উপাচার্যরা ‘এমন’ করছেন কেন

বেশ কয়েকজন শিক্ষক উপাচার্য হওয়ার পর তাদের বায়োডাটার যে চুম্বক অংশ গণমাধ্যমে দেখেছি, সেগুলোতে উল্লেখযোগ্য যে সংযুক্তি ছিল, তা হলো তারা ছাত্রজীবনে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন।

জোবাইদা নাসরীনজোবাইদা নাসরীন
Published : 18 May 2023, 12:48 PM
Updated : 18 May 2023, 12:48 PM

বেশ কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যগণ নানা অভিযোগে আলোচিত-সমালোচিত ও নিন্দিত হচ্ছেন। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলোর মধ্যে ধর্ষণের মতো অনৈতিকতা, শিক্ষক-কর্মকর্তা নিয়োগে ঘুষের লেনদেন, স্বজনপ্রীতি, বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতিসহ আরও নানা কিছু রয়েছে। এসব অভিযোগে বেশ কয়েকজন উপাচার্যের বিরুদ্ধে গঠিত হয়েছে তদন্ত কমিটি। তদন্ত হয়েছে, প্রতিবেদনও জমা হয়েছে। তবে কোথায় পাঠানো হয়েছে সেই তদন্ত প্রতিবেদনগুলো সেই বিষয়ে কোনো সংবাদ পাওয়া যায়নি।

উপাচার্যদের এই ধরনের কর্মকাণ্ডের প্রতি উষ্মা প্রকাশ করতে দেখা গেছে সাবেক রাষ্ট্রপতি মো.আব্দুল হামিদকেও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ সমাবর্তনে এসে উপাচার্যদের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ নিয়ে তিনি আক্ষেপ করেন। কিন্তু কোনো উপাচার্যের বিরুদ্ধেই কোনো ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের নজির নেই।

সাম্প্রতিক সময়ে আরও একটি ঘটনা আগের সমালোচনাগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে। আর সেটি হলো একজন উপাচার্যের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা হয়েছে। সহকর্মীর করা ধর্ষণ মামলায় খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মো. শহীদুর রহমান খানকে ইতোমধ্যে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী গত ১৩ মার্চ খুলনা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৩-এর কাছে উপাচার্যের বিরুদ্ধে মামলার আবেদন করেছিলেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নারী কর্মকর্তা।

এজাহারে অনুযায়ী, শহীদুর রহমান খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকার সময়ে বিয়ের কথা বলে ওই নারীকে একাধিকবার ধর্ষণ করেন। পরে আদালতে মামলা দায়ের করেন ওই নারী। উপাচার্যদের কারোর বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা এটিই প্রথম। এর আগে নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ধর্ষণের বিরুদ্ধে তদন্ত করে দুর্নীতি দমন কমিশন। উপাচার্যের বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলা এবং তাকে কারাগারে পাঠানো নিয়ে যখন তীব্র আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে তখনই আবারও আলোচনায় এলেন আরও দুজন উপাচার্য। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী এই দুই উপাচার্য বিশেষ পদ্ধতিতে নিজেদের কন্যাদের দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দিয়েছেন। যৌথ অঙ্গীকারের মাধ্যমে তারা অনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে, যোগ্য প্রার্থীদের বাদ দিয়ে একজন অন্যজনের কন্যাকে নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে অপরের বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। ভেবেছিলেন নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দিলে এগুলো নিয়ে হৈ চৈ হবে, কথা ওঠবে। কিন্তু এতোকিছু করেও পার পাননি। খবর বের হয়েছে। সমালোচিত হয়েছেন।

উপাচার্যরা তো বটেই, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সন্তানরা প্রতিযোগিতামূলক যোগ্যতায় ঘাটতি থাকার পরও বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পাওয়ার ঘটনা নতুন কিছু নয়।

নিয়োগের ক্ষেত্রে আত্মীয়তার পরিসরকে প্রশস্ত করেছেন উপাচার্যরাই। তাই এখন আর শুধুমাত্র পুত্র-কন্যা নয়, ভাই-বোন, শ্যালক, শ্যালিকা এবং চাচাতো ভাইবোনসহ অন্যান্য আত্মীয় স্বজনকে নিয়োগে এগিয়ে আছেন বেশ কয়েকজন উপাচার্য। পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম সেখ তার শ্যালক, দুই ভাই, স্ত্রীর ফুফাতো ভাই, চাচাতো বোনকে তো নিয়োগ দিয়েছেনই, সেই সঙ্গে তিনি গৃহকর্মী এবং তার স্বামীসহ আরও অনেককেই কর্মকর্তা-কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন।

