‘দাও ফিরে সে অরণ্য’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো জানতেন, আলবত জানতেন, উন্নয়নের নামে যা আমাদের গেলানো হয়, তার ভেতরকার 'শুভঙ্করের ফাঁকি'টির ভালোবাসার ডাকনাম 'সভ্যতা'।

সৌমিত জয়দ্বীপসৌমিত জয়দ্বীপ
Published : 8 May 2023, 04:15 AM
Updated : 8 May 2023, 04:15 AM

রোমান্টিকতার বশবর্তী হয়ে নয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিশ্চয়ই হিসাবনিকাশ করেই কথাটা বলেছিলেন। শুধু বলেনইনি, বড় এক প্রশ্নচিহ্ন এঁটে দিয়েছিলেন এই ‘সভ্যতার প্রতি’। নির্ঝরের যে গান তিনি মহাসাগরের দূরবর্তী ধ্বনিতেও শুনতে পেয়েছিলেন, তা এক অলঙ্ঘনীয় দ্যোতনা তৈরি করে। দ্যোতনা সৃষ্টিকারী সেই পথ পাড়ি দেয়ার হিমালয়সম উচ্চতা নিয়ে ঠাকুর জন্মেছিলেন। ফলে, যান্ত্রিক এ ‘নবসভ্যতা’র প্রতি এক ‘অপরূপ অনাস্থা’ ছিল তাঁর।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো জানতেন, আলবত জানতেন, উন্নয়নের নামে যা আমাদের গেলানো হয়, তার ভেতরকার 'শুভঙ্করের ফাঁকি'টির ভালোবাসার ডাকনাম 'সভ্যতা'। এও তো তিনি বরং আরও অধিক জানতেন যে, পৃথিবীতে সভ্যতার ইতিহাস মূলত প্রকৃতিদত্ত জঙ্গল ধ্বংসেরই ইতিহাস। ফলতঃ ঠাকুরকে বলতে হয়, 'দাও ফিরে সে অরণ্য'।

২.
রবীন্দ্রনাথ যখন বড় হচ্ছেন কলকাতার বুকে, ততদিনে কলকাতা ভারতবর্ষের আধুনিকতম মহানগরীতে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী হয়েছে। গোবিন্দপুর, সুতানুটি ও কলিকাতা নামক তিনটি গ্রামকে একত্রে জুড়ে নির্মিত হয়েছে শহর। কুঠির সাহেব জব চার্নকের হাতে। মানে, গ্রামই খোদ মহানগরে 'উন্নীত' হয়েছে। এমনিই এমনিই হয়নি। গ্রামের জল ও জঙ্গল উল্টেপাল্টেই হয়েছে, গঙ্গার (হুগলি) তীরে।

এহেন কলকাতার পিঠ চাপড়ে দিয়ে 'গোরা' উপন্যাসের একদম প্রারম্ভে রবীন্দ্রনাথ বিদ্রুপাত্মক ভঙ্গিতে লিখেছেন: ‘… এত বড়ো এই-যে কাজের শহর কঠিন হৃদয় কলিকাতা, ইহার শত শত রাস্তা এবং গলির ভিতরে সোনার আলোকের ধারা আজ যেন একটা অপূর্ব যৌবনের প্রবাহ বহিয়া লইয়া চলিতেছে।’ (‘গোরা’ — রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

কঠিন হৃদয় বটে! কৌতুক হলো— কাজের শহর বানাতে গিয়ে বন বা জঙ্গল ধ্বংস করে আমরা ‘সভ্য’ সমাজে এলাকার নাম রেখেছি বনানী। এই ফাঁকিটা যতটা না শুভঙ্করের, তার চেয়েও বেশি আদতেই কৌতুকের! লেখা বাহুল্য, অভিধানেও সংযুক্ত আছে, বনানীর আরেকটি অর্থ ‘ঢাকার আবাসিক অঞ্চল’। কলকাতা থেকে ঢাকায় মুখ ফেরাবার পালা আমাদের। এই যে ঢাকার কথা আমরা বলছি, তার বুকে বন-বনানীর দেখা মেলা ভার। দেখা মেলা ভার জলাধারেরও। তাহলে এতো এতো জল ও জঙ্গল গেল কোথায়!

