Published : 09 Sep 2021, 09:22 PM
দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় গত ৩ সেপ্টেম্বর ভারত সীমান্তে বিএসএফের হাতে ধরা পড়েন বনানী থানার পুলিশ পরিদর্শক সোহেল রানা। এরপরই তার বিপুল সম্পদের হদিস আর অবৈধ ব্যবসার বিষয়টি আলোচনায় আসতে শুরু করে।
এখন যা জানা যাচ্ছে, তাতে সোহেল রানার জীবনটা পুরাই সিনেমার মতো। তিনি দিনের বেলায় নাকি থানায় আসতেন না, মাঝে মাঝে আসতেন রাতে। থানার কোনো গাড়িও তিনি ব্যবহার করতেন না। নিজস্ব দামি গাড়ি ব্যবহার করতেন। উপরমহলে তার যোগাযোগ ছিল অত্যন্ত শক্ত। তাই তো তিনি ঘুরেফিরে গুলশান-বনানী এলাকাতেই প্রায় ১০ বছর চাকরি করছেন। মাঝখানে একবার ডিবিতে বদলি হলেও আবার গুলশানে ফিরে আসেন। তিনি ভিসা সিন্ডিকেট, গুলশান এলাকার অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন বলেও অভিযোগ আছে।
তার সম্পদেরও নাকি কোনো হিসেব নেই। ঢাকায় অন্তত চারটি ফ্ল্যাট আছে। একাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ আছে। খাগড়াছড়িতে রিসোর্টের জন্য জায়গা কেনা আছে। থাইল্যান্ডের পাতায়াতে জমি ও ফ্ল্যাটের পাশাপাশি হিলটন হোটেলের পাশে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেন। গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জে প্রায় ৫০০ বিঘা জমির মালিক তিনি। প্রতারণার মাধ্যমে গ্রাহকের ১১০০ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় আলোচিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জেরও 'পৃষ্ঠপোষক' তিনি!
দেশে ঘুষ-দুর্নীতি-লুটপাট যে কী ভয়ঙ্কর পর্যায়ে উপনীত হয়েছে তার সামান্য নমুনা হয়তো এই সোহেল রানা। তিনি বছরের পর বছর ধরে পুলিশের পদ ব্যবহার অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। অথচ তার সহকর্মী, তত্ত্বাবধায়করা কিছু জানেন না, তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এমনকি বছরের পর বছর একই এলাকায় চাকরি করে যাওয়া, দিনের পর দিন অফিস ফাঁকি দেওয়ার ঘটনাটিও 'স্বাভাবিক' হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। হ্যাঁ, তিনি সব কিছু 'ম্যানেজ' করেছেন, করতে পেরেছেন। দেশে এখন ঘুষ-দুর্নীতি, লুটপাটের ঘটনাগুলো এভাবে কিছু ব্যক্তিকে 'ম্যানেজ' করেই করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে সম্ভবত সরকারের আর কিছু করার নেই। ইচ্ছেও হয়তো নেই।
তবে এ ধরনের ঘটনায় আমার মতো সাধারণ মানুষের মনে যে প্রশ্ন জাগে তা হলো, একজন মানুষের কত টাকা প্রয়োজন? এক কোটি? দশ কোটি? একশ কোটি? হাজার কোটি?
