দেশের বাণিজ্যিক রাজধানীতে দিনেদুপুরে চুরি-ডাকাতি, পাহাড় কেটে ফেলা এসবের পেছনে রাজনীতি রয়েছে। রাজনীতিকরা জেনেও চুপ থাকেন। কারণ এসব কাজের পেছনে আছে তাদের বাহিনী।
Published : 10 Aug 2023, 01:40 AM
চট্টগ্রাম শহরসহ আরও কয়েকটি জেলার মানুষ কার্যত পানিবন্দী। এটা এখন সকলেরই জানা। একটু বর্ষার তাণ্ডব বা ভারী বর্ষণ হলেই শহরের রাস্তাঘাট ডুবে যায়। মানুষ এমনই অভ্যস্ত হয়ে গেছে যে আজকাল এসব খবর কারও কানে ঢুকলেও নড়েচড়ে ওঠে না। কারণ? মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব খবরের কদর কম। বিকোয় না। তারচেয়ে দরকার জনগণের রেটিং বা টিআরপি। এর মান বা সংখ্যা বাড়াতে হলে হিরো আলমের ডিবি অফিসের খাওয়া-দাওয়া বা রিজভীর বিরুদ্ধে মানহানির মামলা সামনে আনা জরুরি। তাতে টানটান উত্তেজনা আছে।
চট্টগ্রাম দেশের দ্বিতীয় বৃ্হত্তম নগরী। আমি জন্মসূত্রে এর যতটুকু জানি বা দেখেছি আমাদের প্রিয় শহরটি কখনো ন্যায্য সম্মানের আসন পায়নি। এমন না যে এর মাটিতে মেধার জন্ম হয় না, বরং একটু বেশিই হয়। কিন্তু জাতীয় রাজনীতির মারপ্যাঁচে এতবড় বিশাল নগরীর কোনো মানুষ এখন পর্যন্ত দেশের রাষ্ট্রপতি হতে পারেননি। এমন অনেক বঞ্চনা আর হতাশা বুকে ধারণ করেও আমরা দেশের সবচেয়ে বেশি রাজস্ব দাতাদের অন্যতম। একদা সূর্য সেন বা স্বাধীনতা যুদ্ধের মহান নেতাদের বীরত্ব কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। যে কারণে দুঃখের বাইরে প্রতিবাদও নেই।
টানা বৃষ্টি, উজান থেকে নামা ঢল এবং জোয়ারে চট্টগ্রাম ও বান্দরবানের বন্যা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হয়েছে। এই মুহূর্তে দুই জেলায় পানিবন্দি অন্তত সাড়ে ছয় লাখ মানুষ খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে ভুগছেন। বিদ্যুতের অভাবে টেলিযোগাযোগ এবং পানির কারণে সড়ক যোগাযোগ উভয়ই ব্যাহত হচ্ছিল, এখনও হচ্ছে।
পার্বত্য জেলা বান্দরবান সারাদেশ থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সাঙ্গু নদীর তীরবর্তী অধিকাংশ ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে। জেলা শহরের কোথাও কোথাও জমেছে বুকসমান পানি। গত কয়েক দিন ধরে বান্দরবানের বিভিন্ন এলাকায় বিদ্যুৎ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই। অন্যদিকে টানা ভারি বৃষ্টিপাত আর পাহাড়ি ঢলে চট্টগ্রামের আট উপজেলার ৩০০ স্থানে বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে জেলার বিভিন্ন এলাকার প্রায় লাখো গ্রাহক বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় রয়েছেন।
কী কারণে বারবার চট্টগ্রাম ডুবে যায়? চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা নিয়ে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সর্বশেষ সমন্বয় সভা হয় গত বছরের ২২ জুন। এর পর আর কোনো সমন্বয় সভা হয়নি। চট্টগ্রামের সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী নগরীতে জলাবদ্ধতার জন্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) অদূরদর্শিতাকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, “নগরের বিভিন্ন খালের মুখে বাঁধ দিয়েছে সিডিএ। বাঁধগুলো বর্ষার আগে সরিয়ে ফেলতে তাদের অনেকবার তাগাদা দেওয়া হয়েছে। সময়ও বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা ঠিকমতো তা করছে না। প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে যথাযথভাবে সমীক্ষাও করেনি সিডিএ। প্রকল্পের নানা ধাপে ত্রুটি থাকায় এখন সমস্যা হচ্ছে।”
তবে সিডিএ চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ বলেন, “জলাবদ্ধতা নিরসনের মূল প্রকল্প সিডিএ বাস্তবায়ন করলেও সিটি করপোরেশনের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। নালা-নর্দমা পরিষ্কার করার দায়িত্ব তাদের। তারা যদি এটা না করে তাহলে জলাবদ্ধতা কমবে না।”
চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে সব পক্ষকে নিয়ে কয়েক দফা বৈঠক করেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। বিভাগীয় কমিশনারকে প্রধান এবং সিটি মেয়র ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানকে উপদেষ্টা করে একটি তদারকি কমিটিও গঠন করে দেওয়া হয়। কমিটি প্রতি মাসে প্রকল্পের কার্যক্রম ও অগ্রগতি পর্যালোচনা করে প্রতিবেদন দেওয়ার কথা। কিন্তু সে কাজটিও হচ্ছে না। প্রায় এক বছর সমন্বয় সভা না হওয়া সেটাই প্রমাণ করে।
একদিকে সরকারি কাজের সমন্বয়হীনতা অন্যদিকে রাজনীতির একপেশে ব্যর্থতা। এমন না যে বিএনপি বা এরশাদ আমলে পানি জমত না। যৌবনে এমন পরিস্থিতি সামলে অফিস আদালতে যেতাম। ধারণা ছিল একদিন এর অবসান হবে। অবসান হয়েছে, তবে আশার অবসান। দেশ এগিয়েছে। বাজারে যতই আগুন থাক, দেশ এগুচ্ছে কিন্তু শহর ডুবে যাচ্ছে। যেসব ভয়াবহ ছবি দেখছি এবং খবর জানছি তাতে কোনো আশার চিহ্ন নেই। খুব বেশিদিনের কথা না, পরিচিত জামাল খান এলাকায় এমন বৃষ্টির পানিতে ভেসে যাওয়া এক মানুষের লাশ মিলেছিল আরেকটি নালার পানিতে। তবু কারো হুঁশ হয়নি।
খবরে দেখলাম, খাতুনগঞ্জ-চাকতাই এলাকার বেশ কিছু আড়তে দুই অগাস্টের বৃষ্টিতে কয়েকশ’ দোকানে পানি ঢুকেছিল। এ সময় কমপক্ষে পাঁচ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেছেন আড়তদার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. আবুল কাসেম। তিনি বলেন, “চাকতাই-খাতুনগঞ্জে খালের মুখে স্লুইচ গেট নির্মাণ করেছে সিডিএ। এ কারণে জোয়ারে এবার পানি প্রবেশ করতে পারেনি। বেচা-কেনা নেই বললেই চলে। জলাবদ্ধতার কারণে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় পণ্য আনা-নেওয়া করা যাচ্ছে না, যে কারণে ব্যবসায় স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।”
রিয়াজুদ্দিন বাজার বণিক সমিতির যুগ্ম সম্পাদক আবদুল শুক্কুর বলেন, “জলাবদ্ধতায় রিয়াজুদ্দিন বাজারে এবার ২০০ থেকে ২৫০টি দোকানের পণ্য নষ্ট হয়েছে। তবে এতে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা এখনও নিরূপণ করা যায়নি। কাজ চলছে। জলাবদ্ধতার কারণে চার দিন ধরে এই বাজারে দোকানপাট খোলা যাচ্ছে না।” তিনি আরও জানান, এবারই প্রথম রিয়াজুদ্দিন বাজারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকেছে। আগে কখনও পানি না ঢোকায় দোকানিরা সেভাবে প্রস্তুতও ছিলেন না, যে কারণে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছে। এখানে কাপড়ের দোকান, সুপারির গুদাম, আচারের দোকানসহ বিভিন্ন পণ্যের দোকান পানিতে তলিয়ে গেছে। উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে ১১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে চলছে চারটি প্রকল্পের কাজ। এসব প্রকল্পের কাজ শেষ পর্যায়ে হলেও মিলছে না কোনো সুফল। বরং দিন দিন বাড়ছে জলাবদ্ধতার সমস্যা।
সমস্যা যত বাড়ছে তাতে একটা বিষয় প্রকাশ্য হয়ে পড়ছে। আমাদের দেশের যে কোনো সমস্যার মূল কারণ নেতা আর নেতৃত্বের অভাব। হ্যাঁ, জলাবদ্ধতার কারণও এই। একজন নেতা বা জনপ্রতিনিধি যখন ভোটে জিতে আসেন তখন তার মনে আগামীবারের জন্য ভয় থাকে। এখন এই ভয়টা লোপাট হয়ে গেছে। ফলে নেতা চেষ্টা করেন হয়তোবা, তবে ভয়হীন আর জবাবদিহিতাবিহীন সে চেষ্টা অনেকটাই দায়সারা গোছের। যে কারণে এবারের এই ভয়াবহ পরিস্থিতিরও দায় নিতে আগ্রহী নয় কেউ। নিলে আমরা নিশ্চয়ই তাদের রাস্তায় পেতাম। তাদের অসহায়ত্বের কারণ জানতাম। সে আশায় কোনো লাভ নাই। তাহলে উপায় কী?
পাহাড় কেটে, বন উজাড় করে, পাথর চুরি করে দেশ ও জনগণকে ঠকালে প্রকৃতি কি তা চোখ বন্ধ করে সহ্য করবে? এখানেই আমাদের সমস্যার আসল উৎস। দেশের বাণিজ্যিক রাজধানীতে দিনেদুপুরে চুরি-ডাকাতি, পাহাড় কেটে ফেলা এসবের পেছনে রাজনীতি রয়েছে। রাজনীতিকরা জেনেও চুপ থাকেন। কারণ এসব কাজের পেছনে আছে তাদের বাহিনী। বাহিনীনির্ভর রাজনীতির মুখে কুলুপ, হাতে হাতকড়া থাকবেই। তার মুখ খোলা নিষেধ। এই নীরবতার ভেতরেই বেড়ে উঠেছে দানব। যাকে এখন আর সামলানোর শক্তি নেই।
আচ্ছা এই যে পানিবন্দী মানুষ, পানিতে ডুবে যাওয়া পথঘাটে যানবাহন থেকে ছিটকে পড়া জলের মানুষ। এরপরও কি আমরা বলতে পারি, না সব ঠিক আছে? এই ছবি, এইসব ঘটনা কি আমাদের ভেতরের দেউলিয়াত্বের প্রকাশ নয়? এটা যাদের বোঝার তারা যদি না বোঝেন তাহলে কাজ হবে না। সাধারণ মানুষ ভুগবে, ভুগে আবার জীবন পার করবে এটাই নিয়তি। কিন্তু যাদের কাজ এর প্রকোপ কমানো তারা সজাগ না হলে লাভ নেই। সে পথ কি আসলেই খোলা আছে আর? নাকি এভাবেই সিঙ্গাপুর হতে চাই আমরা?
চট্টগ্রাম ভালো নেই। তার পরিচর্যা দরকার। জাতীয় পর্যায়ে চট্টগ্রামের কদর ও তার প্রতি যত্নবান হবার সময় শেষ হয়ে আসছে। সেটাও মাথায় রাখা দরকার।