Published : 26 Sep 2019, 03:25 PM
বাড়ির জামাইকে বাড়তি খাতির-যত্নের মধ্যেপক্ষপাত স্পষ্ট; পুরুষের প্রতি পক্ষপাত। এর বিপরীতে শ্বশুরবাড়িতে বউয়ের দশাও সবার জানাকথা। বাঙালি সমাজের পরম্পরা-ঐহিত্য সত্ত্বেও 'জামাই আদর' তাই প্রশ্নচিহ্ন মুক্ত নয়।স্বাভাবিকভাবেই এমন একপেশে আচরণ যখন রাষ্ট্র রপ্ত করে, তখন তা বৈষম্যমূলক ব্যবস্থাকায়েমের দিকে নিঃশব্দ যাত্রার নামান্তর।
ঋণখেলাপিদের এরই মধ্যে দুহাত ভরে যত সুযোগ-সুবিধাদেওয়া হয়েছে, তা বিশ্বসভায় এমনিতেই নজির স্থাপনের পক্ষে যথেষ্ট। এবার আরও একধাপ এগিয়েসরকার এতে 'সিলমোহর' মারতে উদ্যোগী। রীতিমতো ছক কষে ব্যাংক থেকে ৩ হাজার কোটি টাকাহাতিয়ে নেওয়া হল-মার্ক গ্রুপকে রাষ্ট্রের তরফে জামাই আদরের ইন্তেজাম জারি। অর্থমন্ত্রীআ হ ম মুস্তফা কামাল লুটেরা এই গোষ্ঠীর জন্য ব্যবসায়ের পথ খুলে দেওয়ায় সার্বিক সমাধানদেখছেন।
দেশের মুষ্টিমেয় লোকের হাতে মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে পড়ছে সম্পদ। বিশ্বের কুইকেস্ট গ্রোইং বা চোখের পলকে ধনকুবের তৈরির 'ভোজবাজি'র দেশে এমনটা হওয়াই দস্তুর। এই ভোজবাজির সহজলভ্য ও সুপ্রচলিত জ্বালানি দুর্নীতি। আর হরেক দুর্নীতির সেরা তিনটি হলো ব্যাংক লুণ্ঠন, পুঁজিবাজারে নয়-ছয় ও অর্থ পাচার। এই তিনে পারদর্শীদেরই আজ রমরমা; তারাই এযুগের 'রাজারাজড়া'— কী দেমাগে, কী দেখনদারিতে। উপরন্তু রাষ্ট্রের তরফে তাদের জন্য বরাদ্দ 'ফ্রি' জামাই আদর!
অর্থনীতিবিদরা বারংবার বলছেন, সরকারের 'স্বজনতোষীপুঁজিবাদ' নীতি আজকের এই ভয়াবহ বৈষম্যের পটভূমিতে এনে দাঁড় করিয়েছে দেশকে। এখনও এরলাগাম টেনে ধরা সম্ভব যদি সরকারের সদিচ্ছা থাকে।
দেশের ১৫ আনা জনমানুষের বিপরীতে এই একশ্রেণিরফুলেফেঁপে ওঠার বিষয়টিকে অর্থনীতির ভাষায় আয়বৈষম্য বা ধনবৈষম্য যা-ই বলা হোক, বাস্তবেএটি আসলে ব্যবস্থাগত 'সুবিধাবৈষম্য'। হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে খেলাপি হলেও আপনিধরাছোঁয়ার বাইরে। লাখ লাখ কোটি টাকা পাচার করেও আপনি বহাল তবিয়তে। জাল-জালিয়াতি করেব্যাংক লুট করেও আপনি কর্তৃপক্ষের নেক নজরে। অর্থাৎ দেশ-দশের সম্পদ হাতিয়ে নিন, সরকারআছে আপনার পাশে!
লুটতরাজ যখন খুল্লামখুল্লা এবং এর 'স্বীকৃতি'ওজোটে রাষ্ট্রের তরফে, তখন নীতিগত পরিবর্তনের আশা করাটা শতভাগ দুরাশা। জাল-জালিয়াতিকরার পরও যখন হল-মার্কের ব্যাপারে সরকার পরম ক্ষমাশীল, তখন একে দুর্নীতির রাষ্ট্রীয়স্বীকৃতি ছাড়া আর কী-ই বা বলা যায়?
