আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে কেন?

ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় একের পর এক বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে। বিষয়গুলো আগে থেকে দেখভাল করলেই তো এ ধরনের ঘটনা কমে আসত। বিস্ফোরণ থেকে নিদানের উপায় জানা আছে আমাদের, কিন্তু নেই কোনো প্রয়াস।

সুরেশ কুমার দাশসুরেশ কুমার দাশ
Published : 14 March 2023, 12:45 PM
Updated : 14 March 2023, 12:45 PM

তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভূমিকম্পে ধ্বংসের মাত্রা দেখে আমরা অত‍্যন্ত বেদনাবিধুর হয়ে পড়লাম। শোক ঘোষণা করা হলো। এমনকি ওই ধ্বংসযজ্ঞের উদ্ধার কার্যক্রমে সহায়তার জন্য আমাদের দেশ থেকে ফায়ার সার্ভিসের টিম পাঠানো হলো। ওখানকার ধ্বংসযজ্ঞের তুলনায় আমাদের সহায়তা আসলে তেমন কিছুই নয়। কিন্তু যারা তুরস্কের ধ্বংসযজ্ঞে লোক পাঠানোর হিম্মত দেখায়, সিদ্দিক বাজারের একটি ভবন বিস্ফোরণে তাদের দক্ষতা কেমন হওয়ার কথা? আসলে তো যতটা দক্ষতা আমাদের কাঙ্ক্ষিত ততটা নয়, এটা সহজেই অনুমেয়।

ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় একের পর এক বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে। বিষয়গুলো আগে থেকে দেখভাল করলেই তো এ ধরনের ঘটনা কমে আসত। বিস্ফোরণ থেকে নিদানের উপায় জানা আছে আমাদের, কিন্তু নেই কোনো প্রয়াস। পরিস্থিতি যা, তাতে মনে হচ্ছে এ রকম আরও কিছু বিস্ফোরণ ঘটা খুব একটা অস্বাভাবিক হবে না।

বিস্ফোরণে ভবন নির্মাণে ত্রুটি বা জালিয়াতির সঙ্গে গ‍্যাস লাইন ও বিদ‍্যুতের বিষয়টি উঠে আসছে। ঘটনার পর প্রথমে ফায়ার সার্ভিস, পরে পুলিশ-র‍্যাব প্রাণপণ লড়াই করলেও সরকারের বিদ‍্যুৎ এবং গ‍্যাস সরবরাহের দায়িত্বে নিযুক্ত কর্তৃপক্ষ চুপচাপ। ফাঁক গলে বেরিয়ে যায় ভবন নির্মাণকারীরা আর ভবনের অনুমোদনদানকারী কর্তৃপক্ষও। ফায়ার সার্ভিস বা সংশ্লিষ্টরা তদন্ত করে একটা রিপোর্ট দেয় বা দেয় না– যা কোথাও জানাজানি হয় না।

কেমিকেল কারখানায় বিস্ফোরণের কিছু কার্যকারণ থাকতে পারে। কিন্তু আবাসিক এবং বাণিজ্যিক ভবনে বিস্ফোরণ কেন হবে? মসজিদে বিস্ফোরণের কারণ কী? এগুলো কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়। অসর্তকতা, জোচ্চুরি আর অনিয়মকে নিয়মের পর্যায়ে উন্নীত করার কারণেই এমনটা ঘটছে।

দেশে কোনো বিস্ফোরণ ঘটলেই উদ্ধারের দায়িত্ব পড়ে ফায়ার সার্ভিসের ওপর। উদ্ধার অভিযানে তাদের বহু সক্ষমতা আমরা অতীতে দেখছি। এমনকি ফায়ার সার্ভিসের টিম তুরস্ক ও সিরিয়ার ভয়াবহ ভূমিকম্পের ধ্বংসযজ্ঞে সহায়তার জন্য গিয়েছে, সেটা আগেই বলেছি। কিন্তু যারা এত বিপুল ধ্বংসযজ্ঞে গিয়ে কাজ দেখানোর দক্ষতা রাখে, সেই লোকজনই সিদ্দিক বাজারের উদ্ধারকাজে হিমশিম খেয়েছে। অন্যদের জোচ্চুরির ভোগান্তি তাদের পোহাতে হয়েছে। ঘটনার তিন/চারদিন পরও যখন ভেতরে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ বলা হয়, তখন মনে সংশয় জাগে প্রতিটি আবাসিক এবং বাণিজ্যিক ভবন এ রকম ঝুঁকিপূর্ণ কিনা?

