‘আপনারে বড় বলে, বড় সেই নয়’

স্বঘোষিত ভালো মানুষদের টাঙ্গানো ব্যানারগুলোর উপর কর ধার্য করা যায় না? যায় তো। বাজারের বিভিন্ন দোকানের সাইনবোর্ডের জন্য যদি স্থানীয় সরকার থেকে কর আদায় করা যায়, তবে এই সব ব্যানার-ফেস্টুনের বিপরীতে কর আদায় করতে সমস্যা কোথায় তা সাধারণ মানুষের প্রশ্ন।

এম আর খায়রুল উমামএম আর খায়রুল উমাম
Published : 24 May 2023, 09:13 AM
Updated : 24 May 2023, 09:13 AM

কিভাবে মানুষ ভালো মানুষ হয়? এ নিয়ে একটি ছড়া এই রকম : “কেউ ভালো মানুষ ‘পড়ি’/ কেউ ভালো মানুষ ‘কড়ি’/ কেউ ভালো মানুষ ‘মনে মনে’/ কেউ ভালো মানুষ ‘জগতে জানে’।”

যতদূর জানা যায়, ইংরেজ শাসনামলে ছড়াটি রচিত হয়েছিল। সেই থেকে এখনও বহুল চর্চিত।

বলাবাহুল্য সমাজে বিদ্যমান ভালো মানুষদের ধরণ চারটি বলে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এই ছড়ায়। সেখানে কেউ লেখাপড়া শিখে শিক্ষিত হয়ে বড় চাকরি করে ভালো মানুষ হয়েছে। কেউ ব্যবসা-বাণিজ্য করে বিপুল অর্থ উপার্জন করে হয়েছে ভালো মানুষ। কেউ কারো স্বীকৃতির প্রত্যাশায় না থেকে নিজেই মনে মনে নিজেকে ভালো মানুষে রূপান্তরিত করেছে। কেউ আবার নিজের কর্মগুণে দেশের-দশের সবার কাছে ভালো মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

লোকজ এ ছড়াটি বোধ করি জন্মশতবর্ষে এখনও পৌছায়নি। কিন্তু উপমহাদেশের মানচিত্রে এরই মধ্যে কাটাছেঁড়া হয়েছে বারদুয়েক। ১৯৪৭ সালের মর্মন্তুদ ভারত ভাগ তো আছেই। পরে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১ সালে আমরা প্রতিষ্ঠা করেছি বাংলাদেশ। ত্রিখণ্ডে খণ্ডিত অবিভক্ত ভারতবর্ষের একাংশ পাকিস্তানে নৈরাজ্য তো চলছে জন্ম থেকেই। এখন তা আরও ঘনীভূত হয়েছে।

স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের এতগুলো বছর পর এসে লোকজ ওই ছড়ার বাক্যগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করলে সহজেই উপলব্ধি করা যায়– আজকের সময়ে কেউ ভালো মানুষ ‘পড়ি’ আর ‘জগতে জানে’ উপমা দুটি অনেক পিছিয়ে পড়েছে এবং দৌড় প্রতিযোগিতায় ‘কড়ি’ আর ‘মনে মনে’ রকেটের গতিতে এগিয়ে গিয়েছে। সমাজ ও রাষ্ট্রেই আজ শুধু এদের জয়জয়কার নয়, পরিবারেও এরা ব্যাপক জনপ্রিয়। কারণ এই ভালো মানুষেরা পরিবারের পরবর্তী কয়েক পুরুষের অভিজাত জীবন নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছে। তাই সারাদেশে মানুষ এখন প্রতিযোগিতায় নেমেছে নিজেকে ‘কড়ি’ আর ‘মনে মনে’ পর্যায়ের ভালো মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে কে, কিভাবে ভালো মানুষ হচ্ছে তা সবার জানা হলেও কেউ কাউকে কিছু বলে না, কেউ কাউকে প্রতিহত করতে চায় না বরং সহায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে থাকে।

