গত ১৩ মে ২০২৩ তারিখ চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা সাইদুর রহমান (বীরপ্রতীক)। প্রয়াত হওয়ার বেশ কিছুদিন আগে তার বাড়িতে বসেই আলাপ করেন যুদ্ধদিনের নানা ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে।
Published : 17 Jun 2023, 11:49 AM
“আমি এখন কোনো খবরে নাই। বয়স হইছে পঁচাত্তর। দুনিয়া থেকে যাওন লাগবে, সেই অপেক্ষায় আছি। যারা যাওয়ার কথা না, তারাও গেল গা আমার আগে। ওই চিন্তাতেই আছি এখন। ছেলেমেয়েদের বলেছি তোমরা তোমাদের মতো থাকো।
দাওয়াত করলেও সরকারি অনুষ্ঠানে যাই না, আমার স্ত্রী যায়। বেঁচে আছি, এটাই বড় কিছু। সবকিছু থেকেই বিরত আছি। শারীরিকভাবে ভালো আছি। ডায়াবেটিস নাই, এখনও চশমা লাগে না। খুব ভোরে উঠে হেঁটে কালিহাতি বাজারে যাই। সেখানে বসে চা-বিস্কুট খাই। নাস্তা ওটাই। বাসায় ফিরে দুপুরে খাই রুটি। এরপর বইসহ নানাকিছু পড়ি। রাতে খাই ভাত। তবে খাবার শেষে দই থাকতেই হবে। এভাবেই চলছে জীবন। তবে এভাবেই ভালো আছি।
দেশের কথা আপনারাই ভাল বলতে পারবেন। দীর্ঘদিন ধরেই নিজেকে গুটিয়ে রেখেছি। কোনো চাওয়া-পাওয়া নাই ভাই। ওই লোভ থাকলে ঢাকা শহরে কোটি কোটি টাকার মালিক হতাম। নিঃশ্বাসে বিশ্বাস নাই। ডাক পড়লে এক মুহূর্তেই চলে যেতে হবে। যে দুনিয়ায় আসছে তার যাওয়ার গ্যারান্টি আছে, আর কিছুর গ্যারান্টি নাই। যে কর্ম করব সেই কর্মটাই শুধু থাকবে। ওই বিশ্বাসেই বেঁচে আছি।”
সত্যি এমন বিশ্বাস নিয়েই প্রয়াত হয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা সাইদুর রহমান (বীরপ্রতীক)। ১৩ মে ২০২৩ তারিখ চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন এই বীর। কিন্তু আমাদের কাছে একাত্তরের বীরদের মৃত্যু নেই। প্রয়াত হওয়ার বেশ কিছুদিন আগে তার বাড়িতে বসেই আলাপ হয় যুদ্ধদিনের নানা ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে। আলাপচারিতায় তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময়কার নানা ঘটনা, পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ ও বর্তমান রাজনীতিসহ অকপটে তুলে ধরেন বেশ কিছু মতামত। একেকজন মুক্তিযোদ্ধার জীবনের গদ্যই মুক্তিযুদ্ধের একেকটি ইতিহাস। তাই বীরপ্রতীক সাইদুর রহমানের জীবন-ইতিহাসটিও একাত্তরের অকাট্য দলিল। যুগে যুগে যা আন্দোলিত করবে আগামী প্রজন্মকে।
সাইদুর রহমানের পিতা সিরাজুল ইসলাম আর মাতার নাম বশিরুন্নেসা। তাদের বাড়ি টাঙ্গাইলের কালিহাতি উপজেলার কামার্থী গ্রামে। বাবা কৃষিকাজ করতেন। ৫ ভাই ও ৫ বোনের সংসারে তিনি মেজো। কামার্থী গ্রামে আনন্দ হাসিতেই কাটে তার শৈশব ও কৈশোর।
কেমন ছিল সেই জীবন?
