শ্রমিক আন্দোলনের পথের দিশা কোথায়

বাংলাদেশের সকল শ্রমিক ইউনিয়নের দিকে তাকালেই আমরা দেখতে পাই, নেতৃত্বে বসে আছে ওই শ্রমিক শ্রেণিবহির্ভূত মানুষ। আজকের দিনে দেখা যায় ক্ষমতাসীন দলের লোকই একজন এলিট শ্রমিক নেতা, হয়তো সংসদ সদস্যও।

ফেরদৌস আহমেদ উজ্জলফেরদৌস আহমেদ উজ্জল
Published : 1 May 2023, 05:28 AM
Updated : 1 May 2023, 05:28 AM

রাজশাহীর পাশেই পাবনার চাটমোহর অঞ্চলে ছিল ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা কমরেড জসিম উদ্দিন মণ্ডলের বাস। রাজশাহীতে ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যখন সম্পৃক্ত হই, তখন পার্টির কাজের অংশ হিসেবে শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গেও যুক্ত হওয়া লাগত। তবে জসিম মণ্ডলের কাছে যাতায়াত ওই বাধ্যবাধকতার জন্য নয়। তার স্মৃতিচারণ থেকে জানা যেত, উপমহাদেশের শ্রমিক ও কমিউনিস্ট আন্দোলন সম্পর্কে। জ্যোতি বসুসহ অসংখ্য বিখ্যাত ব্যক্তির সঙ্গে সার্বক্ষণিক পার্টি কর্মী হিসেবে কাজ করেছেন তিনি, লড়াই সংগ্রাম করেছেন, জেল-জুলুম খেটেছেন। কোথাও বক্তব্য দিতে গেলে একটা কথা খুব স্পষ্ট করে বলতেন তিনি, ‘এ অংক বুঝিতেই হইবে! এ বিজ্ঞান বুঝিতেই হইবে!’ কী এই অংক ও বিজ্ঞান?

তার বক্তব্যের সারসংক্ষেপ ছিল, শ্রমিক শ্রেণির সংগ্রাম হলো সেই অংক ও বিজ্ঞান। যিনি এই বিজ্ঞান বুঝতে পারবেন তিনিই প্রকৃত বিপ্লবী হতে পারবেন। আবার কেউ শ্রমিক শ্রেণির লড়াই-সংগ্রাম না বুঝলে তিনি রাজনীতিই বুঝবেন না।

মহান মে দিবসে বরাবরই ছাত্র কমরেডদের দায়িত্ব পড়ত টিইউসির বড় মিছিলটার শ্লোগান দেয়া, র‌্যালি সুশৃঙ্খল রাখা আর শ্রমিকদের সঙ্গে সারাদিন কাটানো। মনে পড়ছে, শ্রমিক নেতা জেনু ভাই আমাদের খুবই সমাদর করতেন, উৎসাহ দিতেন, দিন শেষে আমাদের যৎসামান্য চা-নাস্তা করাতেন। আমরাও দিনটিতে শ্রমিকদের সঙ্গে থাকতে পেরে খুবই আনন্দ পেতাম। দীর্ঘ মিছিল শেষে মনে হতো এই মিছিলই আমাদের বিপ্লবের দিশা। একদিন আমরা এই শ্রমিকদের নেতৃত্বেই এগিয়ে যাব।

রাজশাহীতে ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে থাকলেও কখনও মিছিল, কখনও মিটিং, কখনও চিঠি নিয়ে রাজশাহী জুট মিলে পৌঁছে দেয়ার কাজ পেতাম। তখন রাজশাহী জুটমিলের খুব প্রতাপশালী নেতা ছিলেন কমরেড হামিদ ভাই। মিল গেটে আমি আর চন্দনদা কয়েকবারই তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছি। তিনি আমাদেরকে নিয়ে শ্রমিকদের থাকার জায়গায় বসাতেন, চা-নাস্তা খাওয়াতেন। তাদের লড়াই সংগ্রামের অভিজ্ঞতা শুনতাম আমরা। খুব রোমাঞ্চকর ছিল দিনগুলো।