স্মরণে রাখা প্রয়োজন, কড়ি সংগ্রাহক ভালো মানুষদের সঙ্গে মনে মনে ভালো মানুষদের এক প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি, ব্যাংকে লক্ষ কোটি টাকার খেলাপী ঋণ, লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাচার, হাজার কোটি টাকার ব্যাংক জালিয়াতি, ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারীর কোটিপতি হওয়ার প্রতিযোগিতা– এহেন যোগাযোগের অপরূপ সুন্দর দৃশ্যকল্প মাত্র। আবার এসব কাণ্ডকীর্তি দলবদ্ধভাবে করা হলেও ব্যক্তি পর্যায়েও কিন্তু কেউ বসে নেই। কড়িকে নিজের করে রাখার জন্য এ পর্যায়ের ভালো মানুষেরা সারাজীবনের অর্জন বিসর্জন দিতেও কুণ্ঠা বোধ করে না। ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারে তারা ঘুষ, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, স্বজনপ্রীতি, কমিশন বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে বিদেশি অনুপ্রেরণায় দেশ ও জাতির স্বার্থের পরিপন্থী প্রকল্প গ্রহণেও সামান্য পিছপা হন না। আমার দেশের ওভার ইনভয়েসিং কিংবা আন্ডার ইনভয়েসিং করা অর্থ বিদেশে পাচার করে নিজেসহ পরিবারের সকলের নিশ্চিত ভবিষ্যৎ গড়ে তোলে ছড়ায় বর্ণিত দ্বিতীয় গোত্রের এ ভালো মানুষেরা। ‘কড়ি’ বিষয়ে নিশ্চিত হবার পর সেই ভালো মানুষরাই তৃতীয় গোত্র অর্থ্যাৎ ‘মনে মনে’ ভালো মানুষ হিসেবে সমাজে পরিচিত হওয়ার জন্য পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে।

বাংলাদেশের রাজনীতি কড়ি সংগ্রহের জন্য বেশ কিছুকাল ধরেই সহজগম্য, নিরাপদ ও সহায়ক। রাজনৈতিক মতাদর্শ পরিবর্তনের জন্য একগুচ্ছ ফুল এবং গলা ফাটিয়ে দুয়েকটা স্লোগানই যথেষ্ট। বলাবাহুল্য কড়ি সংগ্রাহকদেরও সরকারি দলে অন্তর্ভুক্তির প্রতি আগ্রহই বেশি। এতে সরকারি দলের দুটো লাভ। প্রথমত; দেশের মানুষকে দলটি দেখাতে পারে তাদের সমর্থক সংখ্যা প্রতিনিয়ত কি হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। দ্বিতীয়ত; যে কোনো অঘটন ঘটলে তারাই আবার বলতে পারে অনুপ্রবেশকারীরা দলে এসে এসব কুকর্ম করে সরকারি দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করার চেষ্টা করছে। পাশাপাশি সহায়ক পদক্ষেপ হিসেবে বহিষ্কারের নাটক তো আছেই। কড়ি সংগ্রহের ধারাবাহিক পথকে মসৃণ রাখতে পদ-পদবির প্রয়োজনীয়তাকে তো অস্বীকার করা যাবে না। তাই সাময়িক বিচারে ‘বহিষ্কার’ শাস্তি হিসেবে বিবেচিত হলেও কখন কিভাবে তা আবার সরল বিবেচনার পথে হেঁটে ব্যক্তিকে সাফল্যের দিকে নিয়ে যায় তা অনেকেই বুঝতে সক্ষম হয় না। পদ-পদবি একবার পাওয়া গেলে তো কথাই নেই। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় তা আজীবনের। অপরদিকে কড়ি সংগ্রাহকদের রূপ অনেকটাই উন্মোচিত হয় নির্বাচনের সময় জনপ্রতিনিধিদের দেয়া অর্থ-সম্পদ সম্পর্কীয় প্রতিবেদনের মাধ্যমে। দেশের বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় সাধারণ মানুষেরা বিশ্বাস করে আদমজী-বাওয়ানীদেরও এমন উত্থান হয়নি।

ইতোপূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, কড়ি সংগ্রাহক ভালো মানুষদের সঙ্গে মনে মনে ভালো মানুষদের এক প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রয়েছে। তাই বলাই বাহুল্য ‘কড়ি’ সংগ্রাহক ভালো মানুষ হয়েই থেমে যাবার বান্দা এ পর্যায়ের ব্যক্তিরা নন, বরং কড়ির পাশাপাশি শুরু হয় মনে মনে ভালো মানুষ হওয়ার প্রতিযোগিতা। নিজ নিজ পাড়া-মহল্লা থেকেই এরা শুরু করে হুমকি-ধমকি দিয়ে নিজের ক্ষমতা দেখানোর কাজটি। ছড়ায় বর্ণিত তৃতীয় পর্যায়ের (মনে মনে) তারা যে ভালো মানুষ তা জানানোর জন্য কারণে-অকারণে এরা একে অপরকে শুভেচ্ছা জানানোর কাজটি শুরু করে হাজার হাজার ব্যানার ফেস্টুন এলাকাজুড়ে-দেশজুড়ে টাঙ্গানোর মধ্য দিয়ে। তারা ভুলেই যান ‘আপনারে বড় বলে, বড় সেই নয়/ লোকে যারে বড় বলে বড় সেই হয়।’

স্বঘোষিত ভালো মানুষদের টাঙ্গানো ব্যানারগুলোর উপর কর ধার্য করা যায় না? যায় তো। বাজারের বিভিন্ন দোকানের সাইনবোর্ডের জন্য যদি স্থানীয় সরকার থেকে কর আদায় করা যায়, তবে এই সব ব্যানার-ফেস্টুনের বিপরীতে কর আদায় করতে সমস্যা কোথায় তা সাধারণ মানুষের প্রশ্ন। এই ব্যক্তিরা যেহেতু কড়ির মালিক এবং একজন অন্যজনকে মনে মনে ভালো মানুষ হিসেবে প্রচার করতে ব্রতী, সেহেতু তাদের তো প্রচার-প্রচারণা বিষয়ক কর দিতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। দুঃখের বিষয়, আয়ের এত সহজ ও অনায়াসলভ্য উৎস থাকার পরও কোনো স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি আজ পর্যন্ত এ বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। করবেন কেমন করে, স্থানীয় সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্তরাও তো ‘মনে মনে’ ভালো মানুষদের মধ্যে থেকেই এসেছেন।

ব্রিটিশ শাসনামলে ‘পড়ি’ ভালো মানুষেরা দেশের পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনা করে ‘কড়ি’ ভালো মানুষদের টেক্কা দিয়ে অনেক অনেক উপরে উঠে গিয়েছিল। কিন্তু বর্তমান সময়ে এহেন ভালো মানুষেরাই ‘পড়ি’কে ব্যবহার করে পদ-পদবি প্রাপ্তি নিশ্চিত করে পরবর্তীতে ‘কড়ি’ সংগ্রহে নিবেদিত হয়ে পড়েছে। ‘পড়ি’র মধ্য দিয়ে শিল্পিত সৌন্দর্যমণ্ডিত সমাজ বিনির্মাণে নিবেদিত হওয়ার ন্যূনতম প্রয়োজনীয়তা কেউ অনুভব করে বলে আজ আর মনে হয় না। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন পুরোটা সময় চাকরি করেও বীর মুক্তিযোদ্ধার খেতাব প্রাপ্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে, মন্ত্রী-সচিবদের মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় ভুক্তির জন্য মিথ্যাচার, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের খাল কাটার উপর পিএইচডি করেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের দায়িত্ব পাওয়া, বিদেশে সেকেন্ড হোম করার প্রতিযোগিতা, পরিবার-সন্তানদের বিদেশে রেখে জনগণের সেবক হিসেবে আস্ফালন করা– এসবই তো প্রথম ছত্রে বর্ণিত ‘পড়ি’ পর্যায়ভুক্ত ব্যক্তিদেরই কৃতকর্মের চিত্র। সুতরাং ‘পড়ি’ অর্থ্যাৎ শিক্ষা লাভের পরবর্তী কোনো লজ্জাও এখানে কাজ করে না। দ্বিধাহীন চিত্তে মনের আনন্দে ‘পড়ি’র অপব্যবহার চলমান এবং এসকল ‘পড়ি’ পর্যায়ভুক্ত ভালোমানুষদের কাজকর্ম দেখে দেশে অনেক মানুষ আজ উদ্বুদ্ধ হচ্ছে এবং তারাও বীরদর্পে ‘পড়ি’ পর্যায়ের দলভারির কাজে যুক্ত হয়ে পড়ছে।

‘জগতে জানে’ ভালো মানুষরা নিজেদের গুটিয়ে ফেলেছেন। রাজনৈতিক দলগুলোতে দলের মতাদর্শে বিশ্বাসী কিছু ভালো মানুষ মাঠে থাকলেও তারা সত্যকে সত্য বলার ক্ষমতা যেন হারিয়ে ফেলেছেন। আর যারা এখনও নীতি-নৈতিকতা-মূল্যবোধ ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন তারা আজ প্রায় অপাঙ্‌ক্তেয়দের দলে চলে গিয়েছেন। তবে সমাজের এ অংশটি যে একেবারে নিস্ক্রিয় এমনটা নয়। তাঁরা সীমিত পরিসরে হলেও দেশ ও জাতির কল্যাণের কথা বলে এবং নিজেদের কথাগুলো লিখে রেখে চলেছেন। যদি কোনদিন সাধারণ মানুষের মনে হয় নীতি নৈতিকতা আর মূল্যবোধের নিগড়ে বেধে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের জন্য, স্বাধীনতার সুফল জনগণের কাছে পৌঁছে দেবার জন্য, বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের জন্য, শোষণ-বঞ্চনার ইতি টানবার জন্য সমাজের বর্তমান এ অপাঙ্‌ক্তেয় অংশের ভাবনা, তাদের লেখনিকে নতুন করে সামনে আনা প্রয়োজন তখন নিশ্চয়ই নতুন করে ভাবার সুযোগ আসবে। তবে বর্তমানে ‘জগৎ জানে’ ভালো মানুষের পরামর্শ শোনার পরিবেশ পরিস্থিতি আছে বলে মনে হয় না।

বর্তমান বাংলাদেশ ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন’ কিংবা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ‘আমি শোষিতের দলে’ কিংবা ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ কিংবা ‘সংবিধানের অঙ্গীকার’ ইত্যাদি অনেক কিছুকে পেছনে সরিয়ে রেখে শুধু উন্নয়ন আর অগ্রগতির জোয়ারে ভেসে চলেছে। ফলে সকল আয়োজন, উদ্যোগ এক শ্রেণীর মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। উন্নয়ন ও অগ্রগতির চলমান জোয়ারের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সংবিধানের অঙ্গীকার রক্ষায় ‘জগতে জানে’ ভালো মানুষদের পরামর্শ আজ সমাজের জন্য, ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের জন্য খুবই প্রয়োজন। সাধারণ জনগণের মুক্তির জন্য ‘জগতে জানে’ ভালো মানুষদের পরামর্শ তাই কালের দাবী হয়ে উঠেছে। বিশ্বাস করি আমাদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, অসংখ্য উন্নত সৃষ্টি, নতুন চিন্তা-চেতনায় নির্মিত স্বপ্নে সাধারণ জনগণ উজ্জীবিত হবে। সরকার মানবিচার ও গুণ বিচারে যুক্তি-চর্চা করবে এবং ‘জগতে জানে’ ভালো মানুষেরা অপাংক্তেয় কিংবা নিস্ক্রিয় হবার তকমাকে ছিঁড়ে পেলে সহযাত্রী হওয়ার সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করে এগিয়ে আসবে।