সাইদুর বলেন, “ছোটবেলায় কর্ম করে খেতে হইছে। স্কুলে গেছি, আবার এসে কাজ করতে হইছে। ক্ষেত বুনছি, ক্ষেত নিড়ানো, পাট কাটা, ঘাস কাটা প্রভৃতি। ভলিবল, হাডুডু (স্থানীয় ভাষায় গুডুগুডু) আর খেলতাম টকটক খেলা। এখন সে খেলা নাই। অথচ একসময় টকটক ছিল টাঙ্গাইলের এক নম্বর খেলা। স্কুলভিত্তিক প্রতিযোগিতায় কালিহাতি থেকে একবার টাঙ্গাইল গিয়ে গুডুগুডু খেলছি। ওই খেলাতে জিতছিলাম। গুডুগুডুতে আমি ছিলাম এক নম্বর প্লেয়ার। ছেলেরা তো এখন খেলতেই চায় না। সবাই আছে মোবাইল নিয়া।”
সাইদুর রহমানের লেখাপড়ায় হাতেখড়ি কামার্থী প্রাইমারি স্কুলে। এরপর ষষ্ঠ শ্রেণিতে তিনি ভর্তি হন কালিহাতির রামগতি শ্রী গোবিন্দ (আরএস) উচ্চ বিদ্যালয়ে। ১৯৬৮ সালে এসএসসি পাশ করে ইন্টারমেডিয়েটে ভর্তি হন করোটিয়া কলেজে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন ইন্টারমেডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র।
ছাত্রজীবন থেকেই সাইদুর যুক্ত ছিলেন ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে। ঊনসত্তরের গণআন্দোলন ও ছাত্র ধর্মঘটে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থেকেছেন। তার সঙ্গে পরিচয় ছিল লতিফ সিদ্দিকীর। কলেজে থাকতে তিনিই তাকে পরিচয় করিয়ে দেন কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে। সাইদুরের ভাষায়, “দেশের জন্য কিছু একটা করব এটাই ছিল তখন মূল চিন্তা। যারা ছাত্রলীগের রাজনীতি করছে, তারা সচেতন ছিল। তারাই যুদ্ধে গেছে বেশি। চিন্তা ছিল একটাই–দেশটাকে স্বাধীন করব। এটা তো সবাই করে নাই ভাই। করলে তো একাত্তরে কেউ রাজাকারে যেত না।”
করোটিয়া কলেজেই তিনি যুক্ত হন পিসিসিতে (পাকিস্তান ক্যাডেট কোর)। সেখানে অস্ত্র ট্রেনিং নেন ৬ মাস। পরে ওই ট্রেনিংই কাজে লেগে যায় মুক্তিযুদ্ধে। ওইসময় সাইদুর রহমান আর্মিতেও চান্স পান।
তিনি বলেন, “আর্মিতে অফিসার হিসেবে যেতে পারতাম। পিসিসি টেনিং করার পর একবার লোক নিলো। করোটিয়ায় দাঁড়িয়ে গেলাম। টিকেও গেছি। আর্মিতে থাকা আমাদের বাঙালিরা ডিসকারেজ করলেন। পাকিস্তানিরা আমাদের দেখতে পারে না। এটা শোনার পরই বলছি, ‘ধুর, যামু না’।”
টাঙ্গাইলে ওই সময়কার ছাত্র-আন্দোলন প্রসঙ্গে সাইদুর রহমান বলেন, “আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের পক্ষেই কাজ করেছি। টাঙ্গাইলে আমাদের নেতা ছিলেন লতিফ সিদ্দিকী। সত্তরের নির্বাচনে তিনি এমপিএ পদে দাড়ান। তখন আমরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে তার জন্য ভোট চাইছি। নির্বাচনে সারাদেশে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও ক্ষমতা দিতে টালবাহান করে পাকিস্তানি সামরিক সরকার। ফলে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। আমরাও তখন পথে নামছি।
৭ মার্চ ১৯৭১। বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেবেন ঢাকায়, রেসকোর্স ময়দানে। করোটিয়া কলেজে ছাত্রনেতারা সংগঠিত করেন আমাদের। ওইদিন সকালেই কয়েকটি বাসে করে চলে যাই রেসকোর্স ময়দানে। বঙ্গবন্ধুর পুরো ভাষণটাতেই সাহসের কথা। একটা অংশও গুরুত্বহীন ছিল না।
