অপরাধমূলক ঘটনার দীর্ঘ ও প্রলম্বিত প্রভাব রয়েছে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে। ওইসব ঘটনার বিচারিক নিষ্পত্তির পথ ধরেই পৌঁছতে হবে রাজনীতির ভিন্ন দিগন্তে। কেননা পাল্টাপাল্টি অসহিষ্ণুতার মূল্য শেষ পর্যন্ত জনগণকেই দিতে হয়।
Published : 30 Jul 2023, 12:19 PM
ডিএমপি কমিশনারের বক্তব্যের পর বিএনপি তার মহাসমাবেশ ছুটির দিন শুক্রবারে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ছিল ইতিবাচক। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যথারীতি তাকে অনুসরণ করে নিজেদের কর্মসূচি পাল্টায়। আওয়ামী লীগ এ ধারা থেকে বেরিয়ে আসছে না কেন, তার 'ব্যাখ্যা' অবশ্য দিয়েই যাচ্ছে। বিএনপির 'সম্ভাব্য নৈরাজ্য' ঠেকাতে মাঠে থাকতেই হচ্ছে তাদের! পুলিশ কেন ওই সম্ভাব্য নৈরাজ্য মোকাবেলায় অসমর্থ, তার কোনো ব্যাখ্যা নেই।
২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচন ঠেকাতে বিএনপি ও তার মিত্ররা দেশজুড়ে যে সহিংস আন্দোলন চালিয়েছিল, সেটা কি পুলিশ প্রতিহত করতে পারেনি? এরপর দীর্ঘ সময়ে বিএনপি সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়েছে, এটাই তো আওয়ামী লীগ বলে থাকে। কার্যকর আন্দোলন রচনায় তার সক্ষমতার অভাবের কথাও তারা বলে থাকে না কি? তাহলে বিএনপির সম্ভাব্য নৈরাজ্য ঠেকাতে পুলিশ সক্ষম নয় ভেবে এত উদ্বেগ কেন তাদের?
যাহোক, ২৮ জুলাই নয়া পল্টনের দলীয় কার্যালয়ের সামনে বিএনপি একটি বৃহৎ জমায়েত করতে সক্ষম হয়েছে। একটু দেরিতে হলেও ওই জমায়েত দেখতে গিয়েছিলাম। ততক্ষণে লোক কিছুটা কমে এসেছে বলে মনে হলো। তারপরও বহু কর্মী, সমর্থক ও সহানুভূতিশীল মানুষের একটি বড় উদ্দীপ্ত জমায়েত দেখতে পেয়েছি সেদিন। ফেসবুকে মানুষে ঠাসা রাজধানীর দীর্ঘ পথের ছবি শেয়ার করেছেন অনেকে। ওখান থেকে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন আয়োজিত জমায়েতও দেখতে যাই বায়তুল মোকাররম দক্ষিণ গেটে। তখন সাড়ে পাঁচটা বাজবে। তুলনা করলে ওই জমায়েতে লোক অনেক কম ছিল। তবে বক্তৃতায় উত্তেজনা কম ছিল না। বিএনপির জমায়েতেও উত্তেজক কথাবার্তা কম শুনিনি অল্প সময় অবস্থান করে। দুই জমায়েতের তুলনা অবশ্য ঠিক নয়। কারণ ওইদিন বিএনপির জমায়েতই ছিল মূল ঘটনা।
ভয়ভীতি, বাধাবিঘ্ন ইত্যাদি না থাকলে বিএনপির জমায়েতে এর দ্বিগুণ লোক হওয়াও সম্ভব বলে মনে করি। আওয়ামী লীগও চাইলে ওই ধরনের জমায়েত করতে সক্ষম; সেটা ক্ষমতাসীন দল হওয়ার কারণেও। জমায়েত বড় হলেই ভোট বেশি পাওয়া যাবে, এমন কোনো কথা অবশ্য নেই। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন জয়যুক্ত হওয়ার মুহূর্তে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া পদত্যাগ করে এসে এই নয়া পল্টনেই কর্মী-সমর্থকদের এক বিশাল জমায়েতে বক্তৃতা করেছিলেন। সেটা কোনো অংশে আন্দোলনে বিজয়ী নেত্রী শেখ হাসিনার প্রেসক্লাবের সামনে অনুষ্ঠিত জমায়েতের চেয়ে ছোট ছিল না। তবে প্রতিকূল পরিবেশেও কোনো পক্ষের জমায়েতে বিপুল লোক হলে সেটা একটা বার্তা অবশ্যই দেয়। সেটি বোঝার ক্ষমতাও তার প্রতিপক্ষের থাকা চাই।
