Published : 09 Jan 2024, 12:30 PM
শেষ পর্যন্ত ভালোয় ভালোয় দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন শেষ হয়েছে। এই নির্বাচনকে বিএনপি এবং নুর-সাকিরা প্রত্যাখ্যান করলেও নতুন সরকার গঠনের প্রস্তুতি চলছে। দেশ-বিদেশের পর্যবেক্ষকরা নির্বাচনের প্রশংসা করছে। পাশাপাশি নির্বাচন নিয়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভ-সমালোচনা, আত্মপ্রসাদ, যা হয়েছে, তা যে ভালো হয়েছে-এর যৌক্তিকতা নিরূপণ, এ নির্বাচনের ভালো-মন্দের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ইত্যাদিও সমানতালে চলছে। হয়তো আরও কিছুদিন চলবে।
এবারের নির্বাচন নিয়ে সবচেয়ে বড় সমালোচনা হচ্ছে, এ নির্বাচনে মানুষের বিকল্প রাজনৈতিক দল বা শাসক বেছে নেবার কোনো সুযোগ ছিল না। আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররাই কেবল এবারের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। এই নির্বাচন অনেকটা ‘আমরা আর মামুরা’-র নির্বাচন। যদি আওয়ামী লীগকে কারও ভালো না লাগে, তা হলে তাদের বদলে অন্য কাউকে বেছে নেওয়ার সুযোগ এ নির্বাচনে ছিল না। অথচ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শাসক পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হচ্ছে নির্বাচন। এ নির্বাচনে শাসক পরিবর্তনের কোনো সুযোগ ছিল না। হয় নৌকা মার্কার আওয়ামী লীগকে ভোট দাও। না হলে স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের ভোট দাও। এর বাইরে অন্য কোনো কিছু করার সুযোগ ছিল না বললেই চলে।
এটা অবশ্যই একটা প্রহসনের ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থা মেনে নেওয়া কোনো আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মানুষের পক্ষে আসলেই কঠিন। এ তো গেল নির্বাচনের একটা দিক। তবে নির্বাচনের আরেকটি দিকও কিন্তু আছে। নির্বাচনে শুধু আওয়ামী লীগই ছিল না। ছিল আরও ২৭টি রাজনৈতিক দল। আওয়ামী লীগ যদি খুব খারাপ হয়ে থাকে, তাহলে তো ভিন্ন দলগুলোর কিছু আসন পাবার কথা ছিল। আওয়ামী লীগের বাইরে এবারের নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ২৬৫ জন, জাকের পার্টি ২১ জন, তৃণমূল বিএনপি ১৩৫ জন, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি ১২২ জন, বাংলাদেশ কংগ্রেস ৯৬ জন, জাসদ ৬৬ জন, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি ৭৯ জন, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট ৬৩ জন, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট-বিএনএফ ৪৫ জন, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-বিএনএম ৫৬ জন, বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশন ৩৮ জন, ইসলামী ঐক্যজোট ৪২ জন, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ ৩৯ জন, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট ৩৭ জন, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ৩০ জন, ওয়ার্কার্স পার্টি ২৬ জন, গণফ্রন্ট ২১ জন, জাতীয় পার্টি-জেপি ১৩ জন, কল্যাণ পার্টি ১৬ জন, খেলাফত আন্দোলন ১১ জন, বিকল্প ধারা বাংলাদেশ ১০ জন, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি ৫ জন, গণফোরাম ৯ জন, সাম্যবাদী দল ৪ জন, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ ৫ জন, মুসলিম লীগ-বিএমএল ৪ জন প্রার্থী দিয়েছে। তারা কেন ভোট পেল না? আওয়ামী লীগ বাদে যে ৪টি দল নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে— জাতীয় পার্টি ১১টি, জাসদ ১টি, ওয়ার্কাস পার্টি ১টি এবং কল্যাণ পার্টি ১টি।