তিনি বললেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেবো। এ দেশকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ।... এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম.....’। এই কথাগুলো এখনও মনে দাগ কেটে আছে।”
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বাবা-মাকে জানিয়েই বাড়ি ছাড়েন সাইদুর। তারা কোনো বাধা দেননি। ছোটভাই ইদ্রিসসহ গ্রামের ৫ জন যুবককে নিয়ে যুক্ত হন বল্লার যুদ্ধে। আর্মিরা ছিল নদীর ওপারে। সেখানে ফায়ার করে ওদেরকে সরিয়ে দেন তারা। এছাড়া বল্লার যুদ্ধে নিহত সেনাদের মৃতদেহ পাকিস্তানি সেনারা উদ্ধারের চেষ্টা করলে সাইদুর ও তার দল তা নস্যাৎ করে দেন। চার সহযোদ্ধাকে নিয়ে নদী সাঁতরে নিহত পাকিস্তানি সেনাদের মৃতদেহ নিজেদের অবস্থানে নিয়ে আসেন তিনি।
তিনি বলেন, “প্রথম দিকে আমাদের অস্ত্র ছিল কম। থানায় বাঙালি পুলিশ যারা ছিলেন, তাদের অস্ত্রগুলো সংগ্রহ করি। শুরুটা এভাবেই হয়। পরে ভারতের সাথে যোগাযোগ করেন এমপিএ ও এমএনএরা। তাদের মাধ্যমেই পরে অনেক অস্ত্র পাই। মুক্তিযুদ্ধে সবসময়ই থাকতাম কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে। নানা জায়গায় গিয়ে তাঁর সঙ্গে অপারেশন করেছি প্রায় সাত মাস। কোথাও গেলে কি কি করতে হবে, সেগুলো দেখতে হতো আমায়। কাজগুলো দায়িত্ব নিয়েই করার চেষ্টা করছি।”
কাদের সিদ্দিকী (বীর বিক্রম) যে যুদ্ধে আহত হন সেখানে ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা সাইদুর রহমানও।
কী ঘটেছিল ওইদিন?
তার ভাষায়, “১৬ অগাস্ট ১৯৭১। দুপুরের দিকের ঘটনা। আমরা ঘাটাইলের মাকড়াইয়ে ঘাটাইল-ধলা পাড়া কাঁচা রাস্তার দক্ষিণে গ্রুপগুলো নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় পজিশনে থাকি। কাদের সিদ্দিকীসহ আমরা ছিলাম মাঝখানের একটি জায়গায়।
পাকিস্তানি আর্মিরা ধলা পাড়ায় গিয়েছিল। সেখান থেকে ওরা যখন ব্যাক করে তখন আমরা অ্যাটাক করছি। কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গেই আমরা বিশ-পঁচিশজন ছিলাম। অস্ত্র ছিল এলএমজি, গ্রেনেড, রাইফেল প্রভৃতি। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের মুখে পড়বে এটা ওরা স্বপ্নেও ভাবেনি। তুমুল গোলাগুলি চলে। আমাদের ব্রাশফায়ারে হানাদাররা লুটিয়ে পড়ে। আমার কাছে ছিল ব্রিটিশ এলএমজি। এক পর্যায়ে কাদের সিদ্দিকী সেটা নিয়ে গুলি করতে থাকে। আমি আর শামসুও থেমে থাকিনি। হঠাৎ পাকিস্তানি সেনাদের একটি গুলি এসে তার এলএমজির বাট ভেঙ্গে স্প্লিন্টার তার ডান হাতকে রক্তাক্ত করে। আরেকটি গুলি তার হাঁটুর নিচে বিদ্ধ হয়। আমি আর শামসু তখন তাকে ব্যাকে নিয়ে আসি। এই যুদ্ধে কাদের সিদ্দিকী আহত হলেও প্রায় ত্রিশজন সেনা হতাহত হয়। তিনি আহত অবস্থায় দেশে থাকলে ধরা পড়ার ভয় ছিল। তাই তার চিকিৎসার জন্য ময়মনসিংহ হয়ে ভারতের মেঘালয়ে চলে যাই। সেখানে তার চিকিৎসা চলে আট থেকে দশ দিন। এর পরই আমরা রণাঙ্গণে ফিরি।”
অপারেশনের ধরন নিয়ে আলাপচারিতায় এই মুক্তিযোদ্ধা তুলে ধরেন যুদ্ধকালীন কয়েকটি ঘটনা। সাইদুর রহমানের ভাষায়, “আমাদের গেরিলা বাহিনী যুদ্ধের সময় টাঙ্গাইল অঞ্চলে দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পাকিস্তানি সেনারা একাত্তরে যেসব এলাকায় বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি, তারই একটি টাঙ্গাইল। সাত মাস কেটে যাওয়ার পর আমাকে আলাদা কোম্পানি করে দেন কাদের সিদ্দিকী। কোম্পানিতে ছিল দেড়শ-এর মতো মুক্তিযোদ্ধা। কাদেরীয়া বাহিনীর ২৭ নম্বর কোম্পানির কমান্ডার ছিলাম। কোম্পানির নাম ছিল ‘হিরো কোম্পানি’, হিরো মানে ‘বীর’।
