এ সংশোধনীর মাধ্যমে জেনারেল এরশাদ দুটি উদ্দেশ্য সিদ্ধি করতে চেয়েছিলেন; প্রথমত ইসলামের নাম ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের ধর্মভীরু সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমর্থন আদায় এবং দ্বিতীয়ত, বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে তার সরকারের অন্যতম প্রধান প্রতিপক্ষকে দুর্বল করে দেয়া।
Published : 13 Jun 2024, 06:07 PM
মানুষের ধর্ম থাকে, রাষ্ট্রের নয়। তারপরও বিশ্বের ৮০টির বেশি দেশে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রধর্মের সাংবিধানিক স্বীকৃতি রয়েছে। এর মধ্যে ২৭টি দেশে ইসলাম সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রধর্ম আর ১৩টি দেশে রাষ্ট্রধর্ম খ্রিস্ট ধর্ম। দুটি দেশে বৌদ্ধ ধর্ম হচ্ছে রাষ্ট্রধর্ম আর ইহুদী ধর্মের একমাত্র রাষ্ট্র হলো ইসরায়েল। এর বাইরে অনেক দেশের সংবিধান কোনো ধর্মকে সরাসরি রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা না করলেও বিশেষ একটি ধর্মকে অন্য ধর্মের ওপরে স্থান দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ পরোক্ষভাবে সেসব দেশেও রাষ্ট্রধর্ম আছে বলে মনে করা হয় (পিউ রিসার্চ সেন্টারের গবেষণাপত্র, ৩ অক্টোবর ২০১৭)।
দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে রাষ্ট্রধর্ম আছে চারটি দেশে। এগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও মালদ্বীপ। এসব দেশের সংবিধানে ইসলামকে সরাসরি রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ভুটান ও শ্রীলঙ্কার সংবিধানে বৌদ্ধ ধর্মকে সরাসরি রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করা না হলেও অন্যান্য ধর্মের ওপরে স্থান দেওয়া হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার বাকি দুটি দেশ ভারত ও নেপালের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্মের বিধান নেই।
২০১৫ সালে নেপালে হিন্দু ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করে সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব আনা হলেও সেটি বাতিল করা হয় এবং এই ইস্যুতে হিন্দুদের একটি অংশের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয় (যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ধর্মীয় স্বাধীনতাবিষয়ক রিপোর্ট, ২০১৫)।
পাকিস্তানের সংবিধানের ২ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রধর্ম হবে ইসলাম।’ বাংলাদেশেও রাষ্ট্রধর্মের বিধান রয়েছে সংবিধানের ২ নম্বর অনুচ্ছেদে। যদিও সাবেক প্রধান বিচারপতি এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের দাবি, বাংলাদেশ রাষ্ট্রধর্মের ধারণাটি নিয়েছে মালয়েশিয়ার কাছ থেকে (বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, আইনবিষয়ক প্রবন্ধাবলি, মাওলা ব্রাদার্স/২০২১২, পৃ. ৫১৫)।
বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম
১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ অনুষ্ঠিত চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৫১টি আসনে জয়ী হয় তখন ক্ষমতায় থাকা এরশাদের জাতীয় পার্টি। আ স ম আব্দুর রবের নেতৃত্বে সম্মিলিত বিরোধী দল ১৯টি, ফ্রিডম পার্টি ২টি, জাসদ (সিরাজ) ৩টি আসন পায়। এর বাইরে ২৫ জন প্রার্থী স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচিত হন। ওই বছরের ২৭ মার্চ মওদুদ আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত হয়।
দীর্ঘদিন ধরে আলাপ-আলোচনার পর ১৯৮৮ সালের ১১ মে সংসদ ভবনের কমিটি কক্ষে জাতীয় পার্টির সংসদীয় দলের বৈঠকে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করার অষ্টম সংশোধনী বিল অনুমোদন করা হয়। এরপর সংসদ নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী বিলটি সংসদে উত্থাপন করেন। বিলটি উত্থাপনের ২৭ দিন পর ১৯৮৮ সালের ৭ জুন রাত ৮টা ১০ মিনিটে স্পিকার শামসুল হুদা চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদ অধিবেশনে অষ্টম সংশোধনী বিল পাস হয়। বিলটি পাস হয়েছিল ২৫৪–০ ভোটে। ওই বছরের ৯ জুন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ অষ্টম সংশোধনী বিলে সম্মতি দিয়ে স্বাক্ষর করেন।
মূলত জেনারেল এরশাদ তার বিরুদ্ধে অব্যাহত আন্দোলনকে অন্য খাতে প্রবাহিত করা এবং সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষের সহানুভূতি ও সমর্থন লাভের আশায় নির্বাচনের পর রাষ্ট্রধর্মের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বক্তব্য রাখতে আরম্ভ করেন। মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের অব্যাহত আর্থিক সাহায্য ও সমর্থনের জন্যও তার ধর্মীয় আবেগ ও প্রতীক ব্যবহারের প্রয়োজন ছিল। ওই লক্ষ্যে এরশাদ সরকার অষ্টম সংশোধনী বিল উত্থাপন করেন। (ড. আবুল ফজল হক, বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থা ও রাজনীতি, অনন্যা/২০০৭, পৃ ১৯৩)
এ সংশোধনীর মাধ্যমে জেনারেল এরশাদ দুটি উদ্দেশ্য সিদ্ধি করতে চেয়েছিলেন; প্রথমত ইসলামের নাম ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের ধর্মভীরু সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমর্থন আদায় এবং দ্বিতীয়ত, বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে তার সরকারের অন্যতম প্রধান প্রতিপক্ষকে দুর্বল করে দেয়া। কেননা এরশাদ সরকার শুরু থেকেই বৈধতার সংকটে ভুগছিলেন এবং বৈধতা অর্জনের বিভিন্ন প্রয়োজনেও খুব বেশি সুবিধা হচ্ছিল না। তার বৈধতার সংকট যেমন তীব্র ছিল তেমনি বিরোধীদের সঙ্গেও বিরোধ ছিল তুঙ্গে। বলা যায় এরশাদ সরকার যে দ্রুত গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে বিতাড়িত হবার অবস্থায় উপনীত হয়েছিল, সেখান থেকে বেরিয়ে আসার জন্য এমন কিছু করার দরকার ছিল যাতে করে জনগণের সহানুভূতি ও সমর্থন কিছুটা হলেও ফেরত আসে। (কাজী জাহেদ ইকবাল, বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধনী ১৯৭২-১৯৯৮ প্রেক্ষাপট ও পর্যালোচনা, ধ্রুবপদ/২০১৬, পৃ. ৮৫)।
সংসদে বিতর্ক
প্রশ্ন হলো, ১৯৮৮ সালে রাষ্ট্রধর্মসম্পর্কিত সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী বিলটি যখন সংসদে উত্থাপন করা হয়, তখন এ নিয়ে কী ধরনের বিতর্ক হয়েছিল?
