আজরা জেয়ার প্রকাশ্য ভাষ্য তো বটেই, ষড়যন্ত্রতত্ত্ব নিয়ে যে আলাপ হচ্ছে, তাতেও বোঝা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সমর্থনে দাঁড়াচ্ছে না। ভিসানীতির বাস্তবায়নসহ ভবিষ্যতে যদি আরও কোনো স্যাংশন আসে, সেটা আসবে নির্বাচন হয়ে যাবার পরে।
Published : 19 Jul 2023, 05:42 PM
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি, ভারতীয় বংশোদ্ভুত আজরা জেয়ার নেতৃত্বে উচ্চপর্যায়ের একটি মার্কিন প্রতিনিধিদল সম্প্রতি আড়াই দিনের এক সফরে ঢাকায় এসেছিল। আজরার পূর্বপুরুষ ভারতের বিহার থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসিত হয়েছিলেন।
মার্কিন ওই প্রতিনিধি দলে আরও ছিলেন পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক অ্যাসিট্যান্ট সেক্রেটারি ডনাল্ড লু এবং যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (ইউএসএআইডি) উপ-সহকারী প্রশাসক অঞ্জলী কৌর।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, বর্তমান বাইডেন প্রশাসনে ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসসহ ঊর্ধ্বতন নানা পদে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে অধিক সংখ্যক অভিবাসী এবং প্রথম ও দ্বিতীয় প্রজন্মের ভারতীয় আমেরিকানরা কাজ করছেন। সফরকারী দলের প্রধান আজরা জেয়া এক সময় দিল্লিতে কূটনীতিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৮ সালে পদোন্নতি না পাবার ফলে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্র্যাম্পের বর্ণবাদী নীতির সমালোচনা করে পদত্যাগ করেন। পদত্যাগ করবার পর প্রখ্যাত মার্কিন সাময়িকী The Politico-তে ওই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে জেয়া ‘Trump Is Making American Diplomacy White Again’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লেখেন।
জেয়ার নেতৃত্বে দলটি ঢাকা আসবার আগে নয়াদিল্লি হয়ে আসে। সেখানে তিনি ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কাতরাসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি এবং প্রবাসী তিব্বতি নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কথা বলেন। ভারত সরকারের সঙ্গে দলটির আলোচনার মুখ্য বিষয় ছিল তাদের ভাষায় মুক্ত (free and open) ইন্দোপ্যাসিফিক অঞ্চল, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সহযোগিতা আরও জোরদার করা ইত্যাদি। বৈঠকে যৌথভাবে ইন্দোপ্যাসিফিক অঞ্চল মুক্ত রাখবার ব্যাপারে ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের এক সঙ্গে কাজ করবার বিষয়ে জোর দেওয়া হয়। অনেকের কাছে মনে হয়েছে, ‘মুক্ত’ বলতে ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্র বোঝাতে চাচ্ছে, গণচীনের প্রভাবমুক্ত ইন্দোপ্যাসিফিক অঞ্চল।
মার্কিন প্রতিনিধি দলের এ সফরকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের মাঝে ব্যাপক উৎসাহ তৈরি হয়। এ ধরনের উৎসাহ তৈরি হয়েছিল বছরের শুরুতে ডনাল্ড লু যখন বাংলাদেশে আসেন ওই সময়েও।
