যৌবনে নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে স্বদেশ ও স্বজাতির জন্য সবকিছু বিসর্জন দিলেও এই বিপ্লবী নারী রাষ্ট্রীয় সম্মান পাননি। তাকে একুশে পদক বা স্বাধীনতা পদকও দেওয়া হয়নি।
Published : 23 Mar 2024, 10:20 PM
কুমুদিনী হাজং। লড়াই-সংগ্রামের জীবন্ত কিংবদন্তি। সংগ্রাম করেছেন ব্রিটিশ শোষণের বিরুদ্ধে। এই কুমুদিনী হাজংকে ঘিরেই সেদিন ছড়িয়ে পড়েছিল টংক আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ। জমিদারদের অন্যায্য খাজনা আদায়ের বিরুদ্ধে সেই সময় রাজ সেনার বিরুদ্ধে তিনি কৃষকদের বীরত্বপূর্ণ বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন।
দীর্ঘ সংগ্রামের পর ১৯৫০ সালে বাতিল হয় টংক প্রথা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একে একে বিদায় নিয়েছেন সেই অগ্নি-যুগের বিপ্লবী সন্তানেরা। তাদের মধ্যে কেবল কুমুদিনী হাজং বেঁচে ছিলেন কালের সাক্ষী হয়ে। আজ তিনিও নীরবে চলে গেলেন নক্ষত্রালোকে!
মানুষের ইতিহাস তো লড়াই-সংগ্রামেরই ইতিহাস। শোষণ-নির্যাতন-অন্যায়ের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে রুখে দাঁড়ানোর ইতিহাস। আমাদের আজকের বাংলাদেশ তো আমাদের পূর্বসূরীদেরই রক্ত-ঋণে পাওয়া। কিন্তু আমরা বড় বেশি ইতিহাস বিস্মৃত জাতি। অতীত নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাই না। যুগে যুগে অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য, শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য, প্রিয় মাতৃভূমিকে সুন্দর করবার জন্য যারা আত্মত্যাগ করেছেন, তাদের কথা জানি না। জানতে চাইও না। তেমনই এক অনালোচিত চরিত্র ছিলেন কুমুদিনী হাজং।
তিনি বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে টংক আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেত্রী। তখন ফসলের মাধ্যমে জমিদারদের খাজনা প্রদানের একটি শোষণমূলক প্রথা ছিল। ব্রিটিশ শাসনামলে সুসং দুর্গাপুরে টংক প্রথার প্রচলন ছিল। জমিতে ফসল হোক বা না হোক টংকের ধান জমিদারদের দিতেই হতো। না দিলে কৃষকদের ওপর জমিদাররা অত্যাচার, নির্যাতন করত। ১৯৩৭ সালে উপমহাদেশের কমিউনিস্ট নেতা কমরেড মণি সিংহের নেতৃত্বে কৃষকরা এ প্রথার বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলন শুরু করেন। এই আন্দোলনে কুমুদিনী হাজংয়ের স্বামী লংকেশ্বর হাজং সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন।
১৯৪৬ সালের ৩১ জানুয়ারি আন্দোলনকারীদের দমন করতে ব্রিটিশ সরকারের সশস্ত্র সেনারা লংকেশ্বরকে ধরতে তার বাড়িতে যায়। স্বামীর অবস্থান জানাতে না চাইলে সেনারা ক্ষিপ্ত হয়ে কুমুদিনী হাজংকে ধরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালায়। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে নারী নেত্রী রাশিমণি হাজংয়ের নেতৃত্বে শতাধিক হাজং নারী পুরুষ প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
ব্রিটিশ সেনাদের কাছ থেকে কুমুদিনী হাজংকে ছাড়িয়ে নিতে গেলে নৃশংসভাবে তাদের ওপর গুলি চালান সেনারা। এতে রাশিমণি হাজং, সুরেন্দ্র হাজংসহ বেশ কয়েকজন মারা যান।
সেনারা কুমুদিনী হাজংকে ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে যায়। আন্দোলনের মুখে ১৯৫০ সালে বিলুপ্ত হয় টংক প্রথা।
কুমুদিনী হাজংয়ের জন্মের দু-বছর পরই বাবা অতিথ চন্দ্র রায় হাজং ও মা জনুমণি হাজং মারা যান। মামার কোলে-পিঠেই বড় হন কুমুদিনী হাজং। কুমুদিনী হাজং কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণ করতে পারেননি। সেই সময়ের সামাজিক প্রথার কারণে মাত্র ১১/১২ বছর বয়সেই বেহেরাতলী মাইঝপাড়া গ্রামের দুর্গাদাস হাজংয়ের ছোট ছেলে ১৫ বছর বয়সের কিশোর লংকেশ্বর হাজংয়ের সঙ্গে কিশোরী কুমুদিনী হাজংয়ের বিয়ে হয়। বিয়ের পর কুমুদিনী হাজংয়ের বাবার রেখে যাওয়া চার আড়া (১শ ২৮ শতকে ১ আড়া) জমি ও বাড়ি বুঝিয়ে দিয়ে লংকেশ্বর হাজংকে ঘরজামাই করে নেন।
হাজং সম্প্রদায় বরাবরই সুসং জমিদারদের ভগবান তুল্য গণ্য করত। এরপরও গারো পাহাড়ি অঞ্চলে জমিদার, মহাজনদের সৃষ্ট টংক প্রথার শর্তানুসারে জমিতে ফসল হোক বা না হোক টংকের ধান জমিদার-মহাজনদের দিতেই হতো। সহজ কথায় হাজং সম্প্রদায়ের শ্রম কেড়ে নেওয়ার জন্য জমিদাররা টংক প্রথা নামে ফাঁদ পেতেছিল। এতে হাজংরা ক্রমেই জমি-বাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হতে থাকে।
এ সময় সুসং দুর্গাপুরের জমিদারদের ভাগ্নে কমিউনিস্ট নেতা কমরেড মণি সিংহের নেতৃত্বে ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে টংক প্রথা উচ্ছেদ, টংক জমির খাজনা স্বত্ব, জোত স্বত্ব, নিরিখ মতো টংক জমির খাজনা ধার্য, বকেয়া টংক মওকুফ, জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ ইত্যাদি দাবি নিয়ে টংক আন্দোলন শুরু হয়। হাজং সম্প্রদায় নিজেদের স্বার্থেই টংক আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। সে সূত্রেই কুমুদিনী হাজংয়ের স্বামী লংকেশ্বর হাজং ও তার তিন ভাই টংক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। বহেরাতলীসহ পার্শ্ববর্তী গ্রামে লংকেশ্বর হাজং ও তার বড় ভাই রাজেন্দ্র হাজং, ইসলেশ্বর হাজং ও গজেন্দ্র হাজং টংক প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনের জন্য হাজংদের সংগঠিত করার দায়িত্ব গ্রহণ করে। পরিবারটি কমরেড মণি সিংহের সঙ্গেও সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখত। সে কারণেই জমিদার ও ব্রিটিশ বাহিনীর রোষানলে পড়েছিল লংকেশ্বর হাজং ও তার ভাইরা।
১৯৪৬ সালের ৩১ জানুয়ারি সকাল ১০টার দিকে বিরিশিরি থেকে ৪ মাইল উত্তর-পশ্চিমে বহেরাতলী গ্রামে ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেল বাহিনীর একটি দল লংকেশ্বর হাজংয়ের বাড়িতে হানা দেয়। টংক আন্দোলনের মাঠ পর্যায়ের নেতা লংকেশ্বর হাজং ও তার ভাইদের গ্রেফতার করাই ছিল সশস্ত্র বাহিনীর উদ্দেশ্য। ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার বাহিনীর বহেরাতলীর দিকে আসার সংবাদ পেয়েই লংকেশ্বর হাজং ও তার তিন ভাই আত্নগোপন করে আড়াপাড়ায় মণি সিংহের গোপন আস্তানায় চলে যায়।
লংকেশ্বর হাজং ও তার ভাইদের ধরতে না পেরে ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেল বাহিনীর সশস্ত্র সেনারা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। বাড়ির নারীদের সঙ্গে রূঢ় আচরণ করতে থাকে। এক পর্যায়ে লংকেশ্বর হাজংয়ের সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীকে দেখে সশস্ত্র সেনারা লংকেশ্বর হাজং কোথায় আছে জানতে চায়। টংক আন্দোলনের নেত্রী কুমুদিনী হাজং সঠিক উত্তর না দিয়ে ‘জানি না’ বলে জবাব দিয়ে দেন। এতে সেনারা আরও ক্ষিপ হয়ে উঠে। তারা কুমুদিনী হাজংকে ধরে নিয়ে যায় বিরিশিরি সেনা ছাউনিতে।
কুমুদিনী হাজংকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সংবাদ মুহূর্তেই গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। হাজং অধ্যুষিত গ্রামগুলো থেকে শতাধিক হাজং নারী-পুরুষ সশস্ত্র হয়ে ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার বাহিনীর পথরোধ করে দাঁড়ায় ও কুমুদিনী হাজংকে ছেড়ে দিতে বলে।
ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেল বাহিনীর সেনারা হাজং গ্রামবাসীর কথা কর্ণপাত না করে বিরিশিরির দিকে যেতে থাকে। গ্রামবাসীর মধ্য থেকে মধ্যবয়স্কা রাশিমণি নামে এক হাজং নারীর নেতৃত্বে দিস্তামণি হাজং, বাসন্তী হাজংসহ ১২ জনের নারী সশস্ত্র দল কুমুদিনী হাজংকে ছাড়িয়ে নিতে গেলে সশস্ত্র সেনারা নৃশংসভাবে তাদের ওপর গুলি চালায়। এতে রাশিমণি হাজং গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এ নৃশংস হত্যাকাণ্ড দেখে পেছনের পুরুষ দলের নেতা সুরেন্দ্র হাজং রাশিমণিকে ধরতে গেলে তাকেও নির্দয়ভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় অন্যান্য হাজং নারী-পুরুষ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং সশস্ত্র সেনাদের ওপর বল্লম ও রামদা দিয়ে হামলা চালায়। তাদের হামলায় ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেল বাহিনীর দুজন সেনা ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। বাকি সেনারা পালিয়ে আত্মরক্ষা করে।
ওই ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই সংজ্ঞাহীন কুমুদিনী হাজংকে গ্রামবাসীরা বহেরাতলীর অদূরে গভীর পাহাড় ঘেরা আড়াপাড়া অরণ্যে কমিউনিস্ট নেতা কমরেড মণি সিংহের গোপন আস্তানায় নিয়ে যায়। সেখানে দীর্ঘ সেবা-শুশ্রূষার পর কুমুদিনী হাজং জ্ঞান ফিরে পান।
এ ঘটনায় সরকার ক্ষিপ্ত হয়ে হাজং অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে অত্যাচারের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়। পাশাপাশি সরকার বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলাও দায়ের করে। মামলায় কমরেড মণি সিংহ, লংকেশ্বর হাজং, তার তিন ভাই ও কুমুদিনী হাজংসহ অনেক আন্দোলনকারীকে আসামি করা হয়।
কুমুদিনী হাজং পুলিশের অত্যাচার ও গ্রেফতার এড়াতে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার লক্ষ্মীকুড়া গ্রামে বলেশ্বর হাজংয়ের বাড়িতে আত্মগোপন করেন। পুলিশসহ কেউই যেন কুমুদিনী হাজংকে চিনতে না পারে সেজন্য বলেশ্বর হাজংয়ের পরামর্শে কুমুদিনী হাজংয়ের নাম পরিবর্তন করে সরস্বতী নামে ডাকা হতো। সে কারণেই প্রমথ গুপ্তের ‘মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসী’, সুপ্রকাশ রায়ের ‘মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় কৃষক’ ও ‘ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম’ পুস্তকে কুমুদিনী হাজংয়ের নাম সরস্বতী বলে উল্লেখ পাওয়া যায়।
বহেরাতলী গ্রামসহ পাশের গ্রামগুলোতে পুলিশের অত্যাচারে গৃহহারা হাজংদের মারমুখী হওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিল না। তাই তারা গোপনে গোপনে সাংগঠনিক তত্পরতা জোরদার করে। সে সময় কুমুদিনী হাজং হালুয়াঘাটের লক্ষ্মীকুড়াসহ আশেপাশের গ্রামগুলোতে সরকারের অন্যায় অত্যাচারের প্রতিরোধ আন্দোলন ও টংক প্রথার বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে গোপনে সাংগঠনিক কর্মতত্পরতা চালান।
১৯৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের মূখ্যমন্ত্রী নূরুল আমীনের চক্রান্তমূলক আশ্বাসের ফলে সাধারণ হাজংরা নিজ নিজ ঘরে ফিরতে শুরু করে এতে আন্দোলনে অনেকাংশে ভাটা পড়ে যায়। নূরুল আমীনের প্রহসনের মূল কাজ শুরু হয় পরে, ১৯৬৪ সালে। ওই সময় হাজংরা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কবলে পড়ে। গ্রামে গ্রামে বাঙালি মুসলমানরা প্রবেশ করলে শুরু হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। সে দাঙ্গার হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে হাজংরা দলে দলে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে। ওই সুযোগে সরকারের ইন্ধনে সেটেলাররা হাজংদের জমি-বাড়িসহ সকল সম্পদ দখল করে নেয়। ওই সময় কুমুদিনী হাজংয়ের ৪ আড়া জমিসহ বাড়িঘর সেটেলারদের হাতে চলে যায়।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কুমুদিনী হাজং তার পরিবার নিয়ে ভারতের বাঘমারা শিবিরে আশ্রয় গ্রহণ করেন। দেশ স্বাধীন হলে বাড়ি ফিরে এসে শুধু ভিটে ছাড়া আর জমি ফিরে পাননি।
চরম দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম করে এই অগ্নিযুগের বিপ্লবী নারীর এক শতকের জীবন অতিবাহিত হয়। যৌবনে নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে স্বদেশ ও স্বজাতির জন্য সবকিছু বিসর্জন দিলেও এই বিপ্লবী নারী রাষ্ট্রীয় সম্মান পাননি। তাকে একুশে পদক বা স্বাধীনতা পদকও দেওয়া হয়নি। তবে তিনি অগণিত মানুষের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা পেয়েছেন। তার ত্যাগ ও সংগ্রামী চেতনাকে নতশিরে শ্রদ্ধা জানাই।