বিএনপির মহাসমাবেশের উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল দলটির বিদেশে অবস্থানরত ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের ভিডিও বার্তা প্রদর্শন। উপস্থিত কর্মী-সমর্থকরা এ সময়ে উল্লাসে ফেটে পড়ে। সে দৃশ্য অবশ্য দেখতে পাইনি। যারা দেখেছেন, তাদের কাছে শুনেছি। তারেক রহমান একাধিক মামলায় ইতোমধ্যে দণ্ডিত হলেও দল পরিচালনায় তার ভূমিকা অস্বীকার করা যাবে না। আন্দোলন রচনার প্রয়াসেও তার নির্দেশনা গুরুত্ব পাচ্ছে। সামনে ২ অগাস্ট তার ও তার স্ত্রীর নামে দায়ের করা আরেকটি মামলার রায় দেওয়া হবে বলে খবর রয়েছে। এতে যে দণ্ডই হোক, বিএনপিতে তার নেতৃত্ব অটুট থাকবে বলেই ধারণা। বিএনপির পক্ষ থেকে অবশ্য বলা হচ্ছে, এসব মামলা রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যমূলক এবং রায় গ্রহণযোগ্য নয়।
বিএনপির ওই মহাসমাবেশ থেকে পরদিনই যে কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়, সেটা নিয়ে কিছু প্রশ্ন উঠবে। প্রথমত, এদিন ছিল আশুরা। দ্বিতীয়ত, ঢাকার প্রবেশমুখে কয়েক ঘণ্টার অবস্থান কর্মসূচিতে মহাসড়কে যান চলাচল ব্যাহত হওয়ার শংকা ছিল বলে সেটা অবরোধ কর্মসূচি বলেই অন্তত সরকারের কাছে ধরা দিয়েছিল। আর কর্মসূচিটিকে 'শান্তিপূর্ণ' বলে বর্ণনা করা হলেও আওয়ামী লীগের পাল্টা কর্মসূচিতে সেটা যে আর শান্তিপূর্ণ থাকবে না, তা ছিল একরকম নিশ্চিত। কথা উঠতে পারে, ক্ষমতাসীন দল এখানেও কেন পাল্টা কর্মসূচি দিতে গেল? এর জবাব একটাই—তারা তো পাল্টা কর্মসূচি দিয়েই চলেছে। সে বিষয়ে অগ্রহণযোগ্য হলেও একটা ব্যাখ্যা আছে তাদের। প্রকাশ করা হচ্ছে না, এমন ব্যাখ্যাও রয়েছে। একই স্থানে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি ডাকায় পুলিশ অবশ্য সুযোগ পেয়ে সব ধরনের কর্মসূচির ওপরই নিষেধাজ্ঞা দিয়ে দেয়।
এ অবস্থায় শঙ্কা ছিল আন্দোলনকারী দল হিসেবে বিএনপির সেটা না মানার। এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে আন্দোলনে এগিয়ে যাওয়ার ঘটনা তো অনেক রয়েছে। ভালো হতো আওয়ামী লীগের লোকজন ওইদিন ওইসব পয়েন্টে গিয়ে উপস্থিত না হলে। নিষেধাজ্ঞা তো তাদের কর্মসূচির ওপরও ছিল। এখানেও উঠবে সেই একই প্রশ্ন—পুলিশ কি ঢাকার কয়েকটি প্রবেশমুখে বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের (নিষেধাজ্ঞা অমান্য করা) অবস্থান হটিয়ে দিতে পারতো না? পুলিশের সঙ্গে বিজিবিও নামানো যেতে পারতো। আর আওয়ামী লীগের টানা তিন মেয়াদের শাসনামলে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধিতে অনেক বিনিয়োগ করা হয়েছে বলেই তো জানা যায়।