পাকিস্তানের ইমরান খান সরকারের পতনের আগমুহূর্তে অনেকটা কাকতালীয়ভাবে লু ওই সময় ইসলামাবাদ সফরে ছিলেন। সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিরোধ এবং ইমরান সমর্থক সংসদ সদস্যদের পক্ষ ত্যাগ করবার কারণে ইমরান সরকারের পতন ঘটে। কিন্তু রাজনৈতিক সুবিধা পাবার উদ্দেশ্যে কোন প্রমাণ ছাড়াই ইমরান তাৎক্ষণিকভাবে তার সরকারের পতনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করে বসেন। অবশ্য পরে তিনি তার এ দাবি থেকে সরে আসেন। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র থেকেও স্পষ্ট করা হয় যে, ইমরান সরকারের পতনে যুক্তরাষ্ট্র কোনো ভূমিকা পালন করেনি। এটা পাকিস্তানের সম্পূর্ণ অভ্যন্তরীণ কারণেই ঘটেছে।
পাকিস্তানের রাজনীতির সমীকরণ মাথায় না রেখে এবং পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ অনুসরণ না করেই বাংলাদেশের অনেকে ধারণা করে বসেন, লুর সফরের কারণেই ইমরান খান সরকারের পতন হয়েছে।
পৃথিবীর সমস্ত অঘটনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র দায়ী, এমন একটা ধারণা কোল্ড ওয়ারের সময় বামপন্থীরা জন্ম দেন। যুক্তরাষ্ট্র যখন প্রথমবার ইরাকে অভিযান চালায়, ওই সময় থেকে ইসলামপন্থীরাও এটা বিশ্বাস করতে শুরু করেন। তাদের এ ধারণা ক্রমান্বয়ে বিশ্বের সাধারণ জনগণের একটা বড় অংশের মাঝেও সংক্রমিত হয়। ফলে লু যখন প্রথম বাংলাদেশে আসেন তখন অনেকের মনে হতে থাকে চমকপ্রদ কিছু একটা হয়তো হতে যাচ্ছে।
লু ফিরে যাবার কিছুদিন পরে ভিসানীতি ঘোষিত হবার পর সরকারবিরোধী অংশের মাঝে আশার সঞ্চার হয় এই ভেবে যে, সামনে নিশ্চয়ই আরও বড় কিছু আসতে যাচ্ছে। যদিও বড় কিছু কী, ওই সম্পর্কে কারও কোনো সম্যক ধারণা রয়েছে বলে অনেকের মনে হচ্ছিল না।
এরই ধারাবাহিকতায় জেয়ার নেতৃত্বে মার্কিন প্রতিনিধি দল এবার যখন বাংলাদেশ সফরে আসে বিরোধী রাজনৈতিক মহলে অনেকে ধরে নিয়েছিলেন যে, এবার হয়ত কিছু একটা হতে যাচ্ছে। নিদেনপক্ষে মার্কিন প্রতিনিধি দলটি ঢাকাতে বসেই সরকারকে কঠিন বার্তা দিয়ে যাবে। যদিও তাদের কেউই পরিষ্কার ছিলেন না, সরকারকে কঠিন বার্তা দেওয়া হলেও সেটি তাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাস্তবায়নের আন্দোলনে কীভাবে সহায়ক হবে।
প্রতিনিধি দলটি ঢাকা আসবার পর দিন কক্সবাজার চলে যায় রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে। রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন ছাড়া সেদিন তাদের আর কোনো কর্মসূচি ছিল না। সরকারের প্রতি জনসমর্থন নেই প্রতিনিধি দলটিকে এটা বোঝাতে, সরকার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে সেদিন বিএনপি তাদের কার্যালয়ের সামনে এক বিশাল সমাবেশের আয়োজন করে।
বিএনপির সঙ্গে সঙ্গে সমমনা আরও ৩৫টি নামসর্বস্ব রাজনৈতিক দল বিভিন্ন জোটের ব্যানারে একই দাবিতে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে সমাবেশ করে। এদিকে সরকারি দল আওয়ামী লীগও বিএনপির সমাবেশস্থল থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরে, জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের সামনে এক বড় ‘শান্তি সমাবেশের’ আয়োজন করে।
জাতীয় এবং মার্কিন রাজনীতির গতিপ্রকৃতি অনুধাবন না করে অনেকটা হঠাৎ করে এ ধরনের সমাবেশ বিএনপি যে উদ্দেশ্য নিয়ে ডেকেছিল, সেটা তাদের উদ্দেশ্যের প্রতি বুমেরাং হয়ে দাঁড়ায়। সরকারের জন্য এটা ‘মেঘ না চাইতে জল’ পাবার মতো অবস্থা হয়। সরকার প্রতিনিধিদলটির সামনে বিষয়টি উপস্থাপন করে এভাবে যে, দেশে কার্যকর গণতন্ত্র (Vibrant democracy) এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে। তারা দেখায় যে, তাদের জনসভা থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরে আরেকটি জনসভা থেকে তাদের সরকারের পদত্যাগের দাবিতে নির্বিঘ্নে সমাবেশ করা যাচ্ছে।
