনাইয়ের পীরের ইসলামি আন্দোলনের যে কৌশল, অর্থাৎ কোনোভাবেই সরকারের সাথে সংঘাতে না জড়ানো– এরশাদ এবং খালেদা জিয়ার প্রথম আমলে জামায়াতের কৌশল ছিল অনেকটা সেরকম। আওয়ামী লীগ এবং বামপন্থীদের কাছে আসবার কৌশল হিসেবে তাদের সাথে খালেদা জিয়ার প্রথম আমলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে জামায়াত আন্দোলনে শামিল হয়, যার ফলশ্রুতিতে বিএনপি সরকারের এরশাদের মতোই পতন ঘটে।
বিএনপির পতনের পর জামায়াত প্রথমে ভেবেছিল এরপর হয়ত আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসবে। সেজন্য নির্বাচনী প্রচারণার শুরুতে জামায়াত কোনো পক্ষে না গিয়ে তাদের দলীয় প্রতীক দাঁড়িপাল্লার জন্য ভোট চাচ্ছিল। কিন্তু নির্বাচনী প্রচারণার একেবারে শেষপর্যায়ে গোলাম আযমের ভিন্ন উপলব্ধি হয়। হঠাৎ তার মনে হয় যে, আওয়ামী লীগ নয়, বিএনপিই আবার ক্ষমতায় আসতে যাচ্ছে। আনুষ্ঠানিকভাবে দলীয় প্রধান হবার পর তিনি এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ভুল ধারণা করেন, যেমন ১৯৭১ সালেও প্রথম আমির হবার পর তিনি বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম সম্পর্কে ভুল ধারণা করেছিলেন। তখন তিনি মনে করেছিলেন, মুক্তিযোদ্ধারা কখনো জয়লাভ করতে পারবে না।
এমনই প্রেক্ষাপটে দ্বিতীয়বার গোলাম আযমকে বেশ কাছ থেকে দেখবার সুযোগ হঠাৎ করেই হয়েছিল। নির্বাচনী প্রাচারণার তখন প্রায় শেষ সময়। একটা পারিবারিক কাজে খুলনা গিয়েছিলাম আমার দুই আত্মীয়সহ। ঢাকা ফিরবার জন্য যশোর এসে আমরা সবেমাত্র বিমানে উঠেছি। আমাদের আসন ছিল পঞ্চম সারিতে।
আসন নেবার একটু পরে দেখলাম, সফেদ পাঞ্জাবি পরিহিত দুজন বয়স্ক ভদ্রলোক তৃতীয় সারির আসন নিচ্ছেন। তাদের দিকে চোখ পড়বার পর প্রথম তাই মনে হয়েছিল। কিন্তু পর মুহূর্তেই আবার তাদের দিকে চোখ চলে গেল। দেখলাম বয়স্কজনের একজন হচ্ছেন গোলাম আযম। তিনি আইলের পাশের সিটে বসলেন। বসবার পর তিনি সেদিনের ইত্তেফাক পত্রিকা খুললেন।
আমার হাতেও ছিল ইত্তেফাক। আমি পত্রিকায় চোখ বুলালাম। দেখলাম প্রথম পাতায় নিচের দিকে এক কলামে সংবাদ হয়েছে গোলাম আযমের বক্তৃতাকে উদ্ধৃত করে। নির্বাচনী প্রচারে তিনি গিয়েছিলেন খুলনা। সেখানে জনসভায় তিনি বলেছেন, “নৌকা মার্কা ঠেকাতে ধানের শীষে ভোট দিন”। ইত্তেফাক এটাকে শিরোনাম করেছে।
আমি এদিক সেদিক মাথা ঘুরিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম বিমানে আর কেউ বুঝতে পেরেছেন কিনা গোলাম আযম তাদের সাথে একই ফ্লাইটে ঢাকা যাচ্ছেন। অবশ্য আমার আসনে বসে ঠিক বুঝতে পারলাম না কেউ বিষয়টা খেয়াল করেছেন কিনা। কারও মধ্যে কোনো ভাবান্তর বা ফিসফিসানি চোখে পড়ল না। কিছুক্ষণ পর বিমান ঢাকা এসে পৌঁছাল।
ঢাকা পৌঁছাবার পর কেবিন ক্রু সবাইকে নিজ নিজ আসনে বসে থাকতে বললেন। দেখলাম একজন ক্রু গোলাম আযমের আসনের সামনে আসলেন। গোলাম আযম এবং তার সঙ্গী তার সাথে বিমান থেকে নামলেন।
আমি উৎসাহী হয়ে আসন থেকে উঠে বিমানের দরজার কাছে আসলাম। দেখলাম বিমানের সিঁড়ির নিচে দু-জন পাইলট এবং কেবিন ক্রুসহ চারজন পুরুষ অনেকটা ‘গার্ড অফ অনার’ দেওয়ার মতো করে পাশাপাশি সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়েছেন। এর মধ্যে একটা সাদা গাড়ি বিমানের সিঁড়ির কাছে চলে এসেছে। গোলাম আযম তাদের সাথে মুসাফাহ (দুই হাত মিলান) করে সঙ্গীসহ গাড়িতে উঠে পড়লেন।
এরশাদ আমলে একাডেমিক মহলে বাংলাদেশে ধর্মীয় রাজনীতি বা জামায়াতের উত্থানের পেছনে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা মূলত দায়ী– এরকম একটা তত্ত্ব প্রচলিত ছিল। এরকম যারা ভাবতেন, তারা মনে করতেন, সামরিক শাসকরা (জিয়া এবং এরশাদ) তাদের শাসনকে বৈধতা দেবার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করে, যার উপজাত হল ‘মৌলবাদের’ রাজনীতি।
জামায়াতের পৃষ্ঠপোষকতা পাবার নানা কথা বলা হলেও এর স্বরূপটা সেদিন স্বচক্ষে দেখলাম। কিন্ত তখন তো সামরিক শাসনের সময় না। ক্ষমতায় তো তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমান। তিনি কি তাহলে তার সময়কালে ওই পৃষ্ঠপোষকতার ধারাবাহিকতাই বজায় রেখেছিলেন? নাকি গোলাম আযমকে বিশেষ সুবিধা দিয়েছিলেন, তার স্বল্পকালীন ক্ষমতায় থাকার সময়ে?
রায়ের মাধ্যমে গোলাম আযমকে বাংলাদেশে রাজনীতি করবার সুযোগ করে দিয়ে জামায়াতের রাজনীতি বিকাশে যিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন, ব্যক্তি গোলাম আযমের প্রতি তার দুর্বলতা থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। এ দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে হাবিবুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় গোলাম আযম বিশেষ সুবিধা পেয়ে থাকলে তাতে অবাক হবার কিছু নেই। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণার সাথে যে বিষয়টা যুক্ত ছিল তা হলো ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরি করা। তবে এ কাজটি যে হাবিবুর রহমান করতে পারেননি সেটা সেদিনের ব্যক্তি অভিজ্ঞতা থেকে মনে হলো।
ঢাকা থেকে যশোর যাবার সময় বিমানবন্দরে বাসদের আহবায়ক খালেকুজ্জামান ভূঁইয়াকে দেখেছিলাম সাধারণ যাত্রীদের সাথে লাইনে দাঁড়িয়ে চট্রগ্রামগামী ফ্লাইটে উঠতে। জামায়াত এবং বাসদ প্রধান ১৯৯৬-এর নির্বাচনের সময় যে একই সমতল মাঠে দাঁড়িয়ে ছিলেন না, তা সেদিন বিমান থেকে গোলাম আযমের নেমে যাবার সময় মনে হয়েছিল।