যুগোপযোগী মৌলিক পরিবর্তনের সম্ভাবনাকে দূরে ঠেলে রেখে ‘ফেডারেশন’ কমিটি, নাট্যব্যক্তিত্ব, বিশিষ্ট মোড়ল এসব মেয়াদোত্তীর্ণ ধারণা ও পদবাচ্য দিয়ে বক্তৃতাবাজি করা গেলেও নাট্যাঙ্গনের পেশাদারি উন্নয়নে কোনোই কাজে আসবে না।
Published : 21 Jun 2023, 03:36 PM
পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিতে নাট্যাঙ্গন উত্তপ্ত। এর পেছনের কারণ এবং নেপথ্যের মোড়ল বা গডফাদারদের সম্পর্কে বিশদ বলার আগে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন সম্পর্কে কিছু কথা বলে নিতে চাই। আজ থেকে প্রায় সাড়ে চার দশক আগে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের শাসনামলে দেশে ক্রিয়াশীল নাটকের দলগুলোর জন্য একটি মোর্চা বা ফেডারেশন গঠিত হয়। যা বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন থিয়েটার নামে পরিচিত।
এ ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত নাটকের দলের সংখ্যা শ চারেকের মতো। এখন পর্যন্ত একটি দলও উল্লেখ করার মতো পেশাদারি দল হিসেবে দাঁড়াতে পারেনি। কিন্তু এর বিপরীতে ফেডারেশনের ছাতার তল থেকে কয়েকডজন মোড়ল বেরিয়ে এসেছে। যারা করপোরেট ঠিকাদারি, সংস্কৃতি অঙ্গনের মোড়লগিরি, বিজ্ঞাপন ব্যবসা করে জাতীয় পর্যায়ে নানা পদ-পদবি নিয়েছে, গুরুত্বপূর্ণ নানা কমিটিতে নিজেদের নাম লিখিয়েছে, কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছে। মোড়লদের অনেকেই ইনিয়ে-বিনিয়ে প্রায় সব সরকারের আমলেই সুবিধাভোগী হয়েছে। বিপরীতে এদের কব্জায় থাকা থিয়েটার ফেডারেশন কার্যত একটি মোড়লসর্বস্ব ‘দেউলিয়া প্ল্যাটফর্ম’ হিসেবে বর্তমান অবস্থায় উপনীত হয়েছে। নাটকের পেশাদারি উৎকর্ষতা, প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি ও প্রয়োজনীয় সংস্কার ও বিকাশের জন্যে যে কার্যকর দৃষ্টিভঙ্গি ও উদ্যোগ থাকা দরকার এর কোনোটাই এই ফেডারেশনের যেমন নাই, তেমন নাই প্রায় পাঁচ দশক ধরে মোড়লগিরি করে আসা নাট্যাঙ্গনের অশীতিপর মোড়লদের।
১৯৮০ সালে সামরিক জামানায় প্রতিষ্ঠিত এই সংগঠনের মোটাদাগের উদ্দেশ্যগুলো ছিল এরকম:
– থিয়েটার ব্যক্তিত্বের পেশাদারী স্বার্থ রক্ষা ও সুযোগ তৈরি
– নাটকের বিকাশ, আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্তির উদ্যোগ
– মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন আইনের বিরুদ্ধে জনমত জোরদার
– নাটক সম্পর্কিত উপকরণ প্রকাশ
– একটি থিয়েটার যাদুঘর স্থাপন
– জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কর্মশালার ব্যবস্থা
– জাতীয় নাট্য উৎসব পরিচালনা
– থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত মানুষের জন্য কল্যাণমূলক কর্মসূচি
এই উদ্দেশ্যগুলোর বিপরীতে গত প্রায় সাড়ে চার দশকে দেশের মঞ্চ নাটকের অঙ্গনে উল্লেখ করার মতো কি কোনো অর্জন আছে? প্রায় দুই কোটি মানুষের রাজধানী ঢাকায় নাটক মঞ্চায়নের জায়গা বলতে গেলে বেইলি রোড আর শিল্পকলা একাডেমি। নাট্যাঙ্গনের আরও অনেক দাবির সঙ্গে একটি দাবি হতে পারত নগরের শতাধিক ওয়ার্ডের প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে নাট্যশালা। উনারা পড়ে আছেন কে ফেডারেশনের মোড়ল হইল আর কে বাদ পড়ল এইসব বাদ-বিবাদ নিয়ে।
একটা প্রশ্ন করি। আজকে যদি এই ফেডারেশনকে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়, তাহলে দেশের নাট্যাঙ্গনের কী এমন ক্ষতিবৃদ্ধি হবে? এই প্রশ্নটি নাট্যাঙ্গনের মোড়ল এবং কর্মী যারা দুই ভাগে ভাগ হয়ে মাঠের দখলে আছেন উভয় পক্ষকেই করছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে নাটককে পেশা হিসেবে নেবার ন্যূনতম সুযোগ নাই দেশে। দেশের যাত্রাশিল্প বিলুপ্তির পথে। এসব নিয়ে ফেডারেশন বা নাটকের মোড়লদের ভূমিকা কী?
