Published : 09 Sep 2020, 03:47 PM
নানা বৈচিত্র্যে ভরা আমাদের এই বাংলাদেশ। প্রকৃতি অকৃত্রিম ভালবাসায় এ দেশটি সাজিয়েছে। বাংলাদেশের অপার সৌন্দর্য পর্যটকদের হৃদয়স্পর্শ করে। বাংলার সংস্কৃতি, ঐতিহ্য আর নিসর্গ প্রকৃতি নিঃসন্দেহে আকৃষ্ট করে পর্যটকদের। পর্যটনের অযুত সম্ভাবনার এই দেশের আনাচে-কানাচে লুকিয়ে আছে কত ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি। প্রকৃতির অকৃত্রিম, অনাবিল, অফুরন্ত বহুমাত্রিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশ। এর প্রতি পরতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে পাহাড়, নদী ও হাওরের নির্মল উজ্জ্বলতা। নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, প্রবাল দ্বীপ, সমুদ্র সৈকত, হাওর-বাওড়, ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন, পুরাকীর্তিসহ আরো অনেক দর্শনীয় স্থান নিয়ে আমাদের এই দেশ। হাওর অঞ্চলের সাগরসদৃশ বিস্তীর্ণ জলরাশি এক অপরূপ মহিমায় মাথা উচুঁ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
দ্বীপের মতো করে গড়ে উঠা ঘরবাড়িগুলো বর্ষাকালে যেমন চোখজুড়ানো দৃশ্যপট তৈরি করে, তেমনি শীতের কুয়াশায় আচ্ছন্ন হাওরাঞ্চলে পাখ-পাখালিদের কলতান কিংবা শুষ্ক মৌসুমের পড়ন্ত বিকেলের মিষ্টি রোদের ছড়াছড়ি হাওরকে এক শিল্পীর হাতের সুনিপুণ চিত্রপটের রূপ দেয়। বর্ষায় হাওরের দখিনা বাতাস যখন পালতোলা নৌকাগুলোকে শন শন শব্দে উড়িয়ে নিয়ে চলে এবং সেই সাথে বিস্তীর্ণ জলরাশির ছন্দের তালে তালে ভেসে যাওয়া প্রকৃতিতে যোগ করে সরলতার নতুন মাত্রা। রাতের হাওর এলাকায় ডিঙি নৌকাগুলোর ভরপানিতে কুপিবাতি জ্বালিয়ে মাছ ধরার দৃশ্য কিংবা চাঁদের আলোয় আলোকিত চঞ্চল ঢেউগুলোর চিকমিক করা হৃদয়কাড়া সৌন্দর্য যেকারো স্মৃতিপটে দাগ কাটবে। আর এই মোহনীয় প্রকৃতির রূপ বৃদ্ধি পায় শ্রাবণের দমকা বাতাসের সাথে গর্জে উঠা জলরাশির মেলবন্ধনে।
ঢাকা থেকে কিশোরগঞ্জের দূরত্ব মাত্র ৯০ কিলোমিটার। এই জেলা হাওর-বাওরের জেলা নামে অধিক পরিচিত। এইখানে হাওরকে ঘিরে তৈরি হয়েছে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা। পানিতে দ্বীপের মত ভেসে থাকা ছোট ছোট গ্রাম, স্বচ্ছ জলের খেলা, মাছ ধরতে জেলেদের ব্যস্ততা, ছোট ছোট জলাবন এমন সব অভিজ্ঞতার খোরাক পেতে চাইলে কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার নিকলী হাওরে নৌকায় ঘুরে বেড়ানোর বিকল্প নেই।
