চৌর্যবৃত্তির মামলায় ট্রাম্পকে জেলের হ্যামবার্গার খেতে হতে পারে

যুক্তরাষ্ট্রে ১৯১৭ সালে প্রণীত গুপ্তচর আইনের (Espionage Act of 1917) ৭৯৩ ধারা মোতাবেক, জাতীয় নিরাপত্তাজনিত নথিপত্রের অননুমোদিত ধারণ গুরুতর অপরাধ। এই অপরাধের সর্বোচ্চ সাজা ১০ বছরের জেল।

মোস্তফা সারওয়ারমোস্তফা সারওয়ার
Published : 6 June 2023, 03:17 PM
Updated : 6 June 2023, 03:17 PM

২০২১ সালের ২০ জানুয়ারি বাইডেনের অভিষেক অনুষ্ঠানের আগে ভারাক্রান্ত ও ক্রুদ্ধ হৃদয়ে ট্রাম্পকে হোয়াইট হাউস ছাড়তে হয়েছিল। প্রেসিডেন্টসিয়াল রেকর্ড অ্যাক্ট অনুযায়ী,প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন সকল সরকারি নথিপত্রকে গণ্য করা হয় যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকারের সম্পত্তি হিসেবে এবং এই নথিপত্রগুলো যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল আর্কাইভ অ্যান্ড রেকর্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অথবা নারা (National Archive and Record Administration or NARA)-এর কাছে জমা দিতে হয়। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প ব্যক্তিগত জিনিসপত্রের সঙ্গে অনেক সরকারি নথিপত্র ফ্লোরিডার পাম-বিচে অবস্থিত গলফ রিসোর্ট ‘মার এ লাগো’র নিজ বাসভবনে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। 

মে মাস নাগাদ ন্যাশনাল আর্কাইভ অ্যান্ড রেকর্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের পর্যালোচকরা বুঝতে পারল তাদের কাছে সকল সরকারি নথিপত্র জমা দেওয়া হয়নি। দুটো বহুল পরিচিত জিনিসের হদিস মিলছে না। একটি হল 'প্রেমপত্র' নামে পরিচিত ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে পাঠানো উত্তর কোরিয়ার একনায়ক কিম জং উনের চিঠি।  অপরটি হল 'হারিকেন ডরিয়ান' নামে এক ভয়ানক সামুদ্রিক ঝড়ের সম্ভাব্য গতি পথের ম্যাপ। অভিযোগ রয়েছে ট্রাম্প একটি শার্পি কলমের কালো কালির লাইন এঁকে ডরিয়ান ঝড়ের গতি পথ (ট্র্যাকিং) তাঁর ইচ্ছে মতো পরিবর্তন করেছিল। ট্র্যাকিং ম্যাপে শার্পি দ্বারা বক্ররেখা এঁকে দেখানো হচ্ছিল হারিকেন ডরিয়ান ধাবিত হবে অ্যালাব্যামা স্টেটের দিকে। কিন্তু ডরিয়ান ছিল অনেক পূর্বদিকে বাহামা দ্বীপের কাছাকাছি এবং সেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বতীরের মোটামুটি সমান্তরাল পথে কয়েক মাইল দূরত্ব রেখে আটলান্টিক মহাসাগরের উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল উত্তর ক্যারোলিনা স্টেটে। শার্পি দ্বারা এই ট্র্যাকিং পরিবর্তনের আগে অ্যালাব্যামার উপর দিয়ে ডরিয়ান বয়ে যাবে, এমনি এক ভুল তথ্য দিয়েছিলেন বাচাল-অর্বাচীন ট্রাম্প। পরে সেটার বৈধতা দেওয়ার জন্য শার্পির আঁকে ট্র্যাকিং ম্যাপ পরিবর্তন করেছিলেন— যেটা আইনত অপরাধ। অসৎ ট্রাম্পের কাছে মিথ্যে বলা, আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো, ইত্যাদি, গর্হিত কাজ যেন ছেলের হাতের মোয়া।  প্রসঙ্গত, যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাপ সম্পর্কে ট্রাম্পের জ্ঞান খুবই সীমিত। শার্পি দিয়ে ডরিয়ানের ট্র্যাকিং ম্যাপ পরিবর্তন বিশ্বজুড়ে হাসি ও কৌতুকের খোরাক হয়েছিল।

