নিছক ভাগ্যের কারণে আমার জীবনে একটা দ্বিতীয় সুযোগ পেয়েছি। ২০১৬ সালে বাংলাদেশে ফিরে এসেছি এবং বাংলাদেশেই আমার বাকি জীবন কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বাংলাদেশের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের প্রাপ্য পরিষেবা এবং প্রাপ্য চিকিৎসা নিশ্চিত করার দৃঢ়তায়।
Published : 04 Feb 2024, 01:08 PM
২০১১ সালের জুলাই মাস। আমি তখন কানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডির দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। মা তার অফিস থেকে কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে ঘুরতে এসেছেন টরন্টোতে। দেশে ফেরার কিছুদিন আগে তিনিই প্রথম লক্ষ্য করলেন যে আমার গলার সামনের দিকটা নাকি একটু ফুলে আছে এবং ঢোক গেলার সময় দেখা যায়। আয়নায় এই ফোলাটা আমার চোখে পড়েনি কখনো, তবে মাঝে মাঝেই গলায় খাবার আটকে যেত। বাংলাদেশে ফিরে মা বারবার ফোন করে নিশ্চিত করলেন আমি যেন একজন ডাক্তার দেখাই। ইউনিভার্সিটি হেলথ ক্লিনিকে জেনারেল ফিজিসিয়ান দেখার পর তিনিই পাঠিয়ে দিলেন স্পেশালিস্টের কাছে। শুরু হয়ে গেল পিএইচডির পাশাপাশি নতুন এক যাত্রা— ক্যান্সার লড়াইয়ের যাত্রা।
পরের কয়েকটা মাস কাটল হাসপাতাল আর ক্লিনিকের ওয়েটিং রুমে। সঙ্গে প্রায়ই থাকত ইয়োগেশ, সদ্য বয়ফ্রেন্ড (এখন স্বামী)। আল্ট্রাসাউন্ড, বায়োপসি, বেরিয়াম টেস্ট, আয়োডিন টেস্ট, গাদা গাদা ব্লাড টেস্ট। মা আবার এলেন টরন্টোতে। তবে এবার আর বেড়াতে না, মেয়ের পাশে থাকতে।
আমার প্রথম সার্জারি হলো ২০১২ সালের মার্চ মাসের ১৩ তারিখে। গলা থেকে কেটে বের করা হলো ৬.৩ সেমি. বা একটা টেনিস বল আকারের টিউমার, সঙ্গে থাইরয়েড গ্ল্যান্ডের অর্ধেকটা। ৩০ মিনিটের সার্জারি নিল প্রায় ৩ ঘণ্টা। অধীর অপেক্ষায় নিচে বসেছিলেন মা আর বন্ধু নাবিলা। দুদিন পর বাসায় ফেরত গেলাম, কিন্তু ভালো হবার পরিবর্তে দেখা দিল বিভিন্ন জটিলতা। ঠিক মতো বসতে পারি না, মাথা নাড়াতে পারি না, এমনকি অনেক সময় আঙুল নাড়াতেও কষ্ট। প্রায় বিকেলেই বন্ধুরা আসত মা আর আমায় সঙ্গ দিতে। ধীরগতিতে সুস্থ হওয়া শুরু করলাম কিন্তু এর মধ্যেই ডাক্তারের অফিস থেকে জানানো হলো টিউমারের বায়োপসির ফলাফল ভালো না। খুব শিগগিরই আরও একটা সার্জারি লাগবে, বাকি থাইরয়েডটুকু এবং কিছু লিম্ফনোড ফেলে দিতে হবে।
এক মাস পরেই, এপ্রিল মাসের ১৭ তারিখে তাই আবারও সেই অপারেশন থিয়েটারে। মা তো ছিলেনই, এবার বাবা আর ভাইও চলে এসেছেন। সঙ্গে বন্ধু ইয়োগেশ।
আবার কয়েকটা দিন হাসপাতালে কাটল। নার্সদের সঙ্গে এবার ভালো বন্ধুত্বও হয়ে গেল। ইউনিভার্সিটির বন্ধুরা তাদের কাজের পরে বিকেলে ভিড় জমাত আমার শেয়ারড কেবিনে। ভিজিটরদের জন্য নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার পরেও বন্ধুরা আমাকে রেখে যেতে চাইত না। নার্সরাও ওদেরকে বেশি বকা দিতেন না। বরং মাঝে মাঝে আমাদের সঙ্গে গল্পও করতেন। আমার কেবিনে অন্য যে রোগী ছিলেন, তিনি একজন বয়স্ক ভদ্রমহিলা, হিপ রিপ্লেসমেন্ট সার্জারির পরে রিকভার করছিলেন। ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেল আমাদের মধ্যে। রিলিজ হবার দিন এক বন্ধু হাসপাতালের গিফট স্টোর থেকে অনেকগুলো থ্যাংক ইউ কার্ড নিয়ে এল। নার্স, অ্যাডমিনিসট্রেটিভ স্টাফ, অনকোলজিস্ট, সার্জন, আমার রুমমেট, যত জন আমাকে সুস্থ হতে সাহায্য করেছেন, সবাইকে নিজে গিয়ে একটা করে কার্ড দিলাম। মনে হয় ক্যান্সার থেকে মুক্তির সব থেকে বড় উদযাপন ছিল ওটাই।
এখন ২০২৪। প্রায় এক যুগ কেটে গেছে। স্মৃতিগুলো ম্লান হতে শুরু করেছে। আমার জীবনটা এখন বেশ স্বাভাবিক। সকালে একটা ওষুধ খেতে হয়, আর নিয়মিত কিছু টেস্ট করাতে হয়।
আমার স্বাভাবিক জীবনের একটি বড় কারণ আমার অনকোলজিস্ট ও সার্জন। আমার অনকোলজিস্ট মাসের পর মাস আমার সবকিছু খুব ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। মাত্র পঁচিশ বছর বয়স ছিল বলে রেডিয়েশন থেরাপি থেকে বিরত রেখেছেন, যেন ভবিষ্যতে কোনো জটিলতা দেখা না দেয়। নতুন বা অপ্রচলিত চিকিৎসা দিয়েছেন, তার নিজের তো বটেই, তার দলকেও অনেক সময় ব্যয় করতে হয়েছে, আমাকে বারবার দেখতে হয়েছে। আমার অনকোলজিস্ট অসম্ভব ব্যস্ত এবং গোটা উত্তর আমেরিকার খুবই নামকরা একজন ডাক্তার ছিলেন। তার অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়াটা ছিল অসম্ভব কঠিন একটা বিষয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হতো, কিন্তু যখন দেখতেন মনে হতো যেন আমিই তার একমাত্র রোগী।
দুটো সার্জারি সত্ত্বেও আমাকে প্রথম দেখে মোটামুটি কেউই খেয়াল করতে পারে না যে আমার গলায় দুটো সার্জারি হয়েছে। আমার বয়স অনেক কম ছিল বলে, সার্জন খুব নিখুঁতভাবে সার্জারি করেছেন। ঠিক গলার ভাঁজে, একটার ওপর আর একটা।
অসুস্থতার কারণে আমাকে অনেক ছুটি কাটাতে হয়েছিল বলে ল্যাবের কাজ শেষ করতে অনেক বেশি সময় লেগে গেল। ক্রমান্বয়ে শেষটা কাছে এল। ২০১৫ সালের শেষের দিকে আমার পিএইচডি থিসিস লেখা শুরু করলাম। শুধু থিসিস জমা দেয়া, আর ডিফেন্ড করা বাকি। আমি বরাবরই ভালো ছাত্রী ছিলাম, ল্যাবের কাজেও ভালো, মাথায় বুদ্ধি-শুদ্ধিও আছে ভালোই। এ পর্যায়ে এসে পিএইচডি শেষ করা নিয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না। কিন্তু মাঝে মাঝে যখন রাত জেগে কাজ করতাম, আমার হঠাৎ হঠাৎ মনে হতো, এটা কীভাবে সম্ভব? আমি কীভাবে এখনো বেঁচে আছি? শুধু বেঁচে থাকা নয়, এত সুস্থইবা কীভাবে আছি? ২০১১ সালে যদি আমি টরন্টোতে না থেকে ঢাকায় থাকতাম, তাহলে কি এটা সম্ভব হতো? আমি যে সুবিধাগুলো পেয়েছি, বাংলাদেশের মানুষ কি এই সুবিধাগুলো পায়? আমার কি অধিকার আছে এই সুবিধাগুলো পাওয়ার বা সুস্থভাবে বেঁচে থাকার যদি না আমার দেশের মানুষও একই সেবা ও চিকিৎসা পায়?
নিছক ভাগ্যের কারণে আমার জীবনে একটা দ্বিতীয় সুযোগ পেয়েছি। ২০১৬ সালে বাংলাদেশে ফিরে এসেছি এবং বাংলাদেশেই আমার বাকি জীবন কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বাংলাদেশের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের প্রাপ্য পরিষেবা এবং প্রাপ্য চিকিৎসা নিশ্চিত করার দৃঢ়তায়।
বাংলাদেশে আমি এখন আমার বাবার শুরু করা সিএইচআরএফ— চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনে কাজ করি। ২০১৭ সালে এখানে একটি জিনোমিক্স সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেছি। আমরা ক্যান্সার এবং অন্যান্য জেনেটিক রোগে আক্রান্ত রোগীদের ডায়াগনস্টিক পরিষেবা দেওয়ার জন্য একটি অত্যাধুনিক ডায়াগনস্টিক সেন্টার তৈরির কাজ করছি। একটি অলাভজনক সংস্থা হিসাবে, আমাদের স্বপ্ন এমন একটি কেন্দ্র তৈরির যেখানে রোগীদের সেসব ডায়াগনস্টিক পরিষেবা প্রদান করা হবে, যা এখন সাশ্রয়ী মূল্যে দেশে পাওয়া কঠিন বা অসম্ভব। সেই কেন্দ্র শুধু পরীক্ষার রিপোর্টই দেবে না, প্রয়োজনের সময় একজন রোগীর যে পরিষেবার প্রয়োজন হয়, তার সবটুকুই দেবে, যেমনটি আমি টরন্টোতে পেয়েছি।
তবে আমি কিন্তু শুধু ডায়াগনস্টিক পরিষেবা এবং ডাক্তার বা নার্সদের কারণেই জীবন ফিরে পাইনি, আমার পরিবার এবং বন্ধুরা প্রতিটি ক্ষণ আমার সঙ্গে ছিলেন, যেন পুরো একটি সমাজ একত্র হয়েছিল আমার স্বাস্থ্য ও সুস্থতা নিশ্চিত করতে।
এই পৃথিবীতে এটা আমার দ্বিতীয় সুযোগ এবং আমি আমার জীবনের প্রতিটি অবশিষ্ট ক্ষণ প্রতিটি বাংলাদেশী মানুষের জীবন, স্বাস্থ্য ও সুস্থতা নিশ্চিত করার উদ্দেশে নিয়োজিত থাকব।
লেখক: অণুজীব বিজ্ঞানী
(সেন্টার ফর ক্যান্সার কেয়ার ফাউন্ডেশনের ‘এখানে থেমো না’ বইয়ে লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে)