Published : 12 May 2013, 10:12 PM
জন্ম এবং মৃত্যুর মধ্যকার সময়কালকে আমরা 'জীবন' বলে জানি। তাই জন্মের মধ্য দিয়ে যে জীবনের প্রারম্ভনা মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সে জীবনের অবসান। মধ্যবর্তী সময়কালে আমরা জীবনের রূপ, রস ও গন্ধ আস্বাদনের ভেতর দিয়ে হাসি, কান্না, দুঃখ, বেদনা, প্রেম, ভালোবাসা, কাম, ক্রোধের সম্মিলনে বেঁচে থাকার আনন্দ ও জীবনের অস্তিত্ব উপলব্ধি করি। আর এর ভেতর দিয়ে জীবনের জয়গান গাই।
কিন্তু মৃত্যুর ভয়াল থাবা জীবনের সমস্ত আয়োজন নিঃশেষ করে একদিন 'জীবন' নামক মহাকাব্যের যবনিকা রচনা করে। এটাই জীবন ও মৃত্যুর দার্শনিক ও ডাইয়ালেক্টিক সম্পর্ক। কেননা করুণ বিয়োগান্ত পরিণতির ভেতর দিয়ে 'মৃত্যু' তার উপর অর্পিত রিচ্যুয়াল-কর্তব্য অনুযায়ী 'জীবন' নামক অনিন্দ্যসুন্দর উপাখ্যানের ইতি ঘটায়।
অবশেষে স্বপ্নীল জীবনের পরাজয় ঘটে নিষ্ঠুর মৃত্যুর হাতে। জীবনের সকল মায়া, মমতা, স্নেহ, ভালোবাসার বন্ধন ছিন্ন করে মৃত্যু অপার সম্ভাবনার জীবনকে নিয়ে যায় জীবনের পরপারে। কিন্তু কিছু কিছু জীবন আছে এবং কিছু কিছু জীবনের অপরিসীম শক্তি আছে, যার কাছে কোনো কোনো সময় মৃত্যুও পরাজিত হয়। মৃত্যুঞ্জয়ী এ জীবনের কাছে জীবন-হরণের জন্য প্রয়োগযোগ্য মৃত্যুর সকল কসরত একে একে বিফল হয়। 'মৃত্যু' এসে তখন হার স্বীকার করে সে 'জীবনে'র অপরিসীম জীবনিশক্তি ও অপরাজেয় মনোবলের কাছে।
রেশমা আমাদের সে অপরিসীম জীবনীশক্তির এক উজ্জ্বল উদাহরণের নাম। তাই ইতিহাসের এক বিরল বীরত্বপূর্ণ ব্যতিক্রম হিসাবে অপরাজেয় রেশমা আজ মৃত্যুঞ্জয়ী রেশমা। আমাদের রেশমা। বাংলাদেশের রেশমা।
কোনো বিষয় নিয়ে লিখতে গেলে যুক্তি, ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ, তত্ত্ব, উপাত্ত নানান মালমসলার সমন্বয়ে একটি বক্তব্য দাঁড় করানোর নিরলস বুদ্ধিবৃত্তিক কসরত করতে হয়। কিন্তু রেশমার বেঁচে যাওয়া নিয়ে 'লেখা' হচ্ছে জীবন-মৃত্যুর পাশাখেলায় জীবনের জয়লাভের কেবলই গুণকীর্তন। যে কোনো ধরনের ক্রিটিক্যাল পারসপেক্টিভ এখানে রেশমার 'বেঁচে থাকা' এবং 'বেঁচে যাওয়া'র ঘটনার বীরোচিত মাহাত্ম্যকে খাটো করার সমার্থক।
কেননা এখানে যুক্তি হচ্ছে জীবনের অপার শক্তি; এখানে তত্ত্ব হচ্ছে মানুষের বেঁচে থাকার সীমাহীন সক্ষমতা এবং তার অশেষ সম্ভাবনা; এখানে উপাত্ত হচ্ছে স্বয়ং মানুষের জীবন এবং জীবনের ব্যাখ্যাতীত হাইপোথেসিস; এখানে বিশ্লেষণ হচ্ছে মানুষের বাঁধভাঙা আবেগ এবং কোটি আবেগের সমন্বিত উৎসারণ; আর সংশ্লেষণ হচ্ছে রেশমার জন্য এ দেশের লাখো-কোটি মানুষের আবেগ, প্রার্থনা ও আনন্দাশ্রু। এ লেখা এরকম এক-আকাশ আবেগ এবং এক-সমুদ্র আনন্দাশ্রু নিয়ে লেখা!
রানা প্লাজার ভয়াবহ ধস এবং এ ভবনে অবস্থিত পাঁচটি তৈরি পোশাক কারখানায় কর্মরত প্রায় সহস্রাধিক শ্রমিকের লাশ, প্রায় আড়াই হাজার শ্রমিকের মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা, তার মধ্যে শত শত শ্রমিকের আহত কিংবা পঙ্গু হয়ে যাওয়া এবং আরও প্রায় শত শত শ্রমিকের নিখোঁজ হওয়া বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের উৎপাদন-সম্পর্ক এবং উৎপাদন-ব্যবস্থাপনার ভয়ঙ্কর রূপ আমাদের সামনে নগ্নভাবে উন্মোচিত করেছে। বাংলাদেশ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বিশ্ববাজারে দ্বিতীয় স্থান দখল করলেও, এ দেশের কারখানাগুলো যে এখনও একেকটি মৃত্যুকূপ- রানাপ্লাজাধসের ঘটনা সেটা আমাদের আরও একবার দেখিয়ে দিয়েছে। শ্রমিকের জীবনের নিরাপত্তা বলে যে কোনো কিছুর ছিটে-ফোঁটাও যে এ শিল্পের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় বিদ্যমান নেই, সেটা রানাপ্লাজাধসের ভয়াবহতার ভেতর দিয়েই বোঝা গেল।
তাই রেশমার বেঁচে যাওয়া সর্বার্থেই ওর একক কৃতিত্ব। এটা ওর অশেষ জীবনীশক্তি এবং অপরাজেয় মানসিক শক্তির অফুরন্ত বহিঃপ্রকাশ। সে অর্থে রেশমার এভাবে সতের দিন ধরে ধ্বংসস্তূপের নিচে 'বেঁচে থাকা' এবং মৃত্যুর ভয়াল থাবাকে পরাজিত করে 'বেঁচে যাওয়া' তৈরি পোশাক শিল্পের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা ও গোটা ব্যবস্থাপনার চরম অব্যবস্থাপনার প্রতি এক ধরনের বৃদ্ধাঙুলি প্রদর্শনও বটে!
রানা প্লাজা ধসে পড়ার পর থেকেই গোটা দেশের মানুষ অত্যন্ত বেদনার্ত ও আবেগাপ্লুত হয়ে মেহনতি-শ্রমিকের লাশের মিছিল ও জীবন-মৃত্যুর মাঝামাঝি অবস্থানরত মানুষের আকুতি-আহাজারি দেখে পার করেছে বেশ কটা দিন। আমরা লক্ষ্য করলাম, লাশের মিছিলে যোগ হচ্ছে নতুন নতুন লাশ। আহতের পাশে শুয়ে পড়ছে নিহত মানুষ। আবার নিহতের বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে বুকফাটা আর্তচিৎকারে বিলাপ করছে আহত-আত্মীয়।
ডুকরে কেঁদে উঠছে চারপাশ। ভারি হয়ে উঠছে আলো, বাতাস, দেয়াল, কংক্রিট। মানুষের নিঃশ্বাসে, দীর্ঘশ্বাসে, স্বজনহারানোর বিলাপে, মানুষের মৃত্যুকাতর আহজারিতে চারপাশ যেন মৃত্যুপুরীতে রূপ নিয়েছে। জীবন বাঁচানোর আকুতি, জীবন-মৃত্যুর পুলসিরাতের ভেতর দিয়ে বেঁচে যাওয়া মানুষের আতঙ্কিত অবয়ব, রক্তের গন্ধময় নিহতের প্রায়-কাছাকাছি আহত মানুষ, জীবন-মৃত্যুর এ পাশাখেলার লাইভ-টেলিকাস্ট বুকের গভীরে আবেগের সুতো ধরে সজোরে টান দেয়। এভাবে আর কত?
তাজরিন ফ্যাশনের ১১২ শ্রমিকের পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া লাশের গন্ধ বাতাস থেকে না-যাওয়ার আগেই আশুলিয়ার স্মার্ট গার্মেন্টস সাপ্লাই করেছে নতুন সাতটি লাশ। আর স্মার্ট গার্মেন্টসের লাশের গন্ধ বাতাস থেকে সরে না-যাওয়ার আগেই রানাপ্লাজাধসের ঘটনায় চ্যাপ্টা হয়ে যায় এ দেশের সহস্রাধিক শ্রমিকের জীবন। স্মার্ট গার্মেন্টসের আগে তাজরিন ফ্যাশন, তারও আগে হামীম গার্মেন্টস, তার আগে গরিব এন্ড গরিব গার্মেন্টস, তার আগে কেটিএস- এভাবে লাশ আর লাশ।
তৈরি পোশাক শিল্পের বিকাশ ও প্রবৃদ্ধি যেন শ্রমিকের লাশের সংখ্যাগত পরিবৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গড়ে এবং বেড়ে উঠেছে। এভাবে আর কত মানুষের লাশের ভেতর দিয়ে নির্মিত হবে এ দেশের অর্থনীতির ইমারত? এটা কি তৈরি পোশাক শিল্পের অর্থনীতি নাকি লাশের অর্থনীতি? দীর্ঘ সতের দিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে বেঁচে যাওয়া রেশমা আমাদের নিজেদের বিবেকের কাছে আরও অপরাধী করে দেয়!
তৈরি পোশাক শিল্প-কারখানায় দুর্ঘটনা ঘটবে, লাশ হবে মানুষ, তদন্ত কমিটি হবে, দোষীদের দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি দেওয়া হবে বলে কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে গালি দেওয়া হবে। অতঃপর তদন্ত কমিটি রাজনীতির পকেটে ঢুকে নাকে তেল দিয়ে ঘুমাবে, কারখানার মালিক বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াবে, নতুন নতুন কারখানা করবে, আবার নিত্যনতুন লাশের আয়োজন করবে। এ হচ্ছে বিচারব্যবস্থা এবং বিচারের নমুনা। এ হচ্ছে রাজনীতিবিদদের আশ্বাসের ফাঁকা বেঈমানি-বুলি। এ হচ্ছে রেশমাদের সঙ্গে করা রাষ্ট্রের নির্মম মোনাফেকি।
এদিকে লাশের মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়। সাভারের অধরচন্দ্র মডেল হাইস্কুলের মাঠে লাশের মিছিলে যারা শুয়ে ছিল বা আছে কিংবা গত ১ মে থেকে জুরাইন কবরস্থানে যাদের সারি করে গণকবর দেওয়া হল, তারা আমাদেরই কারও সহোদর ভাই, কারও আদরের বোন, কারও মায়াবতী মা বা প্রিয়তম পিতা। এ দেশের ষোল কোটি মানুষের কারও না কারও আত্মার আত্মীয়।
এ লাশের মিছিল আর মৃত্যুর উৎসব দেখতে দেখতে আমরা যখন প্রায় অনুভূতিহীন হয়ে উঠতে শুরু করেছিলাম, ভবনধসের ১৭ দিন পর আমরা জীবনের তো বটেই এমনকি মৃত্যুর আশাও প্রায় ছেড়ে দিচ্ছিলাম, ঠিক তখনই রেশমার প্রাণ আমাদের হৃদয়ে নতুন স্পন্দন তৈরি করে। উদ্ধারকর্মীরা তখন হয়ে উঠেন আমাদের আবেগের ব্যারোমিটার। রেশমাকে উদ্ধারে তাদের প্রতি পদক্ষেপে আমাদের হৃদয়ের কম্পন আর আবেগের পারদ উঠে আর নামে। আমরা আশায় বুক বাঁধি। গোটা দেশের মানুষ লাইভ-টেলিকাস্টের মাধ্যমে উদ্ধারকার্যে সম্পৃক্ত হয়। সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনায় মগ্ন হয়।
উদ্ধারকর্মীদের হাত ধরে যখন রেশমা ধবংসস্তূপ থেকে বেরিয়ে আসে, তখন দেশের এবং প্রবাসে বসবাসরত লাখো-কেটি বাংলাদেশি একসঙ্গে আনন্দাশ্রুতে ভেসে যায়। এ যেন রেশমা নয়, এ দেশের কোটি মানুষের আটকে থাকা আবেগ ধবংসস্তূপ থেকে উঠে এসেছে। রেশমা তখন কেবল একজন মানুষ নয়, এ দেশের মানুষের ভালোবাসা-আবেগ-মমতার প্রতীক হয়ে উঠে। রেশমা তখন আমাদের অতিপ্রিয় ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের লাল-সবুজের বাংলাদেশ।
রেশমা অপরাজেয়, মৃত্যুঞ্জয়ী। মৃত্যুকে পরাজিত করার মানুষের সীমাহীন জীবনীশক্তির এক সিম্বোলিক আইকন। শব্দও কোনো কোনো সময় অক্ষম হয়ে যায় মানুষের আবেগাপ্লুত আনন্দের অনুপুঙ্ক্ষ বয়ান দিতে গিয়ে। এ ক'ফোটা পবিত্র আবেগ কেবল রেশমার জন্যই বরাদ্দ থাক।
রেশমার মধ্যে বারবার অপরাজেয় বাংলাদেশের মুখই যেন দেখতে পাই।
ড. রাহমান নাসির উদ্দিন: সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। হুমবোল্ট ভিজিটিং ফেলো হিসেবে জার্মানির একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন।