বিদ্যুৎ ও জ্বালানির জন্য অতিরিক্ত অর্থ খরচের সক্ষমতা কত শতাংশ মানুষের আছে? নীতিনির্ধারকরা যদি নিজেদের আর্থিক সক্ষমতার সঙ্গে তুলনা করে কথা বলেন, সেটা দুঃখজনক।
Published : 16 Mar 2024, 10:30 PM
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় যারা গ্যাস পাচ্ছেন না বা চাপ স্বল্পতায় ভুগছেন, বিকল্প হিসেবে তাদেরকে এলপিজি তথা সিলিন্ডারের গ্যাস ব্যবহারে পরামর্শ দিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ (১৩ মার্চ)। ওইদিনই গাজীপুরে সিলিন্ডারের গ্যাসের আগুনে দগ্ধ হয়েছেন অন্তত ৩২ জন— যাদের মধ্যে ১৫ জনের অবস্থাই আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক। এক-দুজন করে মারাও যাচ্ছেন বলে খবর পাচ্ছি।
এর প্রায় অর্ধ মাস আগে ২৯ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর বেইলি রোডে কিচেনের গ্যাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরণে রেস্টুরেন্ট-অধ্যুষিত একটি ভবনে আগুন লেগে ৪৬ জন মানুষের প্রাণ গেছে।
বেইলি রোডের এই ঘটনার দু-দিন পরই ভোক্তা পর্যায়ে ১২ কেজি এলপিজি (তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস) সিলিন্ডারের দাম বাড়িয়ে ১ হাজার ৪৮২ টাকা নির্ধারণ করছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। এ নিয়ে টানা ৮ বার বাড়ল সিলিন্ডার গ্যাসের দাম। গত ফেব্রুয়ারিতে ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম ছিল ১ হাজার ৪৭৮ টাকা। জানুয়ারিতে ১ হাজার ৪৩৩ টাকা। প্রসঙ্গত, এলপিজির ১২ কেজি সিলিন্ডার সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় গৃহস্থালির কাজে।
কমিশনের যুক্তি হলো, বিশ্ববাজারে এলপিজির দাম অপরিবর্তিত থাকলেও মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার মানের অবনমনের জন্য দেশের বাজারে দাম বেড়েছে। আমদানিকারক কোম্পানির ইনভয়েস মূল্য থেকে গড় করে পুরো মাসের জন্য ডলারের দাম হিসাব করা হয়।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, সরকার দাম করে দিলেও এই দামে সিলিন্ডার গ্যাস পাওয়া যায় না। গণমাধ্যমের খবর বলছে, অনেক স্থানেই নির্ধারিত দামের চেয়ে এক থেকে দেড়শ টাকা বেশি দিতে হয়। খুচরা ব্যবসায়ীদের দাবি, পাইকারিতেই তাদের সরকারি দরের চেয়ে বেশি দামে কিনতে হয়। এ কারণে খুচরায় বেশি দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। আবার অনেক দোকানি সরকার নির্ধারিত দামও জানেন না।
রাজধানী ঢাকাসহ দেশের যেসব এলাকার গ্রাহকরা পাইপ লাইনের গ্যাস ব্যবহার করেন, সেটি হোক গৃহস্থালিতে কিংবা কল-কারখানায়, তারা প্রত্যেকেই জানেন গ্যাসের চাপ কতটা কম। গত শীতে যে সংকট মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তখন সরকারের তরফে বলা হয়েছিল যে, শীতে গ্যাসের চাপ কম থাকে। কিন্তু শীত শেষ হয়ে বসন্তও যাই যাই, গ্যাসের চাপ যে বেড়েছে তা বলা যাবে না। বরং রোজার শুরু থেকেই গ্যাস সংকট নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা সমালোচনা হচ্ছে। সাধারণ মানুষ তাদের ক্ষোভের কথা লিখছেন। এমনকি গ্যাসের চাপ না থাকায় ইফতারি বানাতে পারছেন না— এমনও অনেক ভুক্তভোগী লিখেছেন।
এসব সমালোচনার মুখে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী পাইপ লাইনের বিকল্প হিসেবে সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু তিনি এ কথা বলেননি যে, গ্যাস পাওয়া যাক বা না যাক, দুই চুলার গ্যাসের বিল বাবদ প্রতি মাসে গ্রাহককে যে এক হাজার ৮০ টাকা দিতে হয়, তার কী হবে? অর্থাৎ একদিকে প্রতি মাসে তিতাসকে এক হাজার ৮০ টাকা বিল দিতে হবে, আবার দেড় হাজার টাকা দিয়ে সিলিন্ডার গ্যাস কিনতে হবে? পাইপ লাইনের গ্যাস বাবদ যে টাকাটা দিতে হয়, গ্যাস দিতে না পারলে ওই টাকাটা কি সরকার মওকুফ করবে? তা নিশ্চয়ই করবে না। তাহলে জ্বালানির জন্য যে বাড়তি পয়সা খরচ করতে হবে, সেই টাকাটা নাগরিককে কে দেবে? প্রতিমন্ত্রীর এই বক্তব্যটি কি সিলিন্ডার ব্যবসায়ীদের পক্ষে যাবে না? রাষ্ট্র কি কোনো নির্দিষ্ট ব্যবসায়ী গ্রুপের পক্ষে কথা বলবে নাকি সাধারণ মানুষের?
বিদ্যুৎ ও জ্বালানির জন্য অতিরিক্ত অর্থ খরচের সক্ষমতা কত শতাংশ মানুষের আছে? নীতিনির্ধারকরা যদি নিজেদের আর্থিক সক্ষমতার সঙ্গে তুলনা করে কথা বলেন, সেটা দুঃখজনক। এই দেশে এখনও কোনো পণ্যের দাম দশ টাকা বেড়ে গেলে সেটা অনেকের জন্য চিন্তার কারণ। আবার অনেকের কাছে কোটি টাকাও পান্তাভাত। কিন্তু রাষ্ট্রকে নীতি প্রণয়ন করতে হয় সবচেয়ে কম আয়ের মানুষটিও যাতে তার প্রয়োজনীয় সেবাটি পেতে পারেন; তার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যটি কিনতে পারেন, সেটি বিবেচনায় রেখে।
চালের কেজি দুইশ টাকা হলে অনেক মানুষের সেটি গায়ে লাগবে না তা হয়তো ঠিক। কিন্তু সেটি হলে অধিকাংশ মানুষের ঘরেই চুলা জ্বলবে না। মোটা চালের কেজি ৩০ টাকা থেকে ৫০ টাকা হয়ে গেলে এখনও এই দেশে কোটি কোটি মানুষের দুশ্চিন্তা তৈরি হয়। সুতরাং বাজার ব্যবস্থাপনা ও নীতি প্রণয়ন করতে হয় ওইসব মানুষের কথা মাথায় রেখে।
সুতরাং প্রতিমন্ত্রী যখন বলেন যে গ্যাসের চাপ কম থাকলে সিলিন্ডার ব্যবহার করুন, তখন তাকে এও বলে দিতে হবে যে, ওই সিলিন্ডার কেনার পয়সাটা কোথা থেকে পাওয়া যাবে কিংবা পাইপ লাইনে গ্যাস না পেলেও কেন একজন গ্রাহক মাসে মাসে এক হাজার ৮০ টাকা বিল দেবে?
বাজারের ধর্মই হলো আপনি পণ্য বা সেবা দেবেন, তার বিনিময়ে অর্থ নেবেন। কিন্তু আপনি গ্রাহককে তার সময়মতো পর্যাপ্ত গ্যাস দিতে পারবেন না, অথচ মাসে মাসে নির্ধারিত বিল নেবেন, এটি নৈতিকতাবিবর্জিত। এটি অর্থনীতির মৌলিক সূত্রের সঙ্গেই সাংঘর্ষিক। সেবা না দিয়ে আপনি অর্থ আদায় করতে পারেন না। সুতরাং দায়িত্বশীল পদে থেকে কেউ যখন কোনো কথা বলেন, তাকে রাষ্ট্রের সবচেয়ে কম আয়ের মানুষের বাস্তবতা মাথায় রেখেই কথা বলা উচিত। শুধুমাত্র ধনী ও স্বচ্ছল মানুষের স্বার্থ দেখার জন্য রাষ্ট্রধারণা গড়ে ওঠেনি।
২.
সিলিন্ডার গ্যাস যে কোনো সমাধান নয় বরং এটি যে কতটা ঝুঁকিপূর্ণ, তা এরই মধ্যে কিছু ঘটনায় প্রমাণিত হয়েছে। সুতরাং সিলিন্ডার গ্যাসের ব্যবহার ও ব্যবসা বাড়ানো তো নয়ই, বরং ধীরে ধীরে এর ব্যবহার কমিয়ে আনাই রাষ্ট্রের লক্ষ্য হওয়া উচিত। যদিও বিভিন্ন সময়ে সরকারের নীতিনির্ধারকদের বক্তব্যে এটা স্পষ্ট যে, ধীরে ধীরে তারা পাইপ লাইনে গ্যাস সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে চান। অর্থাৎ শতভাগ বাসাবাড়িতেই সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করতে হবে— যা সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবসায়ীদেরই সুবিধা দেবে। আর মানুষ যখন কোনো একটি সেবা বা পণ্যের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়বে, তখন সেখানে ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ও নৈরাজ্যও বাড়বে। আমাদের দেশের বাজার ও ব্যবসায়ীদের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ যে কত দুর্বল, সেটি নতুন করে বলার কিছু নেই।
সেজন্য পাইপ লাইনের গ্যাসের গ্রাহক কমিয়ে শূন্যে নামিয়ে আনা নয় বরং নিরাপত্তা ও ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে সিলিন্ডার গ্যাসের ব্যবহারই শূন্যে নামিয়ে আনা উচিত। সেজন্য পাইপ লাইনের মাধ্যমেই যাতে গ্রাহকরা সার্বক্ষণিকভাবে তার প্রয়োজনীয় গ্যাস পায়, সেটির নিশ্চয়তা দিতে হবে। এক্ষেত্রে সমস্যা হলো গ্রাহকের মানসিকতা। বছরের পর বছর অনেকেই গ্যাসের যথেচ্ছ ব্যবহার করেছেন। জামা কাপড়ও শুকিয়েছেন। সেটি মুদ্রার অন্যপিঠ। গ্যাস পেলেই যে তার যথেচ্ছ ব্যবহার করা যাবে না এবং এটি যে রাষ্ট্রর অমূল্য সম্পদ, সেই বোধটি নাগরিকদের মধ্যে জাগ্রত করা জরুরি। এজন্য কোনো একটি সিস্টেম গড়ে তুলতে হবে। এক্ষেত্রে শতভাগ গ্রাহককে প্রিপেইড মিটারের আওতায় আনতে হবে। অর্থাৎ যিনি যতটুকু গ্যাস ব্যবহার করবেন, তিনি সেই পরিমাণ টাকা দেবেন। তবে তার আগে গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে হবে।
মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্রের সকল সিস্টেম দুর্নীতিগ্রস্ত রেখে নাগরিকদের সৎ ও দেশপ্রেমিক হতে বলাটা স্ববিরোধিতা। সুতরাং রাজনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকরা সৎ হলে সাধারণ মানুষও ধীরে ধীরে সৎ ও দেশপ্রেমিক হয়ে উঠবে। সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা সৎ হলে, তাদের দুর্নীতি করার পথগুলো বন্ধ করা গেলে গ্যাস ও বিদ্যুতের সিস্টেম লস অনেক কমে আসবে। সিস্টেম লস কমানো গেলে সেবার মান বাড়বে। খরচও কমবে। একইসাথে জলে-স্থলে নতুন নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
এলপিজি ব্যবসার কথা মাথায় রেখে দেশের অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। বাংলাদেশের মাটির নিচে ও গভীর সমুদ্রে যে গ্যাস আছে, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। প্রশ্ন হলো, অনুসন্ধান কাজটি সঠিকভাবে চলছে কি না?
মোদ্দা কথা, রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো সাধারণ মানুষের জীবন সহজ করা। রাষ্ট্রের সবচেয়ে কম উপার্জনকারী ব্যক্তিটিও যাতে বাজারে গিয়ে নিত্যপণ্য কিনতে গিয়ে দীর্ঘশ্বাস না ফেলে এবং গ্যাস-বিদ্যুৎ ও পানির মতো সেবা যাতে যে বিনা হয়রানি ও সর্বনিম্ন খরচে পেতে পারে, সেটি নিশ্চিত করা। ধনী ও স্বচ্ছল মানুষের জন্য রাষ্ট্র চাইলে আলাদা নীতি করতে পারে। যদিও সেটি খুব কঠিন। কিন্তু কিছু লোক বাড়তি সুবিধা নেবে বলে সংখ্যাগরিষ্ঠ গরিব ও স্বল্প আয়ের মানুষ কষ্ট পাবে, তা হতে পারে না।