স্বাধীন বাংলাদেশে জামায়াতের উত্থান হয়েছে বিএনপির হাত ধরে, বিএনপির পৃষ্ঠপোষকতায়।
Published : 03 Jul 2023, 07:35 PM
বিএনপির চিরসখা হিসেবে পরিচিত জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে কি তাদের দূরত্ব তৈরি হচ্ছে? কলসির কানা মেরেছে বলে কি জামায়াত আর বিএনপিকে প্রেম দেবে না? নাকি এসব মান-অভিমান লোক দেখানো? ‘ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে জামায়াতের যোগাযোগ স্পষ্ট’– বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের এমন বক্তব্যে দুই দলের মধ্যে ‘মনোমালিন্য’ দেখা দিয়েছে বলে পত্রিকায় অবশ্য খবর বের হয়েছে। এ নিয়ে জামায়াতের প্রতিক্রিয়ার পর বিএনপি মহাসচিব তার বক্তব্যের ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। কিন্তু তাতে সন্তুষ্ট হয়নি জামায়াত। বিবৃতি দিয়ে মির্জা ফখরুলের বক্তব্যে বিস্ময় প্রকাশ করে তা প্রত্যাখ্যান করেছে তারা।
মির্জা ফখরুলের বক্তব্যের পর বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়। জামায়াতকে নিয়ে পর্দার আড়ালে কোনো খেলা চলছে কিনা, ওই প্রশ্নও সামনে আসছে। এ নিয়ে জামায়াতের মধ্যে প্রতিক্রিয়া তৈরি হলে দলটি তাদের আপত্তির বিষয়টি বিএনপিকে জানায়। বিএনপি থেকে বিষয়টি ‘অসাবধানতাবশত’ বলা হলেও জামায়াত গণমাধ্যমে ব্যাখ্যার দাবি করে।
বিএনপি মহাসচিবের বক্তব্যের ব্যাপারে জামায়াতের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের দুই নেতা দাবি করেন, জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির রাজনৈতিক আদর্শগত অমিল রয়েছে। কিন্তু রাজনীতিতে অনেকদিন ধরে তারা একে অপরের সহযোগী। গত ১৫ বছরে বিএনপির তুলনায় জামায়াত কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। তাদের জ্যেষ্ঠ নেতাদের ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। অনেক নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাদের তৃণমূল নেতাকর্মীরাও নির্যাতিত হয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে জামায়াত সরকারের সঙ্গে আঁতাত করলে দল হিসেবে তারাই রাজনৈতিক সংকটে পড়বে। দলের তৃণমূলকে ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।
জামায়াত নেতারা বলেছেন, তাদের সঙ্গে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের যোগাযোগ আছে। বিএনপির সঙ্গে মিল রেখে তারাও এক দফার আন্দোলনে নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কৌশলে হলেও আবার যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত হবেন তারা।
বিএনপির একাধিক নেতাও জামায়াতের সঙ্গে যোগাযোগের কথা স্বীকার করেছেন। বিএনপি মহাসচিবও ঠাকুরগাঁওয়ে দেওয়া বক্তব্যে জামায়াতসহ সব বিরোধী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ আছে বলে জানিয়েছেন। তাহলে সমস্যাটি কোথায়?
বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ এক নেতা বলেছেন, সাংবাদিকদের একের পর এক প্রশ্নের এক পর্যায়ে ‘অসাবধানতাবশত’ মুখ ফসকে এ বক্তব্য বের হয়ে গিয়েছে। কিন্তু বিএনপি মহাসচিবের পুরো বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে জামায়াতের আপত্তি থাকার কথা নয়। তারপরও ভবিষ্যৎ আন্দোলনের স্বার্থে এ বক্তব্যের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।
ঠাকুরগাঁওয়ে দেওয়া বক্তব্যের বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে মির্জা ফখরুল বলেছেন, “রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াত অনেক দিন ধরে রাজনীতি করছে। জাতীয় পার্টিও একটি রাজনৈতিক দল। যদিও এখন জামায়াতের নিবন্ধন নেই। আমি ঠাকুরগাঁওয়ে বলেছিলাম, জামায়াতে ইসলামী একটা রাজনৈতিক দল, তারা তাদের নিজস্ব ধারায় রাজনীতি করছে। আমাদের মূল কথাটা হচ্ছে, সরকারের বিরুদ্ধে যারাই আন্দোলন করবে তাদের ধন্যবাদ দেওয়া উচিত।”
বিএনপি মহাসচিব বলেন, “আমরা যুগপৎভাবে আন্দোলন করছি, আমরা জোটবদ্ধ আন্দোলন করছি না। সব রাজনৈতিক দল যারা মনে করে যে, এই সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলা উচিত তারাই আন্দোলন করতে পারে, এটাই স্বাভাবিক। কমিউনিস্ট পার্টি তারা নিজস্ব জায়গা থেকে আন্দোলন করছে, বাসদ তাদের নিজস্ব জায়গা থেকে আন্দোলন করছে, জামায়াতও নিজস্ব জায়গা থেকে আন্দোলন করছে। এখন আরও অনেক দল যারা যুগপৎ আন্দোলনে নেই কিন্তু তারা আন্দোলন করছে, আমরা সবাইকে স্বাগত জানিয়েছি।”
জামায়াতে ইসলামী বিএনপির বি-টিম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের এমন বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় মির্জা ফখরুল বলেন, “এগুলো বাজে কথা। তারা ইচ্ছা করে এসব কথা বলছে। আমরা এসব কথার উত্তর দিতে চাই না। জনগণই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তাদের কথাগুলোর উত্তর দিয়ে দেবে। এবার জনগণকে সম্পৃক্ত করে যে আন্দোলন শুরু হয়েছে, তাকে ভ্রান্ত দিকে নিয়ে যাওয়া, আবার একটা ইস্যু তৈরি করে সেটাকে অন্যদিকে দিয়ে যাওয়া, ইস্যু পরিবর্তন করা এসবের কোনো সুযোগ এবার তারা পাবে না।”
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের এই বক্তব্যের পরও জামায়াতের প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি মতিউর রহমান আকন্দ বলেছেন, “আমরা বিএনপি মহাসচিবের বক্তব্যের পর ৩৬ ঘন্টা অপেক্ষা করেছি৷ তিনি তার বক্তব্য সংশোধন করেননি৷ আমরা বিবৃতি দেয়ার পর তিনি যা বলেছেন, তা স্পষ্ট নয়৷ তিনি তো বলেছেন, জামায়াতের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক এখন স্পষ্ট৷ আমরা তো আমাদের বিবৃতিতে সেটা উল্লেখ করে দিয়েছি৷ ওনি তো সেটা সুনির্দিষ্ট করে উল্লেখ করেননি তার কথায়৷ তার আরো পরিস্কার করে বলা উচিত ছিলো যে, এ জাতীয় কথা তার বলা ঠিক হয়নি৷ কিন্তু সেটা তিনি করেননি৷”
জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম মাসুম এক বিবৃতিতে বলেছেন, “৩০ জুন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ঠাকুরগাঁওয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে ‘সরকারের সঙ্গে জামায়াতের যোগাযোগ এখন স্পষ্ট’ বলে মন্তব্য করেন মর্মে কয়েকটি জাতীয় দৈনিক ও অনলাইনে প্রচারিত হয়। বিএনপি মহাসচিবের এ বক্তব্যে জনগণ হতাশ হয়েছে। আমরা বিএনপি মহাসচিবের বক্তব্য সর্বোতভাবে প্রত্যাখ্যান করছি।”