বর্ষা মৌসুমে কিশোরগঞ্জের হাওর বৈচিত্র্যপিয়াসী ও ভ্রমণপিপাসুদের জন্য এক চমৎকার ও দৃষ্টিনন্দন স্পটে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন হাজারো দর্শনার্থীর উপস্থিতিতে হাওরের নবনির্মিত স্পটগুলো মুখরিত হয়ে উঠছে নতুন প্রাণচাঞ্চল্যে। বিশেষ করে করিমগঞ্জ উপজেলার বালিখলা, চামড়াঘাট, নিকলী উপজেলার ছাতিরচর করসবন ও বেড়িবাঁধ, মিঠামইন উপজেলার দিল্লির আখড়া, আখড়া সংলগ্ন হিজল বন, হাসানপুর ব্রিজ, তাড়াইল উপজেলার হিজলজানি, ইটনা উপজেলার ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী ব্যারিস্টার ভুপেশ গুপ্ত, বাংলার প্রথম রানলার আনন্দমোহন বসুর বাড়ি এবং অষ্টগ্রাম উপজেলার সুলতানি আমলে নির্মিত ঐতিহাসিক কুতুব মসজিদ ইত্যাদি স্পট ইতিহাস-অনুসন্ধানী প্রতিটি পর্যটককে মোহিত ও আলোড়িত করে।
মিঠামইন-ইটনা-অষ্টগ্রাম উপজেলার সংযোগকারী অবিশ্বাস্য অল-ওয়েদার সড়কটি হাওর পর্যটনের বিস্ময়। এর প্রভাবে গোটা হাওরের দৃশ্যপটে এসেছে আমূল ও বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এই সড়ক পুরো হাওর অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রেই শুধু পরিবর্তন আনেনি, গোটা হাওরের অর্থনৈতিক বুনিয়াদকেও অনেক বেশি শক্তিশালী করেছে। হাওরবাসীর জীবনমানে এসেছে পরিবর্তনের নতুন ছোঁয়া। ভরা বর্ষা মৌসুমে উত্তাল হাওরের বুক চিরে প্রবহমান এই অল-ওয়েদার সড়কটি এক অদ্ভুত ও মায়াবি দৃশ্যের অবতারণা করে। পর্যটকরা এই অসাধারণ সৌন্দর্য উপভোগের জন্য দেশের দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসেন নিকলীর বেড়িবাঁধ ও মিঠামইনের অল-ওয়েদার সড়কে। ইটনা থেকে মিঠামইন হয়ে অষ্টগ্রাম উপজেলা পর্যন্ত হাওরের বুক চিরে নির্মিত ৩৫ কিলোমিটার অল-ওয়েদার সড়ক হয়ে উঠেছে পর্যটকদের দুর্নিবার আকর্ষণ। প্রতিদিন হাজারো পর্যটকের পদচারণায় এখন মুখরিত হাওরের এক সময়ের অবহেলিত আর প্রত্যন্ত এই জনপদ। পর্যটকদের ব্যাপক আগমনের ফলে এই অঞ্চলের দরিদ্র বেকার তরুণ-যুবকদের কর্মসংস্থানের নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। অনেক তরুণ মোটরবাইক, ইজিবাইকসহ বিভিন্ন যানবাহন চালিয়ে যাত্রী পরিবহনের মাধ্যমে প্রতিদিন প্রচুর অর্থ উপার্জন করছেন। এক শ্রেণির পেশাদার মাঝি নৌকা, ট্রলার ও স্পিডবোটের মাধ্যমে পর্যটকদের গভীর হাওরে পরিভ্রমণ করিয়ে অর্থ উপার্জনের সুযোগ পাচ্ছেন। এ ছাড়া যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হয়ে যাওয়ায় পণ্য পরিবহনের ব্যয় আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে। ফলে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সহজলভ্যতা সৃষ্টি হয়েছে এবং মূল্যও ক্রয়সীমার মধ্যে চলে এসেছে। হাওরের বালিখলা, চামড়াঘাট, মিঠামইন সদর, নিকলী বেড়িবাঁধ ও ইটনা-অষ্টগ্রাম সদরে দুই শতাধিক অস্থায়ী হোটেল, রেস্তোরা, খাবারের দোকান স্থাপিত হওয়ায় কয়েকশ' পরিবারের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা হয়েছে। সার্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় হাওরের এসব অবকাঠামো দেশের সার্বিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। বেকার তরুণ-যুবকরা কর্মমুখি হয়ে ওঠায় স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও আগের তুলনায় স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। জানা গেছে, বাংলাদেশের কোথাও হাওরের মাঝখানে এত দীর্ঘতম দ্বিতীয় সড়ক আর নেই। নয়নাভিরাম সৌন্দর্য, বিনোদন আর প্রশান্তির এক অনন্য ঠিকানা হয়ে উঠেছে হাওরের এই অল-ওয়েদার সড়কসহ অন্যান্য অবকাঠামো।
বাংলাদেশের জেলাসমূহের মধ্যে সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিলেট, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া এই সাতটি জেলার ৭ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর জলাভূমিতে ৪২৩টি হাওর নিয়ে হাওরাঞ্চল গঠিত। এর মধ্যে সুনামগঞ্জ জেলায় সর্বোচ্চ ১৩৩টি, কিশোরগঞ্জ জেলায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১২২টি, নেত্রকোনায় ৮০টি, সিলেটে ৪৩টি, হবিগঞ্জে ৩৮টি, মৌলভীবাজারে ৪টি এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৩টি হাওর রয়েছে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি জেলার ৪৮টি উপজেলা নিয়ে গঠিত বিস্তীর্ণ এই হাওরাঞ্চলের আয়তন প্রায় ২৪ হাজার বর্গকিলোমিটার। এই বিশাল অঞ্চলে পর্যটনের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে যার সুবিধা আমরা এখনো উপভোগ করতে পারিনি।
মূলত আমাদের দেশে হাওর পর্যটনের ব্যাপক সম্ভাবনা থাকলেও এর শুরু কিন্তু খুব বেশিদিনের নয়। দেশীয় কিছু তরুণ পর্যটক নিজ উদ্যোগ হাওরের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য নৌকা নিয়ে হাওরের বুকে ভেসে বেড়াত। তারপর আস্তে আস্তে ব্যাপকতা লাভ করতে শুরু করে। কিন্তু এখন পর্যন্ত হাওর অঞ্চলে পর্যটকদের জন্য তেমন কোন অবকাঠামোগত সুযোগ সুবিধা গড়ে উঠেনি। এর ফলে পর্যটকদের থাকা, খাওয়া, নিরাপত্তাসহ অন্যান্য আরো অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। বর্তমানে দুয়েকটি বেসরকারি ট্যুর অপারেটর সিলেট অঞ্চলে হাওরভিত্তিক ট্যুর প্যাকেজ চালু করেছে।
হাওরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পর্যটকরা নৌকায় বসে বিস্তীর্ণ নীল জলরাশির মায়ায় যেমনি ডুব দিতে পারেন, তেমনি রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা পেতে সাঁতার কাটতে পারেন নির্দিষ্ট স্থানগুলোতে। সংস্কৃতিপ্রেমীদের কাছে রাতের চাঁদের আলোর নিচে নৌকায় বসে স্বাদ নিতে পারেন বাউল ও মরমী কবি সাধকদের গানগুলোর সুর তুলে কিংবা হাওরের শীতল হাওয়া ও পূর্ণিমার আলোয় রাত্রী যাপন করে। বর্ষাকালে হাওরের কোলঘেঁষে থাকা সীমান্ত নদী, পাহাড়, পাহাড়ী ঝর্ণা, হাওর-বাওড়ের হিজল, করচ, নলখাগরা বনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, নানান প্রজাতির বনজ, জলজ প্রাণী আর হাওর পাড়ের বসবাসকারী মানুষের জীবন-জীবিকার নৈসর্গিক সৌর্ন্দযে মুগ্ধ হওয়ার মত খোরাক মিলবে পর্যটক ও দর্শনার্থীদের। আর হাজার হাজার দেশী-বিদেশী পাখির মিলন মেলা ও সবুজের সমারোহ শীতের মৌসুমে গড়ে ওঠা চোখ জুড়ানো সৌন্দর্যে মন প্রাণ ছুঁয়ে যাবে পর্যটকদের।
বাংলাদেশের বৃহত্তম মিঠাপানির জলাভূমি হিসেবে পরিচিত সিলেট ও মৌলভীবাজারের ৫টি উপজেলা নিয়ে বিস্তৃত হাকালুকি হাওর প্রায় ২৩৮টি বিল ও ১০টি নদীর সমন্বয়ে গঠিত। হাকালুকি হাওরে শীতকালে অতিথি পাখিদের আগমন ও স্থানীয় প্রায় ১০০ প্রজাতির পাখির কলতান মুখরিত পরিবেশ ভ্রমণপিয়াসুদের আহ্বানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ২০০০ সালে রামসার সাইটের তালিকায় স্থান করে নেয়া সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে ছোট বড় প্রায় ৩০টি ঝর্ণা ভারতের মেঘালয় থেকে এসে মিশেছে। সেই সাথে হাওড়জুড়ে ৪৬টির মতো দ্বীপসদৃশ ছোট ছোট গ্রাম এক অপরূপ লীলাক্ষেত্র সৃষ্টি করেছে। ১২০টি বিল ও ১৮০টি নিম্নাঞ্চল মিলে তৈরি হওয়ায় স্থানীয়ভাবে পরিচিত "নয়কুড়ি কাঁদার ছয়কুড়ি বিল" বলে খ্যাত টাঙ্গুয়ার হাওরের স্বচ্ছ পানির সাথে ১৪০ প্রজাতির মাছ, ১২ প্রজাতির ব্যাঙ, ১৫০ প্রজাতির বেশি সরীসৃপ এবং শীতকালে প্রায় ২৫০ প্রজাতির অতিথি পাখির বিচরণ এক অকল্পনীয় জীববৈচিত্র্য গড়ে তুলেছে।
পরিশেষে হাওর এলাকায় পর্যটন বিকাশ ঘটাতে সবচেয়ে বেশি যেটি প্রয়োজন, তা হলো জনমনে সচেতনতা সৃষ্টি করে পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনাকে তুলে ধরা। পর্যটকদের স্বাভাবিক যোগাযোগ সুবিধা দিতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করে তা বাস্তবায়নে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। হাওরের পর্যটনকে তুলে ধরতে বিভিন্ন অনলাইনভিত্তিক মাধ্যমসমূহের ব্যবহার, পর্যটন সেবা প্রদানকারী সংশ্লিষ্টদের সাথে নিয়মিতভাবে আলোচনা, হাওর জেলাগুলিতে স্যানিটেশনের সকল সুবিধা নিশ্চিত করা ও সেই সাথে পর্যটন টাওয়ার স্থাপন করে পর্যটকদের সেবার ব্যবস্থা করা, নিয়মিত বিরতিতে হাওর এলাকায় সচেতনতা বাড়াতে বার্ষিক উৎসবের আয়োজন করা ও সর্বোপরি হাওর অঞ্চলে পর্যটন সমস্যা এবং সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা ও পাঠ পরিক্রমা চালু করা এখন সময়ের দাবি।
পর্যটনসমৃদ্ধ স্থানগুলো নিয়ে বাস্তবমুখী, দীর্ঘমেয়াদী সুচিন্তিত পরিকল্পনার মাধ্যমে হাওর বেষ্টিত জেলাসমূহকে আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্রে রুপান্তরিত করে পর্যটন শিল্প বিকাশে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। পাশাপাশি হাওরবাসীর জন্য বিকল্প আয় সৃষ্টি, হাওরের পরিবেশ উন্নয়ন ও জীববৈচিত্র সংরক্ষণে অনন্য ভূমিকা রাখতে হাওরের পর্যটন বিস্তার একান্ত প্রয়োজন। এতে নৈসর্গিক সৌন্দর্যের ধারক ও বাহক বাংলাদেশ হাওর পর্যটনে বিশ্বের বুকে পর্যটন শিল্পে নতুন মাত্রা দিতে পারে।