প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে গুরুত্বহীন প্রসঙ্গকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে সামনে আনার অর্থ হচ্ছে পাশ্চাত্যের বৃহৎশক্তি ইসরায়েলের পক্ষে যে নির্লজ্জ অবস্থান নিয়েছে, তাদেরকে অস্ত্র, অর্থ, সৈন্য দিয়ে সহযোগিতা করছে, তাকে আড়াল করার চতুর কৌশল।
Published : 19 Oct 2023, 07:46 PM
পাশ্চাত্যের সংবাদ মাধ্যমে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ নিয়ে কিছু পারম্পর্যহীন আলোচনাকে সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে। যে সব আলোচনা মানুষের মনোযোগকে অন্যদিকে নিয়ে যায়। যেমন, পুতিনের কপাল খুলে গেল, ইরানের যত সুফল, চীনের লাভ-ক্ষতি, ভারতের সংকটসহ ভূ-রাজনীতির এমন নানান বিষয়। প্রশ্ন হচ্ছে কেন এই আলোচনাকে এখন সামনে আনা হচ্ছে? ইসরায়েলের বর্বরতা, হিংস্রতা, যুদ্ধাপরাধ ও দখলদারিত্বকে গুরুত্ব না দিয়ে এই সব আলোচনাকে সামনে আনা মোটেই নিরীহ বিষয় নয়। এই আলোচনা তখনই গুরুত্বপূর্ণ যখন এই যুদ্ধে ইসরায়েল ও তার সহযোগীদের অপকর্ম তাদের স্বার্থ-সমীকরণের বিষয়কে সর্বাগ্রে নির্মোহভাবে তুলে ধরা হবে।
কোনো লোকালয়ে আগুন লাগলে প্রথমে তা নেভানোর কাজটাকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হয়। সেখানে যা আছে তাকে রক্ষা করতে হয়। সে অঞ্চল পোড়ার কারণে কে বা কারা সুবিধাভোগী হবে সে বিশ্লেষণ না হয় পরে করা যাবে। বরং কারা, কীভাবে, সেই আগুনে ঘি-বারুদ ঢালছে, আগুনকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে সে সমালোচনা গুরুত্বপূর্ণ। সেই আগুনের উত্তাপে কে কার ঘর গরম রাখছে, সেই আলোচনা পরেও হতে পারে।
প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে গুরুত্বহীন প্রসঙ্গকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে সামনে আনার অর্থ হচ্ছে পাশ্চাত্যের বৃহৎশক্তি ইসরায়েলের পক্ষে যে নির্লজ্জ অবস্থান নিয়েছে, তাদেরকে অস্ত্র, অর্থ, সৈন্য দিয়ে সহযোগিতা করছে, তাকে আড়াল করার চতুর কৌশল। কেননা কে, কারা, কীভাবে লাভবান, সুবিধাভোগী হবে সে আলাপকে সামনে আনছে কিন্তু কারা ইসরায়েলের এই বর্বরতা-হিংস্রতাকে মদদ, ইন্ধন দিচ্ছে, রসদ যোগাচ্ছে, কোন স্বার্থের কারণে তারা মদদদাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে সে আলাপ করছে না। তাদের কূটকৌশল ও ভুল রাজনীতির মাশুল দিতে হচ্ছে ফিলিস্তিনিদের। সে কারণে বিশ্বকে অস্থিতিশীল করার এই আলোচনা সময় বিবেচনায় অধিক জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য।
রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধকে কেন্দ্র করেও অভিন্ন আলোচনাকে আনা হয়েছে সামনে। এই যুদ্ধে চীন ও ভারত নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখছে, এই নিরপেক্ষতা প্রকারান্তরে রাশিয়াকে সহযোগিতা করা। পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যমে শিরোনাম হয়েছে, এই যুদ্ধে চীন-ভারত কীভাবে লাভবান হচ্ছে। যুদ্ধের আগুনে চীন-ভারত কীভাবে আলু পুড়ে খাচ্ছে, সে গল্প প্রচার করা হয়েছে ফলাও করে। কিন্তু এই যুদ্ধে পশ্চিমা শক্তির বিনিয়োগ, মুনাফা ও সেই যুদ্ধে তাদের আগুনে ঘি ঢালা ও গোপন উদ্দেশ্যকে আড়াল করতেই তা করা হয়েছে।
রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধে ইউরোপের জনদুর্ভোগকে সামানে আনা হয়নি। যুদ্ধ বন্ধে দেশে দেশে যে বিক্ষোভ হয়েছে, জনমত তৈরি হয়েছে তা প্রচার করা হয়নি পশ্চিমা গণমাধ্যমে। ধারণা করা হয়, ওই সংগ্রাম ইউরোপের ৬টি দেশের (ব্রিটেন, ফ্রান্স, ফিনল্যান্ড, ইতালি, জার্মানি ও পোল্যান্ড) সরকার পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছে।