এক গবেষণায় এসেছে, ১৯৯৫ সালে এ শহরের গাছপালা ছিল মোট আয়তনের ১২ শতাংশ। ২০১৫ সালে হয়েছে ৭ শতাংশ। এখন আরও কমে ৫-৬% শতাংশ। জলাধারের অবস্থাও সঙ্গীন। বুড়িগঙ্গার তীরে অবস্থিত ঢাকার দু’পাশে নদী প্রবাহিত হয়েছে উত্তর থেকে দক্ষিণে। এই নদীগুলো এখন দখলদারদের খপ্পরে পড়ে সংকুচিত হওয়ার চূড়ান্ত রূপ পেয়েছে, খাল-বিলের কথা তো বাদই থাকল। জানা যাচ্ছে, ২০১০ সালে ড্যাপের নির্ধারিত জলাভূমির মধ্যে ২০১৯ সালের জানুয়ারির মধ্যেই ভরাট হয়ে গেছে ২২ শতাংশ।

কী করুণ দশা! সব জল ও জঙ্গল উন্নয়নের সভ্যতা ও সভ্যতার অট্টালিকায় খেয়েছে!

ঢাকার সমস্যা বহুবিধ। কোনটা ছেড়ে কোনটা বলবে লোকে! এবং প্রায় প্রত্যেকটি সমস্যাই একটি অপরটির সঙ্গে পারস্পরিকভাবে সম্পর্কযুক্ত।

ভুবনায়নের যে হাওয়া সারাবিশ্ব মাঝে বইছে, ঢাকাতেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। কিন্তু, ঢাকাতে যা ব্যত্যয় ঘটেছে, তা হলো এ নগর ক্রমেই বসবাসের অনুপোযোগী হয়ে উঠেছে এবং সেটা বিশ্বর‌্যাংকিংয়েও তাকে, লজ্জাজনকভাবে, শেষ থেকে একদম শুরুর দিকে রাখছে। বিশ্বায়নের তোড়ে এ মহানগরের জলায়ন ও বনায়ন প্রায় উধাও হয়ে গেছে। ফলে, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের দরুণ ঢাকায় কমেছে বাতায়ন, অপর পৃষ্টে বেড়ে গেছে উষ্ণায়ন।

উষ্ণায়নের বাতাবরণ চলমান মৌসুমে বেশ টের পাওয়া যাচ্ছে। বাতাসে আর্দ্রতা কমায়, বাতাস অনেক বেশি শুষ্ক। ফলে, কর্কটক্রান্তি রেখার ঠিক নিচে অবস্থিত ঢাকা শহর যেন হয়ে উঠেছে সাহারা মরুভূমি কিংবা উপমহাদেশের সবচেয়ে উষ্ণাঞ্চল গুজরাটের কোনো একটি মেগাসিটি। অথচ, ব্যাপক অপরিকল্পনায় ধরাশায়ী এ মহানগর।

ঢাকা এখন মহানগর তো নয়, যেন মহানরক! ঠাকুর তাই বহু আগেই আমাদের কথাটা বলে গেছেন,‘লও এ নগর’!

৩.
বৈশাখের আগমনীগান গাইতে তথা নতুন বর্ষকে বরণ করতেও আমাদের ঠাকুরের কাছেই ঋণী হতে হয়েছে। তিনি গেয়েছেন, ‘অগ্নি স্নানে শুচি হোক ধরা।’ যেমন শুচি হতে হয়েছিল 'রামায়ণে' সীতাকে। যেমন যজ্ঞ থেকে জন্ম নেয়া 'মহাভারতে'র যজ্ঞসিনী (অর্থাৎ পঞ্চপাণ্ডবের স্ত্রী দ্রৌপদী) ফি বছর যজ্ঞের মাধ্যমে পরিশুদ্ধ হয়ে নিজের কুমারিত্বের প্রমাণ দিতেন। যজ্ঞ তো সেই আগুনেরই খেলা।

তবে, এই আজকের আবহাওয়া এতোই বিপদসংকুল যে, এ কালে অগ্নি স্নানে শুচি হওয়ার কথা কেউ ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারে না। মনের মধ্যে এক ব্যাপক বিরূপ ভাব চলে আসে। এ বাবদ ঠাকুরের রোমান্টিকতা তখন অসহ্য লেগে যায়! মনে হয়, ‘ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি!’ তখন আবার ঠাকুরের কাছেই হাতে পেতে বলতে ইচ্ছে করে, ‘লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ট ও প্রস্তুর…/ দাও সেই তপোবন পুণ্যচ্ছায়ারাশি’। ('সভ্যতার প্রতি'  — রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