আজ থেকে বহু বছর আগে বিশ্বখ্যাত রুশ সাহিত্যিক লিও তলস্তয় 'হাউ মাচ ল্যান্ড ডাজ এ ম্যান রিকয়্যার' শীর্ষক এক প্রসিদ্ধ গল্প লিখেছিলেন। গল্পটি এ রকম, একদিন এক দরিদ্র মানুষ এসে রাশিয়ার সম্রাটের কাছে বললেন, তার কোনো জমিজমা বা খেটে খাওয়ার মতো সম্পদ নেই। তিনি চলতে পারছেন না। তখন সম্রাট তাকে বিশাল এক প্রান্তরে নিয়ে গিয়ে বললেন, সামনে যা জমি আছে, সব আমার। তুমি এই সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত দৌড় দিয়ে যতটুকু জমির চারধারে ঘুরে আসতে পারবে, ঠিক ততটুকু জমি তোমার হবে।
দরিদ্র মানুষটি অমনি দৌড় শুরু করল। যতদূর যাবে, সে তত জমির মালিক হবে। তার অনেক অনেক জমি চাই। সে দৌড়োচ্ছে আর ভাবছে, আর একটু, আর একটু। আর একটু হলে বেশি চাষাবাদের জমি পাওয়া যাবে, অন্যকে বর্গা দিয়ে নিজে বসে খেতে পারবে। তারপর আবারও একটু দৌড় দিয়ে ভাবে, আরও একটু বেশি জমি থাকলে বাড়িটা পাকা করা যাবে, সম্রাট তো বলেছে, যতটুকু জমি সূর্যাস্ত পর্যন্ত দৌড়ে সীমানা দিয়ে ঘুরে আসতে পারব, ততটুকুই আমার। ওহ, বড্ড ক্লান্ত হয়েছি। একটু জিরিয়ে নিই। সামান্য জিরিয়ে নেবার পরই সে ভাবে আজ আমার বিরতি নেবার দিন নয়, আজ আমার বিজয়ের দিন, যতটা খাটব, ততটা পাব, সুতরাং দে দৌড়, আজ কোনো বিরতি নেই। সে দৌড়েই চলছে। দৌড় দিয়ে সে জমিগুলোর অনেক ভেতরে প্রবেশ করেছে, যেখান থেকে সম্রাটের রাজ্য দেখাই যায় না। এদিকে সূর্য প্রায় ডুবু ডুবু। এখন তার ফিরবার পালা। সে ডান দিকে ঘুরে একটি আয়তক্ষেত্র আঁকবার চেষ্টা করল। সূর্য পশ্চিমে আরো হেলে পড়েছে। এবার তার ফিরতে হবে। সে দৌড় দিল। সূর্য ক্রমাগত পশ্চিমে নেমেই আসছে। সে আরো দ্রুত দৌড়াতে শুরু করল। সূর্য পশ্চিম দিগন্ত প্রায় ছুঁই ছুঁই করছে, তার আর সময় নেই, তাকে সম্রাটের প্রাসাদের সীমানায় যেতে হবে। সে আরো জোরে দৌড়োচ্ছে। কিন্ত লোকটি সীমানা প্রাচীরের কাছে এসেই আর টিকে থাকতে পারল না। দড়াম করে পড়ে গেল! বুকের ভেতর থেকে শেষ বাতাসটুকু বেরিয়ে গেল। লোকটি মারা গেল। কিন্তু কী পেল সে?
মহান লেখক তলস্তয় তার এ লেখার মধ্য দিয়ে মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, একজন মানুষের প্রকৃতপক্ষে কতটুকু জমি প্রয়োজন?
উল্লিখিত গল্পটি আমরা শিক্ষিত মানুষরা প্রায় সবাই জানি। কিন্তু না, আমরা কারও কাছ থেকে কিছু শিখিনি। শিখেছি কেবল মেরে দেবার, আত্মসাৎ করবার শিক্ষা। যার সুযোগ যত বেশি, সে এখানে তত বড় চোর। আমাদের সবখানে ঘুস লাগে। আমরা মুখে বড় বড় বুলি উচ্চারণ করি। কিন্তু বাস্তব জীবনে একেকজন অসততার প্রতিমূর্তি। যে যেভাবে পারছি, মেরে, কেটে, আত্মসাৎ করে কেবল ধনসম্পত্তি বাড়ানোর ধান্দা করছি। যে প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তি অত্যন্ত ডাটের সঙ্গে জীবন চালায়, আমরা তার অর্থের উৎস কখনও জিজ্ঞেস করি না। যে কর্মকর্তার স্ত্রী দামি শাড়ি-গয়না পরে, সন্তানদের বিলাসী জীবনে তামিল দেয়, সে নিজেও কখনো এই বিলাসের উৎস জিজ্ঞেস করে না। আমরা দামি বাড়ি-গাড়ি-ফ্ল্যাট-জমির মালিক হই। কিন্তু আয়ের উৎস প্রকাশ করি না। তার দরকারও হয় না! আমাদের ফুটানি চলে অবৈধ আয়ে। কিন্তু এসবের কোনো জবাবদিহি নেই। আমাদের দেশে দামি রেস্তোঁরায় কারা যায়? কারা দামি গাড়ি ব্যবহার করে? কারা দামি হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়, কাদের সন্তানরা দামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করে? কারা কারণে-অকারণে বিদেশ সফর করে? কারা নামে-বেনামে ফ্ল্যাট-বাড়ির মালিক হয়? কারা বিদেশে টাকা পাচার করে? বিদেশে জমির মালিক হয়? তাদের আয়ের উৎস কী? টাকা কোত্থেকে আসে? কে কত টাকা ট্যাক্স দেয়? এসব ব্যাপারে আমরা ভীষণ উদার। আমাদের সরকার বাহাদুর আরও উদার। যারা নানা ফিকিরে অবৈধ টাকায় 'করে-কম্মে' খাচ্ছেন, সরকার তাদের টুঁটি টিপে ধরা তো দূরের কথা পারলে ন্যাপকিন টিসু এগিয়ে দেয়! মাঝে-মধ্যে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কিছু মুখস্ত বুলি আওড়ান বটে, কিন্তু তা যেন বলার জন্যই বলা। এই বুলিতেই তাদের দায়িত্ব শেষ। তারপর তারা নিজেরাই ভেড়ার পালে গা ভাসিয়ে দেন। আমাদের একটা দুর্নীতি দমন কমিশন আছে। এই কমিশনের কর্তাব্যক্তিরা বক্তৃতা দেওয়া ছাড়া আর কী করে আল্লাহ মালুম।
আমাদের সম্মিলিত লোভাগ্নির কাছে নীতি-নৈতিকতা-আদর্শ সব আজ জ্বলে-পুড়ে ছাই। পাওয়া আর পাইয়ে দেওয়ার নেশা, অবৈধ উপায়ে টুপাইস কামানো, আবার অবৈধ টাকার জোরে সেই দুর্নীতির ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়া, এই চক্রে আমাদের জাতীয় জীবন বাঁধা পড়ে গেছে। কোথাও কোনো রক্ষাকবচ নেই। যাদের ন্যায় প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব তারা নিজেরাই অন্যায়ের সমুদ্রে নিমজ্জিত।
আপতত 'নীতিদর্শন' চর্চা ছাড়া পরিত্রাণের কোনো পথ আছে বলে মনে হয় না। আমাদের ভাবতে শিখতে হবে। শেখাতেও হবে। ভাবনাটি জীবন নিয়ে, বেঁচে থাকার মানে নিয়ে। এই জীবন নিয়ে আমরা কী করব– এই মৌলিক প্রশ্নটি করতে শিখতে হবে। জীবনে কত টাকা চাই, কত উপার্জন চাই? অসৎ উপায়ে হোক আর সৎ উপায়ে হোক যে টাকা কাজে লাগানো যায় না সে টাকা মাটির ঢেলা ছাড়া আর কী? বস্তা বস্তা টাকা দিয়ে আমরা কী করব? বালি দ্বীপে গিয়ে ফুর্তি করব? জেট বিমানে দেশবিদেশে ঘুরে বেড়াব? দামি অট্টালিকা বানাব? তারপর? গরিব মানুষের কাছে প্রশ্নটির খানিক সদুত্তর রয়েছে। তারা বলতে পারেন ভালো-মন্দ খাব, দামি পোশাক পরব, গাড়ি চড়ব, বাড়ি বানাব। কিন্তু চাহিদা মিটে যাবার পর যদি আরও আরও দেওয়া হয় তখন? তৃষ্ণার্ত ব্যক্তি প্রথম যে পাত্র থেকে জল পান করেন সেই পাত্রটি তৃষ্ণার্তের উদগ্র পিপাসার স্পর্শ পায়। তৃষ্ণার্তও প্রথমবারের জল পানে অপূর্ব তৃপ্তি পান। পরে সেই প্রথমবারের মতো তৃপ্তি কিন্তু আর হয় না। ক্রমাগত জলপানে বাধ্য হলে তা শেষ পর্যন্ত যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ক্রমহ্রাসমান উপযোগিতার তত্ত্ব অর্থনীতির শাস্ত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং মৌলিক ভূমিকা পালন করে। অর্থের ক্ষেত্রেও কি তাই ঘটে? আরও আরও পেতে পেতে তখন এই প্রশ্নটি যন্ত্রণা দেয়- টাকা নিয়ে কী করব? এর সদুত্তর না থাকলে কিন্তু বিপদ। রূপকথার সেই রাজার কথা মনে পড়বে। তার স্পর্শে সকলই সোনা হয়ে যায়। এত সোনা নিয়ে তিনি কী করবেন? সোনা তো আর চিবিয়ে খাওয়া যায় না!