Published : 26 Mar 2021, 02:00 PM
করোনা আবহের মধ্যে অত্যন্ত ঢাক–ঢোল পিটিয়ে পুরো রাজধানীকে বিভিন্ন রঙের আলোয় সাজিয়ে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকারের প্রধানদের নিমন্ত্রণ দিয়ে এনে যখন রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করা হচ্ছে, তখন ছোট্ট একটি খবরে মনটা বিষণ্ন হয়ে উঠছে।
হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামির বদলে প্রায় তিন বছর ধরে কারাভোগ করছেন অন্য এক নারী। তিন সন্তানের ভরণ–পোষণের আশ্বাস পেয়ে বিধবা ওই নারী ২০১৮ সালের জুন থেকে কারাভোগ করছেন। মিনু আক্তার নামে ওই নারী জানিয়েছেন, সন্তানদের খাওয়া–দাওয়া এবং আর্থিক কিছু সহায়তা দেবে বলে মর্জিনা আক্তার নামে এক নারীর কাছ থেকে বদলি জেল খাটার প্রস্তাবে তিনি রাজি হন। অথচ আশ্বাসমতে কোনো টাকা বা সন্তানদের জন্য খাবার কিছুই মিনু আক্তার পায়নি।
সন্তানের ভরণ–পোষণের মিথ্যে আশ্বাসে যে নারী কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠকে বেছে নেন, সে দেশে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর যাবতীয় আয়োজন কেমন প্রহসন বলে মনে হয়!
ওদিকে সুনামগঞ্জের শাল্লায় একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী ব্যক্তি হেফাজতে ইসলামের নেতা মাওলানা মামুনুল হককে নিয়ে ফেইসবুকে আপত্তিকর পোস্ট দিয়েছেন—এমন অভিযোগ তুলে গেল সপ্তাহে মাইকে ঘোষণা দিয়ে চার গ্রামের কয়েক হাজার অধিবাসী মিলে হিন্দু অধ্যুষিত নোয়াগাঁও গ্রামে হামলা চালিয়েছে। এ সময় ওই গ্রামের হিন্দু জনগোষ্ঠীর বাড়িঘর ও মন্দির ভাঙচুর–ব্যাপক লুটপাট করা হয়। সে সময় প্রাণ বাঁচাতে অনেক নারীপুরুষ গ্রাম ছেড়ে চলে যান। বিনা অপরাধে তাদের সব কিছু খোয়াতে হয়। প্রাণ বাঁচাতে নিরুদ্দেশ হতে হয় !
এমন সব নেতিবাচক খবরের ভিড়ে বসে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনে মন তেমন সাড়া দেয় না। তারপরও সাড়ম্বরে রেডিও–টিভিতে বিভিন্ন মঞ্চে–অনুষ্ঠানে স্বাধীনতার জয়গান গাওয়া হচ্ছে। 'ও আমার দেশের মাটি', জয় বাংলা বাংলার জয়' গানে গলা মেলাচ্ছেন দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা, ঘুষখোর অফিসার, ওষুধে–খাবারে ভেজাল মেশানো ব্যবসায়ী, সাম্প্রদায়িক ভাবধারাপুষ্ট ধর্মবাদী রাজনৈতিক কর্মী। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতেও সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প হৃদয়ে ধারণ করে একটি বিশেষ শ্রেণি 'ধর্ম'কেই মানুষের একমাত্র 'পরিচয়' হিসেবে ঊর্ধ্বে তুলে ধরছেন। আষ্ফালন করছেন। এমন মন–মানসিকতা নিয়ে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনের তাৎপর্য কোথায়?