এই কাজগুলোর জন্য গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি সদ্য প্রয়াত কমিউনিস্ট পার্টির রাজশাহী জেলা সভাপতি জননেতা কমরেড এনামুল হককে। কমরেড এনামুল নিজেও শ্রমিক হিসেবে রাজনীতিতে রেখে গিয়েছেন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তিনি বরাবরই আমাদের সকলকে শ্রমিক, কৃষক ও ক্ষেতমজুরদের সঙ্গে মিশে কাজ করার অনুপ্রেরণা দিতেন। মনে পড়ছে রেল শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা কাইয়ুম ভাইসহ অনেক শ্রমিক নেতাদের। এই সকল শ্রমিকদের সঙ্গে আমরা যখন পার্টির কিংবা ১১ দলের মিছিল করতাম, ওইসব মিছিলের শ্লোগান আর গতিই ছিল অন্যরকম। এত বলিষ্ঠ ছিল তাদের পদচারণা তা বলে বোঝানো কঠিন।

রাজশাহী রেশম কারখানা বন্ধ করা হয়েছিল বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসক্রিপশনে। যে রেশমের নামে রাজশাহী শহরের পরিচয় ছিল সিল্ক সিটি হিসেবে। রেশম কারখানা বন্ধ হলে হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে যান। ওই কারখানার অনেক শ্রমিক পার্টির কাজে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। মনে পড়ছে, রাজশাহী রেশম কারখানা পুনরায় চালু করার দাবিতে রাজশাহী শহরে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছিল। ওই কারখানা আজও চালু হয়নি। একই ঘটনা আমরা দেখেছি, আদমজী জুট মিলের ক্ষেত্রেও।

শ্রমিকদের জন্য কোনো বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি না করেই এমন হাজার হাজার মিল-কারখানা বন্ধ করল রাষ্ট্র। খুলনা, কুষ্টিয়া, সিলেট, চট্টগ্রামসহ দেশের নানান প্রান্তে কেবল এই বঞ্চিত শ্রমিকের দীর্ঘশ্বাস আপনি শুনতে পাবেন। প্রায় বছরদশেক আগে মাদারীপুরের এক গ্রামে একজন পাটকল শ্রমিক নেতার সঙ্গে দীর্ঘ আড্ডা হয়েছিল। তার বক্তব্যে ফুটে উঠেছিল কেন আমাদের দেশে এই সকল মিল-কারখানা বন্ধ হচ্ছে আর শ্রমজীবী মানুষেরা কেন দিন দিন আরও অসংগঠিত হচ্ছে। তার স্পষ্ট বক্তব্য ছিল, বিষয়টা রাজনৈতিক। শ্রমজীবী মানুষের একটি রাজনীতি আছে আর তার বিকাশের ওপরই নির্ভর করে শ্রমিক আন্দোলন। আবার শ্রমিক আন্দোলনের ওপর নির্ভর করে রাজনৈতিক আন্দোলন।

বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলনের অসংখ্য কিংবদন্তিতুল্য নেতা ছিলেন যাদের নাম বলে শেষ করা যাবে না। তাদের জীবন-যৌবন দিয়ে তারা এই লড়াইকে বেগবান করেছিলেন। জাতিকে পথ দেখিয়েছিলেন। এখনও শ্রমিক আন্দোলনের অনেক কিংবদন্তিতুল্য নেতা জীবিত আছেন। কিন্তু সেই শ্রমিক আন্দোলন আর নেই। ইতিহাস থেকে আমরা দেখতে পাই, ষাটের দশক তো বটেই, সত্তরের এবং আশির দশকেও দুর্দান্ত প্রতাপশালী শ্রমিক আন্দোলন ছিল আমাদের দেশে। ওই সময়ের জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে শ্রমিক আন্দোলনের স্রোত মেলার কারণেই জাতীয় রাজনীতিতে তা মারাত্মক গতিময়তা তৈরি করেছিল। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে কীভাবে ডেমরা, তেজগাঁও ও টঙ্গী থেকে হাজার হাজার শ্রমিক ছাত্র-জনতার সঙ্গে একাত্ম হয়েছিল আর যার বদৌলতে আন্দোলন বেগবান হয়েছিল। বৈঠা হাতে বুড়িগঙ্গার মাঝিরা এসে যোগ দিয়েছিল ছাত্র-জনতার মিছিলে, শ্লোগানে।