এ ধরনের দুর্ঘটনা শুধু মৃত‍্যুর সন্তাপই সৃষ্টি করছে না, পাশাপাশি যে ধ্বংসস্তূপ তৈরি হচ্ছে সেখানে আরও নতুন বিপদ অপেক্ষা করে থাকে। নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে আমরা যে দালানকোঠার দঙ্গল তৈরি করেছি তাতে ভবিষ্যৎ বহু দুর্ঘটনার ফাঁদ তৈরি করা হয়ে আছে। এসব বিপদ দৃশ‍্যমান নয় বলেই এর ঝুঁকি মোকাবিলা করাও যাচ্ছে না।

অবস্থা এমনই যে র‌্যাবের কর্মকর্তারা একে অস্বাভাবিক বিস্ফোরণ বলতে বাধ্য হয়েছেন। আমাদের কাছে ভবিষ‍্যতের ঘটনাগুলোকে হয়তো আরও অবিশ্বাস্য ঠেকবে। বিষয়গুলোতে আমরা বার বার গাফিলতি করছি। বাড়াবাড়ি করে চলেছি। গতানুগতিক কর্মকৌশল বা তৎপরতায় তা সমাধানের চেষ্টা করছি, যা চলছে ঢিমেতালে। শেষপর্যন্ত এসব কিছুর দায় আর কারও থাকে না। কারণ, কেউ কারও কাছে জবাবদিহি চায় না। এখানে চাপাচাপি না করে জবাবদিহিতায় বাধ্য করা যায় না।

সবাই যখন অনিয়মে, গা জোয়ারিতে একাকার হয়ে যায়, তখন কে কার কাছে জবাবদিহিতা চাইবে? যার যেখানে জায়গা আছে সে-ই চায় কীভাবে ফাঁকি মেরে নিজের মতো একটা ভবন নির্মাণ করে ফেলা যায়। দুর্বল প্রতিবেশী পেলে তাকে ঠেলেঠুলে দিয়ে তার থেকে কিছু জমি হাতিয়ে নিয়ে ভবন নির্মাণ করে ফেলতে পারলে তাকে আর পায় কে? সরকারের অমুক প্রতিষ্ঠান না হলে তমুক প্রতিষ্ঠানকে ম্যানেজ করে যেন-তেন ভাবে ভবন নির্মাণ করে ফেলা। ভবন নির্মাণের পর কোথাও না কোথাও গোঁজামিল দিয়ে বিদ্যুৎ-পানি-গ্যাসের লাইন নিয়ে নেওয়া। তারপর এসব ব্যাপারে আর কোনো তদারকি থাকে না সরকারের ওইসব দপ্তরের।

এতগুলো অঘটনের পরও কেউ আমাদের অবস্থান ছাড়ছি না। সারাদেশের ভবনগুলো কী অবস্থায় আছে তা ওইসব ভবন মালিকদের মারফতেও অন্তত খবর নেওয়া প্রয়োজন। অথবা ভবন মালিকের মধ্যে সক্ষমতা সৃষ্টি করে বা তাকে সচেতন করার দায়িত্ব নেওয়া জরুরি। ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাসেসমেন্ট যেটা সেটা তদারকিতে রাখা।

বছরের পর বছর দেশের বিভিন্ন কর্মব‍্যস্ত এলাকায় বিস্ফোরণে হতাহত হচ্ছে মানুষ। একইসঙ্গে বাড়ছে ভুক্তভোগী মানুষের আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি। এমন অব্যবস্থাপনার মধ্যে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্কও বাড়ছে দিন দিন। বিস্ফোরণ বাড়ছেই। মিলছে না কোনো সুরাহা। সর্বশেষ ৭ মার্চ ঢাকার সিদ্দিক বাজারের নর্থ সাউথ রোডের ১৮০/১ নম্বর হোল্ডিংয়ের কুইন ক্যাফে নামে পরিচিত সাত তলা ভবনটিতে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। সেই ঘটনায় এ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ২৩ জনের। বিস্ফোরণে ওই ভবনের দুটি ফ্লোর ভেঙে নিচে পড়ে যায়। ভবনের ২৪টি কলামের মধ্যে ৯টি কলাম, স্ল্যাব বিমসহ রিটেইনিং ওয়াল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। 

