আমাদের গণ-হতাশার একটা বড় জায়গা জুড়ে আছে আওয়ামী লীগ আর বিএনপি। জনগণের অধিকাংশই মনে করে যে বড় দুই দলের বাইরে তাদের কোনো রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নেই। তাই এই দুই দলের বাইরে গিয়ে ছোট দলগুলোকে কোনোভাবেই নিজেদের মনে জায়গা দিতে চায় না জনগণ।
Published : 09 Sep 2024, 06:19 PM
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রাজনৈতিক দল গঠনের দিকে যাচ্ছে। জাতীয় নাগরিক কমিটি গঠনের মাধ্যমে এরই মধ্যে তারা ওই লক্ষ্যে এগিয়েছে এক ধাপ। রাজনৈতিক দলে রূপান্তরিত হলে আগামীতে ভোটের ময়দানে একটা বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়াতে পারে তারা। গণঅধিকার পরিষদ দল হিসেবে আরও শক্তি, সক্ষমতা ও বিস্তৃতি পেতে যাচ্ছে বলেও মুখরোচক আলোচনা শোনা যাচ্ছে।গণসংহতি আন্দোলনও বড় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে সামনের নির্বাচনে এমনটাই দাবি করছেন দলটির শুভানুধ্যায়ীরা।আগামী নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলোর জোট কিংবা নির্বাচন-পরবর্তী সরকার গঠনের জোট নিয়েও আছে নানা কথা। কেউ কেউ বলছেন, জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম এবং অন্য সব সমমনা রাজনৈতিক দল এবং গোষ্ঠীগুলো একজোট হতে পারে।যদিও অতীত ইতিহাস বলে জামায়াত ও হেফাজতকে এক ছাতার নিচে দেখতে পাওয়াটা প্রায় অসম্ভব।
সুদূর বা অদূর ভবিষ্যতে ঘটনা যাই ঘটুক না কেন, বিএনপি ও আওয়ামী লীগের দ্বৈত-রাজনীতির বাইরে রাজনৈতিক যে পরিসর তৈরি হচ্ছে তা মোটের ওপর ভালো লক্ষণ। অবশ্য এই লক্ষণ এখনো জনগণের হতাশা কাটানোর মতো পর্যায়ে পৌঁছেনি। কেউ কেউ বলছেন, কিছুই হবে না। আওয়ামী লীগ গেছে, এবার বিএনপি আসবে, ক্ষমতায় না এসেও তারা এসে গেছে সবখানে।
আমাদের গণ-হতাশার একটা বড় জায়গা জুড়ে আছে আওয়ামী লীগ আর বিএনপি। জনগণের অধিকাংশই মনে করে যে বড় দুই দলের বাইরে তাদের কোনো রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নেই। তাই এই দুই দলের বাইরে গিয়ে ছোট দলগুলোকে কোনোভাবেই নিজেদের মনে জায়গা দিতে চায় না জনগণ। ভোটের মাঠে এই দুই দলের বাইরের ছোট ছোট দলগুলো হেরে যাবে ধরে নিয়েই জনগণ বারবার ভোট দিতে গেছে। ভোটারের এই মনোভাবের কারণেও বড় দুই দলের গড়া জোটের লেজুড় হতেও বাধ্য হয় ছোট দলগুলো। তবে এবারের হিসেব আগের চেয়ে একটু ব্যতিক্রম হবে বলেই মনে হচ্ছে। বড় দলগুলোর অতীত অপকর্ম আর বারবার প্রতিশ্রুতি ভাঙার কারণেই তাদের প্রতি আমাদের বিপুল মানুষের অনীহা তৈরি হয়েছে। এখনো খুব একটা পরিবর্তন নেই পুরনো প্রভাবশালী দলগুলোর আচরণ, কৌশল ও দৃষ্টিভঙ্গিতে। বড় দলগুলোর প্রতি এই অনীহাও ছোট দলগুলোর জন্য সুযোগ। ভোটের সময় এলে আমরা যে কথা বাণীর মতো নানা দিক থেকে প্রচার হতে শুনি তা হচ্ছে: ‘লেভেল প্লেইং ফিল্ড’— মানে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা। বড় দল আর ছোট দলের জন্য সমান সুযোগ কিন্তু নিশ্চিত আর হয় না। যতটা হয় ততটাও আসলে পেশিশক্তি ও অর্থশক্তিতে বলীয়ান বড় দলগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে ছোট দলগুলোর ছোট শক্তি আর ছোট সামর্থ্যে কাজে লাগানোর সুযোগ থাকে না।