স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ নির্মাণে এদেশের শ্রমিক শ্রেণির রয়েছে সুবিশাল আত্মত্যাগের ইতিহাস। শ্রমজীবী মানুষ তাদের শ্রেণি আন্দোলনের পাশাপাশি, সকল জাতীয় আন্দোলনে রেখেছে অতুলনীয় ভূমিকা। দেশের সকল গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনে শ্রমিকের রক্তে রাজপথ হয়েছে রঞ্জিত। কিন্তু ওই সকল শ্রমিকদের নাম কি আমরা মনে রেখেছি?

বিশ্বব্যাপী শ্রমিক আন্দোলনের সূচনা থেকে আজ পর্যন্ত আমরা দেখতে পাই নানামাত্রিক বাক ও বৈচিত্র্য। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে বিশ্বব্যাপী মুক্তবাজার অর্থনীতির আগ্রাসনের প্রভাব পড়েছে সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বত্র। শ্রেণিতে শ্রেণিতেও এর প্রভাব কম নয়। আজকে ইউরোপ, আমেরিকা, ল্যাটিন কিংবা এশিয়ার শ্রমজীবী মানুষ ও তাদের জীবনযাত্রা, তাদের ওয়েজ, নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও রয়েছে নানামাত্রিক পার্থক্য। আমাদের দেশে একদম খাঁটি শ্রমজীবী শ্রেণি আছে কি নেই তা নিয়েই রয়েছে নানান রাজনৈতিক বিতর্ক। ওই বিতর্কে না গিয়ে এদেশের শ্রমজীবী মানুষের প্রকৃত স্বরূপ যদি দেখতে চাই তাহলে দেখব ইতিহাসের নানান কালপর্বে রয়েছে তাদের ঐতিহাসিক সব ভূমিকা। যেমন, মুক্তিযুদ্ধে ডক শ্রমিকরা অস্ত্র খালাস করতে অস্বীকৃতি জানালে পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর বিরাট প্রভাব তৈরি হয়েছিল। একইভাবে ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধে শ্রমিকরা সকল শ্রেণির নাগরিকদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংগ্রাম করেছে। এদেশের কৃষক-ক্ষেতমজুররাও এই শ্রমজীবী মানুষের কাতারেই অবস্থান করে।

আজকের এই নতুন বিশ্ব ব্যবস্থায় এসে বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলনের স্বরূপটা আসলে কী?

আমরা দেখেছি, বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফের প্রেসক্রিপশনে একের পর এক রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প-কারখানা বন্ধ করা হয়েছে। আমাদের ঐতিহ্য পাট ও পাটকলকে ধ্বংস করা হয়েছে। আমাদের সুতাকল, চিনিকল, রেশম কারখানাসহ যাবতীয় শিল্পকে ধ্বংস করা হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে খুলনা অঞ্চলে পাটকল শ্রমিকরা আন্দোলন করছে কিন্তু তাদের কথা শোনার কেউ নেই।

রেলকে ধ্বংস করা হচ্ছে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে। আমাদের মতো দেশে রেল যেভাবে জনপ্রিয় হবার কথা ছিল স্বার্থান্বেষী মহলের কারণে তা হয়নি। আমাদের পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন পরিণত হয়েছে ক্ষমতাসীনদের প্রায় অঙ্গসংগঠনে। এছাড়াও দেশব্যাপী হাজার হাজার শ্রমিক ইউনিয়ন রয়েছে কিন্তু তারা প্রায় সবাই ক্ষমতাসীনদের আজ্ঞাবহ কিংবা শ্রেণি সচেতন না।