মির্জাপুরের যুদ্ধে আমার কাছে ৭ জন পাকিস্তানি আর্মি ও রাজাকার সারেন্ডার করে। ওরা মির্জাপুর থানায় ছিল। আমরা রাস্তার দিক থেকে গিয়ে ওদের ব্লক করি। মির্জাপুর, কালিয়াকৈর ও গাজীপুর– এই তিনটি এলাকা ছিল আমার কোম্পানির দায়িত্বে। এছাড়াও আমরা নাগরপুর, মানিকগঞ্জ, দুর্গাপুর, ভুঞাপুর, জামালপুর, শেরপুর প্রভৃতি জায়গায় দুর্ধর্ষ অপারেশনে অংশ নিই।”
নাগরপুর ছিল টাঙ্গাইল জেলার দক্ষিণে। এর পরই মানিকগঞ্জ জেলার সীমানা শুরু। মুক্তিযুদ্ধকালে নাগরপুরে ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর শক্তিশালী ঘাঁটি। কাদেরিয়া বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা বারবার ওদের অবস্থানে আক্রমণ করেও জয়ী হতে পারছিলেন না।
নভেম্বরের শেষে মুক্তিযোদ্ধারা সিদ্ধান্ত নিলেন, কয়েকটি দল মিলে সেখানে একত্রে আক্রমণ করবেন। এ জন্য সাইদুর রহমান, মালেক ও খোকার নেতৃত্বাধীন দলের বাছাই করা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে একটি আলাদা দল গঠন করা হয়। অতঃপর তারা ৩০ নভেম্বর তারিখে নাগরপুর আক্রমণ করেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মিলিত দল ওইদিন সকাল আনুমানিক ১০টার দিকে একযোগে আক্রমণ শুরু করেন। সাইদুর রহমান দুঃসাহসের সঙ্গে সহযোদ্ধাদের নিয়ে গুলি করতে করতে পাকিস্তানি প্রতিরক্ষার খুব কাছে অবস্থান নেন। সেখান থেকেই তিনি পাকিস্তানি অবস্থানে প্রচণ্ড গুলিবর্ষণ করতে থাকেন।
পাকিস্তানি সেনাদের দলে ছিল এক কোম্পানি মিলিশিয়া ও শতাধিক রাজাকার। তারা মাটির নিচে সুরক্ষিত বাঙ্কার থেকে পাল্টা আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের দুটি বাঙ্কারও ধ্বংস করে দেয়। কিন্তু তাতেও তারা কাবু হয় না। সারাদিন ধরে গোলাগুলি চলে। অন্ধকার নামতেই শুরু হয় বিক্ষিপ্ত গোলাগুলি।
পরদিন ভোরে মুক্তিযোদ্ধারা নতুন উদ্যোমে উপর্যুপরি আক্রমণ করলে ভেঙে যায় পাকিস্তানিদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।
আনুমানিক বেলা সাড়ে তিনটা তখন। খবর আসে একদল পাকিস্তানি সেনা টাঙ্গাইল থেকে নাগরপুরে আসছে। সাইদুর রহমান এতে বিচলিত হলেন না। তিনি সহযোদ্ধাদের নিয়ে সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাকলেন। তাঁদের সাঁড়াশি আক্রমণে হতাহত হলো বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি মিলিশিয়া ও তাদের সহযোগী রাজাকার। এর মধ্যেই সেখানে উপস্থিত হয় আরও পাকিস্তানি সেনা, তারা ছিল ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত। ওই সময় নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেন কাদের সিদ্দিকী (বীর উত্তম)। সাইদুর রহমান তখন সহযোদ্ধাদের নিয়ে পিছু হটে নিরাপদ স্থানে চলে যান।
নাগরপুরের যুদ্ধ নিয়েই এমন ঘটনার কথাই বলেন বীরপ্রতীক সাইদুর রহমান।
