চিকিৎসা শেষে ক্যান্সার আক্রান্তদের মধ্যে এক ধরনের মানসিক বৈকল্য, অবসাদ বা ভীতি তৈরি হয়। এ ক্ষেত্রে ক্যান্সারজয়ীরা পরস্পরের শক্তি হিসেবে কাজ করতে পারেন। আমি নিজেও এ ধরনের ভূমিকা রাখতে পারলে খুশি হব।
Published : 04 Feb 2024, 12:42 PM
আমার স্বাস্থ্য কখনোই খুব ভালো ছিল না। তবে আমি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলাম। সাধারণত বয়স ৪০ বছর পেরোলে অনেকেই নানারকম অসংক্রামক রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হন। আমার তেমন কিছু ছিল না। আমার একটাই সমস্যা ছিল। ইরেটিবেল বায়োল সিনড্রোম। পেটের বিরক্তিকর এই সমস্যা নিয়েও আমি খুব সক্রিয় জীবনযাপন করেছি। বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনেও কাজ করেছি সক্রিয়ভাবে।
আমার মুখগহবরে অ্যাপথাস হতো। এটি সাধারণত ৪-৭ দিন থাকে। ২০২২ সালের অক্টোবর মাসের প্রথমদিকে সে রকম একটি অ্যাপথাস আবারও হয়। আমি ভেবেছিলাম, এটি স্বাভাবিক ব্যাপার। আমি ডায়াবেটিস সমিতির সহ-সভাপতি। ন্যাশনাল কাউন্সিলের সভায় যোগ দিতে গিয়েছি। সেখানে যাবার আগে একজন ডাক্তারকে দেখালাম। তিনি দেখে বললেন, তার ভালো মনে হচ্ছে না। সেজন্য আমাকে বায়োপসি করালেন।
বায়োপসির ফলাফল জানলাম ২ নভেম্বর। রোগের নাম স্কোয়ামাশ সেল কার্সিনোমা (এসসিসি)। সার্বিকভাবে আমি প্রচণ্ড দুশ্চিন্তায় পড়লাম। আমার জীবনটা বদলে গেল। বারডেম হাসপাতালের চেয়ারম্যান ছিলাম। ওরা দ্রুত একটা বোর্ড গঠন করল। বিএসএমএমইউ-তে ঢেসোমাইনো ডিপার্টমেন্টও ছিল। গঠিত বোর্ড ইতোমধ্যে যা যা টেস্ট করা প্রয়োজন, সবই করল। তারা আমাকে জানালেন, আমাদের দেশে এই সার্জারি এবং রিকনস্ট্রাকশনের সক্ষমতা নেই।
ডা. মঈনী আব্রাহিমকে দেখাতে পরামর্শ দিলেন ডা. এস এম এম। বললেন, মাঝে মাঝে তিনি ভারতের কেরালা রাজ্যের কোচিতে বসেন। মাঝে মাঝে বসেন নিউ ইয়র্কে।
পরে কোচি গিয়ে শুনেছি, ব্যাঙ্গালোরেও তিনি রোগী দেখেন। ভারতে তার অ্যাপয়েনমেন্ট পাওয়া খুব কঠিন ছিল। এখানকার গুরুত্বপূর্ণ ডাক্তাদের চেষ্টায় আমি স্বল্প সময়ে অ্যাপয়েনমেন্ট পেয়ে মেডিকেল ভিসায় ভারতে যেতে পেরেছিলাম। আবার মেডিকেল ভিসা একা পেলে হবে না। রোগীর সহকারীরও মেডিকেল ভিসা লাগবে। এটি বেশ ঝামেলার। যদিও আমাকে দুদিনের মধ্যে ভিসা দিয়েছিল কর্তৃপক্ষ।
কোচিতে গেলাম। ডা. মঈনী একটি মিশনারি হাসপাতালে বসেন। তিনি আমার পেছনে আধা ঘণ্টা সময় ব্যয় করলেন। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, আমাদের দেশে এত সময় নিয়ে রোগী দেখা হয় না। অসুখটা কী সেটি বুঝিয়ে দিলেন। বললেন, জিহ্বা অর্ধেক কেটে ফেলে হাতের বা অন্য মাসল দিয়ে রিকনস্ট্রাক্ট করবেন। সার্জারির পরে কী কী হবে সে সবও জানালেন। বললেন, খেতে পারবেন, কথাও বলতে পারবেন। তবে, সভায় বক্তব্য (পাবলিক স্পিকিং) দিতে পারবেন না।
নির্দিষ্ট দিনে আমার সার্জারি হলো। ওরা ৫ ঘণ্টা ধরে সার্জারি করেছে। আমার জিহ্বার এক তৃতীয়াংশের বেশি কেটে ফেলেছে। ২৯টা লিল্ফনোড ফেলে দিতে হয়েছে। সার্জারির পর ১২ দিন লেগেছিল হিসটোপ্যাথলজি রিপোর্ট পেতে। পুরো সময়টা হাসপাতালেই থাকতে হয়েছে।
সার্জারির পর আমার কেমো বা রেডিওথেরাপি লাগবে কিনা, সেটা হিসটোপ্যাথলজি রিপোর্টের ওপর নির্ভর করবে বলে তারা জানালেন। তবে এটাও বলেছিলেন, তোমার যে বয়স এবং যে পরিমাণ ক্যান্সার হয়েছিল, সে জন্য রেডিওথেরাপি লাগে না। এবং আমার তা লাগেওনি। এমনকি কেমোথেরাপিও দিতে হয়নি।