অর্থাৎএকদল লোক কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থসম্পদের বৃষ্টিতে স্নাত হবে, বাকিরা ন্যূনতম অধিকার থেকেওবঞ্চিত থাকবে, থাকবে খরাকবলিত— এই ব্যবস্থা রাষ্ট্রই অনুমোদন করে। আর তাই কৃষক ফসলের ন্যায্য দাম পাননা। শ্রমিক ন্যায্য মজুরি পান না। ভুক্তভোগী প্রতিকার পান না। বেকার চাকরি পান না।'খরা' এদের জীবনে বহু ব্যঞ্জনাময়— বঞ্চনার, শোষণের, অধিকারহীনতার, অবমূল্যায়নের।
অথচএক হল-মার্কের লুটের ক্ষতি পোষাতে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে সোনালী ব্যাংককে দেওয়া হয়৩ সহস্রাধিক কোটি টাকা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, সরকার ভুলে বসে আছে যে এই টাকা জনগণেরকরের টাকা।
২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত— এই ৩৯ মাসে দেশে ৫৮ হাজার ৪৩৬ জন ঋণখেলাপি 'তৈরি' করা হয়েছে। তৈরিই তো; খেলাপি ঋণের জন্য কাউকে হাতকড়া পরানো দূরে থাক, নিদেনপক্ষে নিন্দেমন্দ করা হয়েছে— এমন খবর দেশবাসীর কানে পৌঁছায়নি। উল্টো শুনতে হয়েছে ঋণখেলাপিদের জন্য নানা সময়ে নানা ধরনের 'পুরস্কার' ঘোষণা। যেমন, মাত্র ২ শতাংশ হারে এককালীন নগদ দিয়ে ঋণ পুনঃ তফসিলের সুবিধাসহ এই পুনঃ তফসিলের কিস্তি পরিশোধের জন্য নতুন ঋণ, রাষ্ট্রায়ত্ত ৮টি ব্যাংকের ১ হাজার ১৯৮ কোটি ২৪ লাখ টাকার সুদ মওকুফ ইত্যাদি।
সাবেকঅর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের জবানিতে উচ্চারিত ৩ হাজার কোটি টাকা 'কিছুই না'মন্তব্য দেশবাসীর মনে এখনও টাটকা। তার এই মন্তব্যের সঠিক 'অনুবাদ' কী হতে পারে, খেলাপিঋণের পরিমাণের দিকে তাকালে তা মালুম হয়। খেলাপি ঋণ এখন ১ লাখ ১০ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা।অর্থাৎ দেশের ইতিহাসে পাস হওয়া সবচেয়ে বড় বাজেটের এক-পঞ্চমাংশ।
গতজানুয়ারিতে দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই নতুন অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল এলান করলেন, খেলাপিঋণ আর ১ টাকাও বাড়বে না। কিন্তু মাস কয়েক না যেতেই তা বাড়ে আরও ১৭ হাজার কোটি টাকা(মাত্র)।
সংশ্লিষ্টদেরঅনেকে কুবল করেছেন, ঋণখেলাপিদের জন্য অর্থমন্ত্রীর জামাই আদরের ঘোষণায় যারা নিয়মিতঋণের কিস্তি পরিশোধ করছিলেন, তারাও তা সটান বন্ধ করে দিয়েছেন। সততার 'মূল্য' যখন নেই,'পুরস্কৃত' হতে তখন খেলাপি হওয়াই শ্রেয়!
গ্লোবাল ইন্টেগ্রিটির হিসাবে, গত ১০ বছরেদেশ থেকে পাচার হয়েছে ৭ হাজার কোটি ডলার বা ৫ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। পাস হওয়া নতুনঅর্থবছরের রেকর্ড বাজেটের চেয়েও অঙ্কটি বড়। কীভাবে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগতির ধনী (পড়ুনলুটেরা!) তৈরির 'কারখানা'য় রূপান্তর হলো দেশ, এই তথ্যের বরাতে কিছুটা অনুমান করা যায়।
কত ধরনের সূচকেই না দেশের সাফল্য-সমৃদ্ধির, এগিয়ে যাওয়ার জানকারি মিলছে। বিশ্বব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের প্রথম পাঁচ দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির একটি বাংলাদেশ। অস্ত্র আমদানিকারক শীর্ষ ২০ দেশের 'সম্মানজনক' তালিকায়ও আছে প্রিয় মাতৃভূমি। আমাদের পা পড়েছে মহাকাশেও; স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণকারী দেশের তকমাও আঁকা হয়েছে বাংলাদেশের কপালে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা— কত কিছুতেই না অর্জন আজ অন্য অনেক দেশের জন্য অনুকরণীয়।
উন্নয়নের রোল মডেল বাংলাদেশ খেলাপি ঋণের জন্যও কি সমান উদাহরণ নয়? হল-মার্কের জন্য 'হল-মার্ক' তুল্য ছাড়ের উদ্যোগ এই প্রশ্নকে 'পাস' বলে এড়িয়ে যাওয়ার কোনও সুযোগ আগামীদিনে সরকারের সামনে রাখবে বলে মনে হয় না।