স্মৃতিতে থাকা একাত্তরে মন খারাপ করা একটি ঘটনার কথাও তুলে ধরেন এই বীরপ্রতীক। বলেন, “ঘাটাইলের ধলা পাড়ার এক বাড়িতে ছিলাম আমরা। রোজার সময়। এক সহযোদ্ধা রোজা রাখেন না বলে ওর বাড়িতে খাবার দেই নাই। কইছি যেহেতু তুই রোজা থাকবি না, তুই কিন্যা খাবি। সে ঘরের ভেতর শুয়ে ছিল। পাশে বসে আরেকজন রাইফেল পরিষ্কার করছিল। হঠাৎ একটা গুলি অসাবধানতাবশত বের হয়ে ওই ছেলেটির বুক দিয়ে ঢুকে টিনের ঘরে লেগে বাইরে আরেকজনের গায়ে গিয়ে লাগে। আমরা বাইরে ছিলাম। ফিরে এসে দেখি ভেতরে ওই ছেলেটা মরে পড়ে আছে। রক্তাক্ত হলেও বাইরের ছেলেটা প্রাণে বেঁচে যায়। এ ঘটনাটি মনে হলে এখনও ওই ছেলেটার জন্য মন খারাপ হয়। ওর নাম এখন মনে করতে পারছি না। এমন শত ঘটনা আমাদের হৃদয়কে রক্তাক্ত করেছিল একাত্তরে।”
১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর ২৪ জানুয়ারি তার কাছে অস্ত্র জমা দেয় কাদেরীয়া বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা। ওইদিন সাইদুর রহমান বঙ্গবন্ধুর পা ছুয়েও সালাম করেছিলেন। মধুময় সে স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে আবেগতাড়িত হন তিনি।
১৫ অগাস্ট ১৯৭৫। সপরিবারে হত্যা করা হয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে। ঘৃণ্য এই হত্যাকাণ্ড মেনে নিতে পারেনি বীরপ্রতীক সাইদুর রহমান। তারা প্রতিবাদ ও প্রতিশোধের প্রস্তুতি নেন।
এ প্রসঙ্গে সাইদুর রহমান বলেন, “বঙ্গবন্ধু আমাদের অন্তরের মানুষ ছিলেন। কোনো নেতা কি এত বছর জেল খাটছে? একটা দেশ স্বাধীনের মহানায়ক, রাষ্ট্র নেতা তিনি। আমাদের জাতির পিতা। তাকেই হত্যা করল সপরিবারে। এটা কি মুক্তিযোদ্ধা হয়ে মেনে নিতে পারি?
চেয়েছিলাম অস্ত্র হাতে প্রতিশোধ নিয়ে পুনরায় আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনতে। কাদের সিদ্দিকী ও লতিফ সিদ্দিকী আমাদের সশস্ত্র প্রতিবাদের নেতৃত্ব দেন। তাদের সঙ্গেই বর্ডার পার হয়ে চলে যাই ভারতে। আমার বড় মেয়ে নাহিদা নাজনিনের বয়স তখন মাত্র ১৫ দিন। একাত্তরের মতো বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করতেও ঘর ছাড়ি। স্ত্রী চাকরি করত। বহু কষ্ট করে সে-ই পরিবারটা চালিয়েছে।
জিয়াউর রহমানের আমল তখন। আমার খোঁজে মাঝেমধ্যে বাড়িতে আর্মি আসত। কোথায় আছি, পরিবার জানত না। কিছুদিন পর বাড়িতে খবর যায়– মারা গেছি। বাড়ির সবাই তা-ই বিশ্বাস করে। সবাই ধরেই নিয়েছে আর ফিরব না। ওটা ছিল আরেক যুদ্ধ ভাই।
কয়েকদিন ট্রেনিং নিয়ে আমরা অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে বর্ডার এলাকায় এসে ফায়ারিং করতাম। সিলেট, শেরপুর, কুড়িগ্রাম, রৌমারি প্রভৃতি এলাকায় বাংলাদেশ আর্মির সঙ্গে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে যুদ্ধ করেছি। এ নিয়ে আমার বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছিল। পরে ফিরে আসি ১৯৮০ সালে।
বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে কাদেরীয়া বাহিনীর ১০৪ জন মারাও গিয়েছিলেন তখন। কিন্তু ইতিহাসে তাদের সে আত্মত্যাগের স্বীকৃতি এখনও দেওয়া হয়নি। তবে এ নিয়ে কোনো আফসোস নেই আমার। বরং আমি গর্বিত। জাতির পিতার হত্যার অন্তত প্রতিবাদটুকু তো হয়েছিল।”
যে দেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছেন স্বপ্নের সে দেশ কি পেয়েছেন?