ঠাকুরের প্রত্যাশাটা বাড়াবাড়ি নয়। তপোবন সদৃশ পুণ্য ছায়ার রাশি পেতে হলে তপোবনে যেতে পারলেই ভালো হতো। কিন্তু, সেখানে তখন মানুষ বন উজাড় করে অপরাপর প্রাণীকূলকে নস্যাৎ করে ফেলবে! মানুষ ও তার ধ্বংসাত্মক রাজনীতি যেখানেই গেছে, সেখানেই তারা দখলদার হয়েছে, বিভক্তি-ব্যাকুল হয়েছে। এমনকি, মানুষ মঙ্গলগ্রহে গেলে সেটিও সম্ভবত রাষ্ট্রে-রাজ্যে ভাগ করে ফেলবে!

সে যাই হোক, বরং, বেশি উচ্চাশা না রেখে, আমরা গ্রামের দিকে তাকাতে পারি। আহা বাংলার গ্রাম! ঠাকুরই তো গেয়েছেন, ‘গ্রামছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ আমার মন ভোলায় রে…’। তবে, গ্রামকে নিয়ে একদম খাসা কথাটা বলেছেন কবি বন্দে আলী মিয়া। তাঁর সেই যে ছোটবেলায় পড়া কবিতাটা মনে পড়ে গেল: ‘আমাদের ছোট গাঁয়ে ছোট ছোট ঘর,/ থাকি সেথা সবে মিলে নাহি কেহ পর।' ওই কবিতাটিতেই আছে, ‘আমাদের ছোট গ্রাম মায়ের সমান/ আলো দিয়ে বায়ু দিয়ে বাঁচাইছে প্রাণ।’  (‘আমাদের গ্রাম’ — বন্দে আলী মিয়া)

এই যে মাতৃবন্দনা, এটা বহুজনের কবিতাতেই আছে। জীবনানন্দ দাশের ‘রূপসী বাংলা’য় বাংলার যে মুখ তিনি এঁকেছেন, তা তো এই এক লেখায় বলে শেষ করা যাবে না। বরং, তাঁর ধানসিঁড়ি নদীর তীরে জন্মান্তরে প্রত্যাবর্তনের যে আকুতি, সেটাই আমরা স্মরণ করি: ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে — এই বাংলায়/ হয়তো মানুষ নয় — হয়তো শঙ্খচীল শালিখের বেশে,/ হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে/ কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল-ছাঁয়ায়;/ হয়তো বা হাঁস হ’ব — কিশোরীর — ঘুঙুর রহিবে লাল পায়,/ সারা দিন কেটে যাবে কলমীর গন্ধ ভরা জলে ভেসে ভেসে;/ আবার আসিব আমি বাংলায় নদী মাঠ ক্ষেত ভালোবেসে।’ (‘আবার আসিব ফিরে’ — জীবনানন্দ দাশ)

অর্থাৎ, কথাটা পরিষ্কার, জন্মান্তরেও শহর নয়, গ্রামের সবচেয়ে সৌকর্যময় তিন উপাদান ‘নদী মাঠ ক্ষেত’ ভালোবেসে বাংলার গ্রামেই ফিরতে চান বাংলার বিশুদ্ধতম ও তর্কযোগ্যভাবে বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠকবি জীবনানন্দ দাশ।

রবীন্দ্র-উত্তর যুগে যেমন জীবনানন্দ দাশ, তেমনই রবীন্দ্র-পূর্বসূরী সর্বশেষ জিনিয়াস কবি ছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। ‘দত্তকুলোদ্ভব’ কবি খ্যাতির মোহে গিয়েছিলেন বিভুঁইয়ে, ফরাসি দেশে। সেখানে গিয়েও বোধোদয়ের স্মৃতিকাতরতা তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছিল নদী-বন্দনা, যার নাম কপোতাক্ষ নদ, শেষ ঠিকানাতেও মাইকেল তাই স্বেচ্ছায় ঘুমিয়ে আছেন কপোতাক্ষ তীরের সাগরদাঁড়ি গ্রামে। মাইকেল লিখেছেন: ‘সতত হে নদ তুমি পড়ো মোর মনে/ সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে/ সতত (যেমনি লোক নিশার স্বপনে/ শোনে মায়া মন্ত্র-ধ্বনি) তব কলকলে/ জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে!’ (‘কপোতাক্ষ নদ’ — মাইকেল মধুসূদন দত্ত)