তবে হাসপাতালে সার্জারির পর একটি অঘটন ঘটেছিল। বিষয়টি ছিল এ রকম, আমাকে তখন রাইস টিউব দিয়ে খেতে হতো। ওটস দুধের সঙ্গে মিশিয়ে খেতাম। একদিন ভোরে দাঁত ব্রাশ করার সময় মেঝেতে পড়ে গেলাম। জ্ঞান হারালাম, সঙ্গে সঙ্গে আমার মেয়ে ওদের জানাল। পরে দেখা গেল, আমার ইলেকট্রোলাইটস ইমব্যালেন্স হয়েছিল। ভুলটা ওদের ছিল। ওরা আমাদের জানায়নি যে, আমার খাবারের সঙ্গে একটু লবণ মিশিয়ে দিতে হবে। ফলে সোডিয়াম কমে গিয়েছিল। পরে ওরা খুব দুঃখ প্রকাশ করেছিল। এটি এজন্য বললাম, অনেক সময় অনেক ছোট ছোট ভুল যে কারোই হতে পারে। তবে, এ ভুল রোগীর জন্য অত্যন্ত বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
সার্জারির প্রায় ২০ দিন পরে আমি দেশে ফিরে আসি। আমার ফেরার যাত্রাটি খুব কঠিন হয়েছিল। কারণ আমি পুরো যাত্রাপথে কিছুই খেতে পারিনি। আমার এই খেতে না পারার কষ্টটা, আমার চেয়েও আমার পরিবারের জন্য অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। সে সময় আমার কষ্টের জন্য আমার স্ত্রী-কন্যাদের বেদনাক্রান্ত মুখচ্ছবি আজও আমার মনে পড়ে। আমাকে পীড়া দেয়। দেশে ফিরে উত্তরায় আমি দীর্ঘ আট মাস ফিজিওথেরাপি নিয়েছিলাম। স্পিস থেরাপিও নিতে হয়েছিল। প্রথম দিকে আমার কথা খুব অস্পষ্ট ছিল। ফিজিওথেরাপি নেবার পর আস্তে আস্তে আমার মুখের নড়াচড়া বাড়ে। কিছুটা জড়তা থাকলেও আমি এখন কথা বলতে পারি। এমনকি পাবলিক স্পিকিংও করতে পারি।
তবে এখনও খেতে অনেকক্ষণ সময় লাগে। কষ্টও হয়। সার্জারির কারণে মুখের ভেতরে একটা পকেটের মতো হয়েছে। যা খাই সেখানে গিয়ে জমে। তাই প্রতিবারই খাওয়ার সময় আঙুল দিয়ে পরিষ্কার করতে হয়। এ বিষয়টি ডাক্তারকে বলেছি। তিনি ভারতে যেতে পরামর্শ দিয়েছেন। দেশের কয়েকজন ডাক্তারের সঙ্গেও পরামর্শ করেছি। তারা ছোট্ট একটা সার্জারির কথা বলেছেন।
আমার পুরো জার্নি থেকে দুটি শিক্ষণীয় দিক আমি বলতে চাই। প্রথমটি হচ্ছে, যদি অ্যাপথাস দীর্ঘদিন হয়, তাহলে সেটি নিয়মিত দেখিয়ে চেকআপ করা দরকার। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, যে সব রোগের চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়া দরকার, সেগুলোর মধ্যে অনেকগুলোর চিকিৎসা বাংলাদেশে পাওয়া গেলেও অনেক ক্ষেত্রে কিন্তু বড় ধরনের দুর্বলতা রয়েছে। যেমন, আমার মতো যদি কারও মুখগহব্বরে ক্যান্সার হয়, তাহলে তার চিকিৎসায় ডেন্টিস, হেজানকি ও রিকনস্ট্রাক্টিভ সার্জারির দক্ষতা প্রয়োজন। বাংলাদেশে এমন দক্ষ ডাক্তারের অভাব আছে।
আমাদের দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থায় রোগীর সেবা বিষয়ক পুরো ব্যাপারটিতে আরও উন্নতি করা প্রয়োজন। রোগীদের কথা শোনা এবং রোগীদের প্রতি মনোযোগ ও সময় দেয়া জরুরি। সেই সঙ্গে রোগীর সন্তুষ্টির বিষয়টি খেয়াল করাও জরুরি। আমি মনে করি, নানা ধরনের ক্যান্সার যেহেতেু দিনকে দিন বেড়েই চলেছে; দেশে সব ধরনের ক্যান্সারের মানসম্মত পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে তোলা এখন সময়ের প্রয়োজন। প্রয়োজন পুরো সমাজকে ক্যান্সার বিষয়ে সচেতন করা। সমাজের সম্মিলিত শক্তির ওপর ভিত্তি করে দেশের সকল মানুষের জন্য সুলভ ক্যান্সার চিকিৎসা সেবাকেন্দ্র গড়ে তোলা খুব কঠিন হবে না। সেই সঙ্গে ক্যান্সারাক্রান্ত হলে এবং চিকিৎসা শেষে আক্রান্তদের মধ্যে এক ধরনের মানসিক বৈকল্য, অবসাদ বা ভীতি তৈরি হয়, তা দূর করতে ক্যান্সার কাউন্সিলিং জরুরি। এ ক্ষেত্রে ক্যান্সারজয়ীরা পরস্পরের সঙ্গে অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে পারেন। পরস্পরের শক্তি হিসেবে কাজ করতে পারেন। আমি নিজেও এ ধরনের ভূমিকা রাখতে পারলে খুশি হব।
লেখক: চিকিৎসক ও ট্রাস্টি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর
(সেন্টার ফর ক্যান্সার কেয়ার ফাউন্ডেশনের ‘এখানে থেমো না’ বইয়ে লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে)