অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় থাকার কারণে বিএনপি এখনো ঠিক বিজয় নিশান উড়াতে পারেনি। আপাতত কেবল তাদের আগমনবার্তা ঘোষণা করছে। আগামী দিনে তারা যে পূর্ণ বিজয়ীর বেশে এসে ছড়ি ঘোরাতে চায়, তর্জনে-গর্জনে ওই কথা জানিয়ে দিচ্ছে৷
Published : 20 Aug 2024, 08:17 AM
ক্ষমতার পালাবদলের পর নতুন করে দখলের উৎসব শুরু হয়ে গেছে। অফিস, হাট-বাজার, বালুমহাল, ফুটপাত, বস্তি, পরিবহন— সবকিছু ছেড়ে পুরোনো দখলদাররা পালাচ্ছে এবং তাদের জায়গায় আবির্ভাব ঘটছে নতুন নতুন দখলদারের। নতুন করে শুরু হয়েছে চাঁদাবাজি।
ঢাকার বর্জ্য ব্যবস্থাপনার প্রাথমিক ধাপের কাজটি করে প্রাইমারি ওয়েস্ট কালেকশন সার্ভিস প্রোভাইডার বা পিডব্লিউসিএসপিরা। এই প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন বাসাবাড়ি থেকে ভ্যানে করে গৃহস্থালি বর্জ্য সংগ্রহ করে সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশনে নিয়ে যায়। সেখান থেকে ট্রাকে করে বর্জ্য নিয়ে যাওয়া হয় ল্যান্ডফিলে। সিটি করপোরেশনের প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি প্রতিষ্ঠানকে বর্জ্য সংগ্রহের কাজ দেওয়া হয়। সেসব প্রতিষ্ঠান আবার একাধিক ব্যক্তিকে এলাকা ভাগ করে দেয়। বাসাবাড়ি থেকে বর্জ্য সংগ্রহের জন্য পিডব্লিউসিএসপি প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিটি বাড়ির জন্য নির্দিষ্ট টাকা আদায় করে। এলাকাভেদে ওই চাঁদার হার ১০০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত।
বর্জ্য সংগ্রহের কাজটি এতদিন নিয়ন্ত্রণ করত স্থানীয় পর্যায়ের আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এখন এই টাকা আদায়ে নেমেছে বিএনপির নেতাকর্মীরা। বর্জ্য সংগ্রহের বিনিময়ে চাঁদা নেওয়াটাকে একটা সেবার বিনিময়ে আদায় করা অর্থ করা বলা যেতে পারে, আদায়টা একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে কিনা সে নিয়ে আলাপ করা যায়। নানাবিধ চাঁদা, যেগুলো এতকাল অকারণে দিতে বাধ্য হতো মানুষজন, সেগুলোও শুরু হয়ে গেছে। চাঁদা আদায়কারীর কেবল পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু চাঁদা আদায়ের ঘটনার পরিবর্তন হয়নি।
সরকারি, বেসরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন সংস্থা এবং প্রতিষ্ঠানেও দখলদারিত্ব চলছে। কেউ চাইছে ঠিকাদারি, কেউ দাবি করছে চাঁদা, আবার কেউ ব্যস্ত চেয়ার দখল নিয়ে। কেউ দখল করতে চাইছে ব্যাংক, কেউ খাস জমি। কেউ পুকুর। বিভিন্ন সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে ঠিকাদারি ও ইউনিয়ন দখলেরও চেষ্টা চলছে। ইতোমধ্যে রাজধানীর জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তর, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), ওয়াসা অফিসে গিয়ে প্রকৌশলীদের হুমকি-ধমকি দেওয়া হয়েছে বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে।
খোদ সচিবালয়ে প্রশাসনে চেয়ার দখলের দৌড় চলছে। নিজেদের বঞ্চিত দাবি করা একটি গ্রুপ বিভিন্ন চেয়ারে বসার জন্য তৎপরতা শুরু করেছে। অনেকে চাপ প্রয়োগ করে গুরুত্বপূর্ণ চেয়ারে তাদের পোস্টিং বাগিয়ে নেন। আবার দীর্ঘদিন পদোন্নতিবঞ্চিত একটি বড় অংশ পদোন্নতিও করিয়ে নেন।
দখল হচ্ছে বিদ্যুৎ কেন্দ্র। সিটি করপোরেশনসহ স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিদের পদ আর নেই। সর্বত্রই চলছে চেয়ার দখলের প্রতিযোগিতা। পুরোনোদের ভয়-ভীতি দেখিয়ে তাড়িয়ে দিয়ে নতুনরা বিভিন্ন পদ দখল করছেন। চেয়ার দখলের হিড়িক পড়েছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে। যে যেভাবে পারছেন, বদলি অর্ডার নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের শপথের আগেই অন্তত ১৪ জন কর্মকর্তার বদলির ঘটনা ঘটেছে। ডিজি নিজের চেয়ার ঠিক রাখার জন্য তড়িঘড়ি করে বিএনপিপন্থী কর্মকর্তাদের পদায়ন করেছেন।
কমবেশি সারাদেশে, সব প্রতিষ্ঠানেই এমন ঘটনা ঘটেছে এবং ঘটছে। ক্ষমতার পালাবদল হতে না হতেই শুধু চেয়ার বা পদ নয়, বিভিন্ন সংঘ-সমিতিও দখল করা হয়েছে। এমনিতেই বাংলাদেশ হলো সংঘ, সংগঠন, সমিতি ও জোটের দেশ। চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, আমলা, আইনজীবী, সাংবাদিক, শিক্ষক, কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, আলেম-ওলামা—প্রত্যেকের পৃথক সংগঠন আছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থায় রাতারাতি এই সংগঠনগুলোর নেতৃত্ব পরিবর্তন ও কর্তৃত্ব কায়েম হয়েছে।
দলবাজি ছাড়া এদেশে পেশাজীবী সংগঠনগুলোর যেন অন্য কোনো ভূমিকা নেই। ছাত্র ও শ্রমিক সংগঠনগুলো স্রেফ চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি করে। পছন্দের লোকদের ভালো পদায়ন ও অপছন্দের লোকদের কোণঠাসা করে রাখাও শ্রমিক সংগঠনগুলোর গুরুত্বপূর্ণ কাজ। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ায়, আর নানা কৌশলে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে, ওই টাকা মেরে দিয়ে দেশের টাকা বিদেশে পাচার করে। প্রকৌশলীরা ঠিকাদারের সঙ্গে লিয়াজোঁ করে রাষ্ট্রীয় অর্থ আত্মসাৎ করার নেশায় মত্ত। চিকিৎসকেরা পছন্দের জায়গায় পোস্টিং নিয়ে হাসপাতাল ফাঁকি দিয়ে ওষুধ কোম্পানি আর বেসরকারি ক্লিনিকের কমিশন বাণিজ্য করে। শিক্ষকরা ক্লাস ফাঁকি দিয়ে কোচিং বাণিজ্য করে, প্রাইভেট পড়িয়ে এবং বিভিন্ন প্রকল্পের পরামর্শক হয়ে টু-পাইস কামানোর ধান্দা করে। আমলা, পুলিশ, আইনজীবীদের সংগঠনও নিজেদের স্বার্থ ও সুবিধা আদায়ের ধান্দায় মশগুল থাকে।
দলীয় আনুগত্যই শেষ বিচারে ঠিক করবে তার পদ, অবস্থা— সরকার পরিবর্তনের পর তাই ‘বঞ্চিত’ অংশ হুমড়ি খেয়ে পড়েছে নিজেদের ‘হিস্যা’ বুঝে নেওয়ার অভিযানে। পুরনো সাইনবোর্ড ফেলে দিয়ে নতুন সাইনবোর্ড তোলা হয়েছে। আমাদের দেশে আমলা, ডাক্তার, পুলিশ, শিক্ষক, প্রকৌশলী প্রভৃতি পেশাজীবীদের আয়-উন্নতির নিয়ামক হয়ে দাঁড়িয়েছে দলীয় আনুগত্য। বিদেশে পড়ার বৃত্তি, অর্থ-বিত্ত, প্রভাব, সস্ত্রীক বা সপরিবারে বিদেশ সফরের কাঙ্ক্ষিত সুযোগ; জীবনের রোশনাই আর ভাগ্যের খোলতাই নির্ভর করছে দলীয় রাজনীতির জটিল সমীকরণে তার খেলবার শক্তির ওপর। চাল আর কূটচালে প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করে দলীয় নেতাদের কতটা নৈকট্যে কারা পৌঁছাতে পারলেন তার ওপরে নির্ভর করছে শান-শওকত, ক্যারিয়ার।
দলের কাজল না মেখে এখন কেউ চোখে দেখে না। গণসংগঠনগুলোও না। আর আমাদের দেশে দল মানে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। এতে কোনো রাখঢাকের বালাই থাকে না। পিয়ন থেকে সচিব বলতে গেলে সবাই এই দুই শিবিরে ভাগ হয়ে পড়েছেন। আরও ভয়ঙ্কর যে, মহামান্য আদালতের মান্যবর বিচারকদের ক্ষেত্রেও এইরকম সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতিতে ঢুকে পড়ার অভিযোগ উচ্চারিত হচ্ছে।
স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংবাদিক, বাস মালিক, আইনজীবী, ট্রাকচালক, ব্যাংক, বিমা, সচিবালয়, ওলামা-মাশায়েখ, ভ্যানচালক সমিতি— সবাই দলীয় রাজনীতির ভিত্তিতে তাদের তথাকথিত নেতা নির্বাচিত করছেন। কোনোটা হচ্ছে একেবারে নগ্নভাবে, প্রকাশ্যে দলীয় লেজুড়বৃত্তিতে, কোনোটায় আবার কিছুটা আড়াল রাখা হচ্ছে। এই নেতারাই সংশ্লিষ্ট বিভাগের নিয়োগ বাণিজ্য, ভর্তি বাণিজ্য, পদোন্নতি, টেন্ডারসহ তাবৎ বিষয় নিয়ন্ত্রণ করছেন। স্বাভাবিকভাবেই ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের দাপট থাকে বেশি, কারণ সুযোগ আর সম্পদের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ থাকে প্রবল আর বিরোধীপক্ষ অপেক্ষায় থাকে কবে তারা ক্ষমতায় যাবে।
সবশ্রেণির পেশাজীবীদের মধ্যে যেমন দলের খাদেমের অভাব নেই তেমনি আবার একদল খাদেম আছেন, যাদের কোনো দল নেই। তারা সবসময়ই সরকারি দল। খেদমতের নামে নিজেদের আখের গোছাতে সবসময় তারা চেষ্টা করেন সরকারি দলে ভিড়তে। তাদের আরেক নাম পার্মানেন্ট গভর্নমেন্ট পার্টি। আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যূত করার পর এখন সবখানে বিএনপির খাদেমদের সমারোহ লক্ষ করা যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে মুখ একই, কেবল সাইনবোর্ডটা বদলেছে।
ক্ষমতা বদলের দুই সপ্তাহ হয়নি। এর মধ্যেই সিবিএগুলোতে বিএনপির কর্তৃত্ব কায়েম হয়েছে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যবসায়ী, মটর শ্রমিক— সব সংগঠন এখন বিএনপির দখলে। অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও ভোল পাল্টে ফেলেছেন। অনেকেই এখন জয় বাংলাপন্থী থেকে জিন্দাবাদপন্থী হয়ে গেছেন। ক্রীড়াঙ্গনেও একই চিত্র।
এতকাল আওয়ামী লীলের সমর্থকরা হাজার হাজার শাখা সংগঠনে দেশ ভরে ফেলেছিল। মুক্তিযোদ্ধা, শিশু, যুব, স্বেচ্ছাসেবক, কৃষক, হকার, বাস্তুহারা, তাঁতী, মজুর, মুটে, রিকশা-ভ্যানচালক, সিবিএ, ব্যবসায়ী, তথ্যপ্রযুক্তি, সংস্কৃতি, চিকিৎসক, আর্থিক, মৎসজীবী, বিনিয়োগকারী, খেলাধুলা, নারী, শিল্প-বাণিজ্য, ব্যবসায়ী, প্রবীণ নাগরিক, ম্যানেজমেন্ট, মানবাধিকারসহ অসংখ্য সেল তৈরি করেছিল। ওইসব সেলে সদস্যেরও কোনো অভাব হয়নি। ক্ষমতা চলে যাওয়ার পর সব সেল শ্মশানের ছাইয়ের মতো মিলিয়ে গেছে। ওই ভস্মে এখন জন্ম নিয়েছে বিএনপির সব সেল। জন্ম নিয়েছে বললে ভুল হবে, তাদের পুনরুজ্জীবন ঘটেছে। এখন সবাই বিএনপি, সবখানে বিএনপি। যেমনটা ছিল ২০০৭ সালের আগে।
তবে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় থাকার কারণে বিএনপি এখনো ঠিক বিজয় নিশান উড়াতে পারেনি। আপাতত কেবল তাদের আগমনবার্তা ঘোষণা করছে। আগামী দিনে তারা যে পূর্ণ বিজয়ীর বেশে এসে ছড়ি ঘোরাতে চায়, তর্জনে-গর্জনে ওই কথা জানিয়ে দিচ্ছে৷
যেহেতু আমাদের দেশে ক্ষমতা যার হাতে সেই শেষ কথা বলবে, সব কিছু দখল করে নেবে, তাই ভিন্ন নামের সংগঠনগুলোকে আর কষ্ট করে দখল করার দরকার কী? দেশের সব সিবিএ, সব সমিতি, সব সংগঠন হবে ক্ষমতাসীন দলের, সব অফিসের নেতৃত্বে ও কর্তৃত্বে থাকবে তারাই, তারাই চাঁদাবাজি-টেন্ডারাবাজি, নিয়োগ-বদলি, প্রমোশন, বাধ্যতামূলক অবসর প্রদানের একচ্ছত্র অধিকার ভোগ করবে— এই বিধান করে নিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়। নীতি তো একটাই, কোনো ক্ষমতা ও সুযোগসুবিধা যেন বিরোধী বা অন্য পক্ষের কাছে না থাকে। অন্তত এই বিষয়ে স্থায়ী একটা নিয়ম চালু করে বিশ্বকে পথ দেখাতে পারে বাংলাদেশ!
আরও পড়ুন:
ক্ষমতার পালাবদলে পাল্টাচ্ছে দখল, চাঁদাবাজিতে চেহারা বদল
সাদিক অ্যাগ্রোকে উচ্ছেদ করা জায়গায় বিএনপির অফিস, পরে ‘অপসারণ’