‘যে মানুষ মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত, তাকে কেউ মারতে পারে না’

তাঁর অন্তরে এই বিশ্বাস দৃঢ়ভাবে প্রোথিত ছিল যে, পাকিস্তানের ধ্বংসস্তূপ থেকে নিশ্চিতভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের উত্থান ঘটবে। বাংলাদেশের চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের পর যদি তাদের (পাকিস্তানি শাসকদের) উন্মত্ত জিঘাংসার শিকার তিনি হন, তবে তাঁর কোনো খেদ থাকবে না।

মোনায়েম সরকারমোনায়েম সরকার
Published : 14 August 2023, 12:41 PM
Updated : 14 August 2023, 12:41 PM

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে গ্রেফতারের তিনদিন পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ২৯ মার্চ প্লেনে করে ঢাকা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই তিনদিন বঙ্গবন্ধুকে ঢাকার আদমজী স্কুলে প্রথমে এবং পরে ফ্ল্যাগ স্টাফ হাউসে আটক করে রাখা হয়। পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে শুরুতে তাঁকে লায়ালপুর (বর্তমানে ফয়সালাবাদ) ও পরবর্তীতে মিয়ানওয়ালি জেলে রাখা হয়েছিল। তাঁকে অপরিসর একটি কুঠুরিতে রাখা হয়েছিল। তাঁর জগৎ বলতে সেখানে ছিল চার দেয়াল, একটি জানালা ও একটি উঁচু বিছানা। এই জগৎ সম্পর্কে তাঁর ভালোভাবেই ধারণা ছিল, কেননা আগেও তিনি কারাবন্দি ছিলেন। তিনি কারাবাস সম্পর্কে প্রায়ই বলতেন যে, প্রথম দফার স্বল্পকালের কারাবাস ছাড়া তাঁকে কারাগারে বরাবর নিঃসঙ্গ কুঠুরিতে আটক রাখা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু প্রায়ই বলতেন ‘তারা যখন তোমাকে কাবু করতে চায়, এটা হয় তাদের প্রিয় অস্ত্র। বহু ক্ষেত্রে তারা সফল হয়।’

পাকিস্তানের কারাভ্যন্তরে তিনি বন্দি ছিলেন ঠিকই, কিন্তু জানতেন না তিনি কোন শহরে আছেন। কেবল জানতেন পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী তাঁকে বন্দি করে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের জেলে রেখেছে। পাহারাদার তাঁর খাবার নিয়ে আসে এবং তারপর তা রেখে জাদুর মতো উধাও হয়ে যায়। তিনি অন্ধকারাচ্ছন্ন সংকীর্ণ কুঠুরিতে অন্তহীন ভাবনারাজির মধ্যে নিঃসঙ্গ সময় কাটাতেন আর অপেক্ষা করতেন সেই মুহূর্তটির জন্য, যখন হঠাৎ করে খুলে যাবে সেলের দরজা এবং সামনে এসে দাঁড়াবে মেশিনগান হাতে সৈনিক। অবশ্য মানসিকভাবে নানাভাবে বঙ্গবন্ধুকে দুর্বল করার চেষ্টা করা হলেও, কারাগারে তাঁকে দৈহিকভাবে নির্যাতন করা হয়নি।

তিনি যে একজন গুরুত্বপূর্ণ বন্দি এবং তাঁর আয়ু আর বেশিদিন নেই এমনভাবেই কারাপ্রহরীরা জানত। কারা কর্তৃপক্ষ প্রতি সপ্তাহে বন্দির আচার-আচরণ সম্পর্কে ইসলামাবাদে বিস্তারিত রিপোর্ট পাঠাত। এই রিপোর্টে উল্লেখ থাকত তিনি কী খাবার খেয়েছেন, তিনি কেমন ঘুমিয়েছেন, সেলের মধ্যে এ দেয়াল থেকে ও দেয়াল অবধি পায়চারি করেছেন, কী করেননি। বন্দির কথাবার্তা সম্পর্কে জানতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খুব উৎসুক ছিলেন। তিনি বন্দি সেলে প্রবেশকারী গার্ডদের সালামের প্রতি-উত্তর দেওয়া ছাড়া সবসময় নীরবই থাকতেন। কাজেই ইয়াহিয়ার প্রত্যাশা কোনোদিনই পূরণ হয়নি।

বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে দীর্ঘকাল নিঃসঙ্গ ছিলেন, বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে তাঁর কোনো যোগাযোগ ছিল না। কোনো পত্রিকা, বই অথবা পরিবারের কাছ থেকে পত্র, কিছুই ছিল না ২৭ ডিসেম্বর অবধি। সবসময় তাঁর চারপাশে ছিল অন্ধকার, সব দিক থেকে যেন চেপে বসে থাকত সেল। যেসব অফিসার তাঁকে পাহারা দিত ও প্রহসনের মামলায় যেসব লোক জড়িত ছিল তারা ছাড়া তাঁর কারাকক্ষের দরজায় নয় মাসে তিনি আর কাউকে দেখেননি। সমগ্র পৃথিবীর মানুষ তখন বঙ্গবন্ধুর জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

১৯৭১-এর সংগ্রামমুখর দিনগুলোতে গণতন্ত্রকামী বিশ্বের অগণিত মানুষ বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর কারা নির্যাতনে উদ্বেগ প্রকাশ করে ২ এপ্রিল, ১৯৭১ সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগর্নি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে এক পত্র লেখেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে পরিচালিত অত্যাচার ও রক্তপাত বন্ধ এবং শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানে উপনীত হতে ‘অতীব জরুরি কয়টি’ ব্যবস্থা নিতে আহ্বান জানান। ২৮ মার্চ করাচিস্থ সোভিয়েত কনসাল জেনারেল পাকিস্তান সরকারকে পদগর্নির মৌখিক বার্তা সম্পর্কে অবহিত করে পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনা সম্পর্কে তথ্য জানতে চান।

গান্ধী শান্তি ফাউন্ডেশনের সেমিনার, মার্কিন আন্তর্জাতিক কাউন্সিল সম্মেলন, বুদাপেস্ট শান্তি সম্মেলন, আন্তর্জাতিক জুরিস্টস কমিশন এবং এমন বহু সমাবেশ ও সংগঠন বাংলাদেশ প্রশ্নে আন্তরিক অনুসন্ধিৎসা প্রকাশ করে। তাদের দাবি ছিল শেখ মুজিবের মুক্তি, সামরিক নির্যাতন রোধ, পাকিস্তানকে সাহায্যদান বন্ধ, সর্বোপরি উদ্ভূত সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান। মার্কিন কংগ্রেসে ও ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এই প্রশ্নে অত্যন্ত শক্তিশালী জনমত গড়ে ওঠে।

রেডিও অস্ট্রেলিয়া জানিয়েছিল যে, মুজিবকে গ্রেফতারের পর ২৬ মার্চ রাত ১৮ প্রহরে ইয়াহিয়া খান ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বলেছিলেন, ‘শেখকে মরতেই হবে।’ ১৯৭১ সালের জুলাইতে তিনি বলেছিলেন, ‘বাঙালি নেতা পশ্চিম পাকিস্তানের এক কারাগারে সুস্থ ও জীবিত রয়েছেন। তবে আজকের পরে কাল শেখ মুজিবের জীবনে কী ঘটবে সেটা আমি হলফ করে বলতে পারব না। তাঁর বিচার করা হবে এবং এর মানে এই নয় যে, আগামী কালই আমি তাঁকে গুলি করব। তাঁর স্বাভাবিক মৃত্যুও ঘটতে পারে। তাঁকে কোনো শ্রম করতে হয় না। বিছানা ও গরম পানির ব্যবস্থাসহ একটি ছোট ঘর তাঁর রয়েছে, দেখাশোনার জন্য একজন ডাক্তারও রয়েছেন। সামরিক আদালতে শেখ মুজিবের বিচার ও মৃত্যুদণ্ডের ব্যবস্থা করার জন্য আমার জেনারেলরা চাপ দিচ্ছেন। আমি সম্মত হয়েছি এবং খুব শিগগিরই বিচার অনুষ্ঠিত হবে।’