অদৃষ্টের পরিহাস, এই শার্পি দিয়ে পরিবর্তিত হারিকেন ডরিয়ানের ট্র্যাকিং ম্যাপটি অবশেষে ট্রাম্পের কাল হয়ে দাঁড়াল। ন্যাশনাল আর্কাইভ অ্যান্ড রেকর্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অথবা নারার কর্মকর্তারা ট্র্যাকিং ম্যাপটি  ট্রাম্পের জমা দেওয়া নথিপত্রের মধ্যে খোঁজ করছিল। তন্ন তন্ন করে খুঁজেও ম্যাপটির টিকিটিও পাওয়া গেল না। তারা বুঝতে পারল প্রেসিডেন্টসিয়াল রেকর্ডের সব কিছু ট্রাম্প ফেরত দেননি। 

কেঁচো খুঁজতে গিয়ে সাপ বেরিয়ে পড়ল। ন্যাশনাল আর্কাইভ অ্যান্ড রেকর্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ২০২১ সালের মে মাসে যোগাযোগ করলো ট্রাম্পের কৌসুলিকে। একটি হলফ-নামা পাঠিয়ে অনুরোধ করলো সব রেকর্ড যথাযথ হস্তান্তরের জন্য। বারবার অনুরোধ করা হল। ছ' মাস পরে ওই বছর ডিসেম্বরে ট্রাম্পের প্রতিনিধি জানালেন ট্রাম্পের কাছে রয়েছে আরও ১২ টি বাক্স বোঝাই সরকারি নথিপত্র এবং সেগুলো অচিরেই আর্কাইভে পাঠানো হবে।

২০২২ সালের ১৮ জানুয়ারি ন্যাশনাল আর্কাইভ অ্যান্ড রেকর্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ট্রাম্পের কাছ থেকে ১৫টি নথিপত্র বোঝাই বাক্স পেল। পরে দেখা গেল ১৪ টি বাক্সে রয়েছে গোপন শ্রেণীবিভাগ করা হয়েছে এমন (classified) সব নথিপত্র। ক্লাসিফাইড নথিপত্রের সঙ্গে মিশে আছে খবরের কাগজ, ছবি ও ব্যক্তিগত চিঠিপত্র। যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী, গোপন শ্রেণীবিভাগ করা নথিপত্র বিশেষ বাক্সে অথবা ফোল্ডারে রাখার নিয়ম কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হয়। নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা রক্ষার সব ধরনের ব্যবস্থা মেনে চলা হয়। অতি গোপন নথি পত্র সব এফবিআই এজেন্টরা অথবা হোয়াইট হাউসের সকল কর্মকর্তারা পর্যন্ত দেখতে পারে না। দেখার জন্য প্রয়োজন হয় শীর্ষ ছাড়পত্র(top clearance)। 

ন্যাশনাল আর্কাইভ অ্যান্ড রেকর্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের বিশেষজ্ঞরা ট্রাম্পের পাঠানো বাক্সগুলোর নথিপত্র পরীক্ষার সময় দেখতে পেলেন কিছু নথিপত্রে রয়েছে বিশেষ চিহ্ন অথবা সংকেত। ওই সব নথিপত্রে বর্ণিত ছিল বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের নাম ঠিকানাসহ সম্পূর্ণ পরিচিতি, যারা গোপনে যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে নিজ দেশের গোপন তথ্য যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন গুপ্তচর সংস্থা যেমন সিআইএকে সরবরাহ করে থাকেন। এদের পরিচয় প্রকাশ হয়ে গেলে সমূহ বিপদ। তাদের হত্যা করা হতে পারে, এমন ধারণা পর্যন্ত উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সর্বোপরি, এমনি ঘটনা ঘটলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বিদেশী এজেন্টদের বিশ্বাসে ধ্স নামবে এবং এর ফলে পরাশক্তি হিসেবে তথ্য সংকট দেখা দিতে পারে।  

১৯১৭ সালে প্রণীত গুপ্তচর আইনের (Espionage Act of 1917) ৭৯৩ ধারা মোতাবেক, জাতীয় নিরাপত্তাজনিত নথিপত্রের অননুমোদিত ধারণ গুরুতর অপরাধ। এই অপরাধের সর্বোচ্চ সাজা হল ১০ বছরের জেল। প্রেসিডেন্টের মেয়াদ শেষ হলে এই গোপন নথিপত্র ধারণের অনুমোদন থাকে না। যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী ওই গোপন নথিপত্র এতদিন ধরে ট্রাম্পের বাড়িতে রেখে দেওয়া গুরুতর অপরাধ। অতএব, ন্যাশনাল আর্কাইভ অ্যান্ড রেকর্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের ডিরেক্টর নিয়ম মাফিক এই বিষয়টি জানালেন জাস্টিস ডিপার্টমেন্টকে। ২০২২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি তিনি জাস্টিস ডিপার্টমেন্টকে পাঠানো হলফ-নামায় লিখেছিলেন, সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হল অতি গোপনীয় নথিগুলো নির্ধারিত ফোল্ডার থেকে সরানো হয়েছে এবং অন্য নথি ও কাগজপত্রের সঙ্গে রাখা হয়েছে। যাতে গোপন নথিগুলো সঠিকভাবে খুঁজে পাওয়া কঠিন।

ন্যাশনাল আর্কাইভ অ্যান্ড রেকর্ড রেকর্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের বা নারার সুপারিশ পর্যালোচনা করে এফবিআই এই বিষয়টি তদন্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ২০২২ সালের ১২ এপ্রিল নারা ট্রাম্পকে জানিয়ে দিল যে জাস্টিস ডিপার্টমেন্টের অনুরোধ মোতাবেক ট্রাম্পের বাড়ি থেকে পাঠানো সব নথিপত্র এফবিআইকে হস্তান্তর করা হবে। মনে হল ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রমাদ গুনেছেন। তাঁর কৌঁসুলি এফবিআইকে হস্তান্তর করা বন্ধ করার জন্য উঠে পড়ে লাগলেন। 

২০২২ সালের ১১ মে জাস্টিস ডিপার্টমেন্ট আরও বাড়তি নথিপত্র দাখিলের জন্য ট্রাম্পকে সাপিনা (subpoena) জারি করল। এই সিদ্ধান্তের পেছনে হয়তো কারণ রয়েছে: সদা মিথ্যাবাদী বলে পরিচিত ট্রাম্পকে জাস্টিস ডিপার্টমেন্ট বিশ্বাস করতে পারেনি অথবা তাঁর বাসভবনে কোন ছুঁচা (mole) রয়েছে, যারা জাস্টিস ডিপার্টমেন্টকে জানিয়েছে বাড়তি নথিপত্র ট্রাম্পের বাড়িতে রাখা আছে। সাপিনা সূত্র ধরে প্রায় তিন সপ্তাহ পর ৩ জুন, তিন জন এফবিআই এজেন্ট ও একজন জাস্টিস ডিপার্টমেন্টের কৌঁসুলি হাজির হলেন ট্রাম্পের 'মার-এ-লাগো'র বাড়িতে। ট্রাম্পের কৌঁসুলির সঙ্গে আলাপ আলোচনার পরই তাঁরা গিয়েছিলেন বাড়তি নথিপত্র সংগ্রহের জন্য। ট্রাম্পের কৌঁসুলি তাঁদের হাতে ধরিয়ে দিলেন টেপ দিয়ে মোড়ানো একটি রেডওয়েল্ড (Redweld) খাম। খামে ছিল সব ধরনের গুরুতর গোপনীয় নথিপত্র। 

১৫টি নথিপত্রের বাক্স ন্যাশনাল আর্কাইভ অ্যান্ড রেকর্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের কাছে পাঠানোর পাঁচ মাস পর এবং ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেয়াদ শেষ হওয়ার দেড় বছর পর এতগুলো গোপন নথিপত্র কেন ট্রাম্পের বাড়িতে রয়েছে তার কোন ব্যাখ্যা দেননি ট্রাম্পের কৌঁসুলি। ট্রাম্পের কৌঁসুলি তাঁর দস্তখত করা একটি সার্টিফিকেট এফবিআই এজেন্টদের দিলেন যাতে লেখা ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের মালিকানাধীন আর কোনো নথিপত্র ট্রাম্পের বাড়িতে নেই। কিন্তু এফবিআই ও জাস্টিস ডিপার্টমেন্ট এটা বিশ্বাস করতে পারেনি। ট্রাম্পের বাসভবনে হয়ত তাঁরা এমন কোন আলামত দেখেছেন অথবা  ছুঁচারা খবর দিয়েছে, যার ফলে এক মাস যেতে না যেতেই ৫ অগাস্ট জাস্টিস ডিপার্টমেন্ট যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাজিষ্ট্রেট জজ 'ব্রুচ রাইনহার্টের কাছ থেকে ট্রাম্পের বাড়ি তল্লাশি এবং সরকারি নথিপত্র জব্দ (search and seizure) করার অনুমতি পেল। তিন দিন পর ৮ অগাস্ট এফবিআই ট্রাম্পের বাড়িতে হানা দিল। সে ছিল চলচ্চিত্রে দেখা যায়, এমনি এক রোমাঞ্চকর কাহিনির মত দৃশ্য। বিপুল সংখ্যক পুলিশ, এফবিআই ও শান্তি রক্ষা বাহিনী ট্রাম্পের বাড়ি ও সংলগ্ন এলাকা ঘেরাও করে তল্লাশি চালিয়েছিল। ট্রাম্পের কৌঁসুলির সই করা সার্টিফিকেট মিথ্যা প্রমাণিত করে এফবিআই ট্রাম্পের বাড়ি তল্লাশি করে আরও সরকারি নথিপত্র জব্দ করেছিল। 

থলের বেড়াল যাতে কিছুতেই বের হতে না পারে তার সব চেষ্টা চালিয়ে গেলেন ট্রাম্প। এফবিআই যাতে পুরো ব্যাপারটি তদন্ত করতে না পারে এবং নথিপত্র পরীক্ষা করতে না পারে সে উদ্দেশ্যে ট্রাম্প একের পর এক বাধার সৃষ্টি করে চলছিলেন। এবার তিনি  দক্ষিণ ফ্লোরিডার ফেডারেল বিচারক আইলিন ক্যাননের দ্বারস্থ হলেন। এই বিচারককে ট্রাম্প নিজেই নিয়োগ দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট মেয়াদের শেষ দিকে। ট্রাম্পের আবেদন: এফবিআইয়ের তদন্ত বন্ধ করতে হবে এবং স্পেশাল মাস্টার্স (নিরপেক্ষ বিচারক) নিয়োগ দিয়ে তাঁর কর্তৃত্বে সব নথিপত্র পরীক্ষা ও লিপিবদ্ধ করতে হবে। এ কাজ এফবিআই ইতিমধ্যে সম্পাদন করেছে। কিন্তু ট্রাম্প সেটা গ্রহণ করতে নারাজ। এফবিআইয়ের তদন্ত বাধাগ্রস্ত করে বিচার কার্য বিলম্বিত করার কৌশল তিনি বেছে নিলেন। অতীতে আমরা দেখেছি মামলাবাজ ট্রাম্প এই কৌশল বহুবার নিয়েছেন। নিদারুণ অর্থশালী ট্রাম্পের এই কৌশলে হেনস্থা হয়েছেন অনেক বাদী, যাদের পাওনা ট্রাম্প শোধ করেননি, উল্টো মামলা প্রত্যাহারে বাধ্য হয়েছেন।   

বিচারক আইলিন ক্যানন ট্রাম্পের পক্ষে রায় দিলেন। এফবিআইয়ের তদন্ত বন্ধ হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত, আইলিন ক্যাননের ঊর্ধ্বতন আপিল কোর্টের বিচারক রায় দিলেন যে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে তদন্তের ব্যাপারে বিচারিক সিদ্ধান্তে আইলিনের কোনো এখতিয়ার নেই। এই রায় মোতাবেক ২০২২ সালের ১২ ডিসেম্বর আপিল বিচারকের নির্দেশ অনুযায়ী আইলিন ক্যানন স্পেশাল মাস্টার্সকে বরখাস্ত করলেন। অতএব, তদন্তে বাধা প্রদানে ট্রাম্পের প্রচেষ্টার করুণ পরিণতি ঘটল।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য খারাপ খবর হল, জাস্টিস ডিপার্টমেন্ট তাঁর সরকারি নথিপত্র চুরির অপরাধ ও ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারির ক্যাপিটল হিল আক্রমণে তাঁর সংশ্লিষ্টতার তদন্ত কাজে বিশেষ পরামর্শদাতা (special Counsel) হিসেবে নিয়োগ দান করেছে 'জ্যাক স্মিথ' নামে এক ঝানু প্রোসিকিউটরকে। তদন্তের স্বার্থে তিনি গ্রান্ড জুরি গঠন করেছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের কৌঁসুলি ইভ্যান করকোর‍্যানকে  গ্রান্ড জুরি আহ্বান করেছিল প্রামাণিক সাক্ষ্য (testimony) দেওয়ার জন্য। তিনি গ্রান্ড জুরির কক্ষে হাজিরা দিয়েছিলেন কিন্তু সাক্ষ্য দেওয়া থেকে বিরত ছিলেন। তিনি প্রয়োগ করেছিলেন উকিল-মক্কেল বিশেষ অধিকার। অনেক আইনি জটিলতা অতিক্রম করে তাঁকে আবার তলব করা হয়েছে।  ২০২৩ সালের ২৪ মার্চ শুক্রবার সাংবাদিকরা তাঁকে দেখেছেন ওয়াশিংটন ডিসির ফেডারেল কোর্ট হাউসে। তিনি যে কক্ষে প্রবেশ করেছিলেন সেখানে সাক্ষীর কাছ থেকে জুরিরা প্রামাণিক সাক্ষ্য শুনে থাকে। এই প্রক্রিয়াগুলো জনগণের কাছ হতে গোপন রাখা হয়।

মনে হচ্ছে স্পেশাল কাউন্সেল জ্যাক স্মিথ হয়তো ট্রাম্পের কৌঁসুলি ইভ্যান করকোর‍্যানকে সাক্ষী বানিয়ে ছাড়বে। সেটা হবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য অশনি সংকেত। কেননা করকোর‍্যানের কাছে ট্রাম্পের হাঁড়ির খবর আছে। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে চৌর্যবৃত্তির মামলা সোজা সাপটা। এর ভিত্তি হল নথিপত্র— যা  জাস্টিস ডিপার্টমেন্টের করতলগত। জ্যাক স্মিথের মত ঝানু এবং অভিজ্ঞ প্রোসিকিউটরের জন্য অভিযোগ প্রমাণ করা তেমন কঠিন হবে বলে মনে হয় না। জ্যাক স্মিথকে সব কিছু ভেবেচিন্তে নিয়োগ দিয়েছেন এটর্নি জেনারেল মেরিক গারল্যান্ড। অতি সাম্প্রতিককালে জ্যাক স্মিথ  নিযুক্ত ছিলেন নেদারল্যান্ডের হেগ শহরে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম কোর্টে এবং সেখানে তিনি যুদ্ধ অপরাধীদের বিচারে সহায়তা করতেন। এর আগে পাঁচ বছর তিনি ছিলেন জাস্টিস ডিপার্টমেন্টের পাবলিক ইন্টিগ্রেটি ইউনিটের প্রধান। সেই সুবাদে তিনি সরকারি কর্মচারীদের ঘুষ গ্রহণ ও নির্বাচন বিষয়ক অপরাধের মামলাগুলো তদারক করতেন। বিশেষ করে সকল পর্যায়ের নির্বাচিত প্রতিনিধি ও কর্মকর্তাদের অপরাধ বিচার ছিল তাঁর  অন্যতম দায়িত্ব। 

সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হোয়াইট হাউস থেকে সরকারি নথিপত্র সরানো অপরাধের পর্যায়ে পড়তে পারে। ওই নথিপত্র ফেরত চেয়ে যখন তাঁকে সাপিনা করা হল তখন নিদারুণ অশ্রদ্ধার সঙ্গে তিনি ফেরত দিতে অনীহা প্রকাশ করলেন। টালবাহানা করলেন দেড় বছর ধরে। এমনকি নথিপত্র  উদ্ধার করতে তাঁর প্রাসাদোপম অট্টালিকাকে সাধারণ ছিঁচকে চোরের বাড়ির মতো তল্লাশি করতে হল। তাতে নথিপত্র  উদ্ধারও হল। তিনি মিথ্যাবাদী হিসেবে আবারও প্রমাণিত হলেন। তাঁর মিথ্যের সংখ্যা কয়েক হাজার ছাড়িয়ে গেছে। নথি উদ্ধারে তাঁর ইচ্ছাকৃত বাধাদান গুরুতর অপরাধের পর্যায়ে পড়ে।

মামলা বিষয়ক তদন্তে ট্রাম্পের বাধা দানের চেষ্টা তাঁর বাড়ি তল্লাশির সময় পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয়। জ্যাক স্মিথ অনেক সময় নিয়ে ট্রাম্পের অপরাধ বিষয়ক দলিল দস্তাবেজ সংগ্রহ করছিলেন। আইনের চোখে বাধা দান অপরাধ জেনে শুনেও ডোনাল্ড ট্রাম্প জ্যাক স্মিথের তদন্তে প্রকাশ্যে বাধা সৃষ্টি করছিলেন। 

যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী আনুষ্ঠানিকভাবে (যথাবিধি) অভিযোগ গঠন (indictment) সম্পন্ন হলে গ্রান্ড জুরির কাজের সমাপ্তি ঘটে। তখন তদন্তের কাজে গ্রান্ড জুরিকে ব্যবহার করা যায় না। অবস্থা দেখে শুনে মনে হচ্ছে ঝানু প্রোসিকিউটর স্পেশাল কাউন্সেল  জ্যাক স্মিথ আদ্যোপান্ত সুষ্ঠুভাবে গ্রান্ড জুরিকে ব্যবহার করতে চাচ্ছেন। গ্রান্ড জুরির সবচেয়ে দায়িত্বপূর্ণ কর্তব্য হল অভিযোগ গঠন করা (to indict)। অপর পক্ষে প্রোসিকিউটর গুরুত্ব দিয়ে থাকেন গ্রান্ড জুরির সমন জারির ক্ষমতাকে এবং  প্রোসিকিউটরের পছন্দ মাফিক সাক্ষীকে প্রামাণিক সাক্ষ্য দানে বাধ্য করার অধিকার। বিশেষ করে ট্রাম্পের কৌঁসুলিদের সাক্ষ্য দানে বাধ্য করতে পারলে প্রোসিকিউটর হিসেবে জ্যাক স্মিথ বুঝতে পারবেন ট্রাম্পকে নির্দোষী প্রমাণিত করার জন্য তাঁর কৌঁসুলিরা আদালতে কি ধরনের কৌশল অবলম্বন করতে যাচ্ছেন। তদন্তের এই সুযোগগুলো রুদ্ধ হয়ে যায় যে মুহূর্তে অভিযোগ গঠন সম্পাদন করা হয়। জ্যাক স্মিথ তাঁর মন মত সব তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ করার পরই গ্রান্ড জুরিকে অনুরোধ করবেন অভিযোগ সম্পাদন শেষ করার জন্য। 

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী জ্যাক স্মিথ সাপিনা জারি করে জানতে চেয়েছিলেন কয়েকটি দেশের সঙ্গে ট্রাম্পের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ট্রাম্প অর্গানাইজেশনের ব্যবসা-বাণিজ্যের খতিয়ান। মনে হচ্ছে উদ্দেশ্য ছিল ট্রাম্পের চুরি করা সরকারি তথ্যগুলো তিনি ব্যবসায়ে ব্যবহার করেছেন কি না। আমরা অপেক্ষায় থাকছি থলের বেড়াল বের হবে কবে।

কতিপয় বিশ্লেষকদের ধারনা জ্যাক স্মিথ প্রমাণ করতে চাইছেন নথি চুরি সংক্রান্ত তদন্তে বাধা দেওয়ার পেছনে ট্রাম্পের ব্যবসায়িক লাভের উদ্দেশ্য (motive) থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। আবার অনেক বিশ্লেষক বলেছেন এই মামলায় উদ্দেশ্য দেখাবার প্রয়োজন হবে না। চুরি করা, মিথ্যে বলা এবং তদন্তে বাধা প্রদানই ট্রাম্পের জেলের হ্যামবার্গার উপভোগ করার জন্য যথেষ্ট। জ্যাক স্মিথ তাঁর এজেন্ট পাঠিয়েছেন ট্রাম্পের 'মার-এ-লাগো' রিসোর্টে কর্মরত কাজের লোকদের সাক্ষাৎকার নিতে। মনে হচ্ছে অতি সাবধানী জ্যাক স্মিথ অভিযোগ গঠনে কোনো পাথর উল্টানো থেকে বিরত থাকছেন না।

সম্প্রতি ন্যাশনাল আর্কাইভ অ্যান্ড রেকর্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন জ্যাক স্মিথকে দিয়েছে কতকগুলো রেকর্ড। এগুলোতে প্রমাণ রয়েছে ট্রাম্পের উপদেষ্টারা তাঁকে অবহিত করেছেন যে ট্রাম্প মনে মনে ইচ্ছে করলেই অথবা বাতাসে তাঁর হাত নাড়ালেই গোপনীয় শ্রেণীভুক্ত সরকারি নথির শ্রেণীভুক্ততার অবসান ঘটে না। এই ধরনের কৌতুকময় আজব চিন্তাগুলোর বিরুদ্ধে ট্রাম্পকে তাঁরা সতর্ক করেছেন। এই প্রমাণগুলো ট্রাম্পের বিপক্ষে শক্তিশালী যুক্তি হবে যদি তিনি না জানার ভান করেন।