“অবশ্যই পেয়েছি। আগে তো পূর্ব পাকিস্তান আছিল, পাকিস্তানের একটা অংশ। যুদ্ধ করে স্বাধীন দেশ তো পেয়েছি। এখন স্বাধীন বাংলাদেশ। তখন স্বপ্ন ছিল একটা স্বাধীন দেশ হবে। সেটা আমরা পেয়েছি। সারা বিশ্বে এখন বাংলাদেশ পরিচিতি পেয়েছে। এটাই অনেক বড় পাওয়া।”
তখনকার রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে বর্তমানের পার্থক্যটা সাইদুর রহমানের চোখে কেমন?
“এখন হিসাব হলো চাওয়া-পাওয়ার, স্বার্থের টানে। তখন দেশের জন্য, মানুষের জন্য, কল্যাণের জন্য রাজনীতি ছিল। এখন এরা কেমনে ইনকাম করবো এই তালে আছে।”
যার নেতৃত্বে একাত্তরে যুদ্ধ করেছেন, সেই কাদের সিদ্দিকীর মূল্যায়ন করতে গিয়ে বীরপ্রতীক সাইদুর রহমান অকপটে বলেন, “একাত্তরের কাদের সিদ্দিকী বঙ্গবীর, ৭৫-এর কাদের সিদ্দিকী বঙ্গবন্ধুর হত্যায় প্রতিবাদকারী। এখনকার কাদের সিদ্দিকী আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে আলাদা দল করেছেন। স্বাধীনতা বিরোধীদের সাথেও উনি মিটিং করেন। এটা আমাদের কষ্ট দেয়। তার সঙ্গে থাকাও তাই সম্ভব হয়নি। উনি বহুবার চেষ্টা করেছেন আমাকে নিতে। যাইনি। স্বার্থের টানে যারা আলাদা হয়ে গেছে তাদের আবার আদর্শ কী?”
তিনি আরও বলেন, “জিয়াউর রহমান জয় বাংলা স্লোগান দিয়া দেশ স্বাধীন করে স্বাধীনতার পর জিন্দাবাদ বলে জাতীয়তাবাদী দল করছে। সবই স্বার্থের টানে। স্বাধীনতা বিরোধীদের নিয়া সরকার করছে। তার ফলও তিনি পেয়েছেন। জিয়া হত্যার বিচারও কেউ চায় না। আমাদের এখানে ছিলেন শাহজাহান সিরাজ, স্বাধীনতার ইস্তেহার পাঠক। দেশের ইতিহাসে মিশে আছে তার নাম। কিন্তু শেষে তিনিও নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। স্বাধীনতার পর জাসদের গণবাহিনী করে বহু মানুষের ক্ষতি করেছিলেন। এ সবই স্বার্থের কারণে। এখন এসব সত্য কথা বললে তো অনেকেরই ভালো লাগবে না। তাই সবকিছু থেকে দূরে দূরে থাকি।”
শত বাধা থাকলেও এদেশ একদিন অনেক এগিয়ে যাবে। কারণ এদেশের স্বাধীনতার জন্য লাখো মানুষ রক্ত দিয়েছেন। শহীদদের ওই রক্ত কখনও বৃথা যাবে না বলে মনে করেন বীরপ্রতীক সাইদুর রহমান।
প্রজন্মের উদ্দেশেই তিনি বলে গেছেন তার শেষ কথাগুলো, ঠিক এভাবে, “তোমরা এদেশের বীরত্বের ইতিহাসটা জেনে নিও। তোমরাই পারবে দেশকে এগিয়ে নিতে। মুক্তিযুদ্ধের ত্যাগের ইতিহাসই তোমাদের পথ দেখাবে। একাত্তরের ইতিহাসটা কেউ মুছে ফেলতে পারবে না। ইতিহাস ইতিহাসই থাকবে। সে ইতিহাসকে তোমরা জাগ্রত রেখ।”