বাংলার পল্লীগ্রাম ও এর পরিবেশকে আরও গ্রামজ-লোকজ পরিব্যাপ্তিতে ভাববার সুযোগ করে দিয়েছেন পল্লীকবি জসীম উদ্ দীন। তাঁর কবিতায় গ্রাম ও গ্রামের প্রতিবেশ-পরিবেশ ধরা পড়েছে এক অনন্য মাত্রায়। তাঁর বিখ্যাত ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ কবিতায় তিনি লিখেছেন: ‘ও-গাঁয় যেন জমাট বেঁধে বনের কাজল কায়া,/ ঘরগুলিরে জড়িয়ে ধরে বাড়ায় বনের মায়া।' ওই কবিতাতেই আরও পাই: ‘এ-গাঁর ও-গাঁর দুধার হতে পথ দুখানি এসে/ জলীর বিলের জলে তারা পদ্ম ভাসায় হেসে!’  (‘নক্সী কাঁথার মাঠ’— জসীম উদ্ দীন)

৪.
কবি-সাহিত্যিকদের গ্রামকে এভাবে দেখতে চাওয়া ও পাওয়ার মধ্যে একটা অবিরল আবেগান্বিত সুখানুভূতি আছে। গ্রামকে, গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদীকে তারা মাতৃসম প্রতিশ্রুতিতে লালন করেছেন। ছায়াদায়িনী ও মায়াদায়িনী হিসেবে অন্তরের গহীনে যাপন করেছেন। এ কথা হয়তো নাগরিক কবি শামসুর রাহমানের ক্ষেত্রেও সত্য যে, তিনিও তাঁর আজন্মলালিত ঢাকা শহরকে নিয়ে কবিকৃতির রোমান্টিকতায় ভর করতে চেয়েছেন। কিন্তু অভিজ্ঞতাটা এতোটাই বৈসাদৃশ্যমূলক যে, তিনি ভিন্ন ভঙ্গিতে ঢাকাকে চিত্রায়িত করে বলতে বাধ্য হন: ‘এ শহর ক্ষুধাকেই নিঃসঙ্গ বাস্তব জেনে ধুলায় গড়ায়;/ এ শহর পল্টনের মাঠে ছোটে, পোস্টারের উল্কি-ছাওয়া মনে/
এল গ্রেকো ছবি হয়ে ছোঁয় যেন উদার নীলিমা,/ এ শহর প্রত্যহ লড়াই করে বহুরূপী নেকড়ের সাথে।’ (‘এ শহর’ — শামসুর রাহমান)

নাহ, কথাটা যে শুধু শামসুর রাহমান একাই বলেছেন, এমনও না। বাংলা সাহিত্যের শক্তিমান কথাসাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর বয়ানেও এ অভিজ্ঞতা ধরা পড়ে। শহর/নগর এবং মফস্বল/গ্রামের পরিবেশগত বাইনারি প্রপঞ্চ তৈরি করার যে প্রয়াসে আমরা এগোচ্ছি এ লেখায়, তাতে খুব চমৎকার এক বর্ণনার যোগসূত্র সৃষ্টি করেছেন ওয়ালীউল্লাহ; তাঁর ‘নয়নচারা’ গল্পে। যে গল্পটি বাংলার মর্মান্তিক পঞ্চাশের মন্বন্তরের  ওপর ভিত্তি করে লেখা এবং যে গল্পে বারবার এসেছে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের মনে (মূখ্যত, আমু) সৃষ্টি হওয়া গ্রাম ও শহরের মানবিক পার্থক্য। এসেছে শহুরে ক্রাইসিসে ময়ূরাক্ষী নদী ও তার তীরবর্তী নয়নচারা গ্রামের প্রতি এক মোহনীয় নস্টালজিয়ার কথা। যা কিছু শুভ ও সুন্দর, তার সবই গ্রামকে উপজীব্য করে গড়ে তোলার পথে ওয়ালীউল্লাহ লিখেছেন: ‘সে [আমু] ভরা চোখে তাকাল ওপরের পানে—তারার পানে, এবং অকাস্মাৎ অবাক হয়ে ভাবল, ওই তারাগুলিই কি সে বাড়ি থেকে চেয়ে-চেয়ে দেখত? কিন্তু সে-তারাগুলোর নিচে ছিল ঢালা মাঠ, ভাঙা মাটি, ঘাস, শস্য আর ময়ূরাক্ষী। আর এ-তারাগুলোর নিচে খাদ্য নেই, দয়ামায়া নেই, রয়েছে শুধু হিংসাবিদ্বেষ নিষ্ঠুরতা, অসহ্য বৈরিতা।’ (‘নয়নচারা’ — সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ) এ গল্পে গল্পকার আমুর মাধ্যমে শহরের মানুষকে ‘কুকুরে’র সঙ্গেও তুলনা করিয়েছেন। 