অনেকে বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে এক-এগারোর প্রকল্প বাস্তবায়নের মনোভাব আছে। এক-এগারো এবং জুলাই অভ্যুত্থানের দেশীয় ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট এবং আন্তর্জাতিক প্রভাবক মোটেও এক নয়। তবে বারবার এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার জন্য বড় দলগুলোই যে দায়ী ওই ব্যাপারে আশা করি কেউ দ্বিমত হবেন না। তাদের রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক ব্যর্থতাই নতুন ও ছোট রাজনৈতিক শক্তিকে এবার সামনে নিয়ে এসেছে। আপাত অরাজনৈতিক শক্তি এবং ছোট রাজনৈতিক দলগুলোও যে প্রবল স্বৈরাচারী সরকারের পতনে বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে তা জুলাই অভ্যুত্থানে প্রমাণ হয়ে গেছে। তারা যে এখন নানা দিক থেকে পৃষ্ঠপোষকতা, সমর্থন ও সহায়তা পাবে, তাই স্বাভাবিক। পরিস্থিতির চাপে পড়ে বড় দলগুলোর আধিপত্যের সুযোগ এরই মধ্যে কমতে শুরু করেছে এবং তাদের কথা ও আচরণে পরিবর্তন আসছে। এই পরিবর্তন তাদের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যে স্থায়ী হলে দেশের রাজনীতিতেও আসতে পারে গুণগত পরিবর্তন।
বিএনপি ও জামায়াতের মতো রাজনৈতিক দলগুলোও অন্তর্বর্তী সরকারকে যেভাবে সময় নিতে দিচ্ছে তাতে বোঝাই যাচ্ছে নির্বাচন এখনও অনেক দূরে। অবশ্য, দেশে যে বিপর্যয়কর ও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি বিরাজ করছে তাতে সময় না দিয়েও কোনো উপায় নেই। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে নির্বাচন দিলে ওই নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করে তোলার জন্য সরকারের যে ধরনের পুলিশ, প্রশাসন ও জনবল দরকার তা এখনও মোটেও প্রস্তুত নয়। অন্তর্বর্তী সরকারের যেমন নির্বাচনের আগে বিপর্যস্ত দেশ ও ব্যবস্থাকে ঠিক করার অনেক কাজ আছে, তেমনি বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের মতো বিপর্যস্ত দলগুলোর আছে নিজেদের নির্বাচনের জন্য গুছিয়ে নেওয়ার অনেক কাজ। যে কারণে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে নির্বাচন আদৌ হবে কি হবে না, এখনই বোঝা যাচ্ছে না। সরকার ও বড় দলগুলোর নির্বাচনের প্রস্তুতির জন্য যে সময় দরকার ওই সময়ের মধ্যে নিজেদের গুছিয়ে নেওয়ার জন্য ছোট দলগুলোরও আছে পর্যাপ্ত সুযোগ। দীর্ঘ সময়ের অবরুদ্ধ বাস্তবতার পর রাজনীতি, সভা-সমাবেশ করার যে মুক্ত-পরিসর তৈরি হয়েছে সেখানে দাঁড়িয়ে আমাদের ছোট দলগুলো এখনই বড় হয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখতে পারে এবং ওই অনুযায়ী কাজও শুরু করতে পারে।
