Published : 03 Sep 2020, 05:51 PM
নিউজিল্যান্ডের হাইকোর্ট গত ২৭ অগাস্ট ব্রেন্টন টারান্টকে প্যারোলবিহীন যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করেছে। নিউজিল্যান্ডের দণ্ড আইনে এটিই সর্বোচ্চ শাস্তি এবং নিউজিল্যান্ডের সাম্প্রতিক ইতিহাসে টারান্টই সেই ব্যক্তি যাকে এই সর্বোচ্চ দণ্ডে দণ্ডিত করা হল। উল্লেখ্য যে, নিউজিল্যান্ডের আইনে মৃত্যুদণ্ড নেই।
২০১৯ সালের ১৫ মার্চ ২৯ বছর বয়স্ক অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক ব্রেন্টন টারান্ট নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের দু'টি মসজিদে ঢুকে এলাপাতাড়ি গুলি চালিয়ে ৫১ জনকে হত্যা করেন, হামলায় গুলিবিদ্ধ ও আহত হন কয়েকজন। ঘটনার সময় বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সদস্যরা খুব কাছেই ছিলেন। অল্পের জন্য তারা প্রাণে বেঁচে যান। ঘটনার পরপরই নিউজিল্যান্ড পুলিশের দুই অকুতোভয় সদস্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ব্রেন্টন টারান্টকে গ্রেপ্তার করেন।
গত বছরের জুন মাসে প্রথম শুনানি অনুষ্ঠিত হয়, এবং ওই ভার্চুয়াল শুনানিতে টারান্ট তার আইনজীবীর মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে আনীত ৯২টি অভিযোগ অস্বীকার করেন। তবে গত ২৬ মার্চ অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় শুনানিতে টারান্ট সবগুলো অভিযোগ স্বীকার করে নিলে দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়ার ধকল থেকে আদালতের রেহাই মেলে এবং বিচারপ্রার্থীরা হাফ ছেড়ে বাঁচেন। এরপর গত ২৪ অগাস্ট থেকে ২৭ অগাস্ট পর্যন্ত 'সেনটেন্সিং-হিয়ারিং' বা দণ্ডের ওপর শুনানি অনুষ্ঠিত হওয়ার পর আদালত 'মাস কিলার' ব্রেন্টন টারান্টকে প্যারোলবিহীন যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে- ৫১ জনের হত্যা, ৪০ জনের হত্যাপ্রচেষ্টা ও একটি সন্ত্রাসী হামলা – এই ৯২টি অপরাধের শাস্তি কি শুধু (প্যারোলবিহীন) যাবজ্জীবন কারাদণ্ড? এতে কি ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে? এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার পর আমাদের আরেকটি ভয়ংকর প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে; আর সেই প্রশ্নটি হচ্ছে– ৫১ জনকে হত্যার পরেও টারান্টের মধ্যে কোনো অনুশোচনা নেই কেন?