রবীন্দ্রনাথ অবশ্য এতোটা বৈপ্লবিক নন। তাঁর কণ্ঠটা মৃদু, কিন্তু স্বরটা তার। যে কারণে, ওয়ালীউল্লাহর অনেক আগেই, বাংলা ছোটগল্পের একদম উষালগ্নে, ঠাকুর তাঁর ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পে শহুরে মানুষের গ্রামের প্রতি বিরূপ মনোভাবের এক নিদারুণ চিত্রাঙ্কন করেছিলেন। মনে রাখতে হবে, এ গল্পের পোস্টমাস্টার কলকাতার ছেলে হলেও, আদতে তৎকালীন (১৮৯২ সাল) ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের রাজধানীর সন্তান। ফলে, একে দেখতে হবে, প্রান্তের প্রতি কেন্দ্রের অবস্থান হিসেবে, যে অবস্থান গ্রামকে ‘অস্বাস্থ্যকর’ বলতেও দ্বিধা করে না। ঠাকুর গল্পের একদম প্রায় শুরুতেই লিখেছেন: ‘... কলিকাতার ছেলে ভালো করিয়া মিশিতে জানে না। অপরিচিত স্থানে গেলে, হয় উদ্ধত নয় অপ্রতিভ হইয়া থাকে। এই কারণে স্থানীয় লোকের সহিত তাঁহার মেলামেশা হইয়া উঠে না।... অন্তর্যামী জানেন, যদি আরব্য উপন্যাসের কোনো দৈত্য আসিয়া এক রাত্রের মধ্যে এই শাখাপল্লব-সমেত সমস্ত গাছগুলা কাটিয়া পাকা রাস্তা বানাইয়া দেয় এবং সারি সারি অট্টালিকা আকাশের মেঘকে দৃষ্টিপথ হইতে রুদ্ধ করিয়া রাখে, তাহা হইলে এই আধমরা ভদ্রসন্তানটি পুনশ্চ নবজীবন লাভ করিতে পারে।’ (‘পোস্টমাস্টার’ — রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

এই যে মনোভাবটা সেটা শুধু ঔপনিবেশিক শিক্ষায় শিক্ষিত পোস্টমাস্টারের মেট্রোপলিটনীয় মধ্যবিত্তের মন নয়। পুঁজিবাদের যুগে এ মননের লালন-পালন সমাজে অবিরল নয়। আজকের দিনে তা প্রায় গগণচুম্বি হয়েছে। নদী দখল হচ্ছে চোখবন্ধ করে, রাষ্ট্র অন্ধের দেশে জন্মান্ধ হয়ে বসে আছে। লোভের বলি হচ্ছে পাহাড়। সবুজভূমে চোখ পড়ে গেছে কর্পোরেটের। হচ্ছে গগণচুম্বি হোটেল-মোটেল, পাহাড়ে! এমনকি রাস্তা প্রশস্তের নামে একাত্তরের স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক যশোর রোডের গাছগুলোও পড়েছে রাষ্ট্রনীতির খপ্পরে। অগত্যা থামতে হচ্ছে, তালিকা তো বলে শেষ কর যাবে না।

আর একদার ‘তিলোত্তমা ঢাকা’র কথা তো আদ্যোপান্ত হতাশার। দূষণের শহর, যানজটের শহর, ভূস্বামীদের শহর, আমলাতন্ত্র-কামলাতন্ত্রের শহর, যাবতীয় নীলনকশার শহর, বায়ান্ন বাজার তেপ্পান্ন গলির শহর! কে বলবে, এ শহরের বুক ঘেঁষে চলা বুড়িগঙ্গার পানি একদা পান করা যেত। কে বলবে, এ শহরের জলববাহিকা একদা ‘নদীপ্রবাহে ভাসমান পথিকের উদাস হৃদয়’ (দ্র. 'পোস্টমাস্টার') জয় করে গন্তব্য পৌঁছে দিত নিরুপদ্রবে। সেসব দিন কোথায় হারিয়ে গেছে!