আমাদের শ্রমজীবীদের একটা বড় অংশ প্রবাসী শ্রমিক কিন্তু তাদের জন্য নেই কোনো নীতিমালা। প্রতিবছর অসংখ্য শ্রমিকের লাশ দেশে আসে কিন্তু তাদের পরিবার পায় না কোনো সুবিচার। না দেশে, না আন্তর্জাতিক ময়দানে। দেশের রেমিটেন্সের সর্বোচ্চ জোগান দিয়েও তারা তাদের ন্যূনতম মর্যাদাটুকুও পাচ্ছেন না।

বাংলাদেশের সকল শ্রমিক ইউনিয়নের দিকে তাকালেই আমরা দেখতে পাই, নেতৃত্বে বসে আছে ওই শ্রমিক শ্রেণিবহির্ভূত মানুষ। আজকের দিনে দেখা যায় ক্ষমতাসীন দলের লোকই একজন এলিট শ্রমিক নেতা, হয়তো সংসদ সদস্যও। বর্তমানে মালিক পক্ষের প্রতিনিধিই হচ্ছেন একজন শ্রমিকনেতা। নব্বই পর্যন্ত এদেশের শ্রমজীবী মানুষেরা নিয়মতান্ত্রিক লড়াই-সংগ্রামের মাধ্যমে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন কিন্তু আজকে তার আর কোনো চিহ্ন দেখতে পাই না। বরং কোনো লড়াই-সংগ্রামের সূচনা হলে তাকে খুব নিয়মতান্ত্রিকভাবে দমন করাটাই বড় টার্গেট হয়ে যায় ইদানিং। আর খুব বেশি হলে লড়াইটা স্রেফ মজুরির দরকষাকষিতেই সীমাবদ্ধ থাকে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শ্রমিকদের আন্দোলনটাকেই আমাদের সামনে আনতে হয়। বিগত বেশ লম্বা একটা সময় ধরে এই সেক্টরকে ঘিরেই নানামাত্রিক শ্রমিক আন্দোলন আমরা লক্ষ্য করেছি। গার্মেন্টসে বেতন দিচ্ছে না তো শ্রমিকরা রাস্তায়। বোনাস দিচ্ছে না তো রাস্তায়। গার্মেন্টস বন্ধ তো তারা রাস্তায়।

আমাদের দেশে ট্রেড ইউনিয়ন করার আন্তর্জাতিক অধিকারের প্রশ্নটিই থেকে যাচ্ছে অন্ধকারে। স্বাধীনভাবে ট্রেড ইউনিয়ন করা, নির্বাচন করা, মজুরি নিয়ে দরকষাকষি করা, ভোটাধিকার, রেশনসহ যাবতীয় বিষয়গুলো নিয়ে এদেশের শ্রমিক আন্দোলনে জোরদার কোনো ভূমিকা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। কেন যাচ্ছে না তা খুঁজতে গিয়ে আমরা দেখি, বাংলাদেশে শ্রমিক আন্দোলনও দ্বিদলীয় বৃত্তে বন্দি। আন্তর্জাতিক শ্রম আইন ও আন্দোলনকে কোনোভাবেই ধর্তব্যের মধ্যেই নেয় না এখানকার শ্রমিক সংগঠনগুলো। ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার ও সিঁড়ি হিসেবেই তারা ব্যবহৃত হচ্ছেন বছরের পর বছর। পৃথিবীর অনেক দেশেই শক্তিশালী শ্রমিক আন্দোলন সংগঠিত হতে দেখেছি। অধিকার আদায়ের জন্য তারা প্রতিদিন তাদের লড়াই সংগ্রাম জারি রেখেছেন। তারা রেশন পান, ন্যূনতম মজুরি পান, পান নাগরিক হিসেবে সম্মান ও মর্যাদা। কিন্তু আমাদের দেশে শ্রমিক শ্রেণি ন্যূনতম মর্যাদা পায় না কোনো একটি সেক্টরেও। এদেশের শ্রমজীবীরা হলো কেবল পুঁজি তৈরির হাতিয়ার। ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার।

কোন দিকে যাচ্ছে আমাদের দেশের শ্রমিক আন্দোলন?

