কারো কারো কাছে দলীয় স্বার্থ বড় হয়ে ওঠায় রাজনীতিতে জাতীয় ঐক্য গড়ে ওঠার সম্ভাবনা কেবলই দূরে চলে গেছে। দেশ-শাসনে সুশাসনের ধারা প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
Published : 17 Jul 2023, 06:30 PM
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের দুই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আজরা জেয়া ও ডনাল্ড লুয়ের সফর নিয়ে অনেকের মধ্যে কি হয়, কি হয় একটা অবস্থা বিরাজ করছিল, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন লেখালেখি হচ্ছিল যেন মার্কিন প্রতিনিধি দল ঢাকায় এসে একটি ওলটপালট ঘটিয়ে দিয়ে যাবে। বিএনপি নেতাকর্মীদের হাবেভাবে মনে হচ্ছিল, আমেরিকা বুঝি শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ছাড়া আর কিছু চাইছে না। তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা না করে আজরা জেয়ার দল আমেরিকা ফিরবে না। কিন্তু বাস্তবে তেমন কিছু হয়নি।
মার্কিন প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর শেষে দেশে ফিরেছেন। এরমধ্য দিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে যে চাপা উত্তেজনা দেখা যাচ্ছিল তার আপাত অবসান হয়েছে। আজরা জেয়া ও তার সফর সঙ্গীরা বিএনপির সুরে সুর মিলিয়ে কথা বলেননি। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি আজরা জেয়া ও পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক অ্যাসিট্যান্ট সেক্রেটারি ডনাল্ড লুয়ের সঙ্গে সফরে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (ইউএসএআইডি) উপ-সহকারী প্রশাসক অঞ্জলী কৌরও ছিলেন।
তারা সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের কথা বারবারই বলেছেন। রাজনৈতিক মতপার্থক্য দূর করার জন্য তারা সংলাপের উপরই জোর দিয়েছেন। বাংলাদেশের গণতন্ত্র, নির্বাচন ও সুশাসনের জন্য তাদের সমর্থন থাকবে এবং এর ব্যতিক্রম কিছু হলে তাদের সমর্থন ও সহযোগিতা বাধাপ্রাপ্ত হবে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পঞ্চাশ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অনেক উত্থান-পতন হয়েছে। রাজনীতিতে ঐকমত্যের বদলে বিভেদের পথ প্রশস্ত হয়েছে। জাতীয় স্বার্থের চেয়ে কারো কারো কাছে দলীয় স্বার্থ বড় হয়ে ওঠায় রাজনীতিতে জাতীয় ঐক্য গড়ে ওঠার সম্ভাবনা কেবলই দূরে চলে গেছে। দেশ শাসনে সুশাসনের ধারা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির ত্রুটি-দুর্বলতার সুযোগে স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারী দল ও ব্যক্তিরা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠা লাভে সক্ষম হয়েছে।
দেশ শাসনে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি ও জাতীয় পার্টি তথা আওয়ামী লীগবিরোধী দুই তরফের রাজনীতিই মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে। মোটা দাগে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু, মোশতাক, জিয়া, এরশাদ, খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনার শাসন মানুষ দেখেছে। কিন্তু সব শাসনকাল মানুষের মনে সমান আস্থা জাগাতে পেরেছে, তা অবশ্যই নয়। বঙ্গবন্ধুর সাড়ে তিন বছরের শাসনকালের পর তাৎপর্যপূর্ণ হলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রথম মেয়াদের ৫ বছর ও গত তিন মেয়াদের প্রায় পনের বছরের শাসনকাল। এসময়ে দেশের অবকাঠামোগত যথেষ্ট উন্নয়ন ঘটলেও মানব সম্পদের চিন্তা ও চেতনাগত উন্নয়ন সেভাবে ঘটেনি। দুর্নীতি ও অনিয়মের মাত্রা না কমে ক্রমাগত বেড়েছে। অনেকেই দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বললেও সুযোগ পেলে খুব কম জনই এ থেকে দূরে থাকেন। রাজনীতিতে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও সম্মানের কোনো বালাই নেই। বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসাপরায়ণতার অপ্রতিরোধ্য বিস্তার ঘটছে।
মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি সাধারণ মানুষের যে সমর্থন আমরা দেখি এটা দলগত, গোষ্ঠীগত ও সামাজিক দলাদলির একটা প্রকাশমাত্র। নীতিগত, আদর্শগত ও দেশপ্রেম থেকে উৎসারিত নয়। এমপি হওয়ার জন্য, ক্ষমতা ও সুবিধা ভোগ করার জন্য শক্তিমানেরা দল করে এবং দল দখল করে নেয়। নীতিবান, আদর্শবান ও দেশপ্রেমিকরা ছিটকে পড়ে গেছে নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে। ফলে রাজনীতির ভারসাম্য যেমন নষ্ট হয়েছে তেমনি নেতৃত্বেও একটা বড় শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে।
আর সেজন্যই এসেছে জাতির ঘুরে দাঁড়ানোর প্রশ্ন। কিন্তু কীভাবে? কার নেতৃত্বে এই ঘুরে দাঁড়ানো?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে বাংলাদেশের জনগণ, রাজনৈতিক দল ও সামাজিক শক্তিগুলোকেই। সেজন্য প্রথমে সব পক্ষকে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের পক্ষে আসতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাইরে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো অবকাশ নেই। বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান সম্প্রতি একটি দৈনিকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘যে-ই বাংলাদেশে রাজনীতি করুক না কেন, তাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থাকতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের বাইরে কোনো রাজনৈতিক দলের রাজনীতি করার সুযোগ বাংলাদেশের মাটিতে দেওয়া উচিত নয়। হবেও না। কারণ সেটা হবে আমার রাষ্ট্রের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে আমার অবস্থান।’
বাংলাদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভাষা, কৃষ্টি ইত্যাদি চর্চায় সবাইকে আন্তরিক হতে হবে। আদর্শের রাজনীতি চর্চার সুযোগ অবারিত করতে হবে। বিদ্বেষ এবং হিংসা, প্রতিহিংসার কবর দিয়ে শান্তি, ভালোবাসা ও মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ থেকে যার যার দলীয় রাজনীতির চর্চা করার পরিবেশ উম্মুক্ত করতে হবে।
আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে এই কাজটি শুরু করতে পারে। একদফা ও গণঅভ্যুত্থান ইত্যাদি বুলি না কপচে বাস্তবতার আলোকে পথ চলতে হবে। মনে রাখতে হবে, দেশের আজকের পরিস্থতির জন্য সব পক্ষেরই কমবেশি দায় আছে । নিজের পাপের বাটখারা দিয়ে অন্যের পাপ মেপে কোনো ফায়দা হবে না।
আওয়ামী লীগ টানা ১৫ বছর দেশ শাসন করলেও নিজ দলের ভালোদের সামনে আনতে না পারার ব্যর্থতার দায় আছে। দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হয়নি। অবশ্য বিএনপি-জামায়াত আমলের মতো পুরো মেয়াদেই দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়নি। ক্ষমতাবানদের ঔদ্ধত্য ও নিপীড়নে মানুষ অতিষ্ঠ হয়েছে। ব্যাপক অর্থ পাচার হয়েছে; তবে পাচারকৃত অর্থের কত অংশ রাজনীতিবিদরা আর কত অংশ আমলারা করেছে তা নিরূপণ করা হয়নি। দেশব্যাপী ব্যাপক উন্নয়ন ঘটাতে শেখ হাসিনার সরকার সফল হয়েছে। অর্থনীতির আকার অনেক বড় হয়েছে। মানুষের দারিদ্র্য আগের তুলনায় অনেক কমেছে। কাজের সুযোগ ও পরিসর বেড়েছে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার দক্ষতা, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার মতো বিচক্ষণতা ও সাহস সর্বমহলে প্রশংসিত এবং স্বীকৃত। অর্থাৎ রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তিনি অদ্বিতীয়।
বিএনপি গত ১৫ বছরে নিজেদের দলকে সুশৃঙ্খল ও সুসংগঠিত করতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে নিজেদের অবস্থানও পরিষ্কার করতে পারেনি। তারা আওয়ামী লীগবিরোধিতাকে পুঁজি করে গতানুগতিক রাজনীতি করে গেছে। এখন সরকারের পতন ঘটিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে। ভাবখানা এমন, এত বছর তোমরা খেয়েছো এবার আমরা খাবো। ছোট দেশে ১৭/১৮ কোটি মানুষ। এরমধ্যে প্রায় অর্ধেকই হয়তো আওয়ামী লীগবিরোধী। এই অর্ধেক লোক হাটে-মাঠে-ঘাটে অফিসে আদালতে সর্বত্র সমানে মুখ চালাচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এদের সরব উপস্থিতি নজরে আসে।