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, “আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে আঁতাত, সমঝোতা বা যোগাযোগ করে জামায়াত কখনো রাজনীতি করেনি, করার প্রশ্নই আসে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা ও এক দফার আন্দোলনের জন্য গোটা জাতি যখন ঐক্যবদ্ধ, তখন এ জাতীয় বক্তব্য সরকারবিরোধী আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।” বিবৃতিতে এ ধরনের বক্তব্য থেকে বিরত থাকার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি এবং সরকারবিরোধী এক দফা আন্দোলন জোরদার করতে সব বিরোধী রাজনৈতিক দল ও সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানানো হয়।
গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে ফ্রান্সের ঘটনাবলি ও ইউরোপের ডানপন্থিদের উত্থান সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, “গণতন্ত্র যখনই ঠিক মতো চলতে না পারে, তখনই এসব সমস্যা দেখা দেয়। পশ্চিমা বিশ্বকে ভিন্নভাবে দেখতে হবে, আমাদের দেশকে ভিন্নভাবে দেখতে হবে। কারণ পশ্চিমা বিশ্বে গণতন্ত্র ইনস্টিটিউশনালাইজ। আমাদের এখানে সেটা নেই। তারপরেও এখানে যদি গণতন্ত্রকে স্পেস দেওয়া না হয়, নির্বাচন যদি সুষ্ঠু না হয়, মানুষ যদি তার গণতান্ত্রিক অধিকার না পায় তাহলে স্বাভাবিকভাবে ডানপন্থি, উগ্রপন্থি, ফান্ডামেটালিস্ট, জঙ্গিবাদ এগুলোর উত্থান হবে। সে কথাগুলো আমরা বারবার বলছি।”
মির্জা ফখরুলের এসব বক্তব্য অনেকটা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো। স্বাধীন বাংলাদেশে জামায়াতের উত্থান হয়েছে বিএনপির হাত ধরে, বিএনপির পৃষ্ঠপোষকতায়। জামায়াত একটি সুশৃঙ্খল সংগঠন। তারা সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়েই কাজ করে। কখনো কখনো আওয়ামী লীগের প্রতি জামায়াতের নমনীয়তা দেখানোও তাদের পরিকল্পনারই অংশ। আওয়ামী লীগের সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যুগপৎ আন্দোলনে জামায়াতের লাভ হয়নি। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে মাত্র তিনটি আসন পেয়েছিল জামায়াত। তাই আওয়ামী লীগের সঙ্গে নয়, বিএনপির সঙ্গেই থাকতে চায় জামায়াত। সেটাই তাদের জন্য লাভজনক।
তবে, একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ভোটের রাজনীতিতে জামায়াত ও অন্যান্য ইসলামী দলগুলো ক্রমশ বড় ফ্যাক্টর হয়ে উঠছে। বিশেষ করে চরমোনাইর পীরের দল ইসলামী আন্দোলন গত কয়েকটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যে ভোট পেয়েছে, তা অনেককেই বিস্মিত করেছে। অন্যদিকে, চাপের মধ্যে থেকেও জামায়াতের সদস্য সংখ্যা না কমে বরং বেড়েছে। জামায়াতের সঙ্গে যদি ইসলামী আন্দোলনের সমঝোতা হয়, তাহলে সেটা বড় বিষয়ই হবে। দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিএনপি জয়ের যে আশা করছে, তা একমাত্র তখনই সফল হতে পারে যদি সব ইসলামী দলের ভোট আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ও বিএনপির পক্ষে যায়। যদি এই ভোট বিএনপির বাক্সে না যায়, তাহলে বিএনপির জয়ের আশা দুরাশায় পরিণত হবে। এই হিসাব মাথায় আছে বলেই বিএনপি মহাসচিব জামায়াতকে তোয়াজ করে কথা বলতে বাধ্য হচ্ছেন। সরকার যদি কৌশলে জামায়াতকে বিএনপি থেকে দূরে রাখতে পারে এবং ইসলামী দলগুলো স্বতন্ত্র রাজনৈতিক অবস্থানে থেকে নির্বাচনে যায়, তাহলে বিএনপির কপাল মন্দই থাকবে।