এখনও এদেশের বামপন্থী দলগুলোর কোনো কোনোটি ন্যূনতম অর্থে হলেও শ্রমজীবীদের লড়াই-সংগ্রামকে এগিয়ে নেয়ার প্রচেষ্টা জারি রেখেছে। কিন্তু কোটি কোটি শ্রমজীবী মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে পারে যে শ্রমিক আন্দোলন তার দেখা মিলছে না। বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন নিয়ে বারবার বিভিন্ন জোট, এলায়েন্স গঠিত হয়েছে, আন্দোলন-সংগ্রামে তাদের ভূমিকাও ছিল কিন্তু বর্তমানে তারা প্রায় সকলেই নিষ্ক্রিয়। সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক এজেন্ডা শেষ হবার পর এই জোটগুলোর আর কোনো ভূমিকা আমরা দেখতে পাই না।

অন্যদিকে মালিকপক্ষ বরাবরই খুবই সুসংগঠিত। তারা ব্যবসা যেমন নিয়ন্ত্রণ করছেন, একইভাবে শ্রমিক আন্দোলকেও দমন-নিয়ন্ত্রণ করছেন। কখনও খুব কৌশলে আবার কখনও পেশীশক্তির ব্যবহারও করতে দ্বিধাবোধ করেন না তারা। আর যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকেন তারা বরাবরই মালিকদের প্রতি খুবই আস্থাভাজন। তার প্রমাণ, সংখ্যাগরিষ্ঠ পার্লামেন্ট প্রতিনিধিই মালিকশ্রেণির লোক, মানে তারাই আইনপ্রণেতা। এই মালিকশ্রেণি অনেক সময় খুব কৌশলে শ্রমিক নেতাদের একটা অংশকে হাত করেও আন্দোলন-সংগ্রামকে নস্যাৎ করে থাকেন।

পথের দিশা কোথায়?

কমরেড জসিম উদ্দিন মণ্ডলের ‘জীবনের রেলগাড়ী’ আর কমরেড অনিল মুখার্জীর ‘শ্রমিক আন্দোলনের হাতেখড়ি’ পাঠ করলে আমরা দেখতে পাই, শ্রমিক রাজনীতি ও আন্দোলন যে আদর্শের পাটাতনে তৈরি হয় এবং তার জন্য যে লড়াই-সংগ্রাম, ত্যাগ-তিতিক্ষার প্রয়োজন তা বর্তমান বাস্তবতায় প্রায় অনুপস্থিত। বর্তমান পুঁজিবাদী ও ভোগবাদী বিশ্বব্যবস্থার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে। এর প্রভাব অর্থনীত, রাজনীতি, সংস্কৃতি, সংগঠন সকল ক্ষেত্রেই পড়েছে। শ্রমিক আন্দোলনের ওপরও এর নানামাত্রিক প্রভাব লক্ষ্যণীয়। যেহেতু শ্রমজীবী মানুষকে সংগঠিত করার রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, পথটা সত্যিই অনেক কঠিন। আর সে কারণেই ব্যবস্থার সঙ্গে নিজেদের খাপ খাওয়ানোর জন্য কিছু কর্মসূচিভিত্তিক লড়াইয়েই সীমাবদ্ধ থাকছে শ্রমিক আন্দোলন। মুক্তির পথ খুঁজে বের করতে এসময়ের শ্রমিক শ্রেণি কতটা একাত্ম হয়ে কাজ করছে তাও একটা বড় প্রশ্ন!

বাংলাদেশ রাষ্ট্র নির্মাণে ও তার সকল অর্জনে শ্রমজীবী মানুষের যে অবদান তা অনেকটা কিংবদন্তির মতো। অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ হওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই এই শ্রমিক শ্রেণির হাতে। শ্রমিক-মেহনতি মানুষের লড়াই জারি থাকুক। জয় হোক শ্রমিকের-মেহনতি মানুষের।