প্রতিনিধি দলটিও পুরো বিষয়কে ইতিবাচক ভাবে দেখে। এই প্রসঙ্গ তুলে ধরে মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি আজরা জেয়া বলেন, “বিশাল জনসভা দেখেছি। স্বস্তির বিষয়টি হচ্ছে, কোনোরকম সহিংসতা ছাড়াই সেটা হয়েছে। আমরা যেমনটা দেখতে চাই, এটা তার সূচনা। ভবিষ্যতেও এটির প্রতিফলন থাকবে বলেই আমাদের প্রত্যাশা।”
কক্সবাজার থেকে ফিরে পরদিন জেয়া তার দলের অন্য সদস্যদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন। দিনভর তিনি ব্যস্ত ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, পররাষ্ট্র সচিব এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে। রাতে তিনি প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের বাসভবনে নৈশভোজে যোগ দেন।
বাংলাদেশ ছাড়বার আগে বার্তা সংস্থা ইউএনবিকে এক সাক্ষাৎকার দেন জেয়া। তবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের যে বিষয়টি অবাক করেছে তা হলো, অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের মিশন নিয়ে আসা জেয়ার এ সফরে বিএনপি বা অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কোনো বৈঠক বা সৌজন্য সাক্ষাৎ না করা।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে এবং ইউএনবির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে যে কথার উপর জেয়া বারবার জোর দেন সেটি হলো, অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা। তিনি বলেন, ‘আমি সহিংসতা প্রত্যাখ্যান করে সত্যিকারের অন্তর্ভুক্তিমূলক, শান্তিপূর্ণ, অবাধ ও ন্যায্য গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সমর্থন করতে সব পক্ষকে আহ্বান জানাই।’ এর জন্য তিনি দলগুলোর মধ্যে সংলাপের ওপর জোর দেন, যদিও একই সঙ্গে এ-ও বলেন যে, এ সংলাপ আয়োজনে যুক্তরাষ্ট্র কোনো ভূমিকা পালন করবে না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রসঙ্গে জেয়া বলেন, এটা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। বাংলাদেশ চাইলে সেটা করতে পারে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের মূল আগ্রহ অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচন, সেটা দলীয় বা তত্ত্বাবধায়ক, যার অধীনেই হোক। লক্ষ্যণীয় যে, অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের কথা বললেও মার্কিন প্রতিনিধি দলটি বেশি জোর দেয় অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে। একই সঙ্গে জেয়া সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশাপাশি অন্য মন্ত্রীদের কাছ থেকে জোরালো প্রত্যয়ের কথা শুনেছি। পররাষ্ট্রসচিবের সঙ্গেও অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের ব্যাপারে আলোচনা করেছি।’ অর্থাৎ, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো আপত্তি নেই। এ বিষয়টি জেয়া ঢাকা সফরে পরিষ্কার করে দিয়ে যান।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণার প্রতি সরাসরি সমর্থন দেওয়া নৈতিক বা রাজনৈতিক, কোনোভাবেই যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইউ) পক্ষে সম্ভব নয়। কেননা, বিশ্বের কোনো প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক দেশেই এ ব্যবস্থা চালু নেই এবং কখনো ছিলও না। এটা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটা ইউনিক ধারণা।
স্বাধীনতা অর্জিত হবার পর অর্ধশতাব্দীর অধিক সময় পার হয়ে গেলেও রাজনৈতিক দলগুলো এখনো এ দেশের সব মহলের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করবার মতো ম্যাচিউরিটি অর্জন করে উঠতে পারেনি। এ কারণেই বারবার ঘুরেফিরে তত্ত্বাবধায়কের ইস্যুটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে সামনে চলে আসে।
নৈতিক বা রাজনৈতিক কারণ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র বা ইউ-এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে অবস্থান নেওয়া সম্ভব নয়, বিষয়টা বর্তমান বাংলাদেশে অসাংবিধানিক হবার কারণে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র তার গণতান্ত্রিক অবস্থানগত কারণে আরেকটি রাষ্ট্রকে অসাংবিধানিক কোনো পন্থা অবলম্বন করবার কথা প্রকাশ্যে বলতে পারে না।
১১ জুলাই প্রাক্তন ইউ কমিশনার এবং প্রতিষ্ঠানটির ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক বিশেষ দূত Ján Figeľ euobserver-এ ‘The EU must not support a caretaker government in Bangladesh’ শিরোনামে একটি মতামতভিত্তিক কলাম লেখেন। এতে তিনি বাংলাদেশসহ কয়েকটা দেশের উদাহারণ টেনে এনে বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা সেনাশাসন আসার পথ উন্মুক্ত করতে পারে। ফলে তিনি ইউ-এর কাছে প্রস্তাব করেছেন, এ ধারণার প্রতি সমর্থন না দেবার জন্য। বস্তুত এ সমস্ত নানা কারণে তত্ত্বাবধায়কের বিষয়টি বাংলাদেশের ওপর ছেড়ে দিয়ে বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন অবাধ এবং সুষ্ঠু হলে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সমস্যা নেই বলে জেয়া জানিয়েছেন।
জেয়া আরও স্পষ্ট করেছেন, নির্বাচন তখনই তারা সুষ্ঠু এবং অবাধ হিসেবে ধরে নেবেন, যখন জনগণের ইচ্ছার প্রকৃত প্রতিফলন নির্বাচনে ঘটেছে বলে তারা মনে করবেন। এটি পরিষ্কার যে, ইউ বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানের নির্বাচন ২০২৩ বা ২৪-এর শুরুতে বাংলাদেশে হয়ে যাবে, এটা জেয়া বা তার দলের কেউ মনে করছেন না। তাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, সবকিছুর পরেও নির্বাচনের ফলাফলে জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে কিনা, সেটা বোঝা।
তবে যেহেতু ষড়যন্ত্রতত্ত্ব বাংলাদেশসহ নানা দেশেই জনপ্রিয়, তাই অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, সম্ভবত শুধু এটুকু বলার জন্যই যুক্তরাষ্ট্র একটি হাই অফিসিয়াল টিম বাংলাদেশে পাঠায়নি। যদিও সমস্ত আলোচনা প্রকাশ্যে হয়েছে, তারপরেও তারা ভাবছেন, নিশ্চয় অন্তরালে এমন কিছু কথা হয়েছে যা প্রকাশ্যে আসেনি।
এ ধরনের ধারণা পোষণকারীদের একটি অংশ বিশ্বাস করেন, সারাবিশ্বে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যুক্তরাষ্ট্র নিবেদিত। সুতরাং সুষ্ঠু নির্বাচন এবং প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চয়ই গোপনে এমন কিছু বলে গেছে, যেটা সাধারণ মানুষের অজানা।
ষড়যন্ত্রতত্ত্ব বিশ্বাসকারী অপর অংশটি যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য নিবেদিত এটা মনে করেন না। তারা মনে করেন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আড়ালে যুক্তরাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ। তারা ধরে নিয়েছেন, বাংলাদেশকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের যে ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ, সেটি পূরণের ইঙ্গিত তারা পেয়েছেন বলেই, এ সরকারের অধীনে নির্বাচন হবার ব্যাপারে কোনো আপত্তি নেই বলে জেয়া বলেছেন।
এখন যে বিষয়টা দাঁড়াচ্ছে সেটা হলো, আজরা জেয়ার প্রকাশ্য ভাষ্য তো বটেই, ষড়যন্ত্রতত্ত্ব নিয়ে যে আলাপ হচ্ছে, তাতেও বোঝা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সমর্থনে দাঁড়াচ্ছে না। ভিসানীতির বাস্তবায়নসহ ভবিষ্যতে যদি আরও কোনো স্যাংশন আসে, সেটা আসবে নির্বাচন হয়ে যাবার পরে।
এ বিষয়টি বিএনপির রাজনীতিকে জটিল করে তুলেছে। আমি আগে একটি লেখায় বলেছি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতিষ্ঠা এবং পুনঃপ্রতিষ্ঠা, দুটোই হয়েছে গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে। বিএনপিকে যে বিষয়টা উপলব্ধি করতে হবে সেটা হলো, বাইরের কোনো রাষ্ট্র তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য আওয়ামী লীগের ওপর চাপ প্রয়োগ করবে না এবং সেটা তাদের পক্ষে সম্ভবও না। তারা যেটা বলতে পারে সেটা হলো, সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা—এটা পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো ক্রমাগত বলেও আসছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনা একমাত্র তখনই সম্ভব হবে যদি এ দাবিতে বিএনপি গণআন্দোলন গড়ে তুলতে পারে।
এ আন্দোলন বিএনপিকে গড়ে তুলতে হবে অনেকটাই এককভাবে। নামসর্বস্ব ৩৫টি রাজনৈতিক দল ছাড়া বিএনপির সঙ্গে এ মুহূর্তে কোনো রাজনৈতিক দল নেই। জামায়াত তত্ত্বাবধায়কের দাবিতে আন্দোলনে যুক্ত হলেও সেটা হবে লিপ সার্ভিস সর্বস্ব।
একমাত্র যুদ্ধাপরাধের দায়ে আটক তাদের নেতৃবৃন্দের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন ছাড়া অতীতের যে সমস্ত আন্দোলনেই জামায়াত অংশগ্রহণ করেছে, তার সবগুলোই ছিল অনেকটা প্রতীকী অর্থে অংশগ্রহণ। এ মুহূর্তে জামায়াতের অগ্রাধিকার হচ্ছে প্রকাশ্যে রাজনীতি করবার সুযোগ তৈরি এবং তাদের নেতাকর্মীদের মুক্তি। তাদের কাছে তত্ত্বাবধায়কের দাবিটি হচ্ছে এ লক্ষ্যে দরকষাকষির একটা কৌশল।
সিপিবি, বাসদের মতো দুটি ছোট বামপন্থী দল তত্ত্বাবধায়কের দাবিতে সরব থাকলেও তাদের তথাকথিত আওয়ামী লীগ ও বিএনপি থেকে সমদূরত্বে চলবার নীতির কারণে বিএনপির সমান্তরাল কোনো কর্মসূচিতে যুক্ত থাকবে না। ফলে বিএনপিকে আন্দোলনের মাঠে অনেকটা একাই নামতে হবে আওয়ামী লীগের মতো একটি বড় রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে, যাদের প্রতি আবার রয়েছে মাঝারি এবং ছোট কয়েকটি দলের সমর্থন।
এসবের পাশাপাশি অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মনে করেন, গত প্রায় পনের বছরে রাষ্ট্র এবং সরকার অনেকটা একীভূত হয়ে গিয়েছে। ফলে, সামরিক, বেসামরিক আমলাতন্ত্রের একটা পরোক্ষ সমর্থন সরকারের প্রতি রয়েছে। এছাড়া কয়েকদিন আগে নজিরবিহীনভাবে ব্যবসায়ীদের সংগঠন এফবিসিসিআই সভা করে এ সরকারের প্রতি তাদের সমর্থন ব্যক্ত করেছে।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চীন, রাশিয়া, ভারত অনেকটা সরাসরিই সরকারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। এর বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ইংরেজিতে যাকে বলে Ambivalent, অনেকটা সে রকম। অর্থাৎ, ক্ষমতাসীন যারাই থাকবে, তাদের সঙ্গেই তারা কাজ করতে আগ্রহী।
এখন প্রশ্ন হলো, রাজনীতির এসব সমীকরণ বিবেচনায় নিয়ে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিএনপি তত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে পারবে কিনা। যদি তারা সেটা না পারে, তাহলে কি তারা নির্বাচনে অংশ নেবে? তারা যদি নির্বাচনে অংশ না নেয়, তাহলে নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক না হলেও আওয়ামী লীগ বলার চেষ্টা করবে, নির্বাচন অবাধ এবং সুষ্ঠু হয়েছে। এতে জনমতের প্রতিফলন ঘটেছে।
বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নেবার পাশাপাশি যদি নির্বাচন প্রতিহতের ডাক দেয়, তাহলে তাদের চিহ্নিত করা হবে নির্বাচনবিরোধী শক্তি হিসেবে। আবার যদি বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে তারা চিহ্নিত হবে সুবিধাবাদী এবং আপোষকামী দল হিসেবে।
বস্তুত বিএনপি তাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি কঠিন যুগ সন্ধিক্ষণের মুখোমুখি। এরকম একটি কঠিন অবস্থার সঠিক বিশ্লেষণ করে বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নিতে পারবার ওপরেই নির্ভর করছে আগামীতে বিএনপির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ।
একটা নির্বাচন আন্তর্জাতিক মহলের কাছে তখনই গ্রহণযোগ্য হয়, যদি সেটা রাষ্ট্রের প্রধান বিরোধী দলগুলোর কাছে গ্রহণযোগ্য হয়। প্রধান বিরোধী দলগুলোর কাছে গ্রহণযোগ্যতা না পেয়ে সরকার গঠিত হলে সেটা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক, উভয় ক্ষেত্রেই দুর্বল সরকার হিসেবে প্রতিভাত হয়। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক কোনো চাপের মুখোমুখি হলে রাষ্ট্রের জবাব হয় বিভাজিত। রাষ্ট্রের পক্ষে তখন শক্তিশালী অবস্থান নেওয়া দুরূহ হয়ে পড়ে। কেননা, সরকার এবং বিরোধী পক্ষ সেক্ষেত্রে বিপরীতমুখী অবস্থান থেকে চাপের জবাব দেয়; অর্থাৎ, একপক্ষ সেটিকে সমর্থন এবং অপরপক্ষ সেটির বিরোধিতা করে।
নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন না থাকবার কারণেই বাইরে থেকে চাপ আসলে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিরোধ থাকা সত্ত্বেও ভারতে প্রায় সব রাজনৈতিক দলই বিদেশী কোনো রাষ্ট্রের চাপ বা সমালোচনার মুখে অনেকেটা একইরকম প্রতিক্রিয়া দেখায়। অর্থাৎ, প্রশ্নবিহীন নির্বাচন ভারতে জাতীয়াতাবাদের বিকাশ ঘটিয়েছে। জাতীয়তাবাদকে শক্তিশালী করেছে। অপরদিকে, প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন বাংলাদেশে জাতীয়াবাদী ধারাকে (বাঙালি এবং বাংলাদেশী উভয়কেই) দুর্বল করেছে।
পরিশেষে এটা বলা যায়, প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশে যদি পরবর্তী সরকার গঠিত হয়, তাহলে তাদেরকে একদিকে যেমন পশ্চিমা দুনিয়ার নানামুখী চাপের কম-বেশি মোকাবেলা করে মেয়াদকাল পার করতে হবে, তেমনি পাশাপাশি ভারতসহ অন্য রাষ্ট্রগুলোও সরকারের দুর্বলতার সুযোগ নিতে চাইবে।