বরগুনা-২ আসন থেকে নির্বাচিত স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম মনি অষ্টম সংশোধনীর বিরোধিতা করে একে ‘ফায়দা লোটার চেষ্টা’ বলে অভিহিত করেন। জীবনানন্দের কবিতা ‘অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ’ আবৃত্তি করে বিলের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেন শাজাহান সিরাজ। শুধু তাই নয়, সংসদে ‘অনুগত’ বিরোধী দল হওয়া সত্ত্বেও অষ্টম সংশোধনী বিলের প্রতিবাদে তারা ওয়াক আউট করেন।
জাতীয় পার্টিকে জামায়াতে যোগদানের আহ্বান
নুরুল ইসলাম মনি সরকারের কড়া সমালোচনা করে বলেন, ‘যে দেশে শতকরা ৯৫ জন মুসলমান, সে দেশে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করে, এরকম একটি নামকরণ করে সুড়সুড়ি দেয়ার অবকাশ কোথায়? এটাতো যেকোনো দিন সকাল বেলা বলে দেওয়া যেতে পারে যে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। আমরা তো সেটা পালন করছি। এখানে তো রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের বিরোধিতা কেউ করবে বলে আমি বিশ্বাস করি না। কিন্তু এটাকে নিয়ে একটি রাজনৈতিক ফায়দা লোটার অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে।’
মনি বলেন, ‘জামায়াত যদিও এটা সমর্থন করছে, এর পাশাপাশি দেখা যাচ্ছে আওয়ামী লীগ সমর্থন করছে না। বিএনপি মাঝামাঝি সমর্থন করছে। একটা অনৈক্যের সৃষ্টি করা হচ্ছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করা হচ্ছে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির ব্যবস্থা করা হচ্ছে এই বিলটির মাধ্যমে।’ এ অবস্থায় জাতীয় পার্টির সদস্যদেরকে জামায়াতে ইসলামীতে যোগদানেরও আহ্বান জানান নুরল ইসলাম মনি। (জাতীয় সংসদের কার্যবিবরণী, ১৯৮৮)।
ঢাকা-৫ থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য মো. সিরাজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এই দেশের শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ জনগোষ্ঠী মুসলমান। আজকে নীতিগতভাবে এই বিলের বিরুদ্ধে বলতে গেলে মৌলবাদীদের চিন্তা-চেতনা বা আমাদের মোল্লাদের চিন্তা-চেতনায় এটাকে তারা কোন ফতোয়ায় ফেলবেন আমি জানি না। তবে যদি এর পক্ষে বলা যায়, তবে কোরান-হাদিস থেকে খুব সুন্দরভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে অনেক কথা বলা যাবে। আজকে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, ঠিক যে মুহূর্তে আমাদের সংসদে এই বিলটি এসেছে, যে সময়ে আজকে পাকিস্তানে ইসলামি শাসনতন্ত্রের নামে জাতীয় সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। পাক-ভারত উপমহাদেশে আজকে ইসলামিকরণের যে হাওয়া বইছে, এই হাওয়া বাংলাদেশেও এসে পৌঁছেছে। ইসলাম মানবতার ধর্ম, ইসলাম সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম। ইসলামের মধ্যে কোনো বিভ্রান্তি নেই। নবী করিম (স.) সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ দিয়েছেন ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি না করার জন্য। কিন্তু আজকে ধর্মকে বাইরে টেনে আনা হচ্ছে। এর ফলে বাইরে যে আন্দোলন, যে কথাবার্তা হচ্ছে, তাতে কিছুটা হলেও আমাদের শান্তি ও স্থিতিশীলতায় বিঘ্ন ঘটছে।’
গোলাম আযমকে নিয়ে প্রশ্ন
রাষ্ট্রধর্মকে একটি ‘অপ্রয়োজনীয় বিল’ উল্লেখ করে একজন সংসদ সদস্য বলেন, ‘আমাদের সংবিধানে জাতীয় ধর্ম সংযোজন করতে হবে, ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করতে হবে এমন কোনো দাবি বা আন্দোলন জনগণের পক্ষ থেকে কোনোদিন সোচ্চার হয়নি। এমন চিন্তাভাবনা জনগণের মধ্যে আসেনি। বরং যারা ইসলামের নামে ৭১ সালে কুফরি করেছে, তাদের বিরুদ্ধে মানুষ সোচ্চার। গোলাম আযমের মতো লোক, যে এ দেশের বুদ্ধিজীবী হত্যার নেতৃত্ব দিয়েছে, এ দেশের মা-বোনের ইজ্জত নষ্ট করতে পাকিস্তানিদের সহায়তা করেছে, তার মতো ঘৃণ্য লোককে বাংলাদেশের মাটিতে রেখে ইসলামকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম করার এই যে গোঁজামিল, এটাকে আমি মনে করি, ইসলামের প্রতি অবমাননা। গোলাম আযমের মতো নরপিশাচকে বাংলার মাটিতে রেখে ইসলামকে মর্যাদা দেওয়া যেতে পারে না। গোলামকে বহিষ্কারের ব্যাপারে বাংলাদেশের মানুষ সোচ্চার। আমি দাবি করব, আজ আমাদের সংসদ-নেতা ঘোষণা করুন, কবে কত তারিখের মধ্যে সরকার বাংলার মাটি থেকে গোলাম আযমকে বহিষ্কার করবেন তা বলুন, কারণ এ কথা বাংলার মানুষ জানতে চায়।’
সম্মিলিত বিরোধী দল থেকে নির্বাচিত রাজবাড়ি-২ আসনের সংসদ সদস্য মোসলেম উদ্দিনে বলেন, ‘একটি ধর্মকে জোর করে কারও উপর চাপিয়ে দেওয়া যায় না। কাউকে বিশ্বাসী করা যায় না। কাউকে জোর করে নামাজ পড়ানো যায় না, রোজা রাখানো যায় না, হজ, জাকাত কোনো কিছুই বাধ্যতামূলক করা যায় না। এগুলো সব একটি মানুষের আত্মার চাহিদা এবং সেই চাহিদা মোতাবেক একটি ঐশ্বরিক শান্তি পাবার আকাঙ্ক্ষায় মানুষ ধর্মকে অনুসরণ করে এবং তার পূর্বপুরুষ থেকে যে ধর্মে অবস্থান করে সেদিকেই সে সম্ভবত প্রবাহিত হয়। তাই, আমি মনে করি যে, এখানকার মানুষ ইসলাম ধর্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম করলেই নতুন করে নামাজ পড়বে না। নতুন করে মসজিদ মাদ্রাসা গড়ে উঠবে না।’
রাষ্ট্রধর্ম বিল সরকারের ‘শেষ ট্যাবলেট’
রাষ্ট্রধর্ম বিলকে সরকারের ‘শেষ ট্যাবলেট’ উল্লেখ করে গাইবান্ধা-৪ আসনের সংসদ সদস্য আতাউর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও আমরা তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারি নাই। ইসলামকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম করার জন্য যারা চিন্তা-ভাবনা, চেষ্টা-চরিত্র করছেন তারা সবাই ক্ষমতায় ছিলেন এবং আছেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কল্যাণের জন্য যতটুকু করা প্রয়োজন তা তারা করতে পারেন নাই। তাই আমরা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায়, সমাজ ব্যবস্থায়, প্রশাসন ব্যবস্থায় দেখছি ঘুষ, দুর্নীতি, অনাচার, অবিচার, জুলুম, নারী নির্যাতন এমন কোনো ব্যবস্থা নাই যেটা বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় এবং প্রশাসনে নাই। আজকে বাংলাদেশের মানুষের কল্যাণের জন্য ধর্মকে টেনে আনা হচ্ছে। আমার মনে হয়, বর্তমান সরকারের এটা শেষ ট্যাবলেট।’
বিরোধী নেতা রবের দীর্ঘ বক্তৃতা
রাষ্ট্রধর্ম বিলের বিরুদ্ধে সবচেয়ে জোরালো এবং দীর্ঘ বক্তৃতা দেন বিরোধী দলীয় নেতা আ স ম আব্দুর রব। তিনি বলেন, ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম পড়ে শুয়োর জবাই করলেই সেটা হালাল হবে না। এই সংসদে একজন সদস্য টুপি মাথায় দিয়ে ট্রেজারি বেঞ্চে বসে আছেন, কয়েকবার হজ করেছেন, হাজী আবদুল ওদুদ সাহেব, তার কাছে শুনেছি যে, পাকিস্তান আমলে একটি জেলা শহরে একটি ওষুধের দোকান ছিল, সেটার নাম ছিল ‘স্বদেশী ঔষধের দোকান’, এর নিচে আবার ছোট করে লেখা ছিল বিদেশি মদ পাওয়া যায়। মাননীয় স্পিকার, আপনি ইচ্ছা করলে ওদুদ সাহেবকে জিজ্ঞাসা করতে পারেন, কথাটা সত্য কি না।’
আব্দুর রব বলেন, ‘পাকিস্তান ছিল ইসলামি রাষ্ট্র। সেই পাকিস্তান ৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষের উপর কী ধরনের ব্যাভিচার, অত্যাচার, জুলুম নির্যাতন করেছে এই ইসলামের নামে, আমরা সবাই সেটা প্রত্যক্ষ করেছি। আজ আমাদের দেশে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হওয়ার পর, এ দেশে যে মদ, জুয়া, জেনা, ধোকাবাজি, ঘুষ, মোনাফেকি, কুফরি এগুলি কি ইসলামি মদ, ইসলামি জুয়া, ইসলামি ঘুষ, ইসলামি কুফরি ইত্যাদি হবে বলে ধরে নেব? আসলে এইসব সামাজিক অনাচার, অপকর্ম যতদিন পর্যন্ত না আমরা আমাদের সমাজ থেকে দূর করতে পারব, ততদিন পর্যন্ত ইসলামি কায়দায় টুপি পরে, চাঁদতারা লাগিয়ে, বুকের মধ্যে তাবিজের মত আল্লাহ আকবর ঝুলিয়ে, পিঠের মধ্যে ইসলামি সাইনবোর্ড লাগিয়ে সমস্ত আকাম-কুকাম করা মানুষটা আল্লাহর খাস মুসলমান বা ইসলামের জন্য জান কোরবান মুসলমান হতে পারে না।’
বিরোধী দলীয় নেতা বলেন, ‘আমার আর এক বন্ধু বলতে গিয়ে ফিল্ড মার্শাল মানেক'শর উদাহরণ দিয়েছেন। উনি বলেছেন যে, ‘বাংলাদেশ একদিন ইসলামী প্রজাতন্ত্র হলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নাই।’ তিনি আরও বলেছেন যে, মানেক'শরা চান যে, আমাদের এখানে fundamentalist-রা যদি ক্ষমতায় থাকেন, তাহলে ভারতের অভ্যন্তরীণ যে সমস্যাগুলো আছে, হরিজন, শিখ, গুর্দা এই যে সমস্যাগুলো আছে, এগুলোর হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য তারা চান যে, বাংলাদেশের মতো তাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রে সাম্প্রদায়িকতা বজায় থাকুক। তাহলে তাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো সমাধান করার জন্য এটার উদাহরণ দিয়ে তারা নিজেরা নিষ্কৃতি পাবেন।’
পূর্তমন্ত্রী শেখ শহীদের সাফাই
পূর্তমন্ত্রী শেখ শহীদুল ইসলাম অবশ্য বিলের পক্ষে যুক্তি দিয়ে বলেন, ‘আল্লাহ আমাদেরকে যে উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছন, তার ধর্মের প্রচার, তার ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করা, সেইজন্য ইসলামকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম করা এটা মুসলমান হিসাবে আমাদের প্রত্যেকের জাতির প্রতি, আমাদের ধর্মের প্রতি একটি অঙ্গীকার। তার অর্থ এই নয় যে, আমরা এই বিল এনে আমাদের দেশকে এমন একটি মৌলবাদী দেশে পরিণত করব, যেখানে অন্য ধর্মের লোক তাদের ধর্মকে পালন করতে পারবে না। সেজন্য এখানে সুস্পষ্টভাবে ধর্মের কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্ম প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাইবে।’
তিনি বলেন, ‘মাননীয় স্পিকার, এই বাংলাদেশ এখানে দশ পারসেন্ট অন্য ধর্মাবলম্বী লোক আছে। কিন্তু আমরা বলতে পারি, এই বাংলাদেশের মানুষ, এই বাংলাদেশের সরকার, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, আমাদের সকলের দৃষ্টিভঙ্গী সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক। যার কারণে বাংলাদেশে ১৯৬৪ সালের দাঙ্গার পরে আর কোনো দাঙ্গা অনুষ্ঠিত হয় নাই। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাংলাদেশের মাটি থেকে চিরকালের জন্য উঠে গেছে এবং বাংলাদেশের মুসলমানেরা এখানকার হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সকল ধর্মের মানুষের সঙ্গে অত্যন্ত শান্তিতে সহৃদয়তার সঙ্গে, সৌহার্দ্যের সঙ্গে বসবাস করছে। এরপরে আর কোনো আশংকা থাকার অবকাশ নেই যে, এই ধর্ম বিল আনার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে এমন একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে যে, এই দেশটি অন্যান্য যারা অমুসলমান সম্প্রদায়ভুক্ত আছেন তাদের জন্য একটি নারকীয় যজ্ঞে পরিণত হবে।’
কী বলেছিলেন সংসদ নেতা মওদুদ?
জনমত যাচাইয়ের প্রস্তাবের ওপর আলোচনার পরে এ বিষয়ে সংসদ নেতা মওদুদ আহমদ তার দীর্ঘ ব্যাখ্যা দেন এবং বলেন, রাষ্ট্রীয় ধর্ম আর ধর্মীয় রাষ্ট্র এক জিনিস নয়। দুটি আলাদা জিনিস। তিনি ইসলামকে ‘সেক্যুলার ধর্ম’ উল্লেখ করে বলেন, ‘এখানে সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্ন তোলা হয়েছে যে, এই সংশোধনীর ফলে সাম্প্রদায়িকতা বেড়ে যাবে। সাম্প্রদায়িকতা নির্ভর করে দেশের মানুষের মানসিকতার উপরে। সাম্প্রদায়িকতার দৃষ্টান্ত আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রের আছে, মাননীয় স্পিকার। অনেক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সেখানে হয়। কিন্তু তার পরেও আমরা বলব না যে, সেটা একটা secular state নয়। কিন্তু আমাদের এখানে শত শত বছর ধরে চেষ্টা করেও সাম্প্রদায়িকতার বীজ এখানে বপন করা সম্ভবপর হয় নাই। কারণ আমাদের এলাকার মানুষ, আমাদের দেশের মানুষ শত শত বছর ধরে হিন্দুদের সঙ্গে, খ্রিষ্টানদের সঙ্গে, বৌদ্ধদের সঙ্গে একসঙ্গে বসবাস করছে। দশ বছর আগে, এগার বছর আগে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম লিখেছে। কোনো মুসলমান গিয়ে কোনো হিন্দুকে কতল করেছে, কোনো খ্রিষ্টানকে অপমান করেছে?’
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ১৯৭২ সালে নতুন রাষ্ট্রের জন্য যারা সংবিধান প্রণয়ন করেন, তারা সংবিধানে মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা উল্লেখ করলেও কয়েক মাস আগেও তাদের অবস্থান ভিন্ন ছিল বলে দাবি করেন মওদুদ। বলেন, ‘সত্তুর সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যখন আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেন তখন তারা পাকিস্তান ন্যাশনাল এ্যাসেম্বলীর ১৬৯টি সিটের মধ্যে ১৬৭টি সিট পেলেন। তাদের উপর দায়িত্ব হল পাকিস্তানের জন্য সংবিধান রচনা করা। ৩১ সদস্য বিশিষ্ট Constitution Committee করা হয়েছিল। অত্যন্ত interesting ব্যাপার। আওয়ামী লীগ সংবিধান কমিটি কর্তৃক ৬ দফার ভিত্তিতে প্রণীত পাকিস্তানের খসড়া শাসনতন্ত্র। ড. কামাল হোসেন হলেন সূত্র। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের একটি তারিখ দেওয়া হয়েছে। "Draft Constitution of the Federal Republic of Pakistan-এর মধ্যে বলা হয়েছে 'secularism' তো দূরের কথা, তার মধ্যে ছিল: "...Collectively to order their lives in accordance with the teachings of Islam as set out in the Holy Quran and Sunnah..." তারপরে বলছে, "Directive Principles of State Policy Islam. No law shall be repugnant to the injunctions of Islam as laid down in the Holy Quran and Sunnah."
যারা আজকে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে এই মুহূর্তে ঢাকা শহরে ছোট সভা করে প্রতিবাদ করার চেষ্টা করছেন তারা যখন এই সংবিধান ড্রাফট করেছিলেন তখন তারা এগুলো কেন লিখেছিলেন? কারণ তখন তো আমরা স্বাধীকারের পথে চলে গিয়েছিলাম।’
মওদুদ আহমদ বলেন, ‘আজকে এখন এই ধর্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম করার জন্য আমাদের দেশের মানুষকে এত undermine করা ঠিক নয়। আমাদের দেশের মানুষ অনেক সচেতন। সুতরাং, সাম্প্রদায়িক এবং সংখ্যালঘুদের উপরে যে কথাবার্তা এসেছে, এগুলো তাৎক্ষণিক। এগুলো আমরা নিজেরাই বাড়িয়ে এসব সম্পর্কে কথা বলে তাদের মনে ভয়ভীতি সঞ্চার করার চেষ্টা করছি।’
প্রসঙ্গত, বিলটির ওপর জনমত যাচাইয়ের প্রস্তাব দিয়ে ১৯ জন সংসদ সদস্য ৫ থেকে ২০ মিনিট করে বক্তব্য দেন। যদিও কণ্ঠভোটে জনমত যাচাইয়ের প্রস্তাব নাকচ হয়ে যায়।
অষ্টম সংশোধনীর প্রতিক্রিয়া
প্রায় সকল বিরোধী দল এবং বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় অষ্টম সংশাধনীর তীব্র বিরোধিতা করে। সর্বপ্রথম পেশাগত প্রতিবাদ শুরু হয় আইনজীবীদের ভেতর থেকে। তারা কোর্ট বর্জনসহ মিছিল মিটিং করে প্রতিবাদ জানান। তাদের প্রতিবাদের মূল কারণ ছিল এই সংশোধনীর মধ্য দিয়ে ঢাকার বাইরেও হাইকোর্টের বেঞ্চ স্থাপন করা হয়। যদিও শেষ পর্যন্ত এরশাদ ওই বিরোধিতা সামাল দিতে পারেননি। তাছাড়া অষ্টম সংশোধনীর এই যে অংশটুকুর দ্বারা হাইকোর্ট সরিয়ে নেয়া হয়েছিল, উচ্চ আদালত সেটি অবৈধ বলে রায় দেন।
অষ্টম সংশোধনীর প্রতিবাদে ৫, ৭ ও ৮ দলীয় জোটের আহ্বানে ১৯৮৮ সালের ১২ জুন তারিখে সারাদেশ হরতাল পালিত হয়। তাদের যুক্তি ছিল যে, ভোটারবিহীন নির্বাচনে নির্বাচিত ‘অবৈধ’ সংসদের সংবিধান সংশোধনের কোনো অধিকার নেই। তাছাড়া ৮ ও ৫ দলীয় জোটের অন্তর্ভুক্ত দলগুলো রাষ্ট্রধর্ম সংক্রান্ত ঘোষণাকে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী বলে মনে করে। এ দলগুলো অভিমত প্রকাশ করে যে, ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা অবান্তর এবং তার ফলে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পথ প্রশস্ত হবে। (ড. আবুল ফজল হক, বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থা ও রাজনীতি, অনন্যা/২০০৭, পৃ ১৯৪)।
একসময়ের ডাকসাইটে আওয়ামী লীগ নেতা এবং পরবর্তীকালে এরশাদ সরকারের প্রধানমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরী তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী বিল পাশের প্রতিবাদে বিরোধী দলগুলো ১৯৮৮ সালের ১৩ জুন দেশব্যাপী অর্ধদিবস হরতাল পালন করলেও ইতিমধ্যে অগাস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে সারাদেশ ভয়াবহ বন্যার কবলে পতিত হয়। বন্যার কারণে বিরোধী দলের আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়ে। এদিকে নীল নকশার নির্বাচনের সংসদ কার্যকর থাকায় এরশাদ খানিকটা সুবিধাজনক অবস্থানে থেকে দেশ চালিয়ে যেতে থাকেন। তাছাড়া বিরোধী দলগুলোর মধ্যেকার অন্তর্দ্বন্দ্ব, জোটের শরীক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহ ও অবিশ্বাস তাদেকে সরকার-বিরোধী আন্দোলনে নামাতে পারেনি। তবে ক্ষুদ্র কয়েকটি বামদলের সমন্বয়ে গঠিত পাঁচ দল আন্তরিকভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলো যে প্রধান দুই জোটের মধ্যকার অবিশ্বাস-সন্দেহ দূর করে সরকারবিরোধী আন্দোলনের নতুন উদ্যোগ নেয়া যায় কি না। (মিজানুর রহমান চৌধুরী, রাজনীতির তিনকাল, অনন্যা/২০০৩, পৃ. ২২৯)।
সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম যুক্ত করার সিদ্ধান্তের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেছিলেন দেশের ১৫ জন বরেণ্য ব্যক্তি। তারা হলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি কামালউদ্দিন হোসেন, বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য, বিচারপতি কে এম সোবহান, কবি সুফিয়া কামাল, অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ, অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক মোশাররফ হোসেন, শিল্পী কলিম শরাফী, সেক্টর কমান্ডার সি আর দত্ত, বদরুদ্দীন উমর, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর ও সাংবাদিক ফয়েজ আহমেদ।
রিট আবেদনের ২৩ বছর পরে ২০১১ সালের ৮ জুন বিচারপতি এএইচএ শামসুদ্দীন চৌধুরী ও বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুরের বেঞ্চ একটি রুল জারি করেন। ওইদিনই অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে ১৪ জন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীকে নিয়োগ দেয়া হয়। তারা হলেন ড. এম জহির, মাহমুদুল ইসলাম, টি এইচ খান, ড. কামাল হোসেন, রফিক-উল হক, এম আমীর-উল ইসলাম, এ এফ হাসান আরিফ, রোকনউদ্দিন মাহমুদ, আখতার ইমাম, ফিদা এম কামাল, আজমালুল হোসেন কিউসি, আবদুল মতিন খসরু, ইউসুফ হোসেন হুমায়ু ও আফম মেজবাহ উদ্দিন। রুল জারির প্রায় পাঁচ বছর পরে ২০১৬ সালের ৮ মার্চ রুল শুনানির জন্য আদালতে ওঠে। কিন্তু ওইদিনই বিচারপতি নাঈমা হায়দার, বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বেঞ্চ রিট আবেদনটি সরাসরি খারিজ করে দেন।
এর ৮ বছর পরে ২০২৪ সালের ২৫ এপ্রিল ৫২ পৃষ্ঠার যে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়, সেখানে বলা হয়: ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে আঘাত করে না’। বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি নাইমা হায়দারের লেখা রায়ে হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ হিসেবে বলা হয়, সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্মের স্বীকৃতি দেওয়া সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকেও আঘাত করে না। সংবিধানের ২ (ক) অনুচ্ছেদে সন্নিবেশিত রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লিখিত মৌলিক নীতিগুলো এবং অন্য কোনো বিধানের সঙ্গেও অসঙ্গতিপূর্ণ নয়। সংবিধানে ইসলামকে ‘রাষ্ট্রধর্ম মর্যাদা’ প্রদান করা হলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে রাজনৈতিক মর্যাদা প্রদানের বাধ্যবাধকতা নেই। অনুচ্ছেদ ২ (ক) অবশ্যই সামগ্রিকভাবে পড়তে হবে এবং পড়লে এটা সুস্পষ্ট হয়, ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করার ধারণার সন্নিবেশ কোনোভাবেই ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সাংবিধানিক অধিকারকে খর্ব করে না। এটি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকেও প্রভাবিত করে না এবং সংবিধানে বাহুল্যতাও সৃষ্টি করে না। (ইত্তেফাক, ২৬ এপ্রিল ২০২৪)।
২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাহাত্তরের মূল সংবিধানের চার মূলনীতি এবং অন্যান্য বিধান ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হলেও রাষ্ট্রধর্ম বাতিল করা হয়নি। তবে রাষ্ট্রধর্মসম্পর্কিত সংবিধানের ২(ক) অনুচ্ছেদে বাক্যে কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়— যেখানে ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম হলেও অন্য ধর্মের সমঅধিকার নিশ্চিত করার বিষয়টি রাষ্ট্রের কর্তব্য বলে ঘোষণা করা হয়েছে।