চারদিকে এত যে ধর্ম পালনের সমারোহ, তবু সমাজে দুর্নীতি কমে না। মুখে ধর্ম, অন্তরে যে কোনো উপায়ে টাকা বানানোর ধান্দা দেশের কোটি কোটি মানুষকে এখনও স্বাধীনতার স্বাদ থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে। দেশের লক্ষকোটি নিরন্ন বুভুক্ষ মানুষ খালি পেট, খালি গা, রুক্ষ চুল, কোটরে বসা চোখ, আর মাথায় দুনিয়ার দুশ্চিন্তা নিয়ে ঘুমোতে যায়। প্রতিদিন গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয় অকুল অন্ধকার। অনুন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের পথে প্রিয় স্বদেশের অগ্রযাত্রা তাদের চেতনা ও জীবনাচরণে তেমন কোনো প্রভাব সৃষ্টি করে না।
মাঝে মাঝে খুব আশাবাদী হয়ে উঠি। নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও দেশ আর্থিক সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলেছে বলে খুব ভালো লাগে। আবার বিপন্ন বোধ করি দেশের জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর অসহায়তা দেখে! তাদের অনেক কিছুই নেই, সবচেয়ে বড় 'নেই' হচ্ছে নাগরিক অধিকার! নিরাপত্তা। সম্মান ও মর্যাদা নিয়ে বাঁচার অধিকার। শাল্লার ঝুমন দাস, রামুর উত্তম, নাসিরনগরের রসরাজ, নারায়ণগঞ্জের শ্যামলকান্তি কিংবা গঙ্গাচরার টিটু রায়ের মত যে কেউ যে কোনো সময় নিশানা হতে পারেন। কোনো একটা হুজুগ তুলে যে কোনও সময় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর যে কারও প্রতি হিংস্রতা নেমে আসতে পারে। মামলা হতে পারে। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হতে পারে। এমন এক ভীতিকর পরিবেশে বাস করে কেন জানি তেমন দেশ দেশপ্রেমিক হওয়া যায় না! সংখ্যালঘু মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে কেবলই মনে হয়, আমার দেশ আছে অধিকার নেই। আমার দেশের সংবিধান অলিখিতভাবে আমাকে 'দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক' বানিয়ে রেখেছে। সব সময় আমাকে হুমকি–উদ্বেগ–উৎকণ্ঠার মধ্যে থাকতে হয়। আমার নিরাপত্তা নেই। মুষ্টিমেয় মানুষের আহ্লাদী স্বাধীনতা আমার জীবন থেকে সাম্প্রদায়িকতার খড়্গ চালিয়ে কেড়ে নিয়েছে দেশপ্রেমিক হওয়ার সেই নির্ভীক অহঙ্কার। এই দেশে এখন আমার অলিখিত পরিচয়— সংখ্যালঘু, 'বিধর্মী' (বধযোগ্য প্রাণী)! যাকে যে কোনও নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করায় কোনও বাধা নেই। ইচ্ছে করলেই হামলা চালানো যায়। অপমান করা যায়। গাল দেওয়া যায়। তখন মনে হয় আমরা সত্যিই কি স্বাধীন?
যারা রাষ্ট্রের কাছে নিশ্চিত নিরাপত্তা পায় না, সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকবার বল–ভরসা পায় না, উচ্চারণ করতে পারে না 'কৃতজ্ঞ' শব্দটা, যে সব অধিকার–বঞ্চিত, সন্ত্রস্ত মানুষ কেবলই ভয়ের প্রহর গোনে, তারা কী করে গাইবে, 'জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো?' কী করে বলবে- 'স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে কে বাঁচিতে চায়?'
মাঝে মাঝে নিজেও বুঝতে পারি না ঠিক কাকে বলে স্বাধীনতা? কীসের মুক্তি সে নিয়ে আসে? স্বাধীনতা কার? ব্যক্তির? পুঁজির? গোষ্ঠীর? সমাজের? আমাদের সংবিধানে লেখা আছে ব্যক্তির ধর্মীয় মতপ্রকাশের কথা, বাক স্বাধীনতার কথা। কিন্তু যদি আমরা পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর চোখে দেশকে দেখার, তাদের উপর নির্যাতনকারী গোষ্ঠীর পরিচয় প্রকাশ করতে চাই, তাহলে তার অনুমতি মিলবে? তার মানে রাষ্ট্রের, সরকারের চোখ দিয়ে আমাকে, আমাদেরকে দেখতে হবে, সে মতো কথা বলতে হবে। রাষ্ট্রই ঠিক করে দেবে আমার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কতটা।
বান্দরবানের গভীর জঙ্গলে বর্ষায় খাবার না পেয়ে কোলের শিশুর কান্না থামাতে মা অজান্তে মাটি খুঁড়ে তার মুখে যখন বিষাক্ত আলু দেন, তার কোলেই যখন সন্তান নেতিয়ে পড়ে, সেই খবর শহরে এসে পৌঁছায় না। আমার মনে হয় না সেই মায়ের কাছে স্বাধীনতা কোনও আলাদা তাৎপর্য নিয়ে আসে। যখন রাষ্ট্রের পুলিশ বাহিনী গাইবান্ধার সাঁওতাল পল্লীতে আগুন দেয়, তখন সেই ঘরবাড়ি হারানো সাঁওতাল নারী–পুরুষের কাছে কীসের স্বাধীনতা?