রাশিয়া-ইউক্রইন যুদ্ধে যেভাবে রাশিয়ার সৈন্যদের হিংস্রতা-বর্বরতার কথা প্রচার করা হয়েছে, সেভাবে ইউক্রেইন সেনাবাহিনী, নাৎসিপন্থি আজেভ ব্যাটালিয়নের বর্বরতা প্রচার করা হয়নি। কিন্তু পরে যুক্তরাজ্যের সরকার বলেছে যে, রাশিয়া খুব সতর্কতার সঙ্গে ইউক্রেনে যুদ্ধ পরিচালনা করেছে। আলজাজিরার তথ্যসূত্র বলছে, ‘ইউক্রেইন যুদ্ধে রাশিয়া সক্ষম, তারা সামান্য শক্তি প্রয়োগ করেছে। ইউক্রেইনে চলা যুদ্ধে রাশিয়া শক্তভাবে প্রতিরক্ষামূলক অভিযান চালিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা প্রমাণ করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে (টুইটার) এক পোস্টে এসব তথ্য জানিয়েছে যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়।’
রাশিয়া প্রতিরক্ষায় শুধু সক্ষমই নয় তারা এই যুদ্ধে সামান্য শক্তিই প্রয়োগ করেছে। এ তথ্য জানিয়েছে এই যুদ্ধের অন্যতম অনুঘটক খোদ যুক্তরাজ্য। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হবার পর থেকে পশ্চিমা প্রচার মাধ্যম তিন ধরনের প্রচারণাকে সামনে নিয়ে অগ্রসর হয়েছে। ১) রুশ বাহিনী বর্বরভাবে হামলা চালিয়েছে, সেখানে তারা ন্যূনতম মানবিকতা প্রদর্শন করেনি, ২)রাশিয়ার অবস্থা অত্যন্ত নাজুক, যেকোনো সময় অঘটন ঘটবে। কেননা ন্যাটো সমর্থিত ইউক্রেইন বাহিনীর সামনে তারা দাঁড়াতে পারছে না ইত্যাদি, ৩) পুতিন সম্পর্কেও তারা নেতিবাচক প্রচারণা চালিয়েছে। তাহলে এখন রাশিয়ার শক্তি, সক্ষমতা এলো কীভাবে? সবকিছু লেজে-গোবরে করে, বিশ্বকে ভুগিয়ে এখন তাদের এ কথা বলতে হচ্ছে।
গাজায় ইসরায়েলের ভয়াবহ হামলা ও নৃশংসতায় পশ্চিমা শক্তি পুতিনের কপালের প্রসন্নতা দেখছেন। মার্কিন ও পশ্চিমা শক্তির সর্বাত্মক নজিরবিহীন অবরোধও রাশিয়াকে এতটুকু দুর্বল করতে ও দমাতে পারেনি। বরং পশ্চিমা শক্তির মাস্তানি ও দৌরাত্ম্যের লাগাম টেনে ধরেছেন পুতিন। রাশিয়াকে শায়েস্তা করতে না পারার বেদনা কীভাবে তারা বহন করবে? এই অবস্থা মেনে নেয়া এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার মাতব্বরদের জন্য কঠিন। এখন গাজায় হামলা করে বিশ্ব মনোযোগ ভিন্ন দিকে নিয়ে নিজেদের সম্মান রক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সে কারণে পশ্চিমা শক্তি অস্ত্র, অর্থ দিয়ে তাদের মর্যাদা রক্ষায় মরিয়া হয়ে উঠেছে। বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা চ্যালেঞ্জের মুখ পড়ায় তারা অধিক বেপরোয়া হয়েছে।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন কয়েকটি আরব দেশ সফর করে ফের ইসরায়েল গেলেন। এই যুদ্ধ যেন ওই আঞ্চলে ছড়িয়ে না পড়ে সেই উদ্দেশ্যেই এই কূটনৈতিক ঝটিকা সফর। ব্লিনকেনের এই সফর মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি স্থাপন নয় বরং ইসরায়েলের অনৈতিক যুদ্ধের পক্ষে সমর্থন আদায় করা ও বৈধতা নেয়া। মুসলিম দেশগুলো যাতে কোনোভাবেই বিগড়ে না যায় সেই তৎপরতা চালানো। অন্যদিকে নেতানিয়াহু বারুদে ঠাসা জ্বলন্ত গাজায় পুরনো ছকেই হাঁটছেন।
মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে তাদের কেন উদ্বেগ? ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেন আমির আবদুল্লাহিয়ান বলেছেন, এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশ বন্দুকের ট্রিগারে আঙ্গুল বসিয়ে রেখেছে। ইতোমধ্যে গাজার হাসপাতালে আক্রমণ করে পাঁচশ মানুষকে হত্যার কারণে আরব দেশের নেতারা বাইডেনের সঙ্গে তাঁদের পূর্ব নির্ধারিত বৈঠক বাতিল করেছেন। উত্তেজনার পারদ ক্রমেই উপরে উঠছে।
ইসরায়েল ক্রমাগত হামলায় গাজাকে পোড়ামাটিতে পরিণত করেছে। বিশ্ব জনমতকে উপেক্ষা করে তারা আকাশ, স্থল, সমুদ্রপথে গাজায় সর্বাত্মক হামলা চালাচ্ছে। ক্রমেই জনশূন্য হয়ে পড়ছে গাজা। জাতিসংঘে নিযুক্ত ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত গিলাদ এরদান বলেছেন, ‘ইসরায়েলের গাজা দখলের কোনো আগ্রহ নেই’। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলছেন, ‘ইসরায়েলের গাজা দখল হবে ভুল সিদ্ধান্ত। তবে হামাসকে সম্পূর্ণ নির্মূল করতে হবে।’ বিষয়টা এমন যে, তাদেরকে মেরে-কেটে এমন অবস্থা করো যাতে কোনোরকম হৃদস্পন্দন থাকে।