আরও বড় বিপদের ভয়ে উদ্ধার অভিযান চালাতেও বেশ বেগ পেতে হয়েছে উদ্ধারকারীদের। এই অবস্থায় বিস্ফোরণের পর যে ধরনের ঝুঁকি তৈরি হয় তা মোকাবিলা করতে উদ্ধারকারীদের প্রাণহানির আশঙ্কা দেখা দেয়। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম ডিপোর বিস্ফোরণের ঘটনায় উদ্ধারকারী ফায়ার সার্ভিস টিমের ১৩ জন ফায়ার ফাইটার নিহত হয়েছিলেন।

গত ৫ মার্চ ঢাকার সাইন্সল্যাব এলাকায় একটি তিনতলা বাণিজ্যিক ভবনে বিস্ফোরণে তিনজন নিহতের পাশাপাশি আহত হয়েছিলেন অনেকে। গত ৪ মার্চ চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে সীমা অক্সিজেন কারখানায় বিস্ফোরণে ৬ জন নিহত হন। ওই বিস্ফোরণের সাতদিন যেতে না যেতেই সীতাকুণ্ডের ছোট কুমিরা এলাকায় একটি তুলার গোডাউনে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। এর আগে গত বছরের ৪ জুন রাতে চট্টগ্রামের ভাটিয়ারির বিএম ডিপোতে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডে ফায়ার সার্ভিসের ১৩ জনসহ ৫১ জন নিহত হয়েছিলেন। ২০২১ সালের ২৭ জুন মগবাজারে একটি ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছিল। ২০২০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় একটি মসজিদে বিস্ফোরণ ৩৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল।

বেশ কয়েকটি বিস্ফোরণের ঘটনার সঙ্গে বিদ্যুৎ, গ্যাস লাইন, পানির লাইনসহ ভবন নির্মাণের ত্রুটির কথা বলা হলেও এসব কিছু কেউ কানে তোলেননি। অন্যদিকে এসব নজরদারি করার ক্ষেত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশন, জেলা প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, বিস্ফোরণ পরিদপ্তর, পরিবেশ অধিদফতর এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যে দায়-দায়িত্ব রয়েছে বিস্ফোরণের পরপরই তা যেন সবাই বিস্মৃত হন।

একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা পরিষ্কার হবে। ফতুল্লার মসজিদ বিস্ফোরণে দেখা গিয়েছে মসজিদের ভেতরে গ্যাস ও বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগ ছিল। গ্যাস লাইনের লিকেজ দিয়ে বের হয়ে আসা গ্যাসের ওপর বিদ্যুতের স্পার্ক পড়তেই বিস্ফোরণ ঘটেছে। এমনটাই ছিল সিআইডির রিপোর্ট। এখন সিদ্দিক বাজারের ভবনে অবৈধ গ‍্যাস লাইনের কথা বলা হচ্ছে।

অগ্নিনিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, সাধারণত কোনো আবদ্ধ জায়গায় যদি গ্যাসের মাত্রা ৫% থেকে ১৭% হয় তাহলে যে কোনোভাবে আগুনের স্ফুলিঙ্গের সংস্পর্শ পেলেই বিস্ফোরণ ঘটে। দিয়াশলাই, জ্বলন্ত সিগারেট, ফ্যানের সুইচের সামান্য স্পার্ক থেকেও আগুন ধরতে পারে। আবার গ্যাস লাইনে লিক হলে সংলগ্ন বিভিন্ন ফাঁকফোকর দিয়ে সেই গ্যাস পানি বা পয়নিষ্কাশন লাইনে মিশে যেতে পারে। যদি পরিবেশ আবদ্ধ থাকে, তাহলে গ্যাস জমতে জমতে বিস্ফোরণের আশঙ্কা তৈরি হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অবৈধ বিদ্যুৎ আর গ্যাসের সংযোগ কীভাবে আসে তা নিয়ে কখনোই কিছু বলা হয় না। সবক্ষেত্রেই ছোট ছোট অনিয়মের কারণেই ঘটছে বড় বড় বিস্ফোরণ। জীবনহানি হচ্ছে বহু মানুষের। দগ্ধ ও আহত হয়ে যন্ত্রণাময় জীবন টানছে বহু মানুষ।