মাওলানা ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উপাচার্যের বিরুদ্ধে দুদকে মামলা হয়েছিল। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের যৌথ আন্দোলনও জাতি দেখেছে।

এর বাইরে অথনৈতিক দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগে গত এক দশকে প্রায় বিশটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে এবং নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে এগুলো নিয়ে আন্দোলনও হয়েছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো গত বছরেই ১৮টি বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এবং দুদকের তদন্তের অধীনে এসেছে। তবে এর মধ্যে ১২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে এবং ১৩ টির বিষয়ে ইতোমধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা হয়েছে। কিন্তু সেগুলোর কী হলো কেউ জানে না।

গত কয়েকবছর ধরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছে, পরে বিভিন্ন আশ্বাসের ভিত্ততে আন্দোলন দমানো গেছে, কিন্তু কোনো উপাচার্যের বিরুদ্ধেই কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বর্তমান বাংলাদেশে ৫২টি পাবলিক এবং সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই্ এখন পর্যন্ত সহ-উপাচার্য এবং ট্রেজারার নিয়োগ দেয়া হয়নি। তাই চলছে অনেক ‘ভারী’ তদবির। সরকারি দল সমর্থক শিক্ষকরা ক্ষমতার জায়গা যেতে চান। সবাইকে এখন ‘কিছু না কিছু’ পেতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন নীল (আওয়ামী লীগ সমর্থক) দলের সভা একটি বড় কক্ষে স্থান সংকুলান হয় না। অথচ দল ক্ষমতায় না থাকলে এই সংখ্যা ৩০-এর কোটায় নেমে আসে। এখন বেশিরভাগ শিক্ষকই নীল। কে কত বেশি নীল, কার বাড়ি কোথায় কিংবা কার বাড়ির কাছাকাছি সেটি প্রমাণেরই চেষ্টা চলে। এই প্রতিযোগিতার মূল উদ্দেশ্য থাকে পদ পাওয়া এবং ক্ষমতার জায়গায় যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা।

এখন প্রশ্ন হলো কীভাবে শিক্ষকরা উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান? এই নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পর্কে হয়তো সবাই আমরা কম বেশি জানি। কিন্তু মজার বিষয় হলো, বেশ কয়েকজন উপাচার্য এবং সহ-উপাচার্যকে জানি যারা নিয়োগ পাওয়ার পর এমন ভাব করেছেন যে, তারা এই বিষয়ে কিছুই জানতেন না, পত্র পেয়েই জানতে পেরেছেন যে তাদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। যেহেতু সরকার চেয়েছেন তাই আর না করতে পারেননি। এখন এটিও যদি সত্যি হয় তাহলে সরকার কী কী বৈশিষ্ট্যকে প্রাধান্য দিয়ে উপাচার্য নিয়োগ দেন?

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এখানে না দিলেই নয়, বেশ কয়েকজন শিক্ষক উপাচার্য হওয়ার পর তাদের বায়োডাটার যে চুম্বক অংশ গণমাধ্যমে দেখেছি, সেগুলোতে উল্লেখযোগ্য যে সংযুক্তি ছিল, তা হলো তারা ছাত্রজীবনে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। কেউ কেউ আবার গুরুত্বপূর্ণ পদেও ছিলেন। এই ধরনের আলামত স্পষ্টতই বোঝা যায় কে কী যোগ্যতায় উপাচার্য হচ্ছেন এবং কেন তারা উপাচার্য হওয়ার পর এতো সব করছেন?

তাহলে যারা উপাচার্য নিয়োগ দেন তারাই কেন সেই উপাচার্যদের জন্য শিক্ষা ব্যবস্থা ধসে পড়ছে বলে আহাজারি করবেন? তারাই তবে কেন এই ধরনের মানুষদের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেবেন? আভিযোগ ওঠার পরও উপাচার্যদের নিয়োগ বাতিল হয় না কেন? কারো কি শাস্তি হয়েছে? হয়নি। বরং কেউ কেউ আরও ক্ষমতাবান হয়েছেন। তাহলে এসব আহাজারির মানে কী?