তৎকালীন পারিপার্শ্বিক অবস্থা দৃষ্টে মনে হয়েছিল যে, ইয়াহিয়া তথাকথিত বিচারানুষ্ঠানের আগেই তাঁকে হত্যা করার চক্রান্ত করছেন। তাঁর উক্তিতেও এমন ইঙ্গিত ছিল। অন্য কারো ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এই মনোভাব প্রকাশ করেননি।

বাংলাদেশে কী ঘটে চলেছে সে সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু কিছুই জানতেন না। তবে তিনি ইতোমধ্যেই বুঝতে পেরেছেন যে, সামরিক একনায়কের খেয়ালখুশির ওপর তাঁর জীবন নির্ভর করছে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি মৃত্যুর জন্য তৈরি ছিলাম। যে মানুষ মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত, তাকে কেউ মারতে পারে না।’ বঙ্গবন্ধু অনুমান করতে পেরেছিলেন যে, ইয়াহিয়ার সৈন্যরা যদি পূর্ব পাকিস্তান দখলে নিয়ে আসতে পারে, আওয়ামী লীগের যদি বিপর্যয় ঘটে, তবে তাঁকে হত্যা করা হবে। জিম্মি হিসেবে যতক্ষণ পর্যন্ত তাঁর কোনো কার্যকারিতা ইয়াহিয়া খানের কাছে থাকবে, তাঁকে ততক্ষণ বাঁচিয়ে রাখা হবে। বঙ্গবন্ধু নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন কারাগারের অবিচ্ছিন্ন নীরবতার কাছে।

জীবন-মৃত্যুর দোলার মধ্যে থেকেও তাঁর জনগণের সংগ্রাম সম্পর্কে আনুমানিক অথচ নিশ্চিত কিছু ধারণা বঙ্গবন্ধুর ছিল। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘জনগণের সঙ্গে আমার আত্মিক সম্পর্ক কখনো ছিন্ন হয়নি, এক মুহূর্তের জন্যও নয়। কোনো কিছু যদি আপনার মনকে অধিকার করে রাখে এমনকি নিরবচ্ছিন্নভাবে, এমন সার্বিক ও তীব্রভাবে, তাহলে সেটা আপনার অস্তিত্বের অংশ হয়ে ওঠে এবং আপনিও হয়ে ওঠেন এর অংশ। সংগতভাবেই এর বহুমুখী দিক সম্পর্কে আপনারও কিছুটা জানা রয়েছে। কোনো একটি বিশেষ সময়ে ঠিক কী ঘটছিল সেটা আমি সঠিকভাবে জানতাম না। তবে এর একটি আভাস আমি পেতাম। বাস্তব যোগাযোগের অনুপস্থিতিতে, জনগণের মধ্যে প্রোথিত আমার মন আমাকে আলোকিত করেছিল। উদাহরণত, যখন বিপদ আমাকে আচ্ছন্ন করত, আমি বুঝতে পারতাম আমার জনগণ তীব্র যন্ত্রণা ভোগ করছে। যখন আমার মনের দিগন্তে দেখা দিত চকিত আশার ঝলকানি, আমি জানতাম তারা সেই দুর্ভোগ অতিক্রম করছে।...একে বলতে পারেন প্রজ্ঞা, টেলিপ্যাথি, ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কিংবা অন্য যা খুশি তাই। কিংবা সম্ভবত এটা এক ধরনের ঐশী প্রেরণা, আমি যেটা জানি তা হলো আমার মন বলছিল বিজয় আমাদের হবেই। এত বিপুল রক্তদান বৃথা যেতে পারে না। রক্ত সেই অতীব জরুরি তরল, বাঁচিয়ে রাখে জীবনকে এবং এমনি রক্তদান যে আদর্শের জন্য, সেই আদর্শকেও তা বাঁচিয়ে রাখবে।’

বিপুল এক নৈঃশব্দে আবৃত দীর্ঘ কারাবাসকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বুঝেছিলেন যে, নিকট ভবিষ্যতে তাঁর মুক্তির সামান্য বা কোনো আশাই নেই। তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছিল কেবল তাঁর চরিত্রের বলিষ্ঠতা; কোনো ব্যক্তি বা কোনো কিছুই যে তাঁর মনোবল ভাঙতে পারবে না– সে সম্পর্কে পরিপূর্ণ আস্থা ছিল তাঁর। বঙ্গবন্ধু তাঁর প্রতি মানুষের ভালোবাসার কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন, তাদের ভালোবাসা তিনি অনুভব করেন সেই ভালোবাসার প্রতিদানও তিনি দেন। তিনি যখন মানুষের মাঝে থাকেন তখনো ভালোবাসার যে রূপ, কারাগারে থাকলেও সেই একই ভালোবাসা তিনি পান। বঙ্গবন্ধু বলেন যে, তিনি তাদের গভীরভাবে ভালোবাসেন এবং তাঁকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তাই-ই যথেষ্ট। তাদের ভালোবাসা যদি না থাকত, বহুবার তাঁর মৃত্যু হতো বলে তিনি উল্লেখ করেন।

বন্দি থাকাকালে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচারণ নিম্নরূপ:

‘সেই সময়ে আমার সেলে যাঁরাই এসেছিলেন তাঁদেরই দেখাত অনেক কম আস্থাবান ও সুস্থির। আটককারীর ঔদ্ধত্য তাঁদের মধ্যে তেমন প্রকাশ পেত না। বরং কোনো অজানা দুশ্চিন্তা যেন তাঁদের পীড়িত করত।...এটা আমার কাছে বেশ তাৎপর্যময় মনে হয়েছিল। তাঁদের নিরাপত্তা বিধানে কাজে লাগতে পারে এমন কোনো বিবৃতি আমার কাছ থেকে আদায়ের জন্য উপযুর্পরি প্রয়াস থেকে এর সমর্থন মিলেছিল। আমি অনুভব করেছিলাম, তাদের নৈরাশ্যজনক অবস্থা সম্পর্কে ক্রমোপলব্ধির এটা একটা ইঙ্গিত। এর ফলে আমার মধ্যে প্রত্যয়ী মনোভাব জেগেছিল যে, আমার দেশে তাদের দিন ভালো যাচ্ছে না। আমি তাদের কথা মান্য করতে অস্বীকার করি। আমি কোনো কিছু বলতে, লিখতে বা সই করতে অস্বীকার করি।’

সাংবাদিকের কাছে স্মৃতিচারণে বঙ্গবন্ধু আরও বলেন যে, পাকিস্তানি সামরিক শাসকবৃন্দ তাঁকে দৈহিকভাবে দখল করেছিল। তারা তাঁর হতাশার কোনো চরম মুহূর্তে, তাঁর দেহ নিয়ে যা-খুশি করতে পারত। তবে তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে, তারা যদি তাঁকে হত্যাও করে, তাঁর দেশের মানুষ তাঁর নেতৃত্বে সূচিত মুক্তিসংগ্রামকে যৌক্তিক পরিণতিতে পৌঁছে দেবে এবং অর্জন করবে স্বাধীনতা।

তিনি তাঁর সামনে ফাঁসির দড়ি ঝুলতে দেখতে পেতেন, তবে সময় সময় একে মনে হতো লাল গোলাপের লকেট-সজ্জিত ফুলের মালা। এটা জোরদার করত তাঁর সেই অদ্ভুত অনুভূতি যে, তাঁর জীবনের লক্ষ্য সাধন না হওয়া পর্যন্ত দয়াবান খোদা তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবেন। অন্য সবাই যেক্ষেত্রে অলীক স্বপ্নকাতর, তিনি সেক্ষেত্রে যেন দিব্যচোখে দেখতে পেতেন এবং তাঁর অন্তরে এই বিশ্বাস দৃঢ়ভাবে প্রোথিত ছিল যে, পাকিস্তানের ধ্বংসস্তূপ থেকে নিশ্চিতভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের উত্থান ঘটবে। বাংলাদেশের চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের পর যদি তাদের (পাকিস্তানি শাসকদের) উন্মত্ত জিঘাংসার শিকার তিনি হন, তবে তাঁর কোনো খেদ থাকবে না। তিনি বলেন, ‘যদি আমার একাধিক জীবন থাকত এবং সবগুলো জীবনই যদি আমার লালিত স্বপ্ন বাংলাদেশকে বাস্তব করে তুলতে বিসর্জন দিতে হতো, তাহলেও আমার কোনো খেদ থাকতো না। তারা আমাকে মাত্র একবারই হত্যা করবে। আমি জানি প্রত্যেক মানুষের আছে সেই চূড়ান্ত পরিণতির দিন। তবে আমার প্রার্থনা ছিল, জয় বাংলার সুমিষ্ট শব্দমাধুরীর মধ্যে যেন আমার মৃত্যু ঘটে।’

বঙ্গবন্ধু কারাগারে শান্তিতে ছিলেন না, কিন্তু তিনি এটা নিশ্চিত করেছিলেন যে, জেলাররা যেন তা টের না পায়। একবার তিনি বলেছিলেন যে, ইতিপূর্বে তাঁকে যখন কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছিল, তখন তিনি ধীর স্থিরভাবে হিসাব কষতে বসেছিলেন– বিচারের অপেক্ষায় কারাগারে কাটানো দিনগুলোর বিনিময়ে কতটা রেয়াত তাঁর প্রাপ্য হয়েছে। সেই সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে প্রাপ্য অব্যাহতি যোগ করলে তাঁকে কারাগারে কাটাতে হবে মাত্র বিশ বছর। তিনি বলেছিলেন, ‘সেই সময় আমার বয়স ছিল চুয়াল্লিশ এবং বিশ বছর পর বয়স হতো চৌষট্টি। তো চৌষট্টি বছর বয়সে তখনো আমার যথেষ্ট শক্তি থাকবে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে আমার জনগণের পক্ষে কাজ করার জন্য।’

শেখ মুজিবকে হত্যা করতে ইয়াহিয়ার সঙ্কল্প সম্বন্ধে ভুট্টো ভালোভাবেই অবহিত ছিলেন। তিনি জেনারেল ইয়াহিয়ার সঙ্গে দেখা করে তাঁকে সতর্ক করে বলেছিলেন যে, ইয়াহিয়ার হাতে নিহত হওয়ার চাইতে অনেক বড় মাপের মানুষ মুজিব। প্রেসিডেন্ট মুখ কালো করে ভুট্টোকে বলেছিলেন, ‘আপনি মনে করেন তাঁকে হত্যা করার মতো বড় আমি নই? আমি এই দেশের সবচেয়ে শক্তিমান মানুষ, দুনিয়ার শক্তিমানদের একজন। যাঁরা মনে করে একজন বিশ্বাসঘাতককে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার মতো সাহস আমার নেই তাঁরা আমার অবমূল্যায়ন করে।’ ইয়াহিয়ার এই দম্ভোক্তির মধ্য দিয়েও শুধু বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধেই তাঁর আক্রোশ ফুটে ওঠে। এ কথা তো ঠিক যে, মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি জনগণ যেমন ঠিক তেমন সশ্রস্ত্র সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা ও অন্যান্য সৈনিক এবং পুলিশ, তৎকালীন ইপিআর বাহিনীও অংশগ্রহণ করে। তা সত্ত্বেও যাঁকে নিয়ে এত বড় মুক্তিযুদ্ধ, তিনি আর কেউ নন, তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁকে ঘিরেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা-যুদ্ধ এবং পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের মাথাব্যথা।