এদিন ঢাকার একাধিক প্রবেশমুখে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ কর্মীদের সঙ্গে বিএনপির আন্দোলনকারীদের যে সংঘাত হয়েছে, তা ভয়াবহ হয়ে না ওঠা যেমন সত্য; তেমনি সত্য যে, শুধু পুলিশ দিয়ে মোকাবেলা করা হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ সহজতর হতো। আর ব্যাপারটা রীতি ও বিধিসম্মত দেখাতো। সব ক্ষেত্রেই দেখা গেল, পুলিশ এক পক্ষকে বাধাদান করলো বা তাদের ওপর চড়াও হলো অন্য পক্ষের উপস্থিতি মেনে নিয়ে। এমন পরিস্থিতিতে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা দুর্ভাগ্যজনক হলেও ঘটে। তবে সম্পদহানি কম হয়েছে—কয়েকটি বাসে আগুন দেওয়া ছাড়া। আগুন দেওয়ার ঘটনাগুলোও যথারীতি প্রশ্নবিদ্ধ। একটি ঘটনা তো ঘটানো হয় পুলিশের সামনে। যাহোক, এর কোনোটাই যাত্রীবাহী ছিল না বলে জানা যায়। এদেশে তো আন্দোলনে যাত্রীবাহী বাসে আগুন দিয়ে নিরীহ মানুষ হত্যার ভয়াবহ সব ঘটনা রয়েছে। আরও দুর্ভাগ্যজনক যে, এর একটারও বিচার সম্ভবত সম্পন্ন হয়নি আজও।
অবস্থান কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে বিএনপির দুই নেতা আহত, অসুস্থ হয়ে ডিবি কার্যালয় ও সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ঘটনা ঘটে। অল্প জিজ্ঞাসাবাদ করে তাদের একজনকে সসম্মানে দুপুরের খাবার খাইয়ে দলীয় কার্যালয়ে পৌঁছে দেওয়া হয়। আরেকজনের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয় প্রধানমন্ত্রীর অফিসের এক কর্মকর্তার হাতে ফলাহার। তার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করার নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী।
এ দুই ঘটনাকে নানাজন নানা দিক দিয়ে ব্যাখ্যা করছেন; করবেন। সাদা চোখে দেখলে এমনটাই তো হওয়া উচিত। এমনকি ওই দুই নেতা রাজপথে আহত হওয়ারও কথা না। গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের মতো একজন সিনিয়র নেতার কপাল যেভাবে ফেটেছে এবং তারপর রাস্তায় ফেলে তাকে যেভাবে পেটানোর দৃশ্য দেখতে হয়েছে, তা বেদনাদায়ক। টিভিতে যতদূর দেখেছি—তিনি পুলিশের মুখোমুখি হওয়া কর্মীদের শান্ত রাখতেই চাইছিলেন।
অবশ্য বলা যেতে পারে, আন্দোলনকারী দলের নেতাদের রাস্তায় ফেলে নির্মমভাবে প্রহারের আরও অনেক ঘটনা আছে। তৎকালীন বিরোধী নেত্রী শেখ হাসিনাকে তো দলেবলে হত্যার উদ্দেশে গ্রেনেড হামলাও চালানো হয়েছিল। সত্যি বলতে, ওই অপরাধমূলক ঘটনার দীর্ঘ ও প্রলম্বিত প্রভাব রয়েছে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে। তবে এখান থেকে অবশ্যই বেরোতে হবে। ওইসব ঘটনার বিচারিক নিষ্পত্তির পথ ধরেই পৌঁছতে হবে রাজনীতির ভিন্ন দিগন্তে। কেননা পাল্টাপাল্টি অসহিষ্ণুতার মূল্য শেষ পর্যন্ত জনগণকেই দিতে হয়।
ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান গ্রহণ কর্মসূচি ঘিরে যা ঘটেছে, তার প্রতিবাদে বিএনপি দেশব্যাপী সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছে আগামী সোমবার। সে খবর পেয়ে আওয়ামী লীগ আবার তার কর্মসূচি পরিবর্তন করে সোমবারে এনেছে বলে জানা গেল। এর আগে তারা রোববার বিক্ষোভ সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছিল রীতিমতো সংবাদ সম্মেলন করে। ক্ষমতাসীন দলের এমন আচরণ সঠিক হচ্ছে কিনা আর এটা করে শেষ বিচারে তারা লাভবান কিনা, তা দেরিতে হলেও চিন্তা করে দেখা প্রয়োজন। বিএনপি তার অবস্থান কর্মসূচি পালন করতে পারেনি, তাদের নেতা-কর্মীরা মার খেয়েছেন, নতুন করে মামলায় পড়েছেন—এজন্য তারা গতানুগতিক প্রতিবাদ কর্মসূচি দিলেও ক্ষমতাসীন দলকে কেন ঘোষিত দিনক্ষণ পাল্টে আবারও মাঠে নামতে হবে, তা বোধগম্য নয়।
বিএনপি দৃশ্যত চাইছে আন্দোলনকে শান্তিপূর্ণ ধারায় রাখতে। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি ঘোষণার পর থেকে তাদের এ-সংক্রান্ত সতর্কতা বেড়েছে। ২০১৪-র ব্যর্থ সহিংস আন্দোলনের অভিজ্ঞতা এবং এজন্য এখনও সমালোচিত হতে হওয়াটাও সতর্ক করেছে তাদের। এ অবস্থায় ক্ষমতাসীন দলের পাল্টাপাল্টির প্রবণতা সংঘাত-সহিংসতায় উস্কানি বলে বর্ণিত ও বিবেচিত হতে পারে। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সেটা সরকারের পক্ষে যাবে বলে মনে হয় না। নির্বাচনের তো বেশি বাকি নেই। সেটা শেষতক কিভাবে অনুষ্ঠিত হয়, তা দেখার অপেক্ষায় আছে জনগণ। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলো একটি সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের ওপর অব্যাহতভাবে জোর দিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় পাল্টাপাল্টি রাজনৈতিক কর্মসূচিতে না গিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সতর্ক তৎপরতা জোরদার করেই সরকার পারে পরিস্থিতি সামলাতে। আন্দোলন শান্তিপূর্ণ ধারায় চলতে থাকলে তা মোকাবেলায় পুলিশকে ব্যবহারও বিধিসম্মত আর নিয়ন্ত্রিত হওয়া প্রয়োজন। ইতোমধ্যে এলিট ফোর্সটি রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায়। নতুন করে নিষেধাজ্ঞা এড়ানোটাই হওয়া উচিত কাম্য।
এক দফা দাবির মধ্যে চলে গিয়ে বিরোধী দল সংকট উত্তরণে আলোচনার পথ বন্ধ করে দিয়েছে বললেও হবে না। সরকারকে বরং শেষ পর্যন্ত এ সদিচ্ছা দেখাতে হবে যে, মাঠের বিরোধী দলের নির্বাচনে আসার পথ প্রশস্ত করতে যথাসম্ভব চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি থেকে সরে আসার ভেতর দিয়ে সে বার্তা দেওয়া যেতে পারে। আগামী নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য ও অর্থবহ করার জন্য যারা সরকারের সঙ্গে কাজ করছে বলে দাবি করে, সেই পশ্চিমা মহলও এ জায়গাটায় ভূমিকা রাখলে তা দোষের হবে না।