গণতান্ত্রিক অনেক দেশে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত নাট্যশালা রয়েছে। একইসঙ্গে দেশের জাতীয় বেতার ও দূরদর্শনে মঞ্চনাটকের জন্যে স্বতন্ত্র বিভাগ রয়েছে। স্থানীয় সরকারের প্রতিটি পর্যায়ে নাটকের জন্যে আলাদা বিভাগ, নাট্যকর্মীদের জন্যে বিশেষ করে তরুণদের জন্যে বৃত্তি এবং অনুদানের ব্যবস্থা রয়েছে। পাশাপাশি জাতীয় পর্যায়ে কেন্দ্রীয় তহবিল বা কমিশন রয়েছে যেখান থেকে নাটকের জন্যে প্রকল্প বরাদ্দ, দেশে-বিদেশের নানা কর্মশালা, উৎসব এবং শিক্ষা কার্যক্রম বা আন্তর্জাতিক নাটক বিনিময় কর্মযজ্ঞে অংশ নেবার জন্যে বৃত্তির ব্যবস্থা রয়েছে।
এবার নাট্যাঙ্গন উত্তপ্ত হবার পেছনের কারণটা সংক্ষেপে বলে নেয়া দরকার। বছর দেড়েক আগে, আর্থিক অনিয়মের অভিযোগে একজন মহাসচিবের বহিষ্কারকে কেন্দ্র করে এই বাদানুবাদ শুরু হয়েছে। যদিও বহিষ্কৃত মহাসচিব অভিযোগ অস্বীকার করে বহিষ্কারের উদ্যোগটাকেই অগণতান্ত্রিক বলেছেন। এরপর নাট্যাঙ্গনের মোড়লদের তরফে বক্তৃতা-বিবৃতি, সভা-সেমিনার হয়েছে। বর্তমান কমিটি কোনোকিছুই খুব একটা ধর্তব্যের মধ্যে নেয়নি।
বেশ! এই করে করে এখন দেশের জাতীয় নির্বাচনের আগমুহূর্তে এসে ওনারা এক্কেবারে উঠেপড়ে লেগেছেন। আর চলছে পাল্টাপাল্টি কর্তৃত্ব প্রদর্শনের মহড়া। কমিটির বাইরে যারা তাদের বক্তব্য কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। তাহলে তো হয়েই গেল। এই একটি সত্যকে ধরে আপনারা আদালতের শরণাপন্ন হলেই তো পারেন। আপনাদের সেই সাহসটুকুর ঘাটতি কেন?
একদিকে বর্তমান কমিটির নেতৃত্বে নাট্যাঙ্গনের একটি অংশ অন্যদিকে ঘোষণা দিয়ে ফেডারেশন থেকে বেরিয়ে যাওয়া ঢাকাভিত্তিক একটি নাট্যদল আর এর প্রতি সহানুভূতিশীল ‘নাট্যব্যক্তিত্ব’ তকমাধারী অঢেল অর্থসম্পদের মালিক কতিপয় মোড়লগণ।
এখন প্রশ্ন খুব সোজাসাপ্টা, আপনারা যদি ফেডারেশন থেকে ঘোষণা দিয়ে বের হয়ে গিয়ে থাকেন, তাহলে ওই ফেডারেশনের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার নৈতিক এবং আইনগত অধিকার কোনোটাই আপনাদের আর থাকে কি? অন্যদিকে কমিটির মেয়াদ যদি ২০২১ সালে শেষ হয়ে থাকে, অবিলম্বে নতুন কমিটি গঠনের উদ্যোগ নিতে বাধা কোথায়? জাতীয় একটি সংগঠন কার্যকর বা অকার্যকর যাই হোক, এটি কারও চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হতে পারে না। যাদের বিরুদ্ধে কমিটির পদ আঁকড়ে থাকার অভিযোগ তাদের বক্তব্য, অতীতে কেউ যদি বাংলাদেশের টেলিভিশনের মহাপরিচালক এবং মন্ত্রিত্ব আঁকড়ে থাকার পাশাপাশি জাতীয় সংগঠনের পদ দখলে রাখতে পারে, তাহলে এখন যারা ফেডারেশনের পদে আছেন তাদের ব্যাপারে আপত্তি উঠবে কেন। আদতে কেবল ফেডারেশনের কমিটি যে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে তা নয়, কার্যত পাল্টাপাল্টি বাদানুবাদে যেসব মোড়লগণ হাওয়া দিচ্ছেন তারাই যে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছেন, সেই সত্যটা নাট্যাঙ্গনের সংস্কারের স্বার্থে ঝালাই করে নেয়া দরকার।
হেলাল হাফিজের কবিতার দুটি লাইন বহুল উদ্ধৃত হয়ে থাকে: ‘এখন যৌবন যার, মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’ নাট্যাঙ্গনে এখনো যাদেরকে বার্ধক্য পেয়ে বসেনি তারা কমিটি বা ফেডারেশন এরকম প্রায় আলোহীন টানেলের পেছনে না ছুটে, নাট্যাঙ্গনের সংস্কারের জন্যে অন্যবিধ তাৎপর্যপূর্ণ কিছু দাবি ও দফা নিয়ে সোচ্চার হতে পারেন। আমি এখানে তারুণ্য বা বার্ধক্যকে বয়সের কাঠামোয় বিবেচনা করছি না বরং কর্মস্পৃহা দিয়ে বিচার করতে চাই। কোটিপতি ক্ষমতালোভী উচ্চাভিলাষী মোড়লদের প্রশ্রয়ে পাল্টাপাল্টি আন্দোলন করে লোক হাসানো ছাড়া বেশি কিছু অর্জনের সুযোগ নাট্যকর্মীদের সামনে খোলা নাই। শেষে গিয়ে পস্তাতে হবে আর শুনতে হবে ‘সেই তো নথ খসালি তবে কেনে লোক হাসালি’।
ফেডারেশনের বর্তমান সভাপতির বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ বিস্তর। তবে তিনি তো দুর্নীতি দমন কমিশনের ডাকে সাড়া দিয়ে সম্পদের হিসেব দিয়ে এসেছেন। এখন তার বিরুদ্ধে অবান্তর কিছু বলার আগে দুদকের ভাষ্যের জন্যে অপেক্ষা করতে হবে। ধারণা করা যায়, এই বাস্তবতাকে বিবেচনায় নিয়ে, ফেডারেশন সভাপতি তার বিরুদ্ধে প্রচারণাকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকি দিয়ে রেখেছেন। আমার প্রশ্ন বাকি মোড়লদের নিয়ে। দুই-একজন ব্যতিক্রম ছাড়া ‘নাট্যব্যক্তিত্ব’ তকমাধারী প্রায় এক ডজন মোড়ল দেশের সংস্কৃতিকে উদ্ধার করার লেবাসকে পুঁজি করে কী পরিমাণ অঢেল অর্থসম্পত্তিটি মালিক হয়েছেন তার হিসেব কি তারা জাতির সামনে খোলাসা করার সাহস রাখেন।
এখন নির্বাচনের আগে ওইসব মোড়লগণ তলে তলে গণ্ডগোল পাকানোর ফন্দি করছেন আর ওপরে ওপরে নীতিসংগীত গাইছেন। ঠিক একইসময়ে কতিপয় বাম মৌলবাদী বুদ্ধিজীবী প্রেসক্লাবে সভা করে প্রকাশ্যে বিএনপিকে পরামর্শ দিয়েছে নির্বাচন ঠেকাইতে। ওইসব বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ পর্দার আড়ালে বিএনপির ডাকসাইটে উপদেষ্টা হিসেবে ভূমিকা রাখেন। তাদের এই ভূমিকার গোড়াপত্তন হয়েছিল ১৯৭৫ সালে জাতির পিতাকে হত্যা করার পর থেকেই। আর নাট্যাঙ্গনের মোড়লদের কেউ কেউ ২০০৭-২০০৮ সালে তথাকথিত সংস্কারপন্থীদের সঙ্গে যোগসাজশ রেখেছেন। এবারের নির্বাচনের প্রাক্কালে ২০০৭-২০০৮ সালের খোয়াবে কী আবারও আচ্ছন্ন হয়েছেন তারা?
নাট্যাঙ্গনের তরুণ ভাই-বোনদের উদ্দ্যেশে কয়েকটি ধারণা দিয়ে রাখতে চাই। মোড়লদের ইশারায় না নড়েচড়ে, নাট্যাঙ্গনের সংস্কার ও বিকাশের স্বার্থে সোচ্চার হতে পারেন। তাতে দেশের নাট্যাঙ্গনের স্থায়ী ভিত্তি নির্মাণে কিছুটা হাওয়া লাগতে পারে। ধারণাগুলো হতে পারে এরকম:
১. জাতীয় সংস্কৃতি নীতি প্রণয়ন
২. জাতীয় নাট্যানীতি প্রণয়ন
৩. জাতীয় যাত্রাশিল্পনীতি ঘোষণা
৪. জাতীয় নাট্যকল্যাণ কমিশন প্রতিষ্ঠা
৫. জাতীয় নাটক উন্নয়ন বোর্ড গঠন
৬. সংস্কৃতির জন্যে জাতীয় বাজেটে কমপক্ষে শতকরা এক ভাগ বরাদ্দের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার পর্যায়ে পৃথক বাজেট বন্দোবস্ত
৭. আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নাটক ও সংস্কৃতি রক্ষা ও বিকাশের জন্যে স্বতন্ত্র উন্নয়ন বোর্ড প্রতিষ্ঠা
যুগোপযোগী মৌলিক পরিবর্তনের সম্ভাবনাকে দূরে ঠেলে রেখে ‘ফেডারেশন’ কমিটি, নাট্যব্যক্তিত্ব, বিশিষ্ট মোড়ল এসব মেয়াদোত্তীর্ণ ধারণা ও পদবাচ্য দিয়ে বক্তৃতাবাজি করা গেলেও নাট্যাঙ্গনের পেশাদারি উন্নয়নে কোনোই কাজে আসবে না।