Published : 28 May 2020, 01:57 PM
আজ ২৮ মে আমাদের শিল্পচার্য জয়নুল আবেদিনের মৃতুবার্ষিকী। ইংরেজি ২০২০ সালের মহামারীকালে জয়নুলের কথা বিশেষ করে বাংলা ১৩৫০ সালের মন্বন্তর নিয়ে দুর্ভিক্ষ সিরিজের (Darkening Days of Bengal) কাজগুলোর কথা আমার বার বার মনে দাগ কাটে। এই সিরিজের বারটি কাজ বঙ্গভূমি, ভারতবর্ষ ছাড়িয়ে পশ্চিমা দুনিয়াতেও সাড়া ফেলে দিয়েছিল।
সময়টা ১৯৩৯ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। সেই যুদ্ধের থাবা থেকে বাংলাদেশও রেহাই পেল না। তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের নিষ্ঠুর নীতির কারণে বাংলায় খাদ্যসঙ্কট দেখা দিল। তিনি বাংলার মানুষের মুখের গ্রাসের আকাল বানিয়ে ব্রিটিশ সৈন্যদের খাবারসহ অন্যান্য রসদ জোগালেন। যার ফলে বাংলা ১৩৫০ সালে বাংলায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। খাবারের খোঁজে দলে দলে ভূখা মানুষ কলকাতা শহরে হাঁটা দিল। পথের উপর মানুষ পড়ে থাকল। ডাস্টবিন থেকে মানুষ রুটির টুকরো তুলে খাচ্ছে। কলকাতা পড়ে থাকা মরা মানুষ কাক, শকুন ও কুকুরের আনাগোনার শহর হয়ে উঠল।
জয়নুল সে সময় বয়স তিরিশের তরুণ। এর মধ্যে তিনি ১৯৩৮ সালে পাঁচ বছরের চিত্রকলার পাঠ শেষ করে শিক্ষক হিসেবে কাজে যোগ দিয়েছেন। পাশাপাশি 'মাসিক মোহাম্মদী' পত্রিকায় কাজও করেন। থাকেন কলকাতার সার্কাস রোডে। বাসা থেকেই শুনতে পান ক্ষুধার্ত মানুষের হাহাকার। একবার বাসা থেকেই তিনি দেখতে পেলেন, একটা কঙ্কালের মতো মেয়ে রাস্তায় ফুটপাতে মরে পড়ে আছে আর তার বুকের কাছে একটা শিশু চিৎকার করে কাঁদছে।
তিনি ব্যথিত হলেন। ভেঙে পড়লেন না। বিদ্রোহী হয়ে উঠলেন। পণ করলেন মানুষের বিবেককে জাগিয়ে তুলতে হবে। তিনি কলকাতার পথে পথে ঘোরেন। মানুষের দুর্দশা দেখেন আর দুর্ভিক্ষ সিরিজের একের পর এক ছবি আঁকতে লাগলেন। এই ছবিগুলো কলকাতার কলেজ মার্কেটে প্রদর্শিত হল। তার খবর বের হল কাগজের পর কাগজে। প্রদর্শনীর খবর বিদেশেও চলে গেল। বাংলার মানুষের দুর্দশার কথা চাপা থাকল না। এরপর ১৯৫০ দশকের শুরুর দিকে ইউরোপের ইংল্যান্ড, বেলজিয়াম, ফ্রান্স এবং এশিয়ার তুরস্ক সফর করেন। এই সফরে তিনি ওইসব দেশের শিল্পীদের সঙ্গে পরিচিত হন। নিজের ছবির প্রদর্শনী করেন। তার ছবির বিশেষ করে দুর্ভিক্ষের উপর আঁকা ছবিগুলো দারুণভাবে সমাদৃত হয়।
এবার জয়নুলের ছাত্র এই সময়ের প্রিয় চিত্রশিল্পী রফিকুন নবীর কাছ থেকে শোনা জয়নুল সম্পর্কে একটি ঘটনা উল্লেখ করব। জয়নুল একবার তার ছাত্র রফিকুন নবীকে গরু দেখে গরুর ছবি এঁকে আনতে বললেন। রফিকুন নবী যথারীতি গরুর ছবি এঁকে নিয়ে আসেন। জয়নুলের গরুর ছবি মনপূত হতে হতে রফিকুন নবী বেকায়দায় পড়ে যান। একপর্যায়ে রফিকুন নবী শিক্ষক জয়নুলের কথা থেকে বুঝতে পারেন, তিনি যে হৃষ্টপুষ্ট নাদুসনুদুস গরুর ছবি আঁকেন, তা তো আমাদের দেশের কৃষকের গরুর বাস্তবচিত্র নয়। বাংলার কৃষকের যেমন হাড়ভাঙা শরীর, তাদের গরুর অবস্থাও তো তাই। এই সত্য বুঝে রফিকুন নবী যখন গরুর ছবি এঁকে জয়নুলকে দেখালেন, তখনই জয়নুলের সায় পেলেন, এইবার হয়েছে। জয়নুলের দেখার চোখটা ছিল এমনই। এক্কেবারে হৃদয়ে রক্ত ঝরিয়ে জীবনকে দেখা, বোঝা, তারপর ছবি আঁকা।
এইবার বাংলাদেশে প্রকাশনার রুচি, পত্রিকার ছবি বা কার্টুনের গোড়াপত্তনের পেছনে জয়নুলের অগ্রণী ভূমিকার কথাও বলতে চাই। এর শুরুটাও তিনি কলকাতাতেই করেছিলেন। আমরা অনেকেই চিত্রশিল্পী কাজী আবুল কাসেমের কথা জেনে থাকব। যিনি জয়নুলের বয়োজ্যেষ্ঠ্য ছিলেন। তিনিও এই বাংলার ছেলে, ঝিনাইদহে যার জন্ম। তিনি জয়নুলের আগেই কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। পারিবারিক কারণে চারুকলা শিক্ষায় ছেদ পড়ে। কিন্তু ছবি আঁকায় পরিচিতি লাভ করেছেন। কলকাতা শহরে নামডাক অর্জন করেছেন। জয়নুলের পরিচয় হয় তার সঙ্গে।
জয়নুল বাড়ি থেকে যা টাকা পেতেন তাতে নিজের থাকা খাওয়া খরচ বাদে ছবির জিনিসপত্র ও অন্যান্য প্রয়োজনে তার টাকার টান পড়ত। ওই সময়ে কলকাতা থেকে প্রকাশিত 'হানাফি' পত্রিকার পরিচালক ইস্কান্দার গজনবীর সঙ্গে আবুল কাসেম জয়নুলের পরিচয় করিয়ে দিলেন। পত্রিকায় তিনি কার্টুন ছবি আঁকা শুরু করলেন। এই শুরু। কার্টুনগুলো মানুষের মনোযোগ কেড়েছিল।
করোনাভাইরাসের ছোবলের পাশাপাশি আম্পানের আঘাতেও বাংলা আজ বিপদগ্রস্ত। ১৯৭০ সালের নভেম্বরে এরকম এক ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় এবং জলোচ্ছাস বাংলার উপর আঘাত হেনেছিল। শত শত গ্রাম প্লাবিত, হাজার হাজার বাড়ি নিশ্চিহ্ন, লক্ষ লক্ষ মানুষ গৃহহারা, মারা গেল হাজারে হাজারে। জয়নুল ঢাকায় বসে থাকলেন না। ছুটে গেলেন বৃহত্তর বরিশালের চর এলাকায়। স্বচক্ষে দেখলেন মানুষের জীবনের দুর্দশা। তার মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত 'চর মনপুরা' ছিল উল্লেখযোগ্য। এই সময়ের উল্লেখযোগ্য ছবি 'মনুপুরা-৭০'।
জয়নুল আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন প্রায় পাঁচ দশক হয়ে যাচ্ছে। এই সময়ে সঙ্কট, জলোচ্ছাস, দুর্দশা আর বিপর্যয়ে জয়নুলের কাজের প্রসঙ্গ বারবার ফিরে এসেছে। আজও তাই- এই আম্পান, এই করোনাভাইরাস এই মহামারীকালে জয়নুলের দেখানো পথে তার ছাত্ররা কতটা হাঁটলেন? সময় ও জীবনকে ধরে আঁকা সেরকম কাজগুলো আজকের শিল্পীদের তুলিতে কোথায়?
এবার জয়নুলের জীবনের আরো একটি ঘটনার অবতারণা করে লেখাটি শেষ করতে চাই। ১৯৭০ সালের মে-জুলাই মাসে জয়নুল আরব লীগের আমন্ত্রণে কয়েক মাসের জন্যে মিশর, সিরিয়া, জর্ডান, ফিলিস্তিন এবং লেবানন ভ্রমণ করেন। তার সফরের উদ্দেশ্য ছিল আক্রমণকারী ইসরাইলীদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাকামী যুদ্ধরত আরব-ফিলিস্তিনীদের উদ্বুদ্ধ করা। জয়নুল যুদ্ধের ওপর অনেক ছবি আঁকেন। আরব ফিলিস্তিনিরা জয়নুলের আঁকা ছবিগুলো দেখে অনুপ্রাণিত হন। তারা তাদের উদেশ্য সম্পর্কেও সচেতন হন।আ
আজ থেকে অর্ধশত বছর আগে ৫৬ বছর বয়সে আমাদের শিল্পাচার্য ছুটে গেলেন ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের আত্মরক্ষার লড়াই দেখতে। তিনি বাঙালি হিসেবে উপলব্ধি করেছিলেন, লড়াইয়ের মুখে থাকা জনগোষ্ঠী বাঙালির প্রতিনিধি হিসেবেও ফিলিস্তিনিদের ভূমিরক্ষার লড়াইয়ের হাতগুলো, মুখগুলো নিজের চোখে দেখা দরকার। এই সফরে তার আঁকা চিত্রকর্মের পুরোটা হদিস এখনো আমরা পাইনি। কিছু কাজের সন্ধান তার বাক্সপেটরা ঘেটে পাওয়া গেছে।
এই খবর আমরা পাই শিল্পচার্যের ছোটছেলে স্থপতি মইনুল আবেদিনের মাধ্যমে। তিনি তার বাবার প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের উদ্যোগে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় চিকিৎসকদের নিরাপত্তামূলক পোশাকাদি তৈরির প্রকল্পের পৃষ্ঠপোষক। এই প্রকল্পে আরো অর্থ জোগানোর উদ্দেশে মইনুল আবেদিন তার বাবার আঁকা মিশরের জীবন যাত্রার উপর নির্মিত একটি চিত্রকর্ম নিলামে উঠিয়েছেন। সাধুবাদ স্থপতি মইনুল আবেদিন, চারুকলা অনুষদের ডিন চিত্রশিল্পী নিসার হোসেন এবং তার সহকর্মীবৃন্দ।