এ শহর শিক্ষারও শহর! অথচ, প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষার রূপকল্পের সঙ্গে এ শহরের কোন সম্পর্কই নেই। এ মাটির শিক্ষার সঙ্গে তপোবন ও বিহারের একটা ওতপ্রোত ও অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক ছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনকে তাই মহানগর কলকাতার বাইরে নিয়ে গিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ঢাকায় এতো এতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কিন্তু, তপোবনীয় শিক্ষাপদ্ধতির কোন ছোঁয়া বা ছায়া এখানে নেই। শিক্ষা মানে এখানে শুধু সনদ বিকোনো এবং বড় বড় দালান। কেন্দ্র যেমন হয়েছে, প্রান্তও সেই পথের পথিক হতে চলেছে। সমগ্র বাংলাদেশেই শিক্ষার সঙ্গে প্রকৃতির যোগ প্রায় বিলীন হওয়ার পথে এবং এ বাবদও রবীন্দ্রনাথ থেকে আমরা কিছুই শিক্ষা নিতে পারিনি।

৫.
গ্রাম-বন্দনা, অরণ্য-বন্দনার কথা যখন আসবে, তখন আমাদের অবশ্যপাঠ্য বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস 'আরণ্যক'। এ উপন্যাসের ‘প্রস্তাবনা’য় বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন: ‘কলিকাতা শহরের হৈচৈ কর্মকোলাহলের মধ্যে অহরহ ডুবিয়া থাকিয়া এখন যখন লবটুলিয়া বইহার কি আজমাবাদের সে অরণ্য-ভূভাগ, সে জোৎস্না, সে তিমিরময়ী স্তব্ধ রাত্রি, ধূ-ধূ বনঝাউ আর কাশবনের চর, দিগ্বলয়লীন ধূসর শৈলশ্রেণী, গভীর রাত্রে বন্য নীলগাইয়ের দলের দ্রুত পদধ্বনি, খররৌদ্রমধ্যাহ্নে সরস্বতী কুণ্ডীর জলের ধারে পিপাসার্ত বন্য মহিষ, সে অপূর্ব মুক্ত শিলাস্তৃত প্রান্তরে রঙিন বনফুলের শোভা, ফুটন্ত রক্তপলাশের ঘন অরণ্যের কথা ভাবি, তখন মনে হয় বুঝি কোন অবসর-দিনের শেষ সন্ধ্যায় ঘুমের ঘোরে এক সৌন্দর্যভরা জগতের স্বপ্ন দেখিয়াছিলাম, পৃথিবীতে তেমন দেশ যেন কোথাও নাই।’ ('আরণ্যক' — বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়)

গ্রাম-প্রকৃতির দুর্দান্ত বর্ণনায় মহীয়ান বিভূতিভূষণের কিংবদন্তিতুল্য উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’। শিশু-কিশোর মনকে তোলপাড় করে তোলা এ উপন্যাস যারাই পড়বে, বারবার তার গ্রামের কাছে যেতে মন চাইবে। হয়তো বিভূতিভূষণ তাকে বহু বছর পরেও টেনে নিয়ে যেতে পারেন গ্রাম ও বনের গাছপালার সন্নিকটে, কেননা: ‘অন্য অন্য গাছপালার মধ্যে একটি বন্য সোঁদাল গাছ তাহার উপর শাখাপত্রে ছায়াবিস্তার করিয়া বাড়িয়া উঠিয়াছে, চৈত্র বৈশাখ মাসে আড়াই-বাঁকীর মোহনা হইতে প্রবহমাণ জোর হাওয়ায় তাহার পীত পুষ্পস্তবক সারা দিনরাত ধরিয়া বিস্মৃত বিদেশী শিশুর ভগ্ন-সমাধির উপর রাশি রাশি পুষ্প ঝরাইয়া দেয়। সকলে ভুলিয়া গেলেও বনের গাছপালা শিশুটিকে এখনও ভোলে নাই।’ ('পথের পাঁচালী' — বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়)