গাজা থেকে হামাস নির্মূল হলে গাজাকে চালাবে কে? কেননা গাজায় ফিলিস্তিন সরকারের কোনো অস্তিত্ব নেই। ২০০৭ সাল থেকে হামাসই সেখানে ক্ষমতায় আছে। বাইডেনের মতে, সেখানে একটা ফিলিস্তিনি প্রশাসন দরকার। এত কিছু করার নেপথ্যের কারণ কি এটিই? কিন্তু তাদের বাদ দিয়ে কোনো কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করা হবে স্পষ্ট দখলদারিত্ব। মার্কিনিরা আগুনে বারুদের পাহাড় ঢেলে আগুন নেভানোর বালতিতে পানি সেচছেন।
আমেরিকায় এক ব্যক্তি এক ফিলিস্তিনি শিশুকে চাকু দিয়ে ২৬ বার আঘাত করে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। এই ঘটনা বিশ্বকে স্তম্ভিত করেছে। এ জন্য বাইডেন ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন কিন্তু সেই তিনিই সিএনএনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন হামাস ইসরায়েলের ৪০ জন শিশুর শিরোচ্ছেদ করে হত্যা করছে। সাংবাদিকরা যখন এই ঘটনার প্রমাণ দাবি করলেন, তখন তা দিতে না পেরে দুঃখ প্রকাশ করেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যক্তির এমন নেতিবাচক বক্তব্য ধর্মবিদ্বেষ ও উগ্রবাদকে প্ররোচিত করে। এমন প্রবণতাই মানুষকে উগ্র হতে, খুন করতে প্ররোচিত করে। এভাবেই তারা বর্ণবাদের বিষ ছড়াচ্ছে।
পশ্চিমা দেশগুলোতে ইসরায়েল ও ইহুদী বিরোধী তৎপরতা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সেখানে ইসরায়েলের পতাকা, প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর ছবি পোড়ানো বা পাড়ানো যাবে না। এগুলো করলে অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইসরায়েলের সমালোচনা করার কারণে কানাডার প্রাদেশিক পরিষদের একজন এমপিকে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করা হয়েছে। এয়ার কানাডার একজন পাইলটের তো চাকরিই চলে গেছে। আরও অনেকের বিরুদ্ধে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করা হয়েছে, শাস্তিমূলক ব্যবস্থার কথা শোনা যাচ্ছে। কিন্তু কানাডায় খালিস্তানপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ভারতের পতাকা পোড়ানো কোনো অপরাধ নয়! যা নিয়ে ভারতের সঙ্গে কানাডার কূটনৈতিক সম্পর্ক তলানিতে।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে যাঁরা ফিলিস্তিনপন্থি দৃষ্টিভঙ্গি লালন করেন, তাদের চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কালো তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। ফ্রান্স ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ নিষিদ্ধ করেছে। সে দেশে বসবাসকারী অন্য দেশের কেউ ইহুদী বিরোধী তৎপরতা চালালে তাকে বহিষ্কারের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। জার্মানিও অভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। ব্রিটেনের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুয়েলা ব্রেভারম্যান তো প্রকাশ্যেই বর্ণবাদী কথাবার্তাই বলছেন।
ব্রিটেনজুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে যে সভা-সমাবেশ হয়েছে বিবিসি তাকে হামাসের সমর্থনে বলে প্রচার করেছে। এর প্রতিবাদ হওয়ায় তারা এ জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছে। ইরাক, লিবিয়া আক্রমণের সময়ও তারা একইভাবে মিথ্যাচার করেছে। ইসরায়েলের গণহত্যাকে আত্মরক্ষা ও মানবিক রূপ দেয়ার চেষ্টা করছে। সংবাদ প্রচারে শব্দ চয়ন ও সংখ্যা নিয়েও আছে নানা কারসাজি। মিথ্যা ও বিভ্রান্তির পক্ষে সমর্থন উৎপাদনই তাদের প্রধান কাজ। এই হচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলোর মিডিয়া ও বাকস্বাধীনতার মানদণ্ড! যে মাধ্যমের সংবাদ আমাদের সকাল-দুপুর গিলতে হয় ও বিশ্বাস করতে হয়। যে কারণে তাদের কাছে ইউক্রেনের যুদ্ধ খুব ঠিক, সেই একই কারণে ফিলিস্তিনিদের যুদ্ধ-প্রতিরোধ বিরাট ভুল! কতটা অদ্ভুত ও স্ববিরোধী তাদের প্রোপাগান্ডা মেশিন এবং বিশ্ব রাজনীতির ব্যাকরণ!