প্রথম প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয় যে, অপরাধ, শাস্তি ও ফৌজদারি ন্যায়বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে বাংলাদেশের গড়পড়তা মানুষের যে ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গি; তাতে ন্যায়বিচারের প্রত্যাশা পূরণ হবে না বলেই প্রতীয়মান হয়। কেউ কেউ আবার আরেকটু এগিয়ে গিয়ে বলতে পারেন যে, টারান্টের মতো একজন 'মাস কিলার'কে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হলে সন্ত্রাসীরা তো আরও উৎসাহিত হবে! প্রশ্ন ও তর্কের এই জায়গাটি বুঝতে হলে ফৌজদারি ন্যায়বিচার ব্যবস্থার বিবর্তনের ইতিহাসটি জানা দরকার।
শত শত বছর ধরে মানব সমাজ অপরাধীদের শাস্তি দিয়েছে কয়েকটি মূল্য বা উদ্দেশ্য অর্জন করার জন্য; আর এই উদ্দেশ্যগুলো হচ্ছে – 'রেট্রিবিউশন' বা প্রতিশোধ; 'ডেটারেন্স' বা নিবৃত্তি; এবং 'প্রিভেনশন' বা প্রতিরোধ। রাজ্য ও সাম্রাজ্যের শাসকেরা এবং সমাজের নীতিনির্ধারকেরা অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার মধ্য দিয়ে অপরাধের প্রতিশোধ, নিবৃত্তি, প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছেন। কিন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলো ফৌজদারি ন্যায়বিচার ব্যবস্থা ও দণ্ডকে অধিকতর 'মানবিক, নমনীয়, ও সভ্য' করার জন্য নানা পদক্ষেপ নিতে শুরু করে। ফলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে মৃত্যুদণ্ডকে বিলুপ্ত করা শুরু হয়। শাস্তির চেয়ে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে অপরাধীর সংশোধন ও পুনর্বাসন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৯ সালের ডিসেম্বর নাগাদ ১৪২টি দেশ মৃত্যুদণ্ড রহিত করে দেয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির পর ন্যুরেমবার্গ ও টোকিও ট্রাইব্যুনালে জার্মান ও জাপানের যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ১৯৯০ সালের পর থেকে জাতিসংঘ কর্তৃক গঠিত কোনো আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ বা মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্যও কাউকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেনি। ২০০২ সালের জুলাই মাসে প্রতিষ্ঠিত আইসিসি বা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সংবিধিতেও মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়নি। মূলত উন্নত গণতান্ত্রিক দেশসমূহ, জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো অপরাধীর দণ্ডের ব্যাপারে যে মানবিক ও সভ্য একটি মানদণ্ড স্থাপন করেছে; তারই প্রতিফলন হচ্ছে ১৪২টি দেশ কর্তৃক মৃত্যুদণ্ড বিলোপ করা এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সংবিধিতে গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের জন্যও মৃত্যুদণ্ডের বিধান না রাখা।
২০১১ সালের জুলাই মাসে অ্যান্ডারস বেহরিং ব্রেইভিক নরওয়েতে গুলি করে ও বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ৭৭ জন যুবক যুবতীকে নির্মমভাবে হত্যা করেন এবং প্রায় ৩শ' ব্যক্তিকে আহত করেন। ১০ সপ্তাহ ধরে চলা বিচারের পরে ব্রেইভিককে ২১ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়; এবং এটিই হচ্ছে নরওয়ের সর্বোচ্চ শাস্তি এবং বলাই বাহুল্য যে, নরওয়ের দণ্ড আইনে মৃত্যুদণ্ডের কোনো বিধান নেই। তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে, হত্যাকাণ্ডের শিকার ৭৭ জনের বাবা-মা ও ঘনিষ্ঠজনেরা এবং নরওয়ের সাধারণ নাগরিকেরা এতগুলো নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্য 'মাস কিলার' ব্রেইভিকের মৃত্যুদণ্ড দাবি করেননি। বরং তারা ব্রেইভিকের সুষ্ঠু বিচারে সন্তোষ প্রকাশ করেন এবং আদালত ব্রেইভিককে নরওয়ের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান করায় ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়েছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন।
আমাদের বুঝতে হবে যে, জীবনের অধিকারকে পুনঃস্থাপন করা যায় না। মানব মর্যাদার অবমাননা এবং মানবাধিকারের চরম লংঘন হওয়ার কারণে সভ্য ও আধুনিক মানুষ মৃত্যুদণ্ড পছন্দ করছে না। ফলে জাতীয়ভাবে অধিকাংশ দেশে এবং আন্তর্জাতিকভাবে মৃত্যুদণ্ডকে শাস্তির তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে সভ্য ও আধুনিক মানুষেরা অপরাধীর সংশোধন ও পুনবার্সনের ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। উন্নত ও গণতান্ত্রিক দেশের ফৌজদারি ন্যায়বিচার ব্যবস্থায় কোনো ব্যক্তি অপরাধ করলে কারাগারে না পাঠিয়ে তাকে তার পরিবারে বা সমাজে রেখে সংশোধনের সুযোগ দেওয়া হয়। আপরাধী যদি সংশোধিত না হয়ে আবার অপরাধ করে, তখন তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। আবার কোনো ব্যক্তি জেনেটিক অ্যাবনরমালিটি বা মানসিক ভারসাম্যহীনতার কারণে যদি আপরাধ করে, তাহলে তাকে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয় ডাক্তার বা মনোচিকিৎসকের কাছে; অথবা আদালত তাকে দণ্ড দেন শাস্তি ও চিকিৎসার সমন্বয়ে। আবার 'মাসকিলার' ও 'সিরিয়াল কিলারে'র কার্যকর বিচারের ক্ষেত্রেও তারা যথাযথ পদক্ষেপ নিয়ে থাকেন। যেটি নরওয়ে করেছে ব্রেইভিকের ক্ষেত্রে এবং নিউজিল্যান্ড করেছে টারান্টের ক্ষেত্রে।
আগেই উল্লেখ করেছি যে, পূর্বনির্ধারিত ২৪ অগাস্ট থেকে টারান্টকে কী দণ্ড দেওয়া হবে, সে বিষয়ক শুনানি শুরু হয়। শুনানির চতুর্থ দিনে বিচারক হত্যাকান্ডের ঘন্টাব্যাপী বর্ণনা দিতে থাকেন যে টারান্ট কিভাবে গুলি করে মসজিদে নামাজ পড়তে আসা মুসল্লীদের হত্যা করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে যে, দোষ স্বীকার করার পরেও নিষ্ঠুর ওই হত্যাকাণ্ডগুলোর ব্যাপারে টারান্টকে অনুতপ্ত বা লজ্জিত হতে দেখা যায়নি।
টারান্টের নির্বিকার থাকা ও অনুতপ্ত না হওয়া যুক্তিবোধসম্পন্ন ও সংবেদনশীল মানুষকে এক কঠিন সত্যের মুখোমুাখি দাঁড় করিয়ে দেয়। টারান্ট যার কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছেন, সেই ব্রেইভিকও সারা বিশ্বকে একই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিলেন। ব্রেইভিক প্রকাশ্য আদালতে বার বার বলেছেন যে, তিনি ঠান্ডা মাথায় জেনে বুঝে ৭৭ জনকে হত্যা করেছেন। সুযোগ থাকলে তিনি আরও হত্যা করতেন। ব্রেইভিক আস্থার সঙ্গে বলেছেন যে, মুসলিম ও কমিউনিস্ট অভিবাসীদের হাত থেকে নরওয়েকে রক্ষা করার জন্য একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক হিসেবে এতগুলো হত্যা তিনি করেছেন এবং সেজন্যে তিনি গর্বিত; আর অনুতপ্ত হওয়ার তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না। সাদা বর্ণবাদী টারান্টকেও আমরা দেখলাম ৫১ জন মুসল্লীকে হত্যা করে ফেসবুক লাইভে সেটি সরাসরি প্রচার করতে, এবং দণ্ড ঘোষণার পরেও তার মধ্যে কোনো অনুতাপ দেখা গেল না!
বর্ণবাদ, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও উগ্র জাতীয়তাবাদ মানুষকে অন্ধ করে দেয়, পরিণত করে যুক্তিবোধহীন হিংস্র দানবে। তারা মনে করেন যে, তিনি যে মতবাদ, ধর্ম বা জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করেন, তার জন্য শত শত, লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা করাও বৈধ, এমন কী সওয়াবের কাজ। এ ধরনের মাস কিলিং বা গণহত্যার জন্য তাদের কোনো অনুশোচনাও দেখা যায় না। এই সত্যের প্রতিফলনই আমরা দেখেছি নাজিদের মধ্যে, হলি আর্টিজানের জঙ্গীদের মধ্যে ও ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বাংলাদেশী সহযোগিদের মধ্যে। ব্রেইভিক এবং টারান্টও আবার সেই সত্যের পুনরাবৃত্তি করে বুঝিয়ে দিলেন যে, বর্ণবাদ, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও উগ্র জাতীয়তাবাদের বিপদ এবং এগুলো থেকে উদ্ভুত সন্ত্রাস, যুদ্ধ, মাস কিলিং ও গণহত্যার বিপদ থেকে মানুষের সভ্যতাকে নিরাপদ রাখাটা কঠিনতর এক চ্যালেঞ্জ।