জুলাই অভ্যুত্থানে জনতার আন্দোলনের পেছনের প্রভাবক শক্তিগুলোর মধ্যে যে রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীগুলো সক্রিয় ছিল তার মধ্যে অন্যতম জামায়াতে ইসলামী, গণসংহতি আন্দোলন, গণ-অধিকার পরিষদ, হেফজতে ইসলাম। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আন্দোলনের পেছনে থেকে তারা যে বড় আত্মবিশ্বাস ও অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে সেটি তাদেরকে নির্বাচনের রাজনীতিতে নিশ্চয়ই নতুন শক্তি ও অনুপ্রেরণা দেবে। অগ্রবর্তী বাহিনী হিসেবে কাজ করা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলন তো সেক্ষেত্রে এগিয়েই আছে। হেফাজতে ইসলামও নিশ্চয়ই নিজেদের গুছিয়ে নিয়ে মাঠে নামবে। তারা নামলে বাড়বে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা অন্য দলগুলোর আতঙ্কও। এক্ষেত্রে সবচেয়ে ক্ষতির মুখে পড়বে জামায়াত। মূলত হেফাজতের কার্যক্রমের ওপর নির্ভর করবে জামায়াতের আগামীর রাজনীতি এবং জোট বাধার হিসাবনিকাশ ও কৌশল।
আমাদের ছোট দলগুলোর আগামীতে বড় হয়ে ওঠার পেছনে বড় বাধা তাদের গণভিত্তির অভাব। এই অভাবকে কাটিয়ে ওঠার জন্য জামায়াত ছাড়া অন্য কোনো দল এখনও আন্দোলনের নতুন ভাববস্তুকে আত্মস্থ করে মাঠে নামেনি। মাঠপর্যায়ে এই দলগুলোর কোনো কার্যক্রম এখনও আমরা সেভাবে দেখছি না। এটি অবশ্যই তাদের একটি বড় দুর্বলতা। প্রতিটি সংসদীয় আসনে তাদের মূল সংগঠনেরই কার্যকর কোনো ভিত্তি প্রতিষ্ঠান নেই। এক্ষেত্রেও তাদের কাজ শুরু করার এখনই সময়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনকেও রাজনৈতিক দল হিসেবে কাজ শুরু করতে হবে দ্রুতই। আন্দোলনের উত্তাপ নেমে গেলে তাদের দল গঠন করা আরও জটিল হবে। তারা যত দেরি করবে ততই পিছিয়ে পড়বে। অবস্থা এমনও হতে পারে যে তারা বিপুল জন-আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তারপর নিতান্ত একটা ‘প্রেশার গ্রুপ’ হিসেবে কয়েক বছর থেকে মিলিয়ে যাবে ধীরে ধীরে হাওয়ায়। তারা যেহেতু এরই মধ্যে সরকারের অংশ হয়ে গেছে সেহেতু সরকারের দোষ ও ব্যর্থতার দায় তাদের ওপরও পড়বে। যে কারণে নিতান্ত ‘প্রেশার গ্রুপ’ না হয়ে যত দ্রুত দল গঠন করবে ততই তাদের মঙ্গল।
আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থায় প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ নেই রাজনৈতিক দলগুলোর। সংসদ নির্বাচনে কোনো আসনে বিজয়ী হওয়াই আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিত্ব করার একমাত্র উপায়। সংবিধান প্রণয়ন বা সংস্কার হলেও এক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন আসবে বলে মনে হচ্ছে না। যদিও এ ধরনের পরিবর্তন আনার ব্যাপারে তাদের দাবি তোলার সুযোগ আছে।
নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা কিছুদিন ধরে ক্রমেই বাড়ছে। যে দলগুলো আওয়ামী লীগের শাসনামলে নিবন্ধন পায়নি তারাও নিবন্ধন নিচ্ছে এখন। আগামী নির্বাচনের আগে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা নিঃসন্দেহে ষাটের বেশি হবে। অনেকেই বলাবলি মুহাম্মদ ইউনূস নিজে ২০০৭ সালের ‘নাগরিক শক্তি’ বা অন্য কোনো নামে একটা দল গঠন করবেন কিনা? এই করা না করা নির্ভর করবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে তার বোঝাপড়ার ওপর। অবশ্য বোঝাপড়ার মাধ্যমেও তারা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রাজনৈতিক উদ্যোগের বিকল্প প্রস্তুত রাখতেই পারেন।
আমাদের অনেকের মধ্যে ধারণা আছে যে, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বড় জোর ৩০ থেকে ৩৫টি আসন পেতে পারে। তবে দলটি আদৌ নির্বাচন করতে পারবে কিনা এ নিয়েও সংশয় রয়েছে। সাধারণ্যে প্রচলিত ধারণা হচ্ছে, আওয়ামী লীগকে আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া হবে না। যদি দেওয়া হয়, তাহলেও হয়তো আওয়ামী লীগ নির্বাচন করার মতো দৃঢ়তা নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। বিএনপি সারাদেশে যেভাবে আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করেছে তাতে তাদের সামনে বিপদ আছে। শুধু দখলবাজির বিপদ নয়, রাজনৈতিক কোন্দল এবং দল ভাঙাগড়ার বিপদও সামনে সামাল দিতে হবে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিকে। এসব জায়গা থেকেও আছে ছোট দলগুলোর সম্ভাবনা। সেদিক থেকে দেখলে এখনই কাজ শুরু করলে স্বাভাবিকভাবেই আগামীতে অন্তত ৩০টির মতো আসন নিশ্চিত হতে পারে ছোট দলগুলোর। আর যদি তাদের কপালে অস্বাভাবিক কোনো আশীর্বাদ জুটে যায় কিংবা তারা যদি নিজেদের গতি ও শক্তি বাড়াতে পারে তবে আসনের সংখ্যা নিঃসন্দেহে আরও বাড়বে।
জামায়াতে ইসলামী এবং অন্যান্য ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলো জোট বাধলে তারা আগামীতে আসন পাওয়ার ক্ষেত্রে নজির সৃষ্টি করবে। তবে তাতেও তারা ৫০টির বেশি আসন পাবে বলে মনে হয় না। অর্থাৎ আগামী নির্বাচনে এককভাবে ১৫০টি বেশি আসন পেয়ে সরকার গঠনের সম্ভাবনা এখনও বিএনপিরই আছে। তবে এই হিসাবনিকাশের আগে আছে আরও অনেক হিসাবনিকাশ। হিসেবের মধ্যে রাখতে হবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের আসন্ন রাজনৈতিক দল বা দলগুলোকেও। রাখতে হবে জাতীয় পার্টিকেও।
আমাদের ছোট রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নির্বাচনমুখী বাম ঘরানার বেশ কয়েকটি দল দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের জোটে থেকে এবং একতরফা, কারচুপি ও রাতের ভোটের শরিক হয়ে, তাদের নিজেদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত করে ফেলেছে। আগামীতেও তাদের আওয়ামী লীগের সঙ্গে থেকেই আত্মরক্ষা করতে হতে পারে। আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে মাঠে সোচ্চার থাকা বাম গণতান্ত্রিক জোট এবং গণতন্ত্র মঞ্চে যে দলগুলো আছে তারা সবাই মিলে আরও বড় ঐক্য গড়তে পারলে একটা বড় সাফল্য আসবে। বিএনপি, জামায়াত ও হেফাজতের মতো দল এবং অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষের দলগুলোর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে তাদের ভুলের সমালোচনা করার মাধ্যমে তারা এগিয়ে যেতে পারে। আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতির কারণে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে ওই শূন্যতা পূরণের সুযোগ তারা কতটুকু কাজে লাগাতে পারবে তার ওপরই নির্ভর করবে তাদের অগ্রগতি।
সারাদেশে মাঠের রাজনীতিতে প্রভাব থাকার ওপর নির্ভর করে ভোটের রাজনীতি। ২০১৪ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত বহুবিতর্কিত নির্বাচন দিয়ে ১৬ বছর ক্ষমতায় টিকে থাকা আওয়ামী লীগকে একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। আওয়ামী লীগ সবচেয়ে প্রাচীন দলগুলোর একটি এবং তৃণমূলে সব সময়ই দলটির সাংগঠনিক তৎপরতা রয়েছে। আওয়ামী লীগ সারা দেশে ভীষণ দমনপীড়ন চালিয়েছে, এটা যেমন সত্য, তেমনই তারা আবার এখানকার সুশীল সমাজকে নিজেদের অনুকূলে রাখতে পরিচর্যাও করেছে। সুশীল সমাজ বলতে এখানে শুধু শহুরে নাগরিক সমাজের কথা বলা হচ্ছে না– গ্রামের অভিজাত, সম্পন্ন গৃহস্থ, মোল্লা, মৌলবি, মাতব্বর এবং মুরুব্বিদেরও তারা তাদের পক্ষে পেয়েছে রাজনৈতিক কৌশলের কারণে। তাদের ছিটেফোঁটা ক্ষমতার স্বাদও দিয়েছে আওয়ামী লীগ। ১৬ বছরের নির্বিকল্প বাস্তবতার কথা ভেবে এসব লোকও তাদের ছায়াতলে এসে দাঁড়িয়ে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করেছে। অবশ্য শেষপর্যন্ত তারা তাদের সঙ্গে থাকেনি। থাকবে না যে এটাই রাজনৈতিক বাস্তবতা। যখনই বিকল্প এসে হাতছানি দিয়েছে তখনই তারা আবার নিজের নিজের জায়গায় চলে গেছে। তারপরও গ্রামে ও শহরে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে সক্ষম ব্যক্তি ও ইউনিটের যা কিছু তাদের অনুকূলে রয়েছে তা-ও রাজনৈতিক ও নির্বাচনি ক্ষমতার কম বড় অনুঘটক নয়। এই অনুঘটকগুলোকে হাতে নেওয়ার সুযোগ এসেছে ছোট দলগুলোর সামনে।
কানেক্টিকাটের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তরুণ অধ্যাপক ড্যানিয়েল সি. ম্যাটিংলি দীর্ঘদিন চীনে থেকে মাঠ গবেষণা চালিয়ে চীনা কর্তৃত্ববাদের শক্তি, ত্রাস, অর্থনীতি, উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণের বাইরে গ্রহণযোগ্যতার মূল উপাদান ও কৌশলগুলো কী তা বোঝার চেষ্টা করেছেন। ‘দ্য আর্ট অব পলিটিক্যাল কন্ট্রোল ইন চায়না’ বইয়ে তিনি চীনা কর্তৃত্ববাদী শাসকদের ওই কোমল শক্তির উৎসগুলো সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। চীনের শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে গবেষণা করতে গিয়ে তিনি দেখিয়েছেন যে, চীন শুধু দমন-পীড়ন দিয়েই একদলীয় ও কর্তৃত্ববাদী শাসনকে যুগের পর যুগ টিকিয়ে রাখেনি। তারা ‘কালটিভেটিং সিভিল সোসাইটি’, ‘কো-অপ্টিং লোকাল নোটেবলস’ এবং ‘ইনফিলট্রেটিং সোসাইটি’ প্রক্রিয়া অবলম্বন করেছে।
শুধু কর্তৃত্ববাদী শাসন নয়, যে কোনো রাজনৈতিক দলকেই আসলে এই কাজগুলো কমবেশি করতে হয়। আমাদের ছোট দলগুলো কখনোই জোরেশোরে তা করেনি। যে কারণে তাদের তৃণমূলে কোনো সাংগঠনিক ভিত্তি গড়ে ওঠেনি। আমরা আশা করি ছোট দলগুলো খুব শিগগিরই এই ধরনের চর্চার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাবে। আগামীর বাংলাদেশে বড় দুই দলের বাইনারির বাইরে যাওয়ার জন্য ছোট দলগুলোর বড় হয়ে উঠতে পারাটাই একমাত্র ভরসা। আশা করি আগামীতে জনগণের সেই ভরসার স্থল হয়ে উঠবে ছোট ছোট রাজনৈতিক দল।