৩১ মে সিএনএন প্রদত্ত খবর অনুযায়ী, ফেডারেল প্রোসিকিউটররা পেয়েছেন একটি অডিও টেপ যার বিষয়বস্তু ২০২১ সালের গ্রীষ্মে ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি মিটিং। এই টেপে তাঁর নিজের কন্ঠস্বরে স্বীকার করেছেন যে তাঁর দখলে রয়েছে পেন্টাগনের গোপন শ্রেণীভুক্ত নথি। একাধিক সূত্র থেকে সিএনএন খবর পেয়েছে।  ট্রাম্পের ভাষায় এই নথিতে রয়েছে ইরান আক্রমণের গোপন শ্রেণীভুক্ত পরিকল্পনা। রেকর্ডিং নির্দেশ করে যে ট্রাম্প জানতেন তিনি দখলে রেখেছেন একটি গোপন  শ্রেণীভুক্ত নথি। তিনি এই নথি অপরের সঙ্গে শেয়ার করতে চাচ্ছেন কিন্তু করবেন না। না করার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন যে সাবেক প্রেসিডেন্ট হিসেবে এই নথিকে ডিক্লাসিফাই অথবা শ্রেণীভুক্ততার  অবসান করার এখতিয়ার তাঁর আর নেই। এই অডিও টেপে পরিষ্কারভাবে প্রমাণ হল ক্লাসিফিকেশন প্রক্রিয়া না জানার ভান কোর্ট নাকচ করে দেবে। অতএব কেল্লা ফতে। 

ট্রাম্পের জন্য আরও দুঃসংবাদ হল জ্যাক স্মিথের কাছে আরও রয়েছে ট্রাম্পের কৌঁসুলি করকোর‍্যানের নিজ হাতে লেখা ৫০ পৃষ্ঠার টীকা ও মন্তব্য। যাতে লিপিবদ্ধ করা আছে কৌঁসুলিদের উপদেশ এবং হাত নেড়ে ট্রাম্পের প্রতিক্রিয়া। হাত নাড়ার বর্ণনাও করকোর‍্যানের নোটে লিপিবদ্ধ করা আছে। গোপনীয় সরকারি দলিল সরকারের অনুরোধ অনুযায়ী ফেরত দেওয়ার দায়িত্ব না জানার অজুহাত এই নোটগুলো নাকচ করে দিচ্ছে। অতএব অভিযোগ খণ্ডনের পথগুলো ধীরে ধীরে রুদ্ধ হয়ে আসছে। 

এখন প্রশ্ন হল কবে নাগাদ স্পেশাল কাউন্সেল জ্যাক স্মিথ সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলার (criminal case) অভিযোগ দাখিল করবেন। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদন অনুযায়ী এই দিনটি অত্যাসন্ন। ৩০ মে ট্রাম্পের কৌঁসুলিরা এটর্নি জেনারেল মেরিক গারল্যান্ডের সঙ্গে বৈঠকে অনুরোধ জানিয়েছেন চেপে যাওয়ার। এটাই মনে হচ্ছে তাঁদের শেষ চেষ্টা যাতে অভিযোগটি দাখিল না হয়।

জাস্টিস ডিপার্টমেন্টের মানদণ্ড অনুযায়ী, মামলা পরিচালনা করার জন্য দুটো শর্ত। একটি হল অপরাধ সংঘটিত হওয়া এবং শাস্তির সম্ভাবনা বিদ্যমান থাকা। এই দুটো শর্ত আগেই পূরণ করা হয়েছে।

জ্যাক স্মিথ খুব সাবধানী প্রোসিকিউটর। তিনি কিছুটা বেশি সময় নিচ্ছেন, যাতে ফৌজদারি মামলাটি স্বতঃসিদ্ধভাবে প্রমাণিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এটাই হতে পারে প্রথম উদাহরণ যেখানে সাবেক প্রেসিডেন্ট দোষী সাব্যস্ত হয়ে ফেডারেল কারাগারে কয়েক বছর জেল খাটতে পারেন। এর আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। বাংলাদেশের একটি লোকজ সংগীত ট্রাম্পকে ধরিয়ে দিতে কেউ কেউ হয়তো উপদেশ বর্ষণ করতে পারেন 'ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে ...’।

পাঠকবর্গ, এই মামলাটা খারিজ হয়েও যেতে পারে। আরও সবার মতো আমিও অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় রইলাম।