নির্বাচনের আগে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেছিলেন, ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতি-দুঃশাসনে সাধারণ মানুষ খুবই ক্ষুব্ধ। তারা ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে ভোট দেয়ার জন্য মুখিয়ে আছে। এবার সারা দেশে জাতীয় পার্টিকে ভোট দিয়ে মানুষ নির্বাচিত করবে। চুন্নু সাহেবের কথা সত্যি হয়নি। মানুষ জাতীয় পার্টিকে বেছে নেয়নি। উল্টো আওয়ামী লীগের ‘কৃপায়’ তারা ১১টি আসন পেয়েছে।
অনেকে হয়তো বলবেন, এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ছাড়া যে দলগুলো অংশগ্রহণ করেছে, তারা আওয়ামী লীগের ‘দালাল’। এরা নামকাওয়াস্তে রাজনৈতিক দল। এদের কোনো আদর্শ নেই, নীতি নেই, ভোট নেই। জনসমর্থন নেই। কাজেই তাদের ভোট পাবার প্রশ্নই ওঠে না।
উল্লিখিত যুক্তিও একেবারে অসত্য নয়। এই বক্তব্যকে কবুল করে এবার নির্বাচন বর্জনকারী দলগুলোর কথা একটু আলোচনা করা যাক। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন মতে, কাগজে-কলমে ৬২টি রাজনৈতিক দল এবারের নির্বাচন বর্জন করেছে। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর মধ্যে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি ছাড়া যেমন অন্য কোনো দলের তেমন জনসমর্থন ও ভোট নেই, নির্বাচন বর্জনকারী দলগুলোর মধ্যেও বিএনপি ও জামায়াত ছাড়া অন্য দলগুলোর তেমন কোনো জনসমর্থন নেই। ‘তত্ত্বাবধায়ক’ সরকারের দাবি মেনে আওয়ামী লীগ যদি বিএনপি-জামায়াত ও তার মিত্রদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দিত, তাহলে আওয়ামী লীগের পরিবর্তে হয়তো বিএনপি-জামায়াত সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করত। আওয়ামী লীগের পরিবর্তে বিএনপি-জামায়াতের শাসন আমরা দেখতে পেতাম। এইটুকু পার্থক্য ছাড়া ভিন্ন কিছু ঘটার সম্ভাবনা ছিল না।
প্রশ্ন হলো, বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এলেই কি গণতন্ত্র ফিরে আসত? ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি জামায়াতের দুঃশাসনের স্মৃতি কি হারিয়ে গেছে? বিএনপি-জামায়াতের সেই সময়টা ছিল জঙ্গিবাদ, খুন, হত্যা, সন্ত্রাসের শাসন। নজিরবিহীন সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস, এক যোগে ৬৩ জেলায় বোমা হামলা, আওয়ামী নেতৃত্বকে নিশ্চিহ্ন করতে ২১ অগাস্টের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা, ১০ ট্রাক অস্ত্রের চোরাচালান, আদালতে জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের দ্বারা বিচারক হত্যা, আহসানউল্লাহ মাস্টার, শাহ এমএস কিবরিয়া, মঞ্জুরুল ইমামসহ জনপ্রিয় নেতাদের গুলি করে হত্যা, তারেক-মামুন-বাবর গংদের ‘হাওয়া ভবন’ নামে প্যারালাল সরকার পরিচালনা কেন্দ্র গঠন, দুর্নীতি-চাঁদাবাজ-লুটপাটের মহোৎসবের কথা কী ভোলা যায়? পূর্ণিমা-ফাহিমা-মহিমাদের হৃদয়বিদারক কান্নার আওয়াজ এখনো বাতাসে ভেসে বেড়ায়। এমন বিএনপিকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করার সুযোগ সৃষ্টিই কী গণতন্ত্র?
যে আওয়ামী লীগকে গ্রেনেড মেরে বিএনপি নেতৃত্ব নিঃশেষ করতে চেয়েছিল, ছলে-বলে-কৌশলে সেই বিএনপিকে আওয়ামী লীগ নির্বাচনের মাঠ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাইবে, এটা কি রাজনৈতিকভাবে অনৈতিক? যে দলের প্রধান দুই ব্যক্তি আদালত-কর্তৃক দণ্ডিত, তারাই যদি নেতৃত্বের আসন আঁকড়ে থাকে, ভার্চুয়াল মাধ্যমে দল চালায়, তাদের সমর্থন করার কোনো যুক্তি আছে কী?
জামায়াত-বিএনপির বাইরে যেসব দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে প্রাণপাত করছে, তাদের আসলে আত্মজিজ্ঞাসা করা দরকার। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে আপনাদের কী লাভ? আপনারা কী একটি আসনেও বিজয়ী হতে পারবেন? তাহলে আওয়ামী লীগের বদলে বিএনপি-জামায়াতকে ক্ষমতায় আনার জন্যই কি আপনাদের আন্দোলন? তাতে আপনাদের কী লাভ? বিএনপি ক্ষমতায় এলে আওয়ামী লীগের চেয়েও ভয়াবহ দুঃশাসন যে আসবে না, এর নিশ্চয়তা কোথায়?
‘জনগণ তাদের নেতা বেছে নেবে, কেউ যদি খারাপ হয়, সাধারণ মানুষ যদি সেই খারাপটাকেই বেছে নেয়, তাহলে সেই সুযোগও থাকতে হবে। এটাই গণতন্ত্র। গণতন্ত্রের বিকল্প আরও আরও গণতন্ত্র।’ এসবই বুকিশ কথা। বাস্তবে আমরা কেউই এমন গণতান্ত্রিক নই। এমন গণতন্ত্রের অস্তিত্ব দুনিয়ার কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
আসলে আমাদের সামনে কোনো যোগ্য বিকল্প তৈরি হচ্ছে না। আমরা আওয়ামী লীগ-বিএনপির মধ্যেই কেবল ঘুরপাক খাচ্ছি। কে কার চেয়ে বেশি খারাপ, সেই তুলনাতেই আবদ্ধ হয়ে পড়েছি। খারাপের দাপটে ভালোরা বিকশিত হচ্ছে না। সংঘবদ্ধ হতে পারছে না। প্রগতিপন্থীরা বলেন, কালো টাকা, পেশিশক্তি, অর্থ-অস্ত্র-ক্ষমতা-দাপট বর্তমান নির্বাচন ব্যবস্থাকে গ্রাস করেছে। এ ব্যবস্থা না বদলালে নির্বাচনে ভালো মানুষ, টাকাহীন সৎ মানুষ কখনই জিততে পারবে না। কথাটা একশভাগ সত্যি। কিন্তু এই ব্যবস্থাটা কে বদলাবে? আওয়ামী লীগ-বিএনপির কাছে এই দাবি জানিয়ে লাভ আছে? তাদের কী দায় এই ব্যবস্থা বদলিয়ে ভিখারী সাজার?
খারাপ মুদ্রা নাকি ভালো মুদ্রাকে বাজার থেকে তাড়িয়ে দেয়। আমাদের রাজনীতিতেও খারাপ মানুষগুলো ভালো মানুষদের তাড়িয়ে দিচ্ছে। এই প্রবণতা এতটাই শক্তিশালী যে এখন ভালোকে আর খুঁজেই পাওয়া যায় না। সন্ধান করতে হয়, একটু খারাপ, তুলনামূলকভাবে কম খারাপ!
আমাদের দশা সেই কবিতায় বর্ণিত গরিবগঞ্জের মানুষগুলোর মতো। কবির বর্ণনা মতে, গরিবগঞ্জের মানুষগুলো গরিব। কারণ সেখানে চাকা নেই, মানে কলকারখানা নেই। চাকা নেই, তাই টাকা নেই। আর টাকা নেই, তাই চাকা নেই!
আমাদের রাজনীতিতে শুভ নেই। শুভ রাজনীতি নেই বলে ভালো রাজনীতি বিকশিত হচ্ছে না। ভালো রাজনীতি বিকশিত হচ্ছে না বলে খারাপ রাজনীতি দূর হচ্ছে না। এক দুষ্টচক্রে আটকা পড়ে গেছি আমরা। একনায়কতন্ত্র বনাম দস্যুতা। বিএনপিবিহীন একতরফা নির্বাচন, না হয় তো বিএনপি-জামায়াতের দুঃশাসন কায়েমের নির্বাচন। এর বাইরে যাবার কোনো পথ নেই। নবম, দশম, একাদশ, দ্বাদশ, ত্রয়োদশ— এভাবে একের পর এক নির্বাচন হয়েই যাবে, একজন ‘নষ্ট মানুষ’ লন্ডনে বসে অর্থহীন, অকার্যকর আন্দোলনের ডাক দিয়েই যাবে, গায়ের জোরে একটি দল নিজের পছন্দের নির্বাচন করেই যাবে, একদল মানুষ ভোট দিয়ে ফেসবুকে আঙুলের অমোচনীয় কালির দাগ প্রদর্শন করবে, নিরাপদ দূরত্বে বসবাসকারী আরেক দল মানুষ তাদের আওয়ামী লীগের দাস, পদলেহনকারী বলে চিহ্নিত করবে, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের পথ কিছুতেই রচিত হবে না!
কারণ? সেই কবিতার মতো, আমাদের চাকা নেই। চাকা নেই, বলে টাকা নেই। টাকা নেই, তাই চাকাও নেই...!