কিংবা মহেশখালীর কৈবর্ত পরিবারের জেলে বর্ষায় বঙ্গোপসাগরে যখন উথালপাতাল ঢেউয়ে তার নৌকাটি নিয়ে প্রাণপণে ডাঙা খুঁজতে ব্যস্ত, তার কাছেও স্বাধীনতার কোনও আলাদা মানে নেই। তাহলে এ স্বাধীনতা কিসের স্বাধীনতা? কার স্বাধীনতা?
ছোটবেলায় বুড়োমানুষরা বলতেন, 'ইংরেজ আমলই ভালো ছিল'। তাদের সঙ্গে কত তর্ক করেছি, বলেছি, সুশাসনের চাইতে স্বশাসন দামি। কিন্তু আজ যখন দেখি লাল–সবুজ পতাকার চেতনা ফিকে হয়ে কেবল একটি বিশেষ শ্রেণির, বিশেষ ধর্মের লোকেদের স্বার্থ রক্ষায় ক্রমেই বাউন্ডারি নির্মাণ করে, তখন বুঝি, দেশের গতি আমাদের স্বাধীনতার যে গতিমুখ ছিল, তার সঙ্গে ঠিক মানানসই নেই।
স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশতাব্দী পরেও আমাদের 'পলিটিক্যাল সোসাইটি' ধর্ম–বর্ণ–শ্রেণি নির্বিশেষে সব মানুষের বেঁচে থাকার, সবার স্বার্থ ও অধিকার রক্ষার চাহিদাটুকুও পূরণ করতে পারল না। একদল অধিকতর গুরুত্ব ও মর্যাদা পেয়ে দাপট দেখাচ্ছে, শাঁসানি দিচ্ছে, আরেকদল কাচু–মাচু হয়ে কোনো মতে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। দারিদ্র্য আর অধিকারহীনতার মাপকাঠিতেই তারা বাঁধা থাকছে, আর 'প্রিভিলেজ্ড' শ্রেণিটি ধনী হতে হতে ১৮ তলা, বিশ তলা অট্টালিকা বানাচ্ছে! নানা কায়দায় বিদেশে টাকা পাচার করে সম্পদের মালিক হচ্ছে। স্বাধীনতা যেন তাদেরই জন্য !
প্রায়ই প্রশ্ন জাগে, আসলে আমরা কোথায় চলেছি? 'সত্যিই, কোথায় চলেছি', এই প্রশ্নের উত্তর এখন কারও কাছেই পাওয়া যায় না। কারণ উত্তরটি সহজ নয়। এক কথায় বলা যায় না। কিন্তু মনে হয় বেশ কিছু 'শিক্ষিত' ও বিত্তশালী ক্ষমতাবান মানুষের হাতে দেশের সবকিছু চলে গেছে। তারা ও তাদের সমর্থনপুষ্ট রাজনৈতিক দল ও নেতারা ঠিক করছেন, দেশে কারা কতটুকু অধিকার ও সুযোগ নিয়ে টিকে থাকবেন। চেষ্টা করা হচ্ছে দেশে আগ্রাসী, সংখ্যালঘু–বিরোধী একটি নতুন ও উগ্র 'মুসলিম জাতীয়তাবাদ' তৈরি করতে। কথায় কথায় ধর্মবিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে। এ ছাড়া সোশ্যাল মিডিয়ায় গালিগালাজ ও অপছন্দের ব্যক্তিদের চরিত্রহননের মচ্ছব তো আছেই। রাজনৈতিক হিসেবটাও পরিষ্কার। মেরুকরণের রাজনীতির ফলে যদি সমস্ত মুসলিম ভোটকে একাট্টা করা যায়, তা হলে সংখ্যালঘু মানুষ কোণঠাসা বোধ করলেও তাদের বিরোধিতা করার কোনও ক্ষমতা থাকবে না। সেই সুযোগে তাদের সহায়–সম্পত্তি গ্রাস করে নেওয়া যাবে, ধর্মপরিচয়ের ভিত্তিতে বাংলাদেশ আবার একটি 'পাকিস্তান' হয়ে পুনর্জন্ম নেবে!
কিছু মানুষের এমন খায়েশ এবং এই খায়েশ পূরণের পথে নীরব কিন্তু ব্যাপক অভিযাত্রা দেখে সত্যিই খুব আফসোস হয়! কবির ভাষায় কেবলই বলতে ইচ্ছে করে: 'বেড়া ভেঙে বুনো মোষ খেয়েছে ফসল/স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধ সবই কী বিফল?'