এরা গলা ফাটিয়ে একতরফা প্রচারণা চালাচ্ছে, একটা অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে আর কোনো কথাই নেই, বিএনপি ক্ষমতায় বসে যাবে।
ভালো কথা। মানুষ যদি আসলেই বিএনপিকে ক্ষমতায় যাওয়ার মতো আসনে নির্বাচিত করে তারা নিশ্চয়ই ক্ষমতায় যাবে। তো নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা না দিয়ে একদফার ঘোষণা কেন? বঙ্গবন্ধু তো সত্তর সালে ইয়াহিয়ার লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডারের (এলএফও) অধীনে নির্বাচন করে জয়লাভ করেছিলেন। বিএনপিকেও শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন করার চ্যালেঞ্জ নিতে হবে।
সব দল নির্বাচনে অংশ নিলে ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচন বাংলাদেশের জন্য এক নতুন ইতিহাস তৈরি করবে। ২০২৪ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ আর আজকের মতো থাকবে না পরিবর্তিত হবে, বিএনপিও পরিবর্তিত হবে। কোনো কিছুই আগের মতো থাকবে না।
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের বিকল্প নেই এই কথা যেমন সত্য, তেমনই আওয়ামী লীগ আমলে দুর্নীতি, প্রশাসনের অব্যবস্থাপনা, আর লুটপাটের কাহিনি শুনতে শুনতে আর দেখতে দেখতে সাধারণ মানুষের কাছে আওয়ামী লীগ আমলে দেশের যে উন্নয়ন হয়েছে তা আর অনেকের বিবেচনায় থাকছে না! এর সঙ্গে আছে সারাদেশে আওয়ামী লীগের কিছু নেতাকর্মীর ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ।
এ ক্ষেত্রে আমি তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদের একটি বক্তৃতার দিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করবো। ১৫ জুলাই সন্ধ্যায় রাজধানীর মিন্টো রোডের সরকারি বাসভবন থেকে অনলাইনে সংযুক্ত হয়ে চট্টগ্রামের ষোলশহরে এলজিইডি ভবনের কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী মিলনায়তনে রাঙ্গুনিয়া সমিতি আয়োজিত সুধী সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেছেন, ‘আমার দলের নেতাকর্মীদের সবসময় বলি, ক্ষমতায় থাকলে বিনয়ী হতে হয়, মাথা নিচু করে চলতে হয়, বিনয় মানুষকে মহান করে।’
চট্টগ্রাম ৭ আসনের সংসদ সদস্য হাছান মাহমুদ বলেছেন, ‘আমি সবসময় এলাকার মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করি। সরকারের মন্ত্রী ও দলের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি আমি প্রতি সপ্তাহে চট্টগ্রামে ও রাঙ্গুনিয়ায় যাই।’
তিনি বলেন, ‘সরকার পরিচালনা করতে গিয়ে ভুলত্রুটি থাকবে, ভুলত্রুটি মানুষেরই হয়। পৃথিবীর কোনো সরকার শতভাগ নির্ভুল কিছু করতে পারে না। পাঁচ’শ বছর অতীতের সরকারেও ভুল ছিল, আগামী পাঁচ’শ বছর পরের সরকারেরও ভুল থাকবে। তবে দেখতে হবে সরকার দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে কিনা।’
আওয়ামী লীগ সরকারের নেতৃত্বে দেশের এই অগ্রযাত্রা যাতে অব্যাহত থাকে সেজন্য সবার সহযোগিতা চেয়ে তথ্যমন্ত্রী নিজ নির্বাচনী এলাকা রাঙ্গুনিয়া উপজেলার সুধীজনের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আমি সব দল ও মতের মানুষের এমপি হওয়ার চেষ্টা করেছি। গত সাড়ে ১৪ বছর সবার জন্য আমার দুয়ার খোলা ছিল। ভবিষ্যতেও যদি কোনো নিবেদন নিয়ে আপনাদের দুয়ারে আসি দয়া করে আপনাদের দুয়ারটাও দলমত নির্বিশেষে খোলা রাখবেন, সেটিই আপনাদের কাছে প্রত্যাশা।’
ভয় দেখিয়ে নয়, ভালোবেসে মানুষের সমর্থন আদায় করতে পারলে সেটা টেকসই হয়। শেখ হাসিনা যে পথে হাঁটছেন, তার কর্মী-সমর্থকরা বিপরীত পথে হাঁটলে চলবে কেন? আওয়ামী লীগের সব নেতাকর্মী যদি বিনয়ী হয়ে দেশের সর্বত্র সরকারের সাফল্যের চিত্র তুলে ধরতে পারেন, তাহলে বিরোধীরা অপপ্রচার করে সুফল পাবে না।