শিশুটির নাম অপু। অপূর্ব এ বর্ণনাটি আছে ‘পথের পাঁচালী’র সপ্তম পরিচ্ছেদ ‘আম আঁটির ভেঁপু’তে। বিভূতিভূষণের বর্ণনায় বন-জঙ্গল-গ্রামকে দেখা একটা পুরোদস্তুর রোমাঞ্চকর ব্যাপার। প্রকৃতিকে উপজীব্য করে গড়ে তোলা তাঁর সৃষ্টিকর্ম নিয়ে বলার আছে হয়তো অনেক কিছু। কিন্তু, বিধিবাম, থামতে হচ্ছে! 

আমরা বরং আরেক কিংবদন্তি ‘বন্দ্যোপাধ্যায়’, কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ উপন্যাস ‘গণদেবতা’-কে উপজীব্য করে এ পর্বটি শেষ করি। উপন্যাসের শেষ দিকে তারাশঙ্করের নিটোল-নির্মেদ বর্ণনায় আমরা পড়ি: ‘নদীর ওপারে মহাগ্রাম রচনা করিয়াছে নূতন কাল। নূতন কালের সে রচনার মধে যে রূপ ফুটিয়া উঠিবে—সে যতীন বইয়ের মধ্যে পড়িয়াছে—তার জন্মস্থান কলিকাতায় প্রত্যক্ষ দেখিয়াছে। সে মনে হইলে শিহরিয়া উঠিতে হয়, মনে হয় গোটা পৃথিবীর আলো নিভিয়া যাইবে, বায়ুপ্রবাহ স্তব্ধ হইবে, গোটা সৃষ্টিটা দুর্বৃত্ত-ধর্ষিতা নারীর মত অন্তঃসারশূন্য কাঙালিনীতে পরিণত হইবে। জীর্ণ-অন্তর বুকে হাহাকার, বাহিরে চাকচিক্য, মুখে কৃত্রিম হাসি। দুর্ভাগিনী সৃষ্টি!’ ('গণদেবতা' — তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়)

বিখ্যাত সমাজতাত্ত্বিক বিনয় ঘোষ বলেছিলেন, কী গড়ে উঠল তা বোঝার জন্য কী ভেঙে গেল তা জানা জরুরি। বাহুল্য ঘটিয়ে লাভ নেই, তারাশঙ্করের উপর্যুক্ত কথাগুলো ব্যাখ্যার জন্য বিনয় ঘোষের কথাটাই যথেষ্ট।

৬.
ফিরে যাই শামসুর রাহমানের কাছে ক্ষণিকের জন্য। তাঁর গ্রাম না-পাওয়ার যে সংকট, সেটা ধরা পড়বে তাঁরই সমসাময়িক দুই কবি, বাংলা কবিতার ‘অবিসংবাদিত বরপুত্র’ আল মাহমুদ ও ‘সব্যসাচী লেখক’ সৈয়দ শামসুল হকের গ্রাম ও গ্রামের পরিবেশকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে।

একটা স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় ভরপুর কবিতায় কবি আল মাহমুদ কী দারুণভাবেই না আঙ্গিক হিসেবে বেছে নিয়েছেন গ্রামবাংলার প্রকৃতির অনুষঙ্গকে। এটা আল মাহমুদ করার সক্ষমতা রাখেন শুধু বড় কবিত্বের গুণেই নয়, তিনি পারেন, কেননা ঢাকার অদূরে যে ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া, ত্রিশ-চল্লিশের দশকে সেই মফস্বলে তাঁর বড় হওয়ার একটি অমূল্য কৃতিত্ব আছে। তাই, ‘নোলক’ কবিতায় তিনি লিখেছেন: ‘আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেল শেষে/ হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে।/ নদীর কাছে গিয়েছিলাম, আছে তোমার কাছে?/ -হাত দিও না আমার শরীর ভরা বোয়াল মাছে।/ বললো কেঁদে তিতাস নদী হরিণবেড়ের বাঁকে/ শাদা পালক বকরা যেথায় পাখ ছাড়িয়ে থাকে।’ (‘নোলক’ — আল মাহমুদ)

অন্যদিকে, সৈয়দ শামসুল হকের জন্ম ঢাকা থেকে বহুদূরের মফস্বল উত্তরবঙ্গের কুড়িগ্রামে। ফলে, গ্রামকে আপন করে নেওয়ার একটা সহজাত বৈশিষ্ট্য তাঁর ছিল। কিন্তু, বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসের পথপরিক্রমার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি শুরুটাই করেছেন আলপথ, পলিমাটি ও নদীর কথার দীপ্ত উচ্চারণে, ‘আমার পরিচয়’ কবিতায়: “আমি জন্মেছি বাংলায়, আমি বাংলায় কথা বলি,/ আমি বাংলার আলপথ দিয়ে হাজার বছর চলি/ চলি পলিমাটি কোমলে আমার চলার চিহ্ন ফেলে।/ তেরোশত নদী শুধায় আমাকে, ‘কোথা থেকে তুমি এলে?’” (‘আমার পরিচয়’ — সৈয়দ শামসুল হক)

৭.
এ পুরো লেখায় আমাদের একটা অভীষ্ট ছিল শহর ও গ্রামের একটি বাইনারি সাহিত্যের মধ্য দিয়ে দেখানোর। দেখা যাচ্ছে, তাতে গ্রামের জয়জয়কার। বাংলার গ্রাম অনেক বদলে গেছে, এটা সত্য। কিন্তু, এখনও গ্রাম অনেক ভালো আছে। ঢাকা শহরে যারা থাকেন, তারা চট করে বলতে পারবেন না, ঋতুচক্রে আসলে কার রাজত্ব চলছে। আবহাওয়াই এমন! বৃষ্টি হলে রাস্তা প্যাকপ্যাক, আর রোদ হলে শরীর! অথচ, এ দেশ নাকি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নাতিশোতষ্ণ দেশ! এমন একটি ভূ-প্রাকৃতিক অঞ্চলে আমরা থাকি, আদতেই পৃথিবীতে এমন আবহাওয়া প্রায় বিরল। অথচ, প্রকৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরা আজও উন্নত হতে পারলাম না। কী করে বলি, এদেশ বিশ্বকবির 'সোনার বাংলা'!

কিন্তু, দেখতে পাচ্ছি, আজও আমাদের গ্রামগুলো অনেক সম্ভাবনাময়। গ্রাম নিজেই একটা প্রাকৃতিক চিকিৎসাশ্রম। সুবাতাসের এপিসেন্টার। কৃত্রিম চিকিৎসালয় লাগে শহুরে সভ্যতার বাঁচা-মরার প্রশ্নে৷ গ্রামের ফল টাটকা, সবজি টাটকা; শহরের সব পরিশোধিত। যে কারণে, শহরে গড়ে ওঠে বড় বড় চিকিৎসাবিদ্যার স্কুল। এবং অত্যাশ্চার্য হলো, এর থেকে আমাদের মুক্তি নেই। কিন্তু, আমরা তো মুক্তি চাই।

এই যে চাওয়া, কিন্তু তার চেয়েও বড় না-পাওয়া, এর সঙ্গে রাজনীতির যোগসাজশ বড়ই প্রবল। রাজনীতি দুষ্টচক্রে পতিত হলে, জনমানুষের চাওয়া ও পাওয়ার মধ্যে সমন্বয় থাকে না। মানুষ তখন অসহায় হয়ে ওঠে। বিশ্বজলবায়ুর এ পরিবর্তনের পেছনে পুঁজিবাদের দোর্দণ্ড আস্ফালন দুনিয়াকে একদম খুবলে খাচ্ছে। মানুষের নাভিঃশ্বাস উঠে গেছে। রেহাই নেই যেন! চারিদিকে বনদস্যু, জলদস্যু, ভূমিদস্যু, নরদস্যুদের প্রবল প্রতাপ এবং এর পেছনে সরাসরি পেট্রনের ভূমিকায় এদের প্রপিতামহ রাজদস্যু। মানুষের আকাঙ্ক্ষার সমাজ ও রাজনীতির আগমন তাই একান্ত পাথেয় ঠাকুরের। স্বাধীনতা চান তিনি, চান আপন শক্তি। তাই তাঁর উদীপ্ত আহবান: ‘চাই স্বাধীনতা, চাই পক্ষের বিস্তার,/ বক্ষে ফিরে পেতে চাই শক্তি আপনার।’ (